দক্ষিণ এশিয়ার ভাষা ও ভাষা সমস্যা by এবনে গোলাম সামাদ
১৯০১
সালে ব্রিটিশ ভারত সাম্রাজ্যে যে আদমশুমারি হয়, তার রিপোর্টে বলা হয়,
বার্মাসহ ভারতের ভাষার সংখ্যা হলো ২২০টি। বার্মাকে বাদ দিলে ভারত
সাম্রাজ্যের যে অংশ থাকে তার ভাষা সংখ্যা হলো ১৪৬টি। এ সময় ব্রিটিশ
ভাষাতাত্ত্বিক জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ার্সন (১৮৫১-১৯৪১) তখনকার ভারতের
ভাষাগুলোকে প্রধানত চারটি ভাষা পরিবারে স্থাপন করেন। এরা হলো : ১. আদি
আর্যভাষা পারিবার, ২. দ্রাবিড়, ৩. কোল এবং ৪. চীনাভাষা পরিবার।
গ্রিয়ার্সনের এই ভাষাবিভাগকে এখনো মোটামুটি স্বীকার করা হয়। বর্তমান ভারতে
ভাষার মোট সংখ্যা কত, তা আমরা জানি না। কোনো নতুন ভাষা-জরিপ সম্ভবত এখনো
করা হয়নি। ব্রিটিশ শাসনামলে প্রশাসনিক কাজকর্ম চলেছে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে।
সৃষ্টি হয়নি সেভাবে কোনো ভাষা সমস্যার। ভাষা সমস্যার সৃষ্টি হয় ভারতে
ব্রিটিশ শাসনের শেষ ভাগে। ১৯৩৫ সালে পাস হয় ব্রিটিশ-ইন্ডয়া অ্যাক্ট। যাতে
ব্রিটিশ-ভারতের প্রদেশগুলোকে দেয়া হয় যথেষ্ট স্বায়ত্তশাসন। এই অ্যাক্ট
অনুসারে তদানীন্তন ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়
১৯৩৭ সালে। তখন ব্রিটিশ-ভারতের প্রদেশ সংখ্যা ছিল ১১টি। এর মধ্যে কংগ্রেস
নির্বাচনে জেতে আটটি প্রদেশে। কংগ্রেস এসব প্রদেশে মন্ত্রিসভা গঠন করে ১৯৩৭
সালের জুলাই মাসে। এ সময় কংগ্রেস মন্ত্রিসভা গঠন করলেও আসল ক্ষমতা থাকে
কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির হাতে। যাকে বলা হতো কংগ্রেস হাইকমান্ড। এই
হাইকমান্ড আবার একটি সাবকমিটি গড়ে। যারা পরিচালনা করতে থাকে বিভিন্ন
প্রদেশের কংগ্রেস-মন্ত্রিসভাকে। মাদ্রাজ প্রদেশে কংগ্রেসের মন্ত্রিসভার
মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন চক্রবর্তী রাজা গোপাল আচারি। যিনি একজন খুব বড়
নেতা হলেও তাকে মেনে চলতে হতো কংগ্রেস হাইকমান্ডের নির্দেশ। তিনি ছিলেন
তামিল ভাষার একজন সুলেখক। ধর্মে হিন্দু এবং ব্রাহ্মণ। মুখ্যমন্ত্রী রাজা
গোপাল আচারি কংগ্রেসের হাইকমান্ডের নির্দেশে মাদ্রাজ প্রদেশের মাধ্যমিক
বিদ্যালয়গুলোর হিন্দিভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেন। যেটা মাদ্রাজর
তামিলভাষী মানুষ মেনে নিতে পারে না। তারা শুরু করে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন।
প্রায় তিন বছর ধরে এই আন্দোলন চলে। ছাত্ররা করে সভা, বিক্ষোভ মিছিল,
