জনসংখ্যা বৃদ্ধি পৃথিবীকে সংকটাপন্ন করে তুলছে
একটি
কথা ভুলে গেলে চলবে না- সব ওষুধই কেমিক্যালস এবং সব কেমিক্যালসই বিষ। All
medicines are chemicals, all chemicals are poison until and unless they
are properly used. অর্থাৎ ওষুধের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার শুধু
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করে না, জীবনকে পঙ্গুত্বের দিকে ঠেলে দিতে পারে
অথবা মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়। মাদকও একটি কেমিক্যাল, যা মানুষ নেশাগ্রস্ত
হওয়ার জন্য ব্যবহার করে আর নেশা বা রোগ নিরাময়ের জন্য যা ব্যবহৃত হয় তা হল
ওষুধ। কথাগুলো বলার জন্য আমার বিবেক আমাকে বেশ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। কারণ বেশ
কয়েক বছর আগে চট্টগ্রাম বন্দরে রেডিয়েশন পাউডারযুক্ত দুধ আমদানির একটা খবর
বেরিয়েছিল। বেশ কয়েক দিন পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে বেশ লেখালেখিও হয়েছিল। মজার
ব্যাপার হল, এরপরও জাহাজভর্তি দুধ ফেরত যায়নি। আমদানিকারকরা বিভিন্ন
চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন এবং বিভিন্ন উপহার দিয়ে এই দুধ বিক্রিও করে ফেলে। এই
তেজস্ক্রিয়যুক্ত দুধের ফলাফল আজ বাংলাদেশে আমরা চিকিৎসকরা হাড়ে হাড়ে টের
পাচ্ছি। অর্থাৎ থাইরয়েডের ক্যান্সারের প্রার্দুভাব এখন এত বেড়ে গেছে যা
অচিন্তনীয়। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণ করার কোনো চেষ্টা না হলেও অথবা সুযোগ
বা উদ্যোগের অভাব থাকলেও থিওরেটিক্যালি এটা বলা অসমীচীন হবে না যে,
তেজস্ক্রিয়যুক্ত দুধের প্রভাবেই থাইরয়েড ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে।
অর্থাৎ ধনী হওয়ার জন্য আমরা জাতির ক্ষতির বিষয়টি কখনও মনে আনি না, ব্যস্ত
থাকি নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধিতে। ভুলে গেলে চলবে না- ‘ঐশ্বর্য রক্ষা করা
কঠিন’, যা আদর্শলিপিতে আমরা পড়েছিলাম। যারা আমদানি করেছিলেন, তারা নিশ্চয়ই
ধরে নিয়েছিলেন, এই দুধ সাধারণ মানুষ খাবে,
সুতরাং তাদের কোনো ক্ষতি হবে না।
চেরনোবিল পারমাণবিক দুর্ঘটনার পর সেখানকার দুধ ১০০ ফুট মাটির নিচে পুঁতেও
নষ্ট করা যায়নি। কারণ ওই তেজস্ক্রিয়তার হাফলাইফ অর্ধশত বছরের অধিক। সুতরাং
যেসব দরিদ্র, মধ্যবিত্ত ব্যক্তি এসব পাউডারের দুধ বিভিন্নভাবে মিষ্টি,
পায়েস বা তরল দুধ হিসেবে পান করেছেন, তাদের শরীরের মল-মূত্রের সঙ্গে সেই
তেজস্ক্রিয়তা নির্গত হয়ে মাটি ও পানিকে বিষাক্ত করে দিয়েছে। ফলে সেই মাটি ও
পানিতে উৎপাদিত পণ্যও তেজস্ক্রিয়যুক্ত থাকবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ফলে
জনবহুল এবং পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতির দেশ হিসেবে এ দেশের জনগণের
তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। বলছিলাম অবিচল সতর্কতার
তৃতীয় অঙ্গ হিসেবে জনসংখ্যাধিক্যের কথা। প্রথমটি জনগণ তথা সরকারের অর্থ
আত্মসাৎ, দ্বিতীয়টি মাদকাশক্তি এবং তৃতীয়টি হল বিশাল জনগোষ্ঠী। এ জনগোষ্ঠীর
সংখ্যা কমানো খুবই জরুরি। সেটা শুধু পরিবার পরিকল্পনার মাধ্যমে নয়,
মানুষকে সামাজিক শিক্ষাদানের মধ্য দিয়েও তা সম্ভব। সম্ভব জীবনযাত্রার মান
