মিথ্যা মামলায় সত্য সাক্ষী by তৈমূর আলম খন্দকার

বাংলাদেশে যিনি বিচার বিভাগের প্রধান, সংবিধানের ৯৪(২) অনুচ্ছেদ মোতাবেক তিনিই বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি। তিনি একটি প্রতিষ্ঠান- তিনি সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনিক প্রধান তো বটেই, অধিকন্তু তিনি অ্যাপিলেট ডিভিশন থেকে তৃতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট পর্যন্ত সব বিষয়ে বিচারিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা রাখেন। বিচারের ক্ষেত্রে তিনিই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।  সত্য-মিথ্যা যাচাইপূর্বক সত্যকে সমর্থন করাটাই বিচার বিভাগের কাজ। পুলিশের কাজ কী? আইনকে সচল রাখা, অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং কেউ আইনের ব্যত্যয় ঘটালে তাকে দেশের প্রচলিত আইন মোতাবেক আদালতের সামনে বিচারের জন্য পেশ করা। তদন্তের কাজটিও পুলিশের ওপর বর্তায়। ফৌজদারি কার্যবিধিতে মামলা মোকদ্দমা তদন্ত করার জন্য ১৫৪ ধারা থেকে ১৭৬ ধারা পর্যন্ত ব্যাপক ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।
আইনের পরিভাষায় পুলিশ INQURY-INVESTIGATION যা-ই করুক না কেন, সত্যকে খুঁজে বের করাই তাদের প্রধান দায়িত্ব। মামলা মোকদ্দমা রাষ্ট্রের একটি UNPRODUCTIVE খাত, যা থেকে খরচের তুলনায় সরকারের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ অপ্রতুল। তথাপি এ খাতকে বাঁচিয়ে রাখতে হয় সভ্যতা ও রাষ্ট্রকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। রাষ্ট্র যদি একটি প্রতিষ্ঠান হয়, তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রতীয়মান হয়, এর প্রতিপক্ষ জনগণ। কারণ, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারে এমন প্রতিনিধি দ্বারা রাষ্ট্র বর্তমানে পরিচালিত হচ্ছে না। এ কারণেই জনগণকে নিবৃত্ত করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। সংবিধানের ২১(২) অনুচ্ছেদ মোতাবেক, যাদের জনগণের কল্যাণের জন্য ব্যবহৃত হওয়ার কথা ছিল, তারাই জনগণের অধিকার আদায়ে কার্যত প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। উক্ত অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে, ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’ এখন প্রশ্ন হলোÑ প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিরা জনগণের কতটুকু সেবা করে যাচ্ছেন? শুধু জনগণ হলেই একটি রাষ্ট্র গঠিত হয় না। তবে রাষ্ট্রের একাধিক উপাদানের মধ্যে ‘জনগণই’ মূল উপাদান এবং সংবিধানের ৭(১) অনুচ্ছেদ মোতাবেক জনগণই রাষ্ট্রের মালিক। উক্ত অনুচ্ছেদ মোতাবেক, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।’ উক্ত অনুচ্ছেদের (২) উপ-ধারায় আরো বলা হয়েছেÑ ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।’ সংবিধানের বর্ণিত বিষয়গুলো যদি মিলিয়ে পড়া যায়, তবে দেশের সর্বোচ্চ আইন হলো ‘সংবিধান’, যা দ্বারা শুধু জনগণের কর্তৃত্বের নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে। সংবিধান যদি জনগণের রক্ষাকবচ হয় তবে জনগণের নিরাপত্তা, সম্মান ও অধিকার কেন আজ রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের দ্বারা পদদলিত?সমাজের অবস্থান এ পর্যায়ে চলে গেছে যে মনে হচ্ছে, খুনি খুন করে আত্মতৃপ্তি লাভ করবে; কিন্তু তাকে খুনি বলা যাবে না। যদি কেউ খুনিকে খুনি বলে তবে তার হয়রানির শেষ হবে না। নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রাস্তায় দাঁড়ানো যাবে না। চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করা যাবে না। রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে কথা বললেই জনগণের অর্থে লালিত যে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, তারাই জনতার ওপর হামলা করে, আর বানোয়াট মামলা তো আছেই। ভিত্তিহীন মামলাই বর্তমানে রাষ্ট্রযন্ত্রকর্তৃক জনগণকে হয়রানির প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশে অনেকগুলো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও আইন রয়েছে, যাদের সাংবিধানিক ও আইনগত দায়িত্ব শুধু জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা। আইন ও সংবিধান সে প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সুর্নিদিষ্ট ক্ষমতা ও অধিক্ষেত্র প্রদান করলেও সরকারের তথা সরকার প্রধানের সন্তুষ্টি বিধান করে নিজ পোস্ট-পজিশনকে সযত্নে রক্ষা করাই তাদের একমাত্র দায়িত্ব বলে তারা মনে করেন। দুদক বা দুর্নীতি দমন কমিশন একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রে সরকারের মদদ জোগানোই তাদের কাজ। ক্ষমতাসীন দলের কোনো দুর্নীতি তাদের চোখে পড়ে না বলেই জনগণের ধারণা। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও রিমান্ডের নামে যে ‘বাণিজ্য’ হয় তা নিয়েও কেউ কোনো কথা বলে না। সরকারি দলের আঙ্গুলি নির্দেশে ভৌতিক এজাহার দিয়ে গ্রামগঞ্জের অনেক পরিবারের সন্তানেরা গ্রেফতার ও রিমান্ড বাণিজ্যের অসহনীয় অত্যাচারে এলাকায় টিকতে না পেরে রাজধানীতে রিকশাচালিয়ে পর্যন্ত জীবিকা নির্বাহ করছে। এ খবরও কেউ রাখে না। সব দুুর্নীতির খোঁজ নেয়ার দায়িত্ব কি দুদকের নয়?
