বই, বইয়ের মেলা by মুহম্মদ জাফর ইকবাল
পৃথিবীতে
যত রকমের মেলা হতে পারে তার মাঝে সবচেয়ে সুন্দর মেলা হচ্ছে বইমেলা। আমার
ধারণা পৃথিবীতে যত বইমেলা আছে তার মাঝে সবচেয়ে মধুর বইমেলা হচ্ছে আমাদের
ফেব্রুয়ারি বইমেলা। কোনো কিছু না করে বইমেলার এক কোনায় চুপচাপ বসে থেকে
শুধু মেলার মানুষজনকে দেখে আমি আমার একটি জীবন কাটিয়ে দিতে পারব! মেলায়
গুরুগম্ভীর বয়স্ক মানুষ যায়, কমবয়সী তরুণ-তরুণী যায়, বাবা-মায়ের হাত ধরে
ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা যায়, প্রত্যেকের ভাবভঙ্গি চালচলন আলাদা! কেউ বই কেনে,
কেউ বই দেখে আবার কেউ শুধু ঘুরে বেড়ায়! এই অতি চমৎকার বইমেলাটি
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শুরু হয়েছে, আমি সিলেটে বসে আছি, লম্বা লম্বা
দীর্ঘশ্বাস ফেলে অপেক্ষা করছি কবে বইমেলায় যাব! গতবার বইমেলায় গিয়ে অবশ্য
আমার এক ধরনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল। বাচ্চাকাচ্চার জন্য বই লিখি বলে
আমাকে একসময় প্রচুর অটোগ্রাফ দিতে হতো। কমবয়সী ছেলেমেয়েরা বই নিয়ে ভিড় করে
আসত। এখনও ভিড় করে আসে, কিন্তু তাদের হাতে এখন প্রায় সময়েই কোনো বই নেই,
তার বদলে আছে একটা স্মার্টফোন! সেই ফোন দিয়ে তারা সেলফি তুলতে থাকে! সেলফি
বা ছবি তোলার বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই; কিন্তু বইমেলায় বইয়ের ওপর
অটোগ্রাফ না নিয়ে শুধু একটা সেলফি তুলে সন্তুষ্ট হয়ে চলে গেলে আমি একটু
অস্বস্তি বোধ করি। এই সোশ্যাল নেটওয়ার্ক বা ফেসবুকের যুগেও আমি
সাংঘাতিকভাবে বইপন্থী মানুষ। যতই দিন যাচ্ছে আমি ততই বেশি বিশ্বাস করতে
শুরু করেছি যে, একটা মানুষকে পরিপূর্ণ হতে হলে তাকে অবশ্যই বই পড়তে হবে।
আমার ধারণা মানুষ আর পশুপাখির মাঝে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হচ্ছে মানুষ বিমূর্ত
চিন্তা করতে পারে, পশুপাখি পারে না। যত রকম বিমূর্ত চিন্তা আছে তার মাঝে
সবচেয়ে কার্যকর হচ্ছে বইপড়া। কাজেই কেউ যেন মনে না করে বই পড়াটি শুধু এক
ধরনের বিনোদন, এটি তার থেকেও অনেক বড় একটি ব্যাপার। আমাদের একমাত্র সম্পদ
হচ্ছে মস্তিষ্ক। সেই মস্তিষ্কের সবচেয়ে বড় ব্যায়াম হতে পারে বইপড়া।
মস্তিষ্ক শানিত করার এর থেকে কার্যকর আর কিছু হতে পারে না। সোশ্যাল
নেটওয়ার্কজাতীয় আপদের প্রবল আক্রমণের সামনে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ হতে
পারে বই। তাই আমার মনে হয়, রীতিমতো যুদ্ধ করে হলেও আমাদের সবাইকে বইয়ের
জগতে নিয়ে যেতে হবে। সে জন্য ফেব্র“য়ারির বইমেলা দেখে আমি এত উত্তেজিত হয়ে
যাই।