উন্নয়নের শিক্ষাদানের মাধ্যমে। তাকে বুঝতে হবে কী করে তার সন্তানকে
মানবসম্পদে রূপ দান করা যায়। শুধু অবয়ব থাকলেই মানুষ বলা যায় না; প্রকৃত
দেশপ্রেমিক, সুশিক্ষিত, কর্মক্ষম সমাজ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখতে পারে কেবল
মানুষই- স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ জীব। যে কোনো লক্ষ্যকে উপলব্ধি করে আসুন সবাই
মিলে তা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সংকল্প করি। আমাদের দেশের লক্ষ্য হল জনগণের
সমৃদ্ধ, স্বাস্থ্যোজ্জ্বল, সুরক্ষিত, শান্তিপূর্ণ ও সুখী জীবন এবং দেশকে
নিরবচ্ছিন্নভাবে উন্নতির পথে এগিয়ে নেয়া, যেখানে গ্রামীণ আর নাগরিক বিভাজন
একটা সূক্ষ্ম রেখায় পর্যবসিত হবে- এবং প্রশাসন হবে সংবেদনশীল, পরিচ্ছন্ন ও
দুর্নীতিমুক্ত। উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি নির্ভর করে সুযোগ্য, সুশিক্ষিত, পরিশ্রমী ও
আত্মত্যাগী মানুষের ওপর। বাংলাদেশের মতো বহু ধর্ম ও সংস্কৃতিসম্পন্ন সমাজে
প্রত্যেক মানুষের জীবনের ব্রত হওয়া উচিত নিজেদের হৃদয় ও মননকে সমৃদ্ধ করা।
‘আমরা করতে পারি’- এই আত্মবিশ্বাস মনের মধ্যে প্রোথিত করা। ক্ষুদ্র
ভূখণ্ডের বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য ধ্বংস হচ্ছে চাষযোগ্য জমি, দ্রুত
কমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর, যা এই বিশাল জনগোষ্ঠী ও ভূখণ্ডকে টিকিয়ে
রাখার জন্য অপরিহার্য। তেল ও গ্যাসের হয়তো বিকল্প আসবে, কিন্তু পানির
বিকল্প কি তৈরি করা যাবে বিজ্ঞানাগারে? নিশ্চয়ই না। বর্তমান গণতান্ত্রিক
বাংলাদেশ যা অর্জন করেছে, তাকে তুচ্ছ করে দেখার কোনো উপায় নেই। গত ৮-৯ বছরে
দেশের অর্জন সমগ্র বিশ্বে শুধু স্বীকৃতিই পায়নি, প্রশংসাও পেয়েছে।
বাংলাদেশ বহু ধর্মাবলম্বী মানুষের দেশ।
এ দেশের এত সাফল্য সত্ত্বেও তার
আবরণে মিশে আছে গভীর অনিশ্চয়তা। রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনের শেষে আকাশে মেঘ জমবে,
বৃষ্টি আসবে, এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের আকাশে যেমন রোদ আছে, তেমনি আছে
কালো মেঘ। সুতরাং দেশপ্রেমিক প্রত্যেক মানুষকে চলতে হবে অবিচল সতর্কতার
সঙ্গে। অনেক সমস্যার মধ্যে জনসংখ্যার সমস্যাকে এক নম্বর হিসেবে চিহ্নিত করে
তা সমাধানের জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আর অথর্ব জনগোষ্ঠীকে মানবসম্পদে
উন্নীত বা রূপান্তরিত করা না গেলে কোনো কিছুই সম্ভব হবে না, এমনকি রফতানিও
করা যাবে না। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, পৃথিবীর সব দেশই এখন ডাক্তার,
ইঞ্জিনিয়ারসহ সব পেশার লোকে সমৃদ্ধ। দরকার শুধু রাস্তাঘাট পরিষ্কার করার
লোক। প্রযুক্তি যেভাবে এগিয়ে চলেছে, তাতে রাস্তাঘাট পরিষ্কার করার জন্য
কিছুদিন পর জনশক্তির প্রয়োজন হবে না (যা বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের দেশে
রফতানি হচ্ছে)। দেখা যাবে কোনো যন্ত্রযান কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রিয়াদ, মক্কা,
মদিনা অথবা স্টকহোম ও লন্ডন সিটির মতো জায়গা পরিষ্কার করে নেবে। ইউরোপের
কিছু কিছু দেশে এখনও হয়তো চাহিদা আছে বিল্ডার, প্লাম্বার বা এ ধরনের দক্ষ
