মালদ্বীপের অশান্তির পেছনের কারণ by মারুফ মল্লিক
আচমকাই
যেন মালদ্বীপের রাজনীতি নড়ে উঠল। আঞ্চলিক রাজনীতির গতিবিধি যাঁরা
পর্যবেক্ষণ করেন ও আঞ্চলিক রাজনীতির সঙ্গে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির হিসাব-নিকাশ
মেলানোর চেষ্টা করেন, তাঁদের কাছে এই সংকট আকস্মিক নয়। ঠিক কখন মালদ্বীপের
রাজনীতিতে নড়াচড়া পড়বে, তা পূর্বানুমান করা না গেলেও কিছুটা তো আঁচ করা
যাচ্ছিল। কারণ চীনের সঙ্গে দেশটির ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি ও ভারতের তা পছন্দ না
হওয়া। আদালতের একটি রায়কে ঘিরে ভারত মহাসাগরের এই দেশে রাজনৈতিক সংকট
ঘনীভূত হয়। মালদ্বীপের এই অভ্যন্তরীণ সংকট এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বাইরে
চলে এসেছে। বিশেষ করে যখন দেশটির প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন সমর্থনের
আশায় চীন, সৌদি আরব ও পাকিস্তানে প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। অন্যদিকে, সাবেক
প্রেসিডেন্ট ও বিরোধী নেতা মোহাম্মদ নাশিদ সরাসরি ভারতকে সংকট সমাধানে
সামরিক হস্তক্ষেপের আহ্বান জানান। সংকটের শুরু মালদ্বীপের প্রধান বিচারপতি
বিরোধী নেতাদের মুক্তি দেওয়া ও সরকারদলীয় কয়েকজন দলত্যাগী সংসদ সদস্যকে
সংসদীয় আসনে বহালের নির্দেশ দেওয়ার পর। এর প্রতিক্রিয়ায় প্রেসিডেন্ট
আবদুল্লাহ ইয়ামিন দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে সেনাবাহিনী ও পুলিশকে প্রধান
বিচারপতি ও বিরোধী নেতাদের আটকের নির্দেশ দেন। তাঁরা আটকও হন। সাধারণভাবে
মনে হতে পারে, আবদুল্লাহ ইয়ামিনের বিরুদ্ধে নানাবিধ অভিযোগ রয়েছে। এ কথা
সত্যি, দেশটিতে গণতান্ত্রিক সংকট রয়েছে। ২০০৮ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট মামুন
আবদুল গাইয়ুমের ৩০ বছরের স্বৈরশাসনের অবসানের পর নির্বাচনরে মধ্য দিয়ে
মোহাম্মদ নাশিদ রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ করেন। তবে ২০১২ সালে এক সিভিল-সামরিক
অভ্যুত্থানের মুখে নাশিদ পদত্যাগ করেন। নাশিদ অভিযোগ করেছিলেন, তাঁকে
বন্দুকের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। ২০১৩ সালে নির্বাচনে আবদুল্লাহ
ইয়ামিন পদত্যাগী মোহাম্মদ নাশিদকে পরাজিত করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এই
নির্বাচন নিয়েও নানাবিধ অভিযোগ রয়েছে বিরোধীদের পক্ষ থেকে। পশ্চিমাদের কেউ
কেউ প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনকে স্বৈরাচারী বলে মন্তব্যও করে থাকেন। আবদুল্লাহ
ইয়ামিন নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই ভারত ও পশ্চিমাদের প্রভাববলয় থেকে সরে
গিয়ে চীনের ঘনিষ্ঠ হওয়ার উদ্যোগ নেন। তবে মালদ্বীপে চীনের উপস্থিতি ভারতের
জন্য শঙ্কার। এখানেই ভারত-চীনের আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ের আড়ালে
মালদ্বীপের রাজনৈতিক সংকটের কারণ লুকিয়ে আছে। কীভাবে? চীনের সঙ্গে
মালদ্বীপের মাখামাখি ভারত খুব একটা পছন্দ করছে না। এটি ভারতের গত কয়েক
বছরের মালদ্বীপসংক্রান্ত বিবৃতিগুলো দেখেই অনুমান করা যায়।
স্বাভাবিকভাবেই
ভারত কখনোই চাইবে না ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভাব আরও বৃদ্ধি পাক। এমনিতেই
ভারত মহাসাগরে চীনের উপস্থিতি ক্রমে বাড়ছে। শ্রীলঙ্কায় ইতিমধ্যেই চীন
সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। পাকিস্তানেও নির্মিত হচ্ছে। এর মধ্যেই যদি
মালদ্বীপে চীন বাণিজ্যিক সহযোগিতার নামে ঘাঁটি গেড়ে বসে, তা কখনোই ভারতের
জন্য স্বস্তিকর হবে না। তবে ভারতের জন্য স্বস্তিকর না হলেও মালদ্বীপ ও
চীনের অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্র ক্রমে প্রসারিতই হচ্ছে। গেল বছর
ডিসেম্বর মাসে মালদ্বীপ ও চীন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। বিরোধী
নেতা মোহাম্মদ নাশিদ এই চুক্তির বিরোধিতা করে বলেছেন, এই চুক্তিতে
মালদ্বীপের স্বার্থ রক্ষা করা হয়নি। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের দ্বীপ গাদহতে
চীনের সহায়তায় একটি সমুদ্রবন্দর নির্মাণের আলোচনাও চলছে কয়েক বছর ধরেই।
২০১৪ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট জি জিনপিংয়ের মালদ্বীপ সফরকালে প্রধান
বিমানবন্দর উন্নয়নের চুক্তি করা হয়। এর আগে মালদ্বীপ ভারতের সঙ্গে
বিমানবন্দর উন্নয়নের চুক্তি বাতিল করে। ওই সফরে জিনপিং বলেন, মালদ্বীপের
অবকাঠামোগত উন্নয়নে চীনের বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা হবে। ওই সময় ৬০০ মিলিয়ন
আরএমবির (চায়নিজ মুদ্রা) অবকাঠামো উন্নয়ন, ২০ মিলিয়ন আরএমবির সামরিক
সহযোগিতা ও দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতার আওতায় বিভিন্ন সেবা খাতে বিনিয়োগের
জন্য আরও ২০ মিলিয়ন আরএমবির চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। ২০১৭ সালে তিন লাখ
চীনা পর্যটক মালদ্বীপ ভ্রমণ করেন। রাজধানী মালের কাছে একটি দ্বীপ অবকাশ
যাপন কেন্দ্র স্থাপনের জন্য ৫০ বছরের লিজ নিয়েছে চীন। সন্দেহ নেই, এসব
অর্থনৈতিক উদ্যোগ বহুল আলোচিত চীনের ‘মেরিটাইম সিল্ক রোড’ ডকট্রিনের অংশ।
চীনের এই মেরিটাইম সিল্ক রোডের বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য জ্বালানি নিরাপত্তা
নিশ্চিত করা। আর সামরিক উদ্দেশ্য হচ্ছে বাণিজ্যিক স্বার্থের আড়ালে ভারত
মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারতকে ঘিরে ফেলা। এ কারণেই দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের উপস্থিতি
বেড়েই চলেছে। পাকিস্তান শুরু থেকেই ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ এশিয়ার
রাজনীতিতে চীনের মিত্র। শ্রীলঙ্কাও এখন অনেকটা ভারতের প্রভাবের বাইরে চলে
গিয়েছে। সেখানেও চীনের বিনিয়োগ বাড়ছে। হাম্বানটোটায় সমুদ্রবন্দর নির্মাণ
করেছে চীন। মিয়ানমারের আকিয়াবেও বন্দর পরিচালনা করছে চীন। এখন যদি
মালদ্বীপেও বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক সম্পর্কে আড়ালে উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়,
তবে ভারতকে আরও শক্তভাবে ঘিরে ফেলা সম্ভব হবে চীনের জন্য। ভারতের মতো
উদীয়মান আঞ্চলিক শক্তির জন্য স্বভাবতই নিজস্ব এলাকার কাছাকাছি
প্রতিদ্বন্দ্বীর ঘাঁটি গেড়ে বসা খুব একটা গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু ভারত
মহাসাগরীয় অঞ্চল ছাড়াও স্থলভাগেও প্রতিবেশীর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে ভারত।
ভারতের প্রতিবেশী নেপালও এখন চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। দেশটি নতুন অর্থনৈতিক
মিত্রের সন্ধান করছে। ইতিমধ্যেই নেপাল ও চীন একাধিক বাণিজ্যিক চুক্তি
করেছে। এতে করে ভারতের ওপর নেপালের নির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে। এ ছাড়া রয়েছে
ভুটান। অর্থনৈতিক, সামরিক দিক দিয়ে ভুটান চীনের জন্য খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ
নয়। বাকি রইল বাংলাদেশ। সার্বিক পরিস্থিতির আলোকে বলা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায়
ভুটানের পর একমাত্র বাংলাদেশেই ভারতের একচ্ছত্র প্রভাব এখনো বিদ্যমান। যদিও
বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে শক্তিশালী বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ চীন
থেকে সাবমেরিন ক্রয় করে দেশটির সঙ্গে সম্পর্কে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করছে।
অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ ও ভুটান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য
দেশ ভারতীয় বলয় বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার
আড়ালে। আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্রে এটি ভারতের জন্য বড়
ধরনের চ্যালেঞ্জ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ভারতীয় বলয় থেকে বেরিয়ে আসার
চেষ্টার অংশ হিসেবেই ভারতের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে চীন এই অঞ্চলে
আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু ভারতও তৎপর রয়েছে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব খর্ব
করতে। এ ক্ষেত্রে ভারত মিত্র হিসেবে পাশে পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানকে।
ভারত ও চীনের আঞ্চলিক রাজনীতির এই খেলার সাম্প্রতিক ক্ষেত্র হচ্ছে
মালদ্বীপ। মালদ্বীপের রাজনৈতিক সংকট নিছকই তাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে
বিভেদের ফলাফল নয়। এর সঙ্গে আঞ্চলিক ও উদীয়মান শক্তির আধিপত্য বিস্তারের
প্রতিদ্বন্দ্বিতাও রয়েছে। নাশিদের আহ্বানের পরই চীন মালদ্বীপে ভারতের
সামরিক হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেছে। সংকট নিরসনে জাতিসংঘের ভূমিকাও নাকচ
করে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেয় চীন। অন্যদিকে, মালদ্বীপের দূতকে সময় দিতে
রাজি হয়নি ভারত। এ থেকে অনুমান করা যায়, আবদুল্লাহ ইয়ামিনকে আর ক্ষমতায়
দেখতে চায় না ভারত। মালদ্বীপের দূতকে সময় না দিয়ে সংকট নিরসনে কূটনৈতিকভাবে
অংশ নেওয়ার সুযোগ হারিয়েছে ভারত; বরং চীনের জন্য পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
এখন ভারতের সামনে দুটি পথ খোলা রইল। এক, নিজ উদ্যোগেই আবার কূটনৈতিক
প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া বা নাশিদের আহ্বান অনুসারে সামরিক অভিযান পরিচালনা
করা। মালদ্বীপের এই সংকটের সুরাহা যেভাবেই হোক, সমূহ শঙ্কা রয়েছে—ভারত এই
খেলায় সাইডলাইনে চলে যেতে পারে। যদি এ খেলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অংশ নেয়,
তবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দীর্ঘমেয়াদি আধিপত্য লড়াইয়ের ক্ষেত্র হতে পারে
মালদ্বীপ। সে ক্ষেত্রে ভারত কী করবে তা দেখার অপেক্ষা।
ড. মারুফ মল্লিক: রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর কনটেম্পোরারি কনসানর্স, জার্মানি
ড. মারুফ মল্লিক: রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর কনটেম্পোরারি কনসানর্স, জার্মানি
No comments