যারা জনগণের বিভিন্ন কর্মের শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্বে নিয়োজিত তারাই অনেক সময়ে জনগণের রক্ত-মাংস এমনভাবে চুষে খাচ্ছে, যার ফলে জনগণ হচ্ছে হাড্ডিসার। অন্য দিকে প্রজাতন্ত্রের বহু কর্মকর্তা হচ্ছে পোয়াবারো। তাদের আর্থিকসঙ্গতি এ পর্যায়ের যে, তারা চাঁদের দেশের জমি বিক্রি হলেও তা হয়তো ক্রয় করার ক্ষমতা রাখেন। আমলারা যদি জনগণের স্বার্থ ন্যূনতম বিবেচনা করতেন তবে দেশের সাধারণ মানুষকে এত হয়রানির শিকার হতে হতো না। পবিত্র কুরআন শরিফে সূরা বাকারায় (আয়াত-১৮) মহান আল্লাহপাক এক শ্রেণীর লোক সম্পর্কে বলেন যে, ‘এরা কানে শোনে না, চোখে দেখে না, কথাও বলতে পারে না; অতএব এসব লোক ফিরে আসবে না।’ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের অবস্থা সেই অন্ধ, মুক ও বধিরদের মতো কেন হবে, যারা জনগণের মৌলিক অধিকার ও জন্মগত অধিকার বা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিকের অধিকারকে গুরুত্ব প্রদান না করে শুধু নির্বিচারে ক্ষমতাসীনদের তাবেদারি করে যাচ্ছে। পুলিশ যেভাবে জনগণের অধিকার হরণ করছে তা ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলকেও হার মানিয়েছে। মামলা সৃজন করা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া, মিথ্যা চার্জশিট ও সে চার্জশিটে সাজা হওয়া বর্তমানে অসম্ভব বিষয়ই না। আমরা জজ মিয়া নাটকের কথা শুনেছি। বিএনপির মহাসচিব নাকি সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িতে আগুন দেন এবং সে মামলায় চার্জশিট পুলিশই দিয়েছে। এখন এ মামলায় মহাসচিবের সাজা হলেও আশ্চর্য হওয়ার কোনো কারণ নেই। মিথ্যার ওপর ভাসছে দেশ ও জাতি। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি বিচারসম্পর্কিত সব বিষয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা দরকার। তিনি যদি তা দেখেন না বা দেখার ফুসরত (সময়) পান না, আমরা কার কাছে যাব? বিচারপতি এস কে সিনহা মূর্তি স্থাপনসহ অনেক বিতর্কের জন্ম দিলেও ‘নিম্ন আদালত বলতে আইন মন্ত্রণালয়’ প্রকাশ্যে বলে সত্যের অবতারণা করেছিলেন। এ জন্য তিনি অনেক বোবা কান্না, আর্তনাদ ও বুকফাটা কান্নার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। পুলিশ গণমানুষের অধিকার হরণ করে, নিম্ন আদালতগুলোও তেমনি ভূমিকা রাখে। আদালত সত্য-মিথ্যা যাচাই করে দেখতে হবে। সিদ্ধান্ত দেয়ার প্রশ্নে সরকারের মুখের দিকে চেয়ে থাকলে চলে না। সরকার অসন্তুষ্ট হতে পারে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিম্ন আদালত যেন না দেয়। যে নিজেকে পরাধীন মনে করে শত আইন পাস করেও তাকে স্বাধীন বানানো যাবে না। সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক, বিচারপতি এস কে সিনহার একটি রায় নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে বিচারিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে মন্তব্য করেছেন। বিদ্যমান অবস্থায়, এ দেশকে পুলিশি প্রজাতন্ত্র বললে কি ভুল করা হবে?
লেখক: বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা
taimuralamkhandaker@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.