বলিউডের ব্লকবাস্টার মুভি ‘পদ্মাবত’ by মো: বজলুর রশীদ
বলিউডের
বিগ বাজেট ছবি ‘পদ্মাবত’, যেটি পদ্মাবতী নামেও পরিচিত, গত ২৫ জানুয়ারি
মুক্তি পেয়েই হিট করেছে। রাজস্থান, হরিয়ানা, গুজরাট ও মধ্যপ্রদেশ ছাড়া পুরো
ভারতে ছবিটি মুক্তি পেয়ে প্রথম দিনে ২৪ কোটি ও দ্বিতীয় দিন ৩২ কোটি রুপি
ব্যবসা করেছে। সে হিসাবে ‘বাহুবলি’-২-কে ছাড়িয়ে গেছে। ছবিটি তৈরি করতে ২০০
কোটি রুপি খরচ হলেও মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে সমুদয় পুঁজি ঘরে তুলছেন
বানসালি। শুরুতেই বলিউডের বøকবাস্টার ছবিতে পরিণত হয়েছে পদ্মাবত। যারা ছবির
বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন তারাই বলছেন, ছবিতে রাজপুতদের ‘অনুশাসন’ তুলে ধরা
হয়েছে। অতএব, কোনো ভাঙচুর-বিক্ষোভ নয়। পাকিস্তানে কোনো ‘কাট’ ছাড়া ছবিটি
মুক্তি পেলেও দিল্লির অতীতকালের শাসক আলাউদ্দিন খিলজিকে নেতিবাচকভাবে
উপস্থাপনের জন্য ছবিটি নিষিদ্ধ করেছে মালয়েশিয়া। পদ্মাবত ছবির গল্প একজন
রাজপুত রানী ও একজন মুসলিম সম্রাটকে নিয়ে। হিন্দু রাজপুত রানী পদ্মাবতীর
রূপে আকৃষ্ট হয়ে দিল্লির তৎকালীন সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজি ওই রাজ্য আক্রমণ
করেন। অভিযোগ করা হয়েছে, খিলজির সাথে রানী পদ্মাবতীর ঘনিষ্ঠ রোমান্টিক
সিকোয়েন্স রয়েছে, যা পরিচালক বানসালি অস্বীকার করেছেন। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার
আগেই গুজরাট ও হরিয়ানা রাজ্যে জ্বালাও-পোড়াও শুরু হয়ে যায়।এই ছবি নিয়ে
কিছু উগ্র হিন্দু ও রাজপুত লোকজন ক্ষেপেছে। ভারতের উগ্র হিন্দুবাদীরা
সহিংসতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। গত জানুয়ারিতে শুটিং চলার সময় ‘কার্নি সেনা’র
রাজপুতরা সেট ভাঙচুর করে পরিচালককে মারধর করে। কানপুরের একটি সংগঠন
পদ্মাবতী চরিত্রে অভিনয় করা দীপিকা পাডুকোনের নাক কাটার হুমকি দিয়েছে,
যেভাবে রামায়ণে বলা হয়েছে, রাবণের বোন শূর্পণখার নাক কেটে দেয়া হয়েছিল।
কানপুর ক্ষত্রিয় মহাসভার প্রেসিডেন্ট গজেন্দ্র সিংহ রাজাওয়াত বলেছেন, ‘আমরা
কানপুরের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করেছি। যিনি
দীপিকার নাক কাটতে পারবেন, তাকে ওই টাকা পুরস্কার দেবো।’ আরো ঘোষণা দেয়া
হয়, যে বানসালি এবং দীপিকা পাডুকোনের মাথা কেটে আনতে পারবে, তাকে ১৫ লাখ
ডলার পুরস্কার দেয়া হবে। কার্নি সেনার সদস্যরা গুরুগ্রামের জিডি গোয়েঙ্কা
স্কুলের বাসে হামলা চালায়। ফলে কয়েক দিন ধরে বন্ধ রাখা হয়েছে ওই শহরের
কয়েকটি স্কুল। বিক্ষোভকারীরা রাস্তা আটকে বাসে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। মথুরায়
বিক্ষোভকারীরা আটকে দেয় ট্রেন। পদ্মাবতের কারণে বন্ধ করা হয় চিতোর দুর্গ।
