‘ক্যাঙারু মাদার কেয়ার’ by আব্দুল কাইয়ুম
নবজাতক
যদি কোনো কারণে কম ওজনের হয় বা সে যদি একটু অসুস্থ থাকে, তাহলে মায়ের বুকে
শিশুকে এমনভাবে শুইয়ে রাখতে হবে, যেন দুজনের ত্বকে ত্বক লেগে থাকে। এটাই
‘ক্যাঙারু মাদার কেয়ার’। নামটা এসেছে অস্ট্রেলিয়ার প্রাণী ক্যাঙারু থেকে।
ওরা নিজের পেটের নিচে একটি বিশেষ থলেতে বাচ্চাদের নিয়ে চলাফেরা করে।
ক্যাঙারু মাদার কেয়ার নিয়ে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি শিশির মোড়লের একটি
প্রতিবেদন ২০১৭ সালের ১৭ এপ্রিল প্রথম আলোয় ছাপা হয়। আন্তর্জাতিক এনজিও সেভ
দ্য চিলড্রেন প্রতিবেদনটি অনুবাদ করে হেলদি নিউ বর্ন নেটওয়ার্ক-এ প্রকাশ
করে। এরপর গত বছর বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল এ বিষয়ে কাজ করার জন্য
কেনিয়ায় যায়। দলটি একটি ক্লিনিকে গিয়ে দেখে, প্রতিবেদনের ইংরেজি অনুবাদটি
সেখানে সেঁটে দেওয়া। ক্লিনিকের চিকিৎসকেরা তাঁদের বলেন, ‘এটা তোমাদের
দেশেরই রিপোর্ট!’ আগে হাসপাতালগুলোতে সাধারণত শিশুর জন্মের পরই তাকে মায়ের
কাছ থেকে সরিয়ে অন্য ঘরে বিশেষ যত্নের জন্য নিয়ে রাখা হতো। এখন আর তা করা
হয় না। বরং নবজাতককে মায়ের বুকের সঙ্গে জড়িয়ে রেখে বিশেষ সেবার ব্যবস্থা
করা হয়। আরও কিছু ব্যবস্থা আছে, সে কথায় পরে আসছি। বাংলাদেশে প্রতি হাজার
জীবিত জন্মে এমন নবজাতকের মৃত্যুহার এখনো ২০। এই হার ভারত, পাকিস্তান ও
নেপালের চেয়ে কম। শ্রীলঙ্কার চেয়ে বেশি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা
(এসডিজি) অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের প্রতি হাজার জীবিত জন্মে এমন
নবজাতকের মৃত্যুহার ১২-তে নামিয়ে আনতে হবে। কিছু ব্যবস্থা নিলে এটা করা
সম্ভব। নবজাতকের মৃত্যুহার কমিয়ে আনার প্রতি এখন জোর দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে
প্রথম ২৪ ঘণ্টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, নবজাতকের যত মৃত্যু ঘটে, তার
অর্ধেকই ঘটে জন্মের প্রথম ২৪ ঘণ্টায়। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ২ থেকে ৬ দিনে এবং
প্রায় ১৯ শতাংশ ৭ থেকে ২৮ দিনে। তাই প্রথম ঘণ্টা তো বটেই, তারপর প্রায় এক
মাস পর্যন্ত নবজাতকের জন্য বিশেষ যত্নের বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
এর ফলে
সার্বিকভাবে শিশুমৃত্যুর হার অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব। সরকারের লক্ষ্য প্রতি
হাজার জীবিত জন্মে এমন শিশুমৃত্যুর হার বর্তমানে ২৮ থেকে কমিয়ে ২০-এ নিয়ে
আসা এবং তাদের মধ্যে বিশেষভাবে নবজাতকের মৃত্যুহার ১০-এ নামিয়ে আনা (২০৩৫
সালের মধ্যে)। আগে পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশুদের প্রতি বিশেষ যত্নের যে
কর্মসূচি ছিল, তা আরও জোরদার করতে হবে, সন্দেহ নেই। কিন্তু তারপরও
বিশেষজ্ঞরা দেখেছেন, শিশুর জন্মের প্রথম ১ ঘণ্টা এবং প্রথম ২৮ দিনই সবচেয়ে
বড় চ্যালেঞ্জ। তাই নবজাতকের প্রতি আলাদাভাবে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
সে জন্যই আমরা বলছি, প্রতিটি নবজাতককে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ইউনিসেফ একটি
উদ্যোগ নিয়েছে, ‘এভরি চাইল্ড অ্যালাইভ ক্যাম্পেইন’। বাংলাদেশসহ ১০টি দেশে
এই কর্মসূচি কার্যকর করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আমাদের অফিসে অনুষ্ঠিত একটি
গোলটেবিল বৈঠকে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক
জানিয়েছেন, দেশের ৪৪টি জেলায় নবজাতকদের মৃত্যু রোধে স্পেশাল কেয়ার নিউ বর্ন
ইউনিট (স্ক্যানু) চালু করা হয়েছে। এ বছরের জুন মাসের মধ্যেই বাকি ২০টি
জেলায় এই ব্যবস্থা চালু করা হবে। এরপর উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত এই সেবা নিয়ে
যাওয়ার উদ্যোগ চলছে। স্ক্যানু একটি বিশেষ ব্যবস্থা। এখানে নবজাতকের জীবনের
ওপর যেকোনো ঝুঁকি রোধের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সব সময় রাখা হয়। আমাদের দেশে
এখনো অর্ধেকের বেশি শিশুর জন্ম হয় বাসায়। সেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও দক্ষ
মিডওয়াইফ বা ধাত্রী প্রায়ই থাকেন না। ফলে ৫৫ শতাংশ মাতৃমৃত্যু ও ৭৩ শতাংশ
শিশুমৃত্যু ঘটছে বাসায় সন্তান প্রসবের সময়।এখন অনেক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে আলাদা প্রসবকক্ষ তৈরি হচ্ছে। সেখানে ২৪ ঘণ্টা থেকে
সাত দিন পর্যন্ত সেবা অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। দেশে যাতায়াতের
ব্যবস্থাও অনেক উন্নত হচ্ছে। তাই শিশুর জন্মের আগে-পরে অন্তত আটবার শিশু
বিশেষজ্ঞদের কাছে যাওয়া, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো ও পরামর্শ নেওয়া
এবং তা মেনে চলার সুযোগ আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি।এখন দুটি দায়িত্ব
আমাদের। প্রথমত, বাল্যবিবাহ বন্ধ করা। ‘১৮ বছরের আগে বিয়ে নয় এবং ২০ বছরের
আগে সন্তান নয়’-এটাই এখন আমাদের সমাজের প্রধান স্লোগান হতে হবে। কারণ, এর
চেয়ে কম বয়সে বিয়ে ও সন্তান ধারণ করলে সেই শিশুর জীবনের ঝুঁকি অনেক বেড়ে
যায়।
যেমন অনেক সময় কম ওজনের শিশু জন্ম নেয়। ৩৭ সপ্তাহ বা এরও আগে শিশু
জন্ম নিলে তার নানা রকম সংকট দেখা দেয়। শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে। শ্বাসকষ্ট হয়।
সেই শিশুকে বাঁচিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়ে। ৩২ সপ্তাহের আগে জন্ম নেওয়া
শিশুরা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হয়ে যেতে পারে। এসবই কম বয়সে বিয়ে ও সন্তান ধারণের
অভিশাপ। তারপরও অপরিণত শিশুদের জন্য বিশেষ যত্ন নেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
তাদের জীবন রক্ষা করা যায়। এমনকি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হওয়ার আশঙ্কাও দূর করা
সম্ভব। দ্বিতীয়ত, বাসায় নয়, কাছাকাছি কমিউনিটি ক্লিনিক বা উপজেলা
স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে সন্তান প্রসবের ব্যবস্থা করা দরকার। যদি তা সম্ভব
না হয়, তাহলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ ধাত্রী বা মিডওয়াইফের সাহায্যে প্রসবের
ব্যবস্থা করতে হবে। তা ছাড়া আছে প্যারামেডিক। এসএসসি পাসের পর তাঁরা দুই
বছরের স্বাস্থ্যসেবা প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করেন। এরপর হাসপাতালে তিন
মাসের ইন্টার্নশিপ করেন। তাঁদের মিডওয়াইফারি বা ধাত্রীবিদ্যা পড়ারও
ব্যবস্থা রয়েছে। কিছু বিশেষ উদ্যোগ নবজাতকের মৃত্যুহার কমিয়ে আনতে সাহায্য
করে। যেমন শিশুর জন্মের প্রথম ঘণ্টায় মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। অনেক
সময় শিশু দুধ পায় না। কিন্তু এতে দমে গেলে চলবে না। শিশু খাওয়ার চেষ্টা
করতে থাকলে অবশ্যই মায়ের দুধ পাবে। যদি শিশুর শরীরের তাপমাত্রা কমে যায়,
তাহলে ক্যাঙারু মাদার কেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। শিশুর জন্মের পর তার শরীর
শুকনো ও পরিষ্কার, জীবাণুমুক্ত কাপড় দিয়ে শুধু মুছে দিতে হবে। অন্তত তিন
দিনের আগে শিশুকে গোসল করানোর দরকার নেই। মায়ের হাত সব সময় সাবান দিয়ে ধুয়ে
পরিষ্কার রাখা উচিত। এসব ব্যবস্থা শিশুর জীবন রক্ষায় বড় ভূমিকা রাখে।
নবজাতকেরা বাঁচলে শিশুমৃত্যুর হার অনেক কমবে। দেশ বাঁচবে।
আব্দুল কাইয়ুম প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
quayum@gmail. com
আব্দুল কাইয়ুম প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
quayum@gmail. com
No comments