২. এবারের বইমেলায় আমার জন্য একটা অত্যন্ত চমকপ্রদ ব্যাপার ঘটেছে। সেটা হচ্ছে, সায়েন্স ফিকশন ক্যাটাগরিতে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার দেয়া। দিন দশেক আগে আমি কলকাতা গিয়েছিলাম। সেখানে খুব জাঁকজমক করে কলকাতা লিট ফেস্টিভেল হয়। সেখান থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল পরাবাস্তব লেখার জন্য। মঞ্চে আমি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের পাশে বসেছিলাম যা আমার জন্য অনেক বড় একটি অভিজ্ঞতা। সেখানে ওরা আমার কাছে বাংলাদেশের সায়েন্স ফিকশন লেখালেখি নিয়ে জানতে চেয়েছিল। আমি অনেক জোর গলায় বলে এসেছি, বাংলাদেশের পাঠক নিশ্চয়ই সায়েন্স ফিকশন পড়তে খুব পছন্দ করে, কারণ আমাদের দেশে অনেক সায়েন্স ফিকশন লেখক। শুধু তাই নয়, তারা একটা সোসাইটি করেছেন এবং বইমেলায় তারা র্যালি করে গিয়ে দলবেঁধে একসঙ্গে সায়েন্স ফিকশন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন! তবে কলকাতার মানুষকে যেটা বলিনি, সেটা হচ্ছে দেশের সাহিত্যের মূলধারার মানুষরা সায়েন্স ফিকশনকে গুরুত্ব দিয়ে দেখে না। সবাই ধরেই নেয় সাহিত্যের কিছু সম্ভ্রান্ত এলাকা আছে; যারা সেই এলাকায় ঘোরাঘুরি করতে পারে তারাই প্রকৃত সাহিত্যিক! অন্যদের ক্ষেত্রে লেখক, দলিল লেখক কিংবা সায়েন্স ফিকশন লেখকের মাঝে বড় কোনো পার্থক্য নেই। আজকাল অনেকরকম সাহিত্য পুরস্কার দেয়া হয়, প্রায় সব ক্ষেত্রেই একজন প্রবীণ এবং একজন নবীন লেখক নেয়া হয়। নবীন লেখকদের বেলায় কখনও একজন সায়েন্স ফিকশন লেখককে বেছে নিতে দেখিনি! যদিও অনেকেই আছেন যারা খুব চমৎকার লেখেন। এরকম একটা অবস্থায় যদি হঠাৎ করে আবিষ্কার করি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটা পুরস্কার সায়েন্স ফিকশন ক্যাটাগরিতে দেয়া হয়েছে, তাহলে অবশ্যই আনন্দিত হওয়ার কারণ আছে। মনে হচ্ছে সাহিত্যের জগৎটা কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে রাখা ছিল। শুধু সম্ভ্রান্ত কিছু মানুষ সেখানে যেতে পারত, হঠাৎ করে কাঁটাতার তুলে দিয়ে সেখানে অন্যদেরও ঢুকতে দেয়া হয়েছে। সায়েন্স ফিকশন লেখক ঢুকেছেন, তাদের পিছু পিছু ভৌতিক গল্প লেখকরা ঢুকে যাবেন, তার পিছু পিছু রহস্য উপন্যাসের লেখক এবং সবার শেষে শিশুসাহিত্যিকরা! এ বছর সায়েন্স ফিকশনের জন্য পুরস্কার পেয়েছেন মোশতাক আহমেদ। তাকে আমি অনেকদিন থেকে চিনি! চেনা মানুষটি পুরস্কার পেলে আনন্দ বেশি হয়। বেশ কয়েক বছর আগে তিনি মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পুলিশদের অবদান নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন, বইটির নাম নক্ষত্রের রাজারবাগ। মোশতাক আহমেদ আমাকে অনুরোধ করেছিলেন বইটির মোড়ক উন্মোচন করে দিতে এবং আমি আনন্দের সঙ্গে রাজি হয়েছিলাম। কোনো একটা কারণে নির্দিষ্ট সময়ে মোশতাক