ধর্মঘট। এ সময় পুলিশের হাতে প্রতিবাদকারী দু’জন ছাত্রের মৃত্যু ঘটে, আটক
অবস্থায়। এ সময় পুলিশের হাতে বন্দী হয় এক হাজার ১৯৮ জন ব্যক্তি। এই আন্দোলন
যেমন হয়ে দাঁড়ায় হিন্দিবিরোধী, তেমনি আবার হয়ে দাঁড়ায় ব্রাহ্মণবিরোধী।
কেননা মুখ্যমন্ত্রী রাজা গোপাল আচারি ছিলেন ব্রাহ্মণ। আর অনেক ব্রাহ্মণ
ছিলেন তার সমর্থক। এই আন্দোলনে মাদ্রাজ প্রদেশে সব তামিলভাষী মুসলমান যোগ
দেয় হিন্দি বিরোধীদের পক্ষে। অন্য দিকে উর্দুভাষী মুসলমানেরা যায় হিন্দিকে
রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে। এ সময়ের মাদ্রাজ প্রদেশ ছিল পরবর্তী মাদ্রাজ
প্রদেশের চেয়ে অনেক বড়। আর এখানে ছিল কিছু উর্দুভাষী মুসলমান। যদিও সংখ্যায়
তারা খুব বেশি ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর
মাসে। কংগ্রেস চায় না বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনকে সহযোগিতা করতে। কংগ্রেস
সদস্যরা আটটি প্রদেশের বিধানসভা থেকে পদত্যাগ করে। ১৯৩৯ সালে মাদ্রাজ
প্রদেশে ক্ষমতা গ্রহণ করেন গভর্নর লর্ড এরসকিন (Lord Erskine)। তিনি
ক্ষমতায় এসে মাধ্যমিক স্কুলে হিন্দি শেখার আইন বাতিল করেন। আমি এ সময়ের কথা
বলছি, কারণ আমাদের দেশে অনেকে মনে করেন ভাষা নিয়ে আন্দোলন এই উপমহাদেশে
প্রথম হয়েছে ঢাকায়, পাকিস্তান আমলে। এই উপমহাদেশের ইতিহাস অনুশীল করলে দেখা
যাবে, ভাষা নিয়ে প্রথম বিরোধ সৃষ্টি হয় তামিলভাষী মাদ্রাজে। আর এতে প্রাণ
যায় দু’জন তামিলভাষী ছাত্রের। অনেকে ভাবেন, পাকিস্তান না হলে ভাষা সমস্যার
উদ্ভব হতো না। কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার অনেক কয়েক বছর আগেই ব্রিটিশ ভারতের
মাদ্রাজ প্রদেশে সৃষ্টি হতে পেরেছিল ভাষা সমস্যা। ১৯৪৯ সালে রচিত ভারতের
সংবিধানে বলা হয়, ভারতে ১৯৬৫ সালের মধ্যে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা হবে
হিন্দিকে। কিন্তু এর বিরোধিতা শুরু করে দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড়ভাষী লোকেরা।
এই আন্দোল সবচেয়ে তীব্র হয়ে ওঠে মাদ্রাজে। তামিলভাষী মাদ্রাজের অধিবাসীরা
শুরু করে প্রচণ্ড বিক্ষোভ। তারা ট্রেনে ও সরকারি ভাবনে শুরু করে
অগ্নিসংযোগ। পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায়। এতে
১৯৬৫ সালে সরকারি হিসাব অনুসারে দু’জন পুলিশসহ মারা যায় ৬০ ব্যক্তি।
কিন্তু বেসরকারি হিসাবে মারা যায় ৫০০ জন। ফলে হিন্দিকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা
করার আইন মুলতবি করা হয়। প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী বেতারে ঘোষণা
