সন্দেহের বশে গণ-আটক
খালেদা
জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট-সংক্রান্ত মামলার রায় ঘোষণার এক
সপ্তাহেরও বেশি আগে থেকে ঢাকাসহ সারা দেশে যে পুলিশি তৎপরতা শুরু হয়েছিল,
তাতে শুধু বিএনপি-জামায়াত ও তাদের অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরাই আটক হননি,
অনেক নিরীহ সাধারণ মানুষও পুলিশের অমানবিক দুর্ব্যবহার ও অন্যায় হেনস্তার
শিকার হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দৃশ্যত ভুলে গিয়েছিল যে
রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ সব নাগরিকের স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার সংবিধানসম্মত
অধিকার অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। ‘সন্দেহভাজন’ হিসেবে নারী-পুরুষনির্বিশেষে
মানুষকে গণহারে ধরে নিয়ে গিয়ে থানায় আটকে রাখায় দায়িত্বশীলতার প্রকাশ
ঘটেনি, ব্যক্তি-নাগরিকের মানবিক মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধা তো নয়ই। ৩০
জানুয়ারি থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণার দিন পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশজুড়ে প্রায়
তিন হাজার মানুষকে আটক করা হয়েছে। শুধু রায় ঘোষণার দিনেই আটক করা হয়েছে ২৮৯
জনকে, তাঁদের মধ্যে ৯৯ জনকে ঢাকায়। এটা পুলিশের দেওয়া হিসাব, িবএনপি দাবি
করেছে, তাদের সাড়ে তিন হাজার নেতা–কর্মীকে আটক করা হয়েছে। পুলিশের তরফ থেকে
দাবি করা হয়েছে, আটক ব্যক্তিরা বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সহযোগী
সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মী। কিন্তু এই দাবি সঠিক নয়, আটক ব্যক্তিদের মধ্যে
অনেক নিরীহ সাধারণ মানুষ আছেন, যাঁদের কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা
নেই। পুলিশের এই পাইকারি আটকাভিযান সম্পর্কে ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষের
প্রতিক্রিয়া এ রকম, ‘মন চাইল, ধরে নিয়ে এল।’ শনিবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত
একটি প্রতিবেদন থেকে পুলিশের আটকাভিযানের প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া
যায়। খালেদা জিয়ার রায়কে কেন্দ্র করে ভাঙচুর হতে পারে—এই আশঙ্কায় ৬৭ বছর
বয়সী এক নারী তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ি না নিয়ে গাড়ির চালককে সঙ্গে নিয়ে একটি
সিএনজি অটোরিকশায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিলেন।
তিনি ও তাঁর চালক
অটোরিকশা থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ দুজনকেই আটক করে থানায় নিয়ে গিয়ে
আটকে রাখে। প্রথম আলোর প্রতিবেদক শুক্রবার সকালে ঢাকার শাহবাগ থানার সামনে
প্রায় ৫০ জন মানুষের জটলা দেখতে পান, যাঁদের স্বজনদের ওই বৃদ্ধ নারীর মতোই
থানায় আটকে রাখা হয়েছে। আটক স্বজনদের জন্য থানার সামনে অপেক্ষমাণ ওই
মানুষদের সঙ্গে কথা বলে প্রথম আলোর প্রতিবেদক যেসব অভিযোগ পেয়েছেন, সেগুলো এ
রকম: একজন বুটিক ব্যবসায়ী মোটরসাইকেলে করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল
বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছেন অসুস্থ স্বজনকে দেখতে। কিন্তু পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে
থানায় আটকে রেখেছে। ১৭-১৮ বছরের এক তরুণ শাহবাগের একটি দোকানে কাজ করেন,
তিনি সকালে কাজে যাওয়ার পথে পুলিশ তাঁকে আটক করে থানায় নিয়ে গেছে। এভাবে ৬১
জন পুরুষ ও ১১ জন নারীকে বৃহস্পতিবারেই আটক করা হয়েছে—এটা স্বজনদের কাছ
থেকে জানা গেছে। আইনের শাসনের ভিত্তিতে পরিচালিত কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে
আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে পুলিশ সাধারণ মানুষকে এভাবে হেনস্তা করতে পারে না।
সুনির্দিষ্ট ও নির্ভরযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে নাশকতা বা অন্য কোনো অপরাধের
প্রস্তুতিকালে কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করার অধিকার পুলিশের আছে; কিন্তু
মনগড়া সন্দেহের বশে পাইকারি হারে আটক করার অধিকার নেই। আমরা আশা করব, পুলিশ
বাহিনী এ ধরনের গণ-আটক ও গণ-হেনস্তার প্রবণতা ত্যাগ করবে; নাগরিক অধিকারের
প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে যথাযথ আইনি পন্থায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সচেষ্ট হবে। এ
বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে বোধোদয় প্রয়োজন।
No comments