আহমেদ জরুরি কাজে আটকা পড়ে গেলেন এবং বইটির মোড়ক উন্মোচন করা হল না। আমি সেদিনই ঢাকা থেকে সিলেট চলে এসেছি। পরদিন ভোরে আমি অফিসে গিয়েছি। গিয়ে দেখি মোশতাক আহমেদ আমার অফিসের সামনে অপেক্ষা করছেন, তার হাতে রঙিন কাগজে মোড়ানো একটি বই। আমাকে বললেন বইটির মোড়ক উন্মোচন করানোর জন্য তিনি রাতের ট্রেনে ঢাকা থেকে সিলেট চলে এসেছেন! তিনি ঠিক করেছিলেন আমাকে দিয়ে মোড়ক উন্মোচন করাবেন, কাজেই সেটি তিনি করে ছাড়বেন। আমি সবসময়ই দেখে এসেছি মোড়ক উন্মোচন হয় দশজনের সামনে, রীতিমতো একটা আনন্দঘন অনুষ্ঠান। কিন্তু নক্ষত্রের রাজারবাগ বইয়ের মোড়ক উন্মোচনটি হল আমার অফিসে। আমি আর মোশতাক আহমেদ ছাড়া কেউ নেই। আমি মোড়কটি উন্মোচন করলাম, তিনি আমার হাতে বইটি তুলে দিয়ে তক্ষুনি ছুটলেন ঢাকা। আমার জীবনে এর চেয়ে বিচিত্র মোড়ক উন্মোচন আর কখনও হয়নি, মনে হয় আর কখনও হবে না। ২০১২ সালে এই বইটি যখন কালি ও কলম সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিল, তখন আমার চেয়ে বেশি খুশি মনে হয় আর কেউ হয়নি।
৩. আমি প্রতিবছরই ভাবি বইমেলার আগে কয়েকজন নতুন লেখকের বই নিয়ে কিছু লিখব; কিন্তু কখনও সেটি ঠিক করে করতে পারিনি। এ বছরেও সেটি করা হল না, কারণ মেলার আগে নতুন লেখকদের বইগুলো খুঁজে পড়তে পারিনি। বইটি পড়া হয়নি, কিন্তু বইমেলায় গিয়ে যে বইটি কিনব বলে ঠিক করে রেখেছি সেই বইটি নিয়ে দু-একটি লাইন অন্তত লিখি। দুই বছর আগে একজন মা আমাকে একটা ই-মেইল পাঠিয়েছিল। তার শিশুসন্তানটি কোনো একটি রক্তজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে। অপ্রতিরোধ্য শোকে দিশেহারা হয়ে সেই মা শিশুটির শেষ কয়েকটি দিনের কথা লিখে আমাকে অনুরোধ করেছিল, যদি সম্ভব হয় তাহলে আমি যেন এ ধরনের শিশুদের নিয়ে কিছু একটা লিখি। একজন লেখক যখন কোনো গল্প বা উপন্যাস লিখে সেটি পড়ে, অনেক সময়েই আমরা ব্যাকুল হয়ে যাই, কখনও কখনও সেই কাল্পনিক চরিত্রের দুঃখ-কষ্টে আমাদের চোখে পানি চলে আসে। কিন্তু বইপড়া শেষ হলে আমরা চোখ মুছে হাসিমুখে নিজের কাজে ফিরে যাই, কেননা আমরা জানি আমাদের দুঃখটা সত্যিকারের দুঃখ নয়, কারণ চরিত্রগুলো কাল্পনিক। কিন্তু একজন মা যখন তার শিশুসন্তানের জীবনের শেষ মুহূর্তের ঘটনাগুলো গভীর মমতা দিয়ে লিখে পাঠায়, সেটি পড়ে চোখ মুছে আবার হাসিমুখে নিজের কাজে ফিরে যাওয়া যায় না। কারণ চরিত্রগুলো কাল্পনিক নয়, তারা সত্যি। বুকের ভেতর কোথায় জানি ব্যথা টনটন করতে থাকে। আমি এরকম মৃত্যুপথযাত্রী কিন্তু প্রাণোচ্ছল হাসিখুশি একটি শিশুকে নিয়ে লিখতে পারব বলে মনে হয় না। তাই আমি ভাবছিলাম মা’টিকে চিঠি লিখে বলব, তোমার এই অচিন্তনীয় কষ্টের কথাটুকু তুমি নিজেই কষ্ট করে লিখো। তোমার মতো অন্য যারা