সপ্তম শতাব্দীতে নির্মিত এই দুর্গেই পদ্মাবতী কাহিনীর জন্ম। দুর্গটি
ইউনেস্কো ঘোষিত ‘বিশ্ব ঐতিহ্য স্থাপনা’গুলোর অন্যতম। চলচ্চিত্রটি রাজস্থানে
দেখানো হলে ১৫০ জন রাজপুত নারী ওই দুর্গে গিয়ে আত্মাহুতি দেয়ার হুমকি
দিয়েছিলেন। পদ্মাবত চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া কার্নি সেনারা
দুর্গটিতে প্রবেশের চেষ্টা করার পর সেটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন দল ও
রাজপুতরা মনে করেছেন, এই মুভিতে রাজপুত রানীর ইমেজকে হেয় করা হয়েছে। পুরনো
পদ্মাবতীর বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি রয়েছে যেমন- কাইতি, নাগরি ও নাস্তালিক বা
ফার্সি। মোহাম্মদ শাকির ১৬৭৫ সালে আমরোহ ভাষায় তা কপি করেছিলেন। কাইতি
পাণ্ডুলিপিতে অনেক অতিরিক্ত কবিতার লাইন জুড়ে দেয়া হয়েছে, যা অসম্পূর্ণ ও
দুর্বল। মাতাপ্রসাদগুপ্ত সব পাণ্ডুলিপি মিলিয়ে সপ্তদশ শতাব্দীতে অপার এক
পাণ্ডুলিপি বানান। ১৫৯০ সালে বিজাপুর সালতানাতের ইব্রাহিম শাহের রাজকবি হংস
বাবু ‘প্রেমনামা’ নামে পদ্মাবতীর আরেকটি সংস্করণ বের করেন। ফার্সি ও
উর্দুতে পদ্মাবতীর ১২টি সংস্করণ আছে। এগুলোর মধ্যে প্রসিদ্ধ হলো- ‘রত-পদম’ ও
‘শামা ওয়া পরওয়ানা’। ১৬ শতাব্দীতে এই মহাকাব্য বাংলায় অনূদিত হয়। বাংলাতে
১৯০৬ সালে ক্ষিরোদ প্রাসাদের হাতে এবং ১৯০৯ সালে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে
বাংলা রূপপরিগ্রহ করে। পদ্মাবতীকে নিয়ে ১৯৬৩ সালে তামিল মুভি ‘চিতোর রানী
পদ্মিনী’, ১৯৬৪ সালে হিন্দিতে ‘মহারানী পদ্মিনী’ নিজস্ব ঘরানায় ও ভিন্নরূপে
চিত্রায়িত হয়েছে। ‘চিতোর কি রানী পদ্মিনী কা জহর’ নামে সনি টেলিভিশন
(ভারত) পদ্মিনীর ওপর ২৫ মে ২০০৯ থেকে ১০৪ পর্বের ড্রামা সিরিয়াল প্রচার
করেছে। পরিচালক ছিলেন নীতিন চন্দ্রকান্ত দেশাই। কিন্তু ৪৮ পর্বের পরই
সিরিয়ালটি ফ্লপ করে, ফলে প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। মধ্যযুগের ঐতিহাসিক ফিরিস্তা
ও হাজী উদ্দাবীর পদ্মাবতীকে ইতিহাসের সাথে মেলাতে চেষ্টা করেছিলেন। এ
দু’জনের প্রচেষ্টায় কোনো ঐক্য ছিল না। রাজপুতরাও নিজস্ব চিন্তাধারায়
পদ্মাবতীর কাহিনী সাজিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ১৫৮৯ সালের বাবু হেম রতনের
‘গোরা বাদল পদ্মিনী’। ঐতিহাসিক কিশোর শরন লাল পদ্মাবত কাহিনীতে অনেক বড়
অসঙ্গতির কথা উল্লেখ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ- রতন সিং ১৩০১ সালে সিংহাসন লাভ
করে আলাউদ্দিনের কাছে ১৩০৩ সালে পরাজিত হন। কিন্তু পদ্মাবতে বলা আছে- রতন
সিং ১২ বছর পদ্মাবতীর সন্ধানে ছিলেন এবং আট বছর আলাউদ্দিনের সাথে বিরোধে
