আজকের দিনে একুশের ডাক by মো. মইনুল ইসলাম
গভীরভাবে
চিন্তা করলে এটা স্পষ্ট যে, একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন ও রক্তদান
আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন তথা জাতীয় মুক্তির ভিত্তি রচনা করেছিল। এটা শুধু
ভাষার আন্দোলন ছিল না। এটা ছিল বাঙালির জাতীয় রাষ্ট্র রচনার সূচনা মাত্র।
বাংলাদেশের অঙ্কুর মূলত তখনই বিকশিত হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি জন্মলগ্ন
থেকেই ছিল প্রচণ্ড বাঙালি বিদ্বেষী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একদল তরুণ
ছাত্র রাষ্ট্রীয় মর্যাদা থেকে বাংলা ভাষাকে অপাঙ্তেয় করার অপমানের বিরুদ্ধে
তাই প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। এটা ছিল পাকিস্তানের
অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে আমাদের প্রথম লড়াই। এ পথ ধরেই পাকিস্তানি শাসনের
২৪ বছর ধরে আমরা ক্রমাগত আন্দোলন এবং লড়াই করেছি। শেষ লড়াইটি হয় ১৯৭১ সালে।
তাতে আমাদের ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছে এবং প্রায় ৩ লাখ মা-বোন সম্ভ্রম
হারিয়েছে। একুশ ছিল রাষ্ট্রীয় অন্যায়, অবিচার এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে
প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ। শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক আবুল ফজলের ভাষায়, ‘একুশ
মানে মাথা নত না করা।’ অর্থাৎ অন্যায়-অত্যাচারের কাছে নতি স্বীকার না করা।
একুশের ধারাবাহিকতায়ই আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। একুশের জন্য আমাদের
কিছু মানুষ প্রাণ দিয়েছিল, তা ছিল জীবন উৎসর্গের সূচনা। এটি শেষ হয় ৩০ লাখ
মানুষের জীবনদানের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের মাধ্যমে। আমাদের এই
মুক্তি ও স্বাধীনতার পেছনেও একটি চেতনা সক্রিয় ছিল। সেটি ছিল একটি
অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত এবং সুখী-সমৃদ্ধ
বাংলাদেশ গঠন করা। এ দুটো চেতনাকে ধারণ করেই আজকের একুশ উদযাপন করতে হবে।
এই মহৎ এবং বৃহৎ উদ্দেশ্য অর্জনই আমাদের সামনে আজ বড় কাজ এবং বৃহৎ
চ্যালেঞ্জ। প্রায় ৬৫ বছর আগেকার একটি শোকাবহ ঘটনাকে স্মরণ করে আজকের ২০১৮
সালের ফেব্র“য়ারিতে শোকের গান গাইলে মনে হয় না প্রকৃত অর্থে আমরা শহীদদের
রক্তের ঋণ শোধ করতে পারব এবং যথাযথ শ্রদ্ধা নিবেদনে সক্ষম হব। এর জন্য
দরকার দেশকে একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক এবং উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত
করা এবং জাতীয় জীবনে যে দুর্নীতি-সন্ত্রাস এবং সামাজিক অন্যায়-অবিচার চলছে,
তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলা। তা হলেই আমরা শোককে শক্তিতে
পরিণত করতে পারব, যার অপর নাম সংগ্রাম। শান্তিপূর্ণ এ সংগ্রামের পথটি
নিঃসন্দেহে দীর্ঘ। তবে সেটাই স্থায়ী সাফল্যের পথ রচনা করবে। দেশপ্রেমিক
রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম এবং সচেতন বুদ্ধিজীবীদের
চিন্তা-ভাবনা ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ক্রমাগত সমাজ ও রাজনীতিতে সক্রিয়
দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ঘৃণা ও নিন্দার সৃষ্টি হচ্ছে।
এটা একটা নীরব বিদ্রোহ বা বিপ্লব। বিখ্যাত ফরাসি লেখক ভিক্টর হুগোর মতে, সব
বিপ্লবেরই জন্ম হয় নীরবে মানুষের মনে। মনের এই নীরব আগুনই একদিন পুঞ্জীভূত
হয়ে প্রকাশ্যে জ্বলে ওঠে এবং অত্যাচারীদের আস্তানা পুড়িয়ে দেয়। পাকিস্তান
গেছে আজ প্রায় ৪৬ বছর। কিন্তু উন্নয়নের নিরিখে আমরা কতটা অগ্রগতি সাধন
করেছি, সেটা খতিয়ে দেখার একটি সুযোগ এনে দেয় একুশে ফেব্র“য়ারি। উন্নয়ন বলতে
এখানে আমরা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নকে বোঝাচ্ছি।
অর্থনৈতিকভাবে আমরা বেশ খানিকটা অগ্রগতি সাধন করেছি। এর বিশেষ কয়েকটি সূচক