লোকের। অদূর ভবিষ্যতে তাও থাকবে না। ধর্মভীরু জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে কীভাবে
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এ নিয়ে প্রচুর গবেষণা দরকার, দরকার
আলেম-উলামা, সাধু-সন্ন্যাসী এবং গির্জার ধর্মগুরুদের সুচিন্তিত মতামত।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে অথবা সমুদ্র থেকে নতুন জমি উদ্ধার করা না
গেলে, নতুন জনবসতির সুযোগ না পেলে জনবসতির ঘনত্ব শুধু অস্বাস্থ্যকর
পরিবেশের সৃষ্টি করবে না, রোগব্যাধি ছড়াতেও ভূমিকা রাখবে। তবে সুখবর হল
বাংলাদেশ স্যানিটেশন খাতে এবং সুপেয় পানি ব্যবস্থায় যথেষ্ট উন্নতি করেছে।
অবশ্য আর্সেনিক সমস্যা এক বিরাট সমস্যা আজও। পৃথিবীর অনেক দেশ শুধু
জনসংখ্যার সুষ্ঠু বিন্যাসের জন্য বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে। সোশ্যাল
সার্ভিসে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগোচ্ছে।
প্রায় সর্বক্ষেত্রেই উন্নত দেশের মতো ভাতা প্রদান শুরু করেছে, যা ওয়েলফেয়ার
রাষ্ট্রের প্রথম নিদর্শন। নারী ও শিশু পুষ্টিতেও যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে।
বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়েও বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে,
যা বিশ্ব অবাক হয়ে দেখছে। ১৯০০ সালে যেখানে পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল ১.৬
বিলিয়ন, তা ২০০০ সালে এসে দাঁড়ায় ৬.১ বিলিয়নে, যার ৮৫ ভাগ বৃদ্ধি ঘটেছে
শুধু এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায়। জাতিসংঘের পপুলেশন প্রজেকশন দেখে
মনে হয় ২০৩০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৮ বিলিয়ন বা ৮০০ কোটিতে দাঁড়াবে। যেখানে
উন্নত বিশ্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে ২ শতাংশ, সেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলোয়
বৃদ্ধি পাবে ৪৫ শতাংশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিটি মৌলিক চাহিদার দাবি বাড়িয়ে
দেয়, ফলে রাষ্ট্র অর্থের সংকুলান করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে
ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। জনসংখ্যার বৃদ্ধি কৃষির দাবিকে জোরালো করে তোলে।
জনসংখ্যার বৃদ্ধি শুধু খাদ্যাভাব সৃষ্টি করবে না, বরং বিশ্বব্যাপী
পানীয়জলের সংকট সৃষ্টি করে মানবসভ্যতাকে বিপন্ন করে তুলবে। বস্তুত জনসংখ্যা
বৃদ্ধি শুধু পরিবেশ নয়, বনায়ন ধ্বংস করে পৃথিবীকে সংকটাপন্ন করে তুলছে।
বিংশ শতাব্দী ছিল পরিবর্তনের শতক। এ শতাব্দীতে শুধু জনসংখ্যার বৃদ্ধিই
ঘটেনি, অর্থনীতি ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে, ঘটেছে
ভূপৃষ্ঠের মারাত্মক দূষণ। মানুষের জীবনযাত্রার মানও বেড়েছে বিংশ শতাব্দীতে।
অনিরাময়যোগ্য নতুন নতুন সংক্রামক ব্যাধির সংখ্যাও বেড়ে চলেছে, যা পৃথিবীতে
মানবসভ্যতার বিপর্যয় ঘটাতে পারে।
অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত : বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক; সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত : বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক; সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
No comments