কাটিয়েছেন। শরন লাল বলেছেন, মূল লেখক জয়সি নিজেই বলেছেন- পদ্মাবত একটি
রূপকাহিনী, ইতিহাসের কোনো বিবরণী নয়। সুফি কবি জয়সি ভূমিকায় বলেছেন, চিতোর
দিয়ে মানবশরীরকে, রতন সেনকে দিয়ে মন, সিংহল দিয়ে হৃদয়, পদ্মাবতীকে দিয়ে
প্রজ্ঞা এবং আলাউদ্দিনকে দিয়ে ক্রোধ বুঝানো হয়েছে। তিনি মনে করেন, ইতিহাস
শুধু এতটুকুই যে, আলাউদ্দিন খিলজি চিতোর জয় করেছিলেন এবং দুর্গের ভেতরে
মহিলারা ‘জহরব্রত’ পালন করেছিলেন। সেখানে রতন সিংয়ের স্ত্রীও ছিলেন। তিনি
পদ্মাবতীর কোনো উল্লেখ করেননি। ঐতিহাসিক বানারসী প্রসাদ সাকসেনা বিশ্বাস
করেন, জহরব্রত পালন করার ঘটনা ভুয়া ও জাল। ঐতিহাসিক আমির খসরুও এমন বিষয়ের
কোনো উল্লেখ করেননি। জওয়াহেরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক আদিত্য
মুখার্জি বলেন, সমসাময়িক ইতিহাসে এমন কোনো ঘটনা ও চরিত্র খুঁজে পাওয়া যায়
না।
এটি কবির কল্পনাপ্রসূত। সুতরাং পদ্মাবত একটি ‘লিজেন্ড’ ও ‘ফিকশন’।
পদ্মাবতী কাহিনী নেয়া হয়েছে মালিক মোহাম্মদ জয়সির ফার্সি ভাষায় লেখা
‘পদ্মাবত’ বা পদুমাবৎ মহাকাব্য থেকে। যেটি ১৫৪০ সালে লেখা হয়; অর্থাৎ
খিলজির চিতোর জয়ের ৩০০ বছর পর। তার উল্লেখযোগ্য অপর কাব্য হলো ‘আখেরি
কালাম’। এ ছাড়াও তিনি কৃষ্ণের ওপর রচনা করেছেন ‘কানহাবত’। তার কাব্য
গ্রন্থের সংখ্যা ২৫। জয়সি একজন সুফি কবি ও পীর ছিলেন। তার এক চোখ অন্ধ এবং
বসন্তের দাগে চেহারা ভরপুর ছিল। সাত সন্তানের মৃত্যুর পর জয়সি ফকিরি জীবন
বেছে নিয়ে আমেথির জঙ্গলে অবস্থান করতেন। কথিত আছে, জয়সি প্রায় সময় বাঘের
বেশ ধরে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। পদ্মাবতী বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এর
পুরনো ১২টি সংস্করণ পাওয়া যায়। তবে সংস্করণগুলো পরস্পরবিরোধী বলে জানা
গেছে। এ দেশে অনেক মহাকাব্য সাহিত্যপ্রেমীদের সমাদর পেয়েছে। যেমন-
বাল্মিকীর রামায়ণ, বেদব্যাসের মহাভারত, ইসমাইল হোসেন সিরাজীর স্পেন বিজয়
কাব্য, রবীন চন্দ্রের কুরুক্ষেত্র, হেম চন্দ্রের বৃত্র সংহার, হামিদ আলীর
কাসেমবধ কাব্য, যোগীন্দ্র বসুর পৃথ্বীরাজ ও শিবাজী, শিরি ফরহাদ,
লাইলি-মজনু, আলিফ লায়লা, মেঘনাদবধ, মহাশ্মশান, বেহুলা সুন্দরী প্রভৃতি।
পশ্চিমা এপিকের আদলে বীরত্বগাথা এসব মহাকাব্যে তুলে ধরা হলেও এগুলো বেশির
ভাগই মহাকবিদের কল্পনাপ্রসূত। কিছু গল্পকথা এবং ঐতিহাসিক কোনো সূত্রকে
অবলম্বন করে মহাকাব্যের বিভিন্ন কল্পিত চরিত্র প্রস্ফুটিত হয়েছে। তেমনি
একটি হলো, জয়সির পদ্মাবতী। মনে রাখতে হবে- মহাকাব্য ইতিহাস নয়। আলাউদ্দিন
ছিলেন খিলজি রাজবংশের প্রচণ্ড শক্তিধর শাসক। ভারতবর্ষের বিরাট অংশ তিনি
শাসন করেছেন। ১৩০৩ সালে তিনি চিতোর জয় করেন। খিলজির প্রথম স্ত্রী, সুলতান
