দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়ার সাজার পর আওয়ামী লীগ নেতাদের উল্লাস by বদরুদ্দীন উমর
জিয়া
অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সাজার পর ওপর
থেকে নিচে পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতানেত্রীরা ‘holier-than-thou’ অর্থাৎ
‘তোমার থেকে অনেক বেশি পূতপবিত্র’ ভাব ধারণ করে ইচ্ছেমতো বক্তব্য দিয়ে
যাচ্ছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যার ভাষা খুব অশ্লীল। ১৯৭২ সাল থেকেই লুটতরাজ,
চুরি, দুর্নীতি করে যে নব্য ধনিক ও শাসক শ্রেণী বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে,
অশ্লীলতা তাদের জিহ্বার ভূষণ হবে, এর মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। খালেদা
জিয়া দোষী কী নির্দোষ, এ প্রশ্ন বাদ দিয়ে প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার,
বাংলাদেশে যেখানে শাসন কর্তৃত্বের প্রতিটি ক্ষেত্রে
চোর-ঘুষখোর-দুর্নীতিবাজদের রাজত্ব ও দোর্দণ্ড প্রতাপ, সেখানে খালেদা জিয়ার
দুর্নীতি নিয়ে আওয়ামী লীগ মহলে যে হৈ-হুল্লা দেখা যাচ্ছে এটা হাস্যকর। এ
অবস্থা দেখে দেশের লোকও সর্বত্র হাসাহাসি করছে। বাংলাদেশে এখন দুর্নীতি
কোনো ব্যতিক্রমী ব্যাপার নয়। প্রতিদিনের সংবাদপত্রে বড় বড় চুরি, দুর্নীতি,
লুটতরাজের খবর এখন পাওয়া যায়। সরকারি ব্যাংক লুটপাট, নানা ধরনের সরকারি
প্রকল্পে চুরি-দুর্নীতি, প্রশ্নপত্র ফাঁস, আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগের
সদস্যদের নানা অপরাধমূলক কাজের রিপোর্ট এসব খবরে থাকে। মাত্র কয়েক দিন আগে ৬
ফেব্রুয়ারি ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় ছাত্রলীগ নেতাদের মাদক ব্যবসার ওপর একটা
দীর্ঘ রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দুর্নীতির
আখড়া হিসেবে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড প্রবল প্রতাপে ও বেপরোয়াভাবে চলে আসছে।
চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও তার টাকা নিয়ে ছাত্রলীগের নেতাদের পারস্পরিক
সংঘর্ষের খবরও কোনো নতুন ব্যাপার নয়। এখন ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতারা
চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির সঙ্গে মাদক ব্যবসাতেও বেশ বড় আকারে নিযুক্ত হয়েছে।
এক্ষেত্রে ‘প্রথম আলো’র উপরোক্ত রিপোর্টটি উল্লেখযোগ্য উপরোক্ত রিপোর্ট
থেকে কিছুটা উদ্ধৃত করা দরকার। এতে বলা হয়েছে, ‘রাজধানীর পল্টনের
নাইটিঙ্গেল মোড়ে গত ১৪ ডিসেম্বর পুলিশ ইয়াবাসহ গ্রেফতার করে বাংলাদেশ
টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি নূরে মোজাচ্ছেম ওরফে
রঙ্গনসহ তিনজনকে। মামলার এজাহারে বলা হয়, এই তিনজন দীর্ঘদিন ধরে পল্টনসহ
ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ইয়াবা বিক্রি করে আসছেন। শুধু নূরে মোজাচ্ছেম
নন, ঢাকায় বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক মাদক বেচাকেনায় জড়িত রয়েছেন
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন শাখার নেতাদের অনেকেই। বিশ্ববিদ্যালয় ও
কলেজের আবাসিক হলগুলোকে তারা ব্যবহার করছেন মাদক কেনাবেচার নিরাপদ স্থান
হিসেবে। সম্প্রতি ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক মাদক
ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এই তালিকা ধরে
অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, মাদক ব্যবসায় জড়িত ছাত্রলীগের নেতাদের মধ্যে আটজন
ছাত্রলীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা, দু’জন সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা,
তিনজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক নেতা, পাঁচজন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
শাখার কর্মী এবং দু’জন ধানমণ্ডি থানা ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক শীর্ষস্থানীয়
নেতা।’ এ বিষয়ে ছাত্রলীগের একজন কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক নাম প্রকাশ না
করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘‘সহসভাপতি আনোয়ার হোসেন মাদক ব্যবসার সঙ্গে
যুক্ত, এটা অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেট’ বিষয়। তিনি যখন এসএম হল শাখা ছাত্রলীগের
সভাপতি ছিলেন, তখন থেকেই মাদক বেচাকেনায় যুক্ত হন।’’ এখানেই শেষ নয়। একই
দিনে ‘প্রথম আলো’য় ‘ঢাকার ছয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদক ব্যবসায় ২৪ জন’ শীর্ষক
অন্য এক রিপোর্টে বলা হয়, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও রাজধানীর আরও ছয়টি
সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী মাদক ব্যবসায়
জড়িত থাকার তথ্য এসেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায়। প্রতিষ্ঠানগুলো হল
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, ইন্সটিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং
অ্যান্ড টেকনোলজি, ধানমণ্ডির ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, ইউনাইটেড
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি। সম্প্রতি ঢাকাসহ
বিভিন্ন জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক মাদক ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা
প্রস্তুত করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে এই ছয়টি
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ২৪ জনের নাম রয়েছে।
তাদের মধ্যে ছাত্রলীগের দুই নেতা, পাঁচ কর্মী ও যুবলীগের দুই নেতার নাম
রয়েছে। পুলিশের একজন উপপরিদর্শকের নামও আছে এই তালিকায়।’ তাহলে এই রিপোর্টে
দেখা যাচ্ছে যে, ছাত্রলীগের শুধু নেতা নয়, কর্মীরা পর্যন্ত মাদক ব্যবসার
মতো এক বিপজ্জনক অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে,
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাধ্য হয়ে এই রিপোর্ট তৈরি করলেও সরকারি দলের এই
অপরাধীদের দু’-চারজনকে গ্রেফতার ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ পুলিশ ও
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় তাদের নাম
অন্তর্ভুক্ত হলেও তাদের শাস্তির কোনো ব্যাপার নেই।
সরকারের ছত্রছায়ায় তারা
নিরাপদে মাদক ব্যবসার মতো অপরাধমূলক কাজ বেপরোয়াভাবে করে চলেছে। এসব
রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের
শুধু নেতা নয়, কর্মীরা পর্যন্ত দুর্নীতি ও মাদক ব্যবসার মতো অপরাধমূলক
কাজের সঙ্গে জড়িত। এসব সংগঠনের মধ্যে পচন না ধরলে তাদের নেতা-কর্মীদের এই
দুর্নীতি তাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। কিন্তু এখানে যে বিষয়টি গুরুত্বের
সঙ্গে উল্লেখ করা দরকার তা হল, দলের উচ্চপর্যায়ে পচন না ধরলে এবং তারা
নিজেরা দুর্নীতিতে ডুবে না থাকলে নিচের স্তরে এই দুর্নীতি কখনও সম্ভব নয়।
নেতৃত্বের দুর্নীতি দ্বারাই নিচের পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা দুর্নীতিতে
‘উদ্বুদ্ধ’ হয়েছে। তারা এটা উপলব্ধি করেছে যে, উচ্চপর্যায়ে যেভাবে
চুরি-দুর্নীতি চলছে তাতে তারা দুর্নীতি করলে তাদেরকে ধরার কোনো সম্ভাবনা
সরকারের নেই। এ অবস্থায় তারা বেশ সহজেই মাদক ব্যবসাসহ নানা ধরনের দুর্নীতি ও
অপরাধ অবাধে চালিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছে। কতভাবে উচ্চপর্যায়ে এই দুর্নীতি
হচ্ছে তার হিসাব নেই। ব্যাংক লুটপাট, প্রশ্ন ফাঁস, নদী-নালা-বিল দখল, নানা
ধরনের প্রকল্পে ঘুষ ইত্যাদি সব ধরনের চুরি-দুর্নীতিই চলছে। শুধু তাই নয়,
চুরি-দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টিও সরকার তাদের দলীয় লোকদের জন্য করছে। এর একটি
রিপোর্ট বিগত ৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রকাশিত হয়েছে সমকাল পত্রিকায়। ‘আসছে
নির্বাচনী বরাদ্দ’ শীর্ষক এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘‘দেশের প্রতিটি সংসদীয়
এলাকায় উন্নয়ন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে নির্মাণ করা হচ্ছে ১০টি বেসরকারি
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রতিটিতে একটি করে মোট তিন হাজার অত্যাধুনিক একাডেমিক
ভবন। আর মাত্র ১০ মাস পরে অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচনের আগেই সাতটি
ক্যাটাগরিতে এসব ভবন নির্মাণ করা হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী ‘শিক্ষা
প্রকৌশল অধিদফতর’ (ইইডি) চলতি মাসেই এসব ভবন নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করতে
চলেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সংশ্লিষ্ট এলাকার সংসদ সদস্যদের
চাহিদা ও পছন্দক্রমের ভিত্তিতে প্রতিটি আসনে ১০টি করে মোট তিন হাজার
বিদ্যালয় এ প্রকল্পের জন্য নির্বাচন করা হবে। এটিকে বর্তমান এমপিদের জন্য
‘নির্বাচনী বরাদ্দ’ হিসেবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।’’ এ ধরনের নির্বাচনী
বরাদ্দ যে বিদ্যমান সংসদ সদস্যদের নির্বাচনের সময় নিজেদের প্রচার সুবিধার
ব্যবস্থা, এ নিয়ে কোনো বিতর্ক হতে পারে না। শুধু তাই নয়, এই কোটি কোটি টাকা
বরাদ্দের একটা বড় অংশ যে দুর্নীতির মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের পকেটে যাবে,
এতেও কোনো সন্দেহ নেই। এই দুর্নীতি যাতে সরকারের পক্ষে সম্ভব না হয় এজন্য
ভারতের আগামী সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে এ ধরনের বরাদ্দের বিরুদ্ধে
বিভিন্ন পার্টি ও মহল সোচ্চার হয়েছে। কিন্তু এখানে এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে
কোনো প্রতিবাদ নেই। সরকারের দমন-পীড়নের মুখে এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ
খোলার কোনো ব্যাপার নেই। কাজেই সরকার বেশ প্রকাশ্যেই নিজেদের দলীয় লোকদের
জন্য এই প্রচার সুবিধা ও দুর্নীতির ব্যবস্থা করছে। বাংলাদেশে সরকারের লোকরা
যে কতভাবে দুর্নীতি করছে তার তালিকা দেয়া এখানে সম্ভব নয়। তার প্রয়োজনও
নেই। কারণ এসব দুর্নীতি এত প্রকাশ্যে ও বেপরোয়াভাবে হচ্ছে যে এসব এখন
সাধারণভাবে জনগণের জানা। এই পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি
মামলা ও মামলায় তার সাজা নিয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা থেকে পাতি
নেতারা যেভাবে ‘holier-than-thou’ ভাব ধারণ করে লম্ফঝম্ফ করছেন, একে অশ্লীল
ও হাস্যকর ছাড়া আর কী বলা যায়?
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
No comments