আছে তারা হয়তো তোমার লেখাটি থেকেই সান্ত্বনা পাবে। আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ করার আগেই সেই কমবয়সী মা আমাকে লিখে জানাল, সে বুকে পাথর বেঁধে কাহিনীটি লিখেছে। সে একা নয়, তার মতো আরও যারা দুর্ভাগা মা রয়েছেন, তারাও লিখেছেন। এ বইটি দিয়ে তারা এরকম অসহায় মা’দের মাঝে একটা যোগসূত্র তৈরি করতে চাইছে যেন শেষ মুহূর্তে তাদের সন্তানরা সত্যিকার চিকিৎসা পেতে পারে, সম্ভব হলে শিশুটিকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে। বইমেলায় গিয়ে আমি বইটি কিনব। বইটির নাম ‘ওরা নেই ওরা আছে’। শোকাতুর মায়ের নাম সায়মা সাফিজ সুমী।
৪. এ বছর বইমেলায় গিয়ে আমি আরও একটি বই সংগ্রহ করব। কিন্তু আমি মোটামুটিভাবে নিশ্চিত সেই বইটি আমি নেড়েচেড়ে দেখব, চোখ বুলাব, কিন্তু পড়ার সাহস পাব না। বইটির নাম ‘বীরাঙ্গনা রচনা সমগ্র’, লেখিকার নাম সুরমা জাহিদ, প্রকাশকের নাম অন্বেষা। সুরমা জাহিদ এবারে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক লেখার জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। এর চেয়ে যথার্থ পুরস্কার আর কিছু হতে পারে কিনা আমার জানা নেই। সুরমা জাহিদের জন্ম ১৯৭০ সালে। একাত্তরে তিনি একজন অবোধ শিশু ছিলেন, তারপরও একাত্তর সালের বীরাঙ্গনাদের জন্য তার ভেতরে একধরনের গভীর মমতা রয়েছে। সেই মমতা ও ভালোবাসায় তিনি বীরাঙ্গনাদের নিয়ে সাতটি বই লিখেছেন। সেই বইগুলোকে সংকলিত করে ৫৫টি ভিন্ন ভিন্ন জেলার মোট ৩৬১ জন বীরাঙ্গনাকে নিয়ে ‘বীরাঙ্গনা রচনা সমগ্র’ বইটি দাঁড় করেছেন। একদিকে মানুষের নিষ্ঠুরতার অন্যদিকে নারীদের দুঃখ-কষ্ট এবং বেদনার ইতিহাসের এর চেয়ে বড় কোনো দলিল আছে বলে আমার জানা নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি মুক্তিযুদ্ধ কর্নার আছে। সেখানে আমরা সুরমা জাহিদের বীরাঙ্গনাদের ওপর লেখা বইগুলো সংগ্রহ করেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের যে কোনো ইতিহাস আমি খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ি, কিন্তু তারপরও সুরমা জাহিদের লেখা এই বইগুলো আমি পড়তে পারি না। বুকের ভেতর একধরনের রক্তক্ষরণ হয়। তারপরও আমি হৃদয়ের রক্তক্ষরণের এই বইটি বইমেলা থেকে সংগ্রহ করব।
৫. বইমেলা নিয়ে লিখতে গিয়ে আমি এবারে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বিষয় নিয়ে লিখি। সেটি হচ্ছে নতুন লেখক এবং তাদের প্রকাশিত বই। আমি মোটেও জানতাম না যে, আমাদের বইমেলায় নতুন লেখকরা যে বই প্রকাশ করেন সেই বইগুলো তারা নিজেদের পকেটের টাকা দিয়ে ছাপান। বিষয়টি জানার পর আমি প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা আমাকে জানিয়েছেন বইমেলায় প্রকাশিত ৭০ থেকে ৮০ ভাগ বই নাকি এরকম নিজের পকেটের টাকায় ছাপানো বই। অন্যরা বলেছেন, সংখ্যাটি নাকি আরও বড়। যদি একজন লেখক নিজের পকেটের টাকা দিয়ে কোনো একজন প্রকাশককে দিয়ে তার বই বের করেন, তাহলে সেই প্রকাশককে ‘প্রকাশক’ বলা যাবে না, তাকে ‘মুদ্রক’ বা এ ধরনের কিছু বলতে হবে। প্রকাশক তিনি, যিনি কোনো একজন লেখক-গবেষকের কাজটুকু নিজের দায়িত্বে পাঠকদের সামনে তুলে ধরবেন। সেই কাজটুকু করার জন্য তার যদি অর্থের প্রয়োজন হয় সেই অর্থটুকু প্রকাশকের নিজের জোগাড় করতে হবে। যদি প্রকাশকের সেই অর্থ না থাকে, তাহলে বুঝতে হবে প্রকাশনার বিষয়টি তার জন্য নয়- তাকে অন্য কোনো কাজ খুঁজে নিতে হবে। ঠিত একইভাবে নতুন লেখকের জন্যও বলতে হবে, যদি কোনো লেখক নিজের পকেটের টাকা দিয়ে একটা বই প্রকাশ করে থাকেন তাহলে বুঝতে হবে তার বইটি এখনও প্রকাশের উপযোগী হয়ে ওঠেনি। কেউ যদি সত্যি সত্যি লেখালেখি করতে চায়, তাহলে তাকে কোনোভাবেই নিজের টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করা চলবে না। এটি এক ধরনের অসম্মান। একজন সত্যিকারের লেখক কোনোভাবেই নিজেকে অসম্মানিত করতে পারে না। নতুন লেখকদের সবসময়ই বলতে শোনা যায়- তারা নতুন লেখক বলে কেউ তাদের লেখা ছাপতে চায় না। এ অভিযোগটি অনেক পুরনো, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সেটি মানতে রাজি ছিলেন না, তার বন্ধুদের বলেছিলেন, অভিযোগটি সত্যি নয়, ভালো লেখা হলেই ছাপা হবে। শুধু তাই নয়, বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে একেবারেই অপরিচিত নতুন লেখক হিসেবে তিনি ‘অতসী মামী’ নামে একটি গল্প লেখে সেই সময়কার সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত ম্যাগাজিনে ছাপিয়েছিলেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো উদাহরণ আমাদের দেশেও অনেক আছে। সবচেয়ে বড় কথা- এখন যারা প্রতিষ্ঠিত লেখক তারা সবাই একসময় নতুন লেখক ছিলেন, অপরিচিত লেখক ছিলেন। কাজেই নতুন লেখককে কেউ গুরুত্ব দেয় না এমন অভিযোগ আমি শুনতে রাজি নই। এখন ইন্টারনেট ও ব্লগ আছে, কাজেই নতুন লেখকরা সেখানে লেখালেখি করতে পারেন। সেখানে বুঝতে পারবেন তার লেখালেখি কতটুকু মানসম্মত হয়েছে। যদি লেখক হিসেবে তার একটা পরিচিতি হয়, তখন প্রকাশকরা আনন্দের সঙ্গে তার বই ছাপতে রাজি হবেন। আমি মনে করি, প্রতিষ্ঠিত লেখক, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক- তাদেরও একটা দায়িত্ব আছে। তাদের সবসময় ভালো তরুণ লেখকের খোঁজ করতে হবে। যদি কাউকে খুঁজে পান তাকে দশজনের সামনে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। বইমেলার আগেই যদি এই কাজটি করা যেত, তাহলে আরও ভালো হতো। নতুন ভালো লেখকরা অনুপ্রেরণা পেতেন, উৎসাহ পেতেন