জালালুদ্দিনের কন্যা মালিকা-ই জাহান অত্যন্ত বদমেজাজি ছিলেন। এরপর মাহরু
নামে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করেন। খিলজির চিতোর বিজয় তার বিভিন্ন রাজ্য
বিজয়ের একটি অংশ মাত্র। অনেকে বলেন, সুন্দরী রানীকে পাওয়ার জন্য তিনি চিতোর
আক্রমণ করেছিলেন। কোনো ঐতিহাসিক এটা বিশ্বাস করেন না। কেননা দিল্লির সাথে
চিতোরের বিরোধ ছিল আট বছরের। ইতঃপূর্বে পদ্মাবতী নিয়ে ভারতে আরো ছবি
নির্মিত হয়েছে। ১৯৬৩ সালে ‘চিতোর রানী পদ্মিনী’ ছবি মুক্তি পেয়েছিল। সেখানে
খিলজি চিতোর রাজা রতন সিংকে যুদ্ধে পরাজয়ের পর বন্দী করে দিল্লি নিয়ে আসার
দৃশ্য দেখানো হয়েছে। রতন সিংয়ের প্রাসাদে তিনি ভোজ উপভোগ করেছেন। সেখানে
পদ্মাবতী দোতলা থেকে খিলজিকে দেখেছেন এবং খিলজিও তাকে দেখেছেন। এর বাইরে
কোনো দৃশ্য দেখানো হয়নি ছবিটিতে। খিলজি নারীলোলুপ ছিলেন, এমন কোনো তথ্য
ইতিহাসে নেই। তিনি তার সাম্রাজ্য বাড়ানোর জন্য রাজ্যের পর রাজ্য জয় করেছেন।
অনেক হিন্দু রাজ্যের খিলজির অভিযানে পতন হয়, ইতিহাস এসব তথ্যেই ভরপুর।
খিলজি একজন যোদ্ধা, বীর ও বুদ্ধিমান শাসক ছিলেন। তিনি যেদিকে গিয়েছেন,
সেদিক থেকেই জয় ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। খিলজি ঐতিহাসিক চরিত্র হলেও
ইতিহাসবিদরা বিশ্বাস করেন, পদ্মাবতী কাল্পনিক চরিত্র। ষোড়শ শতাব্দীর মুসলিম
কবি মালিক মোহাম্মদ জয়সির কাব্যে পদ্মাবতীর কাল্পনিক চরিত্র আঁকা হয়েছে।
এই কাব্যে আরো লেখা আছে, সম্ভ্রম রক্ষায় রানী পদ্মাবতী চিতায় উঠে আত্মহত্যা
করেছিলেন। আসলে কবি জয়সি হিন্দু রমণীদের এমন ত্যাগকে বীরগাথায় পরিণত করার
জন্য পদ্মাবতীকে ‘সৃষ্টি’ করেছেন কি না- বোধগম্য নয়। তিনি নিজেই বিষয়টি
রূপক বলে মন্তব্য করেছেন, যা এর আগে বর্ণনা করা হয়েছে। এটি ৭০০ বছর আগের
ঘটনা। আর কাব্য লেখা হয়েছে খিলজির অভিযানের ৩০০ বছর পর। ইতিহাস থেকে জানা
যায়, রানী পদ্মাবতী বলতে আসলে কোনো চরিত্র নেই। এটা নিছক মিথ বা কল্পনা।
মোগল-ই আজম থেকে ‘যোধা আকবর’ ছায়াছবি কতটুকু ইতিহাসনির্ভর সেটি এখনো
প্রমাণসাপেক্ষ। আনারকলি চরিত্র কতটুকু সত্য তা-ও বিবেচনার বিষয়। এখন এমন
কথাও বলা হচ্ছে, যোধার সাথে জাহাঙ্গীরের বিয়ে হয়েছিল আকবরের সাথে নয়! এমন
প্রেক্ষাপটে সঞ্জয়লীলা বানসালির ছায়াছবি পদ্মাবতের জন্ম। রাজস্থানের চিতোরে
পাঁচটি সার ও অ্যাগ্রোকেমিক্যাল কারখানা, তিনটি ফ্যাব্রিক্স ও ব্যাগের
কারখানা, তিনটি পাওয়ার প্লান্ট, পাঁচটি মিনারেল কারখানা, দু’টি টেক্সটাইল
ইউনিট। এসব ইন্ডাস্ট্রির অনেকগুলোতে বিভিন্ন ঐতিহাসিক চরিত্রের নাম ব্যবহার
করা হলেও ছোট-বড় কোনো কারখানায় পদ্মাবতী নাম ব্যবহার করা হয়নি। পদ্মাবত
তৈরি করতে যে কোম্পানি পয়সা খরচ করেছে, সেটি বিখ্যাত শিল্পপতি মুকেশ
আম্বানির। তারা কিভাবে টাকা কামাতে হয়, সে জাদু জানে। মুকেশ আম্বানি মোদি
সরকারের খুব কাছের লোক। তারা এ ব্যাপারে কোনো মুখ খোলেননি। বিজেপি সরকারের
পক্ষে বছর ধরে কর্নি সেনার যে হইচই, তা বন্ধ করা কোনো ব্যাপার নয়। সিনেমা
না দেখেই কোনো হইচই করা আসলে ব্যবসায়িক চালবাজি কিনা তা এখনো বলার সময়
আসেনি। কলকাতার বহুলপ্রচারিত দৈনিক আজকালের সম্পাদকীয় কলামে ২৬ জানুয়ারি
বলা হয়েছেÑ ঠোঁটের কোণে নিষ্ঠুর হাসি, জ্বলন্ত দুই চোখ আর পেটানো চেহারা
নিয়ে ‘পদ্মাবত’ ছবিতে হাজির আলাউদ্দিন খিলজি। সঞ্জয় লীলা বানসালি তাকে
‘বর্বর’ চেহারাতেই এঁকেছেন। কিন্তু ইতিহাস তাকে বর্বর বলতে একেবারেই রাজি
নয়। ঐতিহাসিক রানা সাফাভির মতে, আলাউদ্দিন খিলজি আর যাই হোন, বর্বর ছিলেন
না। তিনি নিজের সাম্রাজ্যে পারস্যের শাসনব্যবস্থা চালু করেছিলেন, যা ছিল
প্রাচীনতম সভ্য এবং সেই সময়ের উন্নততম শাসনব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় সরকার ও
জনগণের মধ্যে যে যোগাযোগ চালু ছিল, সেটাই আলাউদ্দিন চালু করেছিলেন
দিল্লিতে। অন্য দিকে, আলাউদ্দিনের সমসাময়িক বিখ্যাত কবি আমির খসরুর লেখায়
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে আলাউদ্দিনের আমলের যুদ্ধ, রাজ্যজয় ও শাসনব্যবস্থা
সম্পর্কে যে বিস্তারিত লেখা পাওয়া গেছে, তাতেও বর্বর শাসকের চেহারায়
আলাউদ্দিনকে দেখা যায় না। ইতিহাস বলছে, আলাউদ্দিন যুদ্ধবাজ, পররাজ্যলোভী ও
খিলজি সাম্রাজ্যের বিস্তারে তৎপর ছিলেনÑ এসবই ঠিক কথা এবং সেসব ক্ষেত্রে
তিনি ছিলেন ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর। কিন্তু মহিলাদের প্রতি অসভ্য আচরণের কোনো নজির
সেই নিষ্ঠুরতার মধ্যে ছিল না। বরং যেটুকু মনে হয়, প্রশাসক আলাউদ্দিন খিলজি
মহিলাদের প্রাপ্য মর্যাদা দিয়েছেন বরাবর। পদ্মাবত ছবিতে আলাউদ্দিন যতখানি
অসভ্য বা বর্বর, ঠিক ততটাই সভ্যরূপে দেখানো হয়েছে রতন সিংকে। এই প্রসঙ্গে
রানা সাফাভির মন্তব্য, ‘এই ছবির মুখ্য উদ্দেশ্য সম্ভাবত ছিল আলাউদ্দিনের
চরিত্রটি যতখানি সম্ভব কালো করে আঁকা।’ সাফাভি জানিয়েছেন, ‘ধর্মাচরণেও
আলাউদ্দিন উদার ছিলেন। তিনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন, বা খুব গোঁড়া ছিলেন এমন
কোনো তথ্যও পাওয়া যায়নি। আসলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মুসলিম শাসকদের ভিলেন
হিসেবে দেখানো হয়। সেখানে আসল ঐতিহাসিক সত্যের কোনো ছোঁয়া নেই; কিন্তু
এভাবে ইতিহাসের অবমাননা করা যায় না।’
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব, বাংলাদেশ সরকার ও গ্রন্থকার
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব, বাংলাদেশ সরকার ও গ্রন্থকার
No comments