ব্যাংক খাতে আতঙ্ক, উদ্বেগ ও বিভ্রান্তি
ব্যাংক
খাতে এখন আতঙ্ক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরই এ কথা বললেন। আমানত তুলে
নেওয়ার ঘটনা বাড়ছে। আতঙ্কের কারণে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন ব্যাংকাররা। আর এতে
বিনিয়োগকারীরা হয়ে পড়েছেন বিভ্রান্ত। কারণ, সঠিক তথ্য কেউই দিচ্ছে না।
ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, নতুন কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকে টাকা রাখার জন্য
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিরাপদ বোধ করছে না।
মূলত রাজনৈতিক বিবেচনায়
লাইসেন্স পাওয়া নতুন ব্যাংকগুলোর প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না সরকারি
প্রতিষ্ঠানগুলোই। পুরোনো বেসরকারি ব্যাংক থেকেও কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান
টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এতে তারল্যসংকটে পড়েছে ব্যাংকগুলো। তারা নতুন ঋণ
দেওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছে, বাড়ছে সুদহার। যার প্রভাব পড়েছে পুরো অর্থনীতিতে। এ
ঘটনায় ব্যাংকাররা যেমন উদ্বিগ্ন, একই উদ্বেগ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর
ফজলে কবিরেরও। পরিস্থিতি সামাল দিতে গতকাল শনিবার গভর্নর প্রকাশ্যে
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। রাজধানীর একটি
হোটেলে গতকাল অগ্রণী ব্যাংকের বার্ষিক সম্মেলনে গভর্নর বলেন, ‘একটি
বেসরকারি ব্যাংক খারাপ অবস্থায় পড়ে গেছে। এখন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো
বেসরকারি ব্যাংক থেকে আমানত সরিয়ে নিতে চাইছে। একটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এই
আতঙ্ক আগে শেয়ারবাজারে ছিল, এখন ব্যাংকে চলে আসছে।’ সম্মেলনের প্রধান অতিথি
অর্থমন্ত্রীর উদ্দেশে গভর্নর বলেন, ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অহেতুক এটা
করছে। তারা যাতে বেসরকারি ব্যাংক থেকে টাকা না সরিয়ে ফেলে। আপনি নিশ্চয়ই
বিষয়টা দেখবেন।’ জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন
আহমেদ এ নিয়ে গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটা ব্যাংকের ঘটনার কারণে সরকারি
প্রতিষ্ঠান কেন টাকা তুলে ফেলবে? বিশ্বের সব দেশের ব্যাংকেই দুর্ঘটনা ঘটে।
এখন সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন, যাতে কোনো প্রতিষ্ঠান হঠাৎ
করে টাকা তুলে না ফেলে। আর আমানতের নিরাপত্তা যে আছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা
গ্রাহকদের আশ্বস্ত করতে পারে। দোষীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে,
তা–ও জানাতে পারে।’
আতঙ্ক: শুরুটা হয়েছিল বেসরকারি খাতের ফারমার্স ব্যাংক
কেলেঙ্কারির ঘটনা থেকে। এই ব্যাংকে রাখা টাকা ফেরত পাচ্ছেন না আমানতকারীরা। জলবায়ু তহবিল ৫০৮ কোটি টাকা ফেরত না পাওয়ার কথা আলোচনা হয় জাতীয় সংসদেও। এরপরই বেসরকারি ব্যাংক থেকে তহবিল সরিয়ে ফেলতে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি
প্রতিষ্ঠান। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি গ্যাস, বিদ্যুৎ ও টেলিযোগাযোগ
খাতের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তিনটি ব্যাংক থেকে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা তুলে
সরকারি ব্যাংকে জমা করেছে। হঠাৎ করে বড় অঙ্কের টাকা তুলে ফেলায় কিছুটা
বেকায়দায় পড়েছে ব্যাংক তিনটি। ব্যাংকাররা জানান, বেসরকারি আরও কয়েকটি
ব্যাংক এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। বিশেষ করে নতুন ব্যাংকগুলো। অগ্রণী
ব্যাংকের ওই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির আরও বলেন,
আমদানি যে হারে বাড়ছে, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় সে হারে আসছে না। এতে বৈদেশিক