এখানে উল্লেখ করা যায়। যেমন আমাদের জিডিপি বা মোট দেশজ আয় গড়ে প্রায় ৭
শতাংশ। মাথাপিছু গড় আয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ৬০০ ডলারের কিছু বেশি এবং
দারিদ্র্যের হার ক্রমাগত কমছে। নিুআয়ের দেশ থেকে আমরা নিুমধ্যম আয়ের দেশে
উন্নীত হয়েছি। শিগগিরই স্বল্পোন্নত দেশ বা সিডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে
উন্নীত হব। এ উন্নয়নগুলো ঘটেছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলেই।
তবে
আরও অধিকতর মাত্রায় উন্নয়ন অর্জনে আমরা সক্ষম হতাম, যদি দুর্নীতির হার কম
হতো। এর জন্য দরকার ছিল অধিকতর সরকারি সক্রিয়তা। এখানেই রাজনীতির বিষয়টি
এসে পড়ে। আমাদের মতো দেশে রাজনীতি যত গণমুখী হবে, ততই উন্নয়নের বিষয়টি
প্রাধান্য পাবে। কারণ উন্নয়নই দারিদ্র্য নিরসনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। আর
দারিদ্র্য নিরসন মানেই আর্থিকভাবে দুর্বল মানুষকে সবল করা। এর সঙ্গে
মানুষের রাজনৈতিক তথা গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো বৃদ্ধি করাও গণমুখী রাজনীতির
কাজ। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতন্ত্রের কথায় সোচ্চার থাকতে দেখা যায়।
তাদের কাছে নির্বাচনই গণতন্ত্র বলে মনে হয়। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ সত্য নয়।
সুশাসন এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া গণতন্ত্র সম্পূর্ণ হয় না। এ দুটির
ব্যাপারে দেশে বড় ধরনের ঘাটতি আছে। বেসিক ব্যাংক এবং সম্প্রতি জনতা ব্যাংক
কেলেঙ্কারি দেশে সুশাসনের অভাবের চিত্র ভয়াবহভাবে তুলে ধরেছে। দু’বেলা আহার
জোগাড়ের জন্য সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ যে অমানবিক পরিশ্রম করে, তা
নিত্যদিন চোখের সামনেই দেখি। এর বিপরীতে অতি ক্ষুদ্রসংখ্যক ব্যক্তি
দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলাটা
কোনো মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ বা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মেনে নিতে
পারে না। একুশের আন্দোলনটির শুরু হয়েছিল শিক্ষাঙ্গনে। স্বাধীন বাংলাদেশে
জীবনের নানা ক্ষেত্রে বহুবিধ অন্যায়-অবিচার এবং সমস্যা বিরাজ করছে। এ
অবস্থা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পবিত্র অঙ্গনও মুক্ত নয়। শিক্ষা শিক্ষার
মতো হচ্ছে না। তাই শিক্ষার গুণগত মানের ওপর এখন এত গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় একদল ছাত্রের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে শিক্ষার
আদর্শ ও উদ্দেশ্য চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানে
দেশপ্রেমিক ও আদর্শবাদী ছাত্রদের পড়াশোনা এবং দেশ ও দশের স্বার্থে কথা বলা
দুষ্কর হয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মুষ্টিমেয় দলবাজ ও কোচিংবাজ
শিক্ষক, যারা মানুষ গড়ার কারিগর না হয়ে টাকা বানানোর এবং দলবাজির কারিগর
হয়ে পড়েছে। সুতরাং একুশকে শুধু অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ না রেখে তার মূল চেতনায়
ফিরে যেতে হবে। আগেই বলা হয়েছে, মূল চেতনাটি হচ্ছে সর্বপ্রকার
অন্যায়-অত্যাচার এবং জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়া এবং
প্রতিরোধ গড়ে তোলা। আজকের স্বাধীন বাংলাদেশেও নানা অন্যায়-অবিচার বিরাজমান,
যা আমাদের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করছে। এর বিরুদ্ধে আমাদের শান্তিপূর্ণ
আন্দোলন-সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। আমি মনে করি, নতুন এ সংগ্রামের ডাক
দিয়ে একুশ আবার আমাদের মাঝে এসেছে। এ ডাকে সাড়া দিয়েই আমরা একুশের প্রতি
প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারি।
মো. মইনুল ইসলাম : সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মো. মইনুল ইসলাম : সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments