অলিম্পিক কূটনীতি ও সম্ভাবনা by মনজুরুল হক
খেলাধুলাকে
রাজনৈতিক বিতর্কের বাইরে রাখার প্রত্যয় নিয়ে বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে
নতুন করে অলিম্পিক ক্রীড়া আন্দোলনের যাত্রা শুরু হলেও অলিম্পিক গেমসের জনক
পিয়েরে দা কুবের্তিনের সেই স্বপ্ন শুরু থেকেই যেন অধরা রয়ে গেছে। প্রাচীন
গ্রিসে আদি অলিম্পিক ছিল সমাজের যাঁরা নিয়ন্ত্রক তাঁদের বিনোদনের উদ্দেশ্যে
আয়োজিত নানা রকম প্রতিযোগিতা, যেখানে সরাসরি অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই ছিল
ক্রীতদাস। ফলে রাজনৈতিক বিভাজন সেখানে ছিল অলিম্পিকের একটি আবশ্যকীয়
উপাদান। তবে নব্য অলিম্পিক আন্দোলনের সূচনায় আয়োজকেরা শুরু থেকেই ঠিক করে
নিয়েছিলেন যে খেলাধুলাকে সম্পূর্ণভাবে রাজনীতির বাইরে তাঁরা রাখবেন। তবে
তাঁদের সেই স্বপ্ন যে স্বপ্নই থেকে গেছে, সে জন্য অবশ্য অলিম্পিকের
আয়োজকদের চেয়ে বরং সময়কে দোষারোপ করা অনেক বেশি যুক্তিসংগত শোনাবে। বিংশ
শতাব্দীর সূচনালগ্নে নব্য অলিম্পিক আন্দোলনের যাত্রা শুরুর দিনগুলো থেকেই
বিশ্ব হয়ে পড়েছিল অনেক বেশি সংঘাতময়। এর প্রথম সর্বগ্রাসী পরিণতি লক্ষ করা
যায় ১৯১৪ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার মধ্য দিয়ে। সেই যুদ্ধকে মানব
ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী সংঘাতের একটি বলে গণ্য করা হয়। এরপর থেকে পুরো
বিংশ শতাব্দী সংঘাত এড়িয়ে যেতে পারেনি। ফলে শতাব্দীজুড়ে খেলাধুলাও হয়ে
উঠেছিল রাজনৈতিক সংঘাতেরই বিস্তৃত একটি অঙ্গন। আর এখন একবিংশ শতাব্দীতে এসে
বিশ্বরাজনীতির বড় খেলোয়াড়েরা নিজেরা সংঘাত এড়িয়ে গেলেও অন্যদের দিয়ে
কলকাঠি নাড়িয়ে সংঘাতকে নানাভাবে জিইয়ে রাখছেন। সে রকম অবস্থায় খেলাধুলার
জগৎকেও এর বাইরে রাখা যে সম্ভব হচ্ছে না, ডোপিং কেলেঙ্কারি নিয়ে চলা নতুন
তেলেসমাতি মনে হয় সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে তারপরও নানাভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে
অলিম্পিক আন্দোলনকে অন্তত সংঘাতময় বিশ্বের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে শান্তির
পরোক্ষ বার্তা এর মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে দেওয়ার। গত শুক্রবার ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে
দক্ষিণ কোরিয়ার পিয়ংচ্যাংয়ে শুরু হওয়া শীতকালীন অলিম্পিক সেদিক থেকে খুবই
তাৎপর্যপূর্ণ। এ কারণে যে কোরীয় উপদ্বীপ এখন হয়ে উঠেছে সংঘাতের এক সম্ভাব্য
রণক্ষেত্র, যে সংঘাত কিনা বিশ্বের অস্তিত্বকেও হুমকির মুখে ঠেলে দিতে
পারে। কোরীয় উপদ্বীপে নতুন করে সংঘাতের সূচনা হলে সবচেয়ে মারাত্মক হুমকির
মুখে যাদের পড়তে হবে তারা নিশ্চয় হচ্ছে সেই ভূখণ্ডে বসবাস করা লোকজন, উত্তর
ও দক্ষিণের বিভাজনে বিভক্ত হয়ে পড়লেও মূলত যারা হচ্ছে একই
জাতিগোষ্ঠীভুক্ত। ফলে সংঘাত এড়িয়ে চলার যৌক্তিকতা তাদের চেয়ে তো অন্য কারও
ভালো বোঝার কথা নয়। তবে দূরের খেলোয়াড়েরা এখানে যুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়ার খেলায়
অনেক দিন থেকেই তৎপর, যার ফলে উত্তর কোরিয়া হয়ে উঠেছে এমন বেপরোয়া এক
রাষ্ট্র। যুদ্ধের পরিণতি কী হতে পারে, তা নিয়ে দেশটির নেতৃত্ব মনে হয় এখন
আর খুব বেশি চিন্তিত নন। দেশটির এ রকম চিন্তামুক্ত হওয়ার একটি কারণ অবশ্যই
হচ্ছে পরমাণু শক্তির অধিকারী দেশ হয়ে ওঠা। উত্তর কোরিয়ার পরমাণু অস্ত্রের
অধিকারী রাষ্ট্র হয়ে ওঠার বিষয়টি নিয়ে এখন আর দ্বিমত পোষণের উপায় তেমন নেই।
দেশটি যে সেই মারণাস্ত্রের পারদর্শিতায় শাণ দিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি অস্ত্র
গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার বাহকের কার্যকারিতা উন্নয়নে নিয়োজিত, সেই বাস্তবতাও
বিশ্বের এখন আর অজানা নয়। অন্যদিকে উত্তর কোরিয়ার এ রকম আচরণকে যারা গর্হিত
পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে, তারা দেশটিকে বাগে আনার নানা রকম ফন্দি-ফিকিরের
সন্ধানে যে ব্যস্ত, সেই সত্যও আমরা প্রতিনিয়ত জানতে পারছি সংবাদমাধ্যমের
কল্যাণে। ফলে পুরো পূর্ব এশিয়ার পরিস্থিতি হয়ে উঠছে খুবই ঘোলাটে আর
অস্বচ্ছ। সে রকম অবস্থায় অলিম্পিকের প্রস্তুতি সামনে রেখে দক্ষিণ কোরিয়ার
নতুন প্রশাসন উত্তেজনা প্রশমনের উপায় হিসেবে অলিম্পিকে অংশগ্রহণ এবং সেই
সূত্রে দুই কোরিয়ার মধ্যে সমঝোতা বৃদ্ধির পথ খুঁজে পাওয়ার নতুন সম্ভাবনা
যাচাই করে দেখার প্রস্তাব উত্তর কোরিয়ার কাছে রেখেছিল। উত্তরের কাছ থেকে
আসা ইতিবাচক সাড়ার আলোকে দুই কোরিয়া এখন পিয়ংচ্যাং শীতকালীন অলিম্পিকে যৌথ
যেসব উদ্যোগ নিতে চলেছে, সেই তালিকায় আছে ঐক্যবদ্ধ কোরিয়ার পতাকার নিচে দুই
দেশের ক্রীড়াবিদদের অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কুচকাওয়াজে যোগ দেওয়া
এবং নারীদের আইস হকি প্রতিযোগিতার জন্য সম্মিলিত একটি দল ঠিক করে নেওয়া।
বিগত দিনগুলোর বাগাড়ম্বরপূর্ণ পদধ্বনির আলোকে সাম্প্রতিক এই উদ্যোগকে
রীতিমতো বৈপ্লবিক আখ্যায়িত করা যায়। তবে অলিম্পিক-পরবর্তী সময়ে এর প্রভাব
কতটা বিস্তৃত হতে পারবে, তা অবশ্য নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কেননা
শান্তির পথে অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করার খেলোয়াড়েরা বসে নেই এবং ইতিবাচক
যেকোনো অগ্রগতিকে নস্যাৎ করে দেওয়ার পাঁয়তারা এরা বরং এখন প্রকাশ্যেই করে
চলেছে।
ফলে অলিম্পিক কূটনীতি পিয়ংচ্যাং গেমস শুরু হতে যাওয়ার আগে দুই দিক
থেকেই অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে উঠছে এবং মুখ্য খেলোয়াড়েরা নেমে পড়েছেন নিজ নিজ
চাল দেওয়ার মধ্য দিয়ে যত বেশি সম্ভব ফায়দা লুটে নেওয়ার তৎপরতায়। কোরীয়
উপদ্বীপে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার যেকোনো অগ্রগতিকে নস্যাৎ করে দেওয়ার
খেলায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
অলিম্পিক কূটনীতির প্রতি কটাক্ষ করে মন্তব্য করতেও তিনি পিছপা হননি। দুই
কোরিয়া অলিম্পিককে কেন্দ্র করে আলোচনায় মিলিত হওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকার
মুখে গত সপ্তাহে হঠাৎ করেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট উত্তর কোরিয়ার দলত্যাগী
একটি গ্রুপকে নিয়ে হোয়াইট হাউসে উপস্থিত হয়ে ঘোষণা দেন যে ‘কমপক্ষে
অলিম্পিকের জন্য হলেও সংলাপের প্রস্তুতি যে নেওয়া হচ্ছে, সেটা ভালো ব্যাপার