মুদ্রার ওপর চাপ বেড়েছে। দাম বেড়ে গেছে। চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক
প্রায় ১৫০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। এর মাধ্যমে বাজার থেকে ১০ হাজার কোটি
টাকার বেশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে এসেছে। তবে তিনি তারল্যসংকটের কথা নাকচ
করে দেন। তবে ব্যাংকাররা বলছেন, ঋণপ্রবাহ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন
নির্দেশনার কারণেও অনেক ব্যাংক নতুন ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। অনেকে
নির্ধারিত ঋণসীমার মধ্যে আসতে দেওয়া ঋণও ফেরত আনছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের
নির্দেশনা পালন করতে গিয়ে সবাই আমানত সংগ্রহে জোর দিয়েছে। বাজারে নতুন
আমানত কম, তাই এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে বেশি সুদে স্থানান্তর হচ্ছে। এ
কারণে আমানত ও ঋণ উভয়ের সুদহার বাড়ছে।
উদ্বেগ: সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা উদ্বিগ্ন। কোনো অজানা কারণে সরকারি প্রতিষ্ঠান টাকা তুলে নিচ্ছে। দেশের ব্যবসার ৭০ শতাংশই করছে এখন বেসরকারি ব্যাংকগুলো। অথচ এই ব্যাংকগুলো সরকারি আমানত পাচ্ছে মাত্র ২৫ শতাংশ। আমরা সরকারি আমানত অর্ধেক বেসরকারি ব্যাংকে রাখার দাবি জানাই।’ অগ্রণী ব্যাংকের সম্মেলনে অবশ্য গভর্নর বলেন, আমানতের সুদহার বাড়তে শুরু করেছে, এটা আমানতকারীদের জন্য ভালো। তবে ঋণের সুদহার বাড়াটা ভালো না। এটা স্বল্প সময়েই ঠিক হয়ে যাবে। তিনি বলেন, আগ্রাসী ঋণ বিতরণ বন্ধ, ঋণের মান ভালো ও ঋণশৃঙ্খলা নিশ্চিতে ঋণসীমা কমানো হয়েছে। তারল্যসংকটের কারণে গত নভেম্বর থেকে আমানতের সুদহার বাড়াতে শুরু করে ব্যাংক। এখন ৯ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করছে কয়েকটি ব্যাংক। ফলে বেড়ে গেছে ঋণের সুদহার। এ ছাড়া ডলার কিনতেও অনেক টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে যাচ্ছে। ২০১৭ সালে ব্যাংকগুলোতে ৮৫ হাজার ৯১১ কোটি টাকার আমানত বাড়লেও ঋণ যায় ১ লাখ ৩১ হাজার ৩২২ কোটি টাকা।
বিভ্রান্তি: ব্যাংকগুলোতে হঠাৎ করেই ঋণ দেওয়ার মতো অর্থের টান পড়েছে। বেশ কিছু ব্যাংক নতুন করে ব্যবসায়ীদের ঋণ দিচ্ছে না। প্রায় সব ব্যাংকই বাড়িয়েছে সুদের হার। এমনকি কিছু ব্যাংকের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের দেওয়া ঋণের টাকা ফিরিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, মাস দুয়েক আগেও ব্যাংকগুলো বড় গ্রাহকদের ৮ থেকে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিত, যা এখন ২ থেকে ৩ শতাংশ বেশি দিতে হচ্ছে। একইভাবে বেড়ে গেছে ভোক্তা ও গৃহঋণের সুদের হারও। ব্যাংকাররা হঠাৎ এই সংকটের পেছনে কয়েকটি কারণ দেখছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো ব্যাংকের আমানতের বিপরীতে ঋণ বিতরণের সীমা কমিয়ে দেওয়া। এ ছাড়া সুদের হার কম হওয়ায় ব্যাংকে আমানত কমে যাওয়া, ডলার বিক্রি করে ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে নেওয়া এবং বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংকের সাম্প্রতিক কেলেঙ্কারিও পরোক্ষভাবে এ সংকটে ঘি ঢেলেছে। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) একটি প্রতিনিধিদল গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে একটি বৈঠক করে। এতে ব্যাংকের তারল্যসংকট এবং ঋণের সুদের হার বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিও আলোচনায় আসে। জানতে চাইলে সংগঠনটির সভাপতি আবুল কাসেম খান গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘গভর্নর আমাদের আশ্বস্ত করে বলেছেন যে ব্যাংকে তারল্যসংকট সাময়িক। এটা কিছু ব্যাংকের জন্য হচ্ছে, পুরো খাতের চিত্র নয়। তবে আমরা যখন ব্যাংকারদের সঙ্গে কথা বলছি, তখন ঠিকই তাঁরা তারল্যসংকটের কথা বলছেন।’ ঢাকা চেম্বারের সভাপতি বলেন, ‘আমরা আসলে বিভ্রান্ত। সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংক মালিকদের সংগঠনের উচিত হবে প্রকৃত পরিস্থিতি জানিয়ে বা তুলে ধরে বিবৃতি দেওয়া।’ তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারির প্রভাব পড়ছে ব্যাংক খাতে। আর এসব কেলেঙ্কারির শাস্তি হয় না বলেই সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে আতঙ্ক, উদ্বেগ ও বিভ্রান্তি।
উদ্বেগ: সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা উদ্বিগ্ন। কোনো অজানা কারণে সরকারি প্রতিষ্ঠান টাকা তুলে নিচ্ছে। দেশের ব্যবসার ৭০ শতাংশই করছে এখন বেসরকারি ব্যাংকগুলো। অথচ এই ব্যাংকগুলো সরকারি আমানত পাচ্ছে মাত্র ২৫ শতাংশ। আমরা সরকারি আমানত অর্ধেক বেসরকারি ব্যাংকে রাখার দাবি জানাই।’ অগ্রণী ব্যাংকের সম্মেলনে অবশ্য গভর্নর বলেন, আমানতের সুদহার বাড়তে শুরু করেছে, এটা আমানতকারীদের জন্য ভালো। তবে ঋণের সুদহার বাড়াটা ভালো না। এটা স্বল্প সময়েই ঠিক হয়ে যাবে। তিনি বলেন, আগ্রাসী ঋণ বিতরণ বন্ধ, ঋণের মান ভালো ও ঋণশৃঙ্খলা নিশ্চিতে ঋণসীমা কমানো হয়েছে। তারল্যসংকটের কারণে গত নভেম্বর থেকে আমানতের সুদহার বাড়াতে শুরু করে ব্যাংক। এখন ৯ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করছে কয়েকটি ব্যাংক। ফলে বেড়ে গেছে ঋণের সুদহার। এ ছাড়া ডলার কিনতেও অনেক টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে যাচ্ছে। ২০১৭ সালে ব্যাংকগুলোতে ৮৫ হাজার ৯১১ কোটি টাকার আমানত বাড়লেও ঋণ যায় ১ লাখ ৩১ হাজার ৩২২ কোটি টাকা।
বিভ্রান্তি: ব্যাংকগুলোতে হঠাৎ করেই ঋণ দেওয়ার মতো অর্থের টান পড়েছে। বেশ কিছু ব্যাংক নতুন করে ব্যবসায়ীদের ঋণ দিচ্ছে না। প্রায় সব ব্যাংকই বাড়িয়েছে সুদের হার। এমনকি কিছু ব্যাংকের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের দেওয়া ঋণের টাকা ফিরিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, মাস দুয়েক আগেও ব্যাংকগুলো বড় গ্রাহকদের ৮ থেকে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিত, যা এখন ২ থেকে ৩ শতাংশ বেশি দিতে হচ্ছে। একইভাবে বেড়ে গেছে ভোক্তা ও গৃহঋণের সুদের হারও। ব্যাংকাররা হঠাৎ এই সংকটের পেছনে কয়েকটি কারণ দেখছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো ব্যাংকের আমানতের বিপরীতে ঋণ বিতরণের সীমা কমিয়ে দেওয়া। এ ছাড়া সুদের হার কম হওয়ায় ব্যাংকে আমানত কমে যাওয়া, ডলার বিক্রি করে ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে নেওয়া এবং বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংকের সাম্প্রতিক কেলেঙ্কারিও পরোক্ষভাবে এ সংকটে ঘি ঢেলেছে। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) একটি প্রতিনিধিদল গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে একটি বৈঠক করে। এতে ব্যাংকের তারল্যসংকট এবং ঋণের সুদের হার বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিও আলোচনায় আসে। জানতে চাইলে সংগঠনটির সভাপতি আবুল কাসেম খান গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘গভর্নর আমাদের আশ্বস্ত করে বলেছেন যে ব্যাংকে তারল্যসংকট সাময়িক। এটা কিছু ব্যাংকের জন্য হচ্ছে, পুরো খাতের চিত্র নয়। তবে আমরা যখন ব্যাংকারদের সঙ্গে কথা বলছি, তখন ঠিকই তাঁরা তারল্যসংকটের কথা বলছেন।’ ঢাকা চেম্বারের সভাপতি বলেন, ‘আমরা আসলে বিভ্রান্ত। সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংক মালিকদের সংগঠনের উচিত হবে প্রকৃত পরিস্থিতি জানিয়ে বা তুলে ধরে বিবৃতি দেওয়া।’ তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারির প্রভাব পড়ছে ব্যাংক খাতে। আর এসব কেলেঙ্কারির শাস্তি হয় না বলেই সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে আতঙ্ক, উদ্বেগ ও বিভ্রান্তি।
No comments