করেন, হিন্দির সঙ্গে অনির্দিষ্ট কালের জন্য সহযোগী রাষ্ট্রভাষা থাকবে
ইংরেজি। ইংরেজি ভাষার মাধ্যমেই গ্রহণ করা হবে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা,
হিন্দি ভাষার মাধ্যমে নয়। এর ফলে বন্ধ হয় মাদ্রাজ প্রদেশে হিন্দিবিরোধী
আন্দোলন। ১৯৬৬ সালে ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি ১৯৬৭
সালে আইন করেন, ইংরেজি ভাষা অনির্দিষ্টকালের জন্য ভারতের সহযোগী
রাষ্ট্রভাষা হিসেবে থাকবে। অর্থাৎ কার্যত ইংরেজি ভাষাই এখনও সারা ভারতে
চলেছে প্রশাসনিক ভাষা হিসেবে। মাদ্রাজিরা ব্রিটিশ শাসনামলে যথেষ্ট ভালোভাবে
শেখে ইংরেজি ভাষাকে। মাতৃভাষার মতোই অনেক তামিলভাষী বলতে পারে ইংরেজি।
ইংরেজি ভাষা তাদের কাছে ঠিক বিদেশি ভাষা বলে বিবেচিত নয়।
মাদ্রাজ প্রদেশে
কংগ্রেস ১৯৬৫ সালে পরাজিত হয় তামিল জাতীয়তাবাদী দল, দ্রাবিড় মুনাত্রা
কাজাঘাম দলের কাছে। এই দল ১৯৬৯ সালের ১৪ জানুয়ারি মাদ্রাজ প্রদেশের নাম বদল
করে রাখে, তামিলনাড়ু। তামিল ভাষায় ‘নাড়ু’ শব্দের অর্থ হলো দেশ। অর্থাৎ
তামিলনাড়ু মানে হলো তামিলদের দেশ। ১৯৯৬ সালের পহেলা অক্টোবর তামিলনাড়ুর
রাজধানী মাদ্রাজের নাম বদলে রাখা হয় চেন্নাই। তামিলরা এখন তাদের ভাষাকে
বিশুদ্ধ তামিল করতে চাচ্ছে। এ জন্য তারা বাদ দিচ্ছে তাদের ভাষায় প্রবিষ্ট
সংস্কৃত শব্দকে। যেহেতু তামিল ব্রাহ্মণরা ধর্মীয় কারণে সংস্কৃত শব্দ পছন্দ
করে, তাই বিশুদ্ধ তামিল ভাষা প্রবর্তনের জন্য আন্দোলনকারীদের হয়ে উঠতে দেখা
যাচ্ছে ব্রাহ্মণবিরোধী। তামিলরা খুব কর্মঠ জাতি। তারা চেন্নাইতে প্রস্তুত
করছে কেবলমাত্র তামিল ভাষার ছায়াছবি নয়, দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য দ্রাবিড়
ভাষারও ছায়াছবি। চেন্নাই হয়ে উঠেছে ছায়াছাবি নির্মাণের ক্ষেত্রে মুম্বাইয়ের
হিন্দি ছায়াছবির বিশেষ প্রতিদ্বন্দ্বী। আমরা সাবেক পাকিস্তানে আন্দোলন
করেছিলাম বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য। এখন এটাকে বলা হচ্ছে
মাতৃভাষার আন্দোলন। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন আর মাতৃভাষা আন্দোলন
সমার্থক নয়। আমরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছিলাম, মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলন
নয়। পাকিস্তান আমলে কখনই বলা হয়নি যে, পূর্ববঙ্গ প্রদেশে প্রাদেশিক সরকারের
কাজকর্ম চালাতে হবে উর্দুভাষার মাধ্যমে। বাংলাভাষাকে জর্জ গ্রিয়ার্সন
স্থাপন করেছেন আর্যভাষা পরিবারে। কিন্তু বাংলাভাষার অনেক বৈশিষ্ট্য আছে যা
হলো দ্রাবিড় ভাষাগুলোরই মতো। যেমন বাংলা শব্দের আদিস্বরে শ্বাসাঘাত রীতি
দ্রাবিড় ভাষার মতো। বাংলা ভাষায় বাক্যরচনা করতে হলে আমরা অনেক সময়ই
ক্রিয়াপদের ব্যবহার করি না। যেমন আমরা বাংলাভাষায় বলতে পারি ‘তিনি একজন
বিশিষ্ট ভদ্রলোক’। আমরা বলি না, ‘তিনি হন একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক’। বাংলার এই
বাক্যগঠন প্রণালী হলো দ্রাবিড় ভাষার অনুরূপ। বাংলাদেশের অনেক জায়গার নামের
শেষে থাকতে দেখা যায় ভিটা, হিটি, গড্ডা, গুড়ি, জোলা প্রভৃতি শব্দ যুক্ত
থাকতে। এরও দৃষ্টান্ত মেলে দ্রাবিড় ভাষায়। আমরা জানি হিন্দি ও উর্দু ভাষার
ব্যাকরণ হলো একই। উর্দু হলো আরবি-ফারসি শব্দবহুল হিন্দি ভাষা মাত্র। যা
লেখা হয় ফারসি-আরবি অক্ষরে। আমরা উর্দুকে চাইনি সাবেক পাকিস্তানের একমাত্র
রাষ্ট্রভাষা করতে। হতে পারে এর একটা কারণ হলো আমাদের মধ্যে প্রচ্ছন্ন হয়ে
থাকা আর্যবিরোধী দ্রাবিড় মনোভাব। ভারতে এখন ক্ষমতায় আছে বিজিপি দল। বিজিপির
বুদ্ধিজীবীরা প্রমাণ করতে ব্যস্ত যে, ভারতে আর্য ভাষায় কথা বলা মানুষ
বাইরে থেকে এসেছিল না। আর্যভাষী জাতি ছিল উত্তর-ভারতে। উত্তর-ভারত থেকে
তারা ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন স্থানে। গড়ে তোলে উন্নত সভ্যতা। কিন্তু সাধারণভাবে
বেশিরভাগ পণ্ডিত মনে করেন, প্রাচীন যুগে হরপ্পা এবং মহেনজোদারো নগর সভ্যতা
গড়ে তুলেছিল দ্রাবিড়ভাষী মানুষ। তাদের ছিল একটা লিখিত ভাষা। এই লিখিত ভাষার
পাঠ উদ্ধার এখনো করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এই সভ্যতার যথেষ্ট মিল থাকতে দেখা
যায় সুমেরীয় সভ্যতার সঙ্গে। সুমেরীয় ভাষা ও দ্রাবিড় ভাষার মধ্যে থাকতে
দেখা যায় অনেক মিল। অনেকের মতে, সুমেরীয় ভাষা থেকেই উদ্ভব হয়েছে
দ্রাবিড়ভাষাগুলোর। বিজিপির পণ্ডিতরা মানতে চাচ্ছেন না হরোপ্পা ও মহেনজোদারো
সভ্যতাকে দ্রাবিড়ভাষীর সৃষ্ট সভ্যতা হিসেবে। বিজিপি প্রমাণ করতে চাচ্ছে
যে, এসব সভ্যতা হলো আর্যদেরই সৃষ্টি। এসব সভ্যতা হলো আর্য তথা হিন্দু
সভ্যতার প্রাচীন নিদর্শন। বিজিপির মতে, যেহেতু হিন্দি ভাষায় ভারতের
সর্বাধিত সংখ্যক লোক কথা বলে এবং যেহেতু তা হলো একটি আর্য ভাষা, তাই তাকে
করা যেতে পারে ভারতের একমাত্র সরকারি ভাষা। কিন্তু বিজিপি এটা করতে গেলে
ভারতে সৃষ্টি হবে তীব্র দ্রাবিড়-আর্য সঙ্ঘাত। যার ফলে ভারতীয় ইউনিয়ন ভেঙে
যেতেও পারে।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
No comments