হলেও সামনে কোনো পথ এখন আর খোলা দেখা না যাওয়ায় সেখানে কী হয় সেদিকে আমরা
নজর রাখব এবং আমার মনে হয় অলিম্পিক ভালোভাবে শেষ হলেও এরপরে কী হবে তা কারও
জানা নেই। আমার ধারণা, দ্রুতই আমরা তা জেনে নিতে পারব।’ সংকট নিরসনে
চালানো উদ্যোগের প্রতি অনুমোদন ট্রাম্পের এই বক্তব্যে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
তবে কি হামলার প্রস্তুতি যুক্তরাষ্ট্র নিচ্ছে? এই সন্দেহ একেবারে উড়িয়ে
দেওয়া যায় না। ব্যবসার হিসাবনিকাশে পারদর্শী ট্রাম্প নিশ্চয় হিসাব করে
দেখেছেন যে যুদ্ধ একবার বাধিয়ে দিতে পারলে মার্কিন অর্থনীতির জন্য তা সুফল
বয়ে আনবে। পূর্ব এশিয়ায় মার্কিন অস্ত্রের বড় দুই ক্রেতা হচ্ছে জাপান আর
দক্ষিণ কোরিয়া। যুদ্ধের দোহাই দিয়ে এদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া যাবে নানা রকম
অস্ত্রের নতুন ভান্ডার, যা কিনা অর্থনীতির জন্য খারাপ এই সময়ে সব দিক থেকেই
মঙ্গলজনক। অলিম্পিকের প্রস্তুতি সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথ
সামরিক মহড়া দক্ষিণ কোরিয়া স্থগিত রাখলেও অলিম্পিক শেষ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে
সঙ্গে মহড়া আবারও বর্ধিত কলেবরে শুরু করার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর
ইতিমধ্যে নানা দিক থেকে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। চাপ প্রয়োগকারীদের দলে
সর্বশেষ যোগ দিয়েছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। বছরের শুরুতে তিনি
ঘোষণা করেছিলেন যে পিয়ংচ্যাং অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দেবেন
না। যৌনদাসী সমস্যা সমাধান করা নিয়ে ২০১৫ সালে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার
মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি দক্ষিণ কোরিয়ার নতুন প্রশাসন পুনর্বিবেচনা
করে দেখার ইঙ্গিত দেওয়ায় জাপানের অসন্তুষ্টির প্রকাশ প্রধানমন্ত্রীর সেই
ঘোষণায় ছিল। তবে দুই কোরিয়া এখন অলিম্পিককে ঘিরে আলোচনায় মিলিত হতে থাকায়
জাপানের নেতা নড়েচড়ে বসে এখন ঘোষণা করেছেন যে অলিম্পিকের উদ্বোধনী
অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দেবেন এবং অলিম্পিক শেষ হয়ে যাওয়ার পর উত্তর কোরিয়ার
ওপর চাপ বৃদ্ধি করে নিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথ মহড়া বিলম্ব না করে
আবারও শুরু করার গুরুত্ব সম্পর্কে দক্ষিণ কোরিয়ার নেতার কাছে তিনি ব্যাখ্যা
দেবেন। ফলে ডোনাল্ড ট্রাম্প একাই কেবল যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে যাচ্ছেন না,
অন্যরাও তাঁর সঙ্গে যোগ দিতে শুরু করেছেন। ফলে ধারণা করা যায়, চলতি মাসের
শেষ দিকে পিয়ংচ্যাং গেমস শেষ হয়ে যাওয়ার পর অলিম্পিক কূটনীতির গালিচা
গুটিয়ে নেওয়ার জন্য আরও বেশি চাপের মুখে পড়বেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট
মুন জে-ইন। অলিম্পিক কূটনীতিতে সূচিত বিগত দিনগুলোর অগ্রগতি তাই আবারও মুখ
থুবড়ে পড়তে পারে।
মনজুরুল হক শিক্ষক ও সাংবাদিক
মনজুরুল হক শিক্ষক ও সাংবাদিক
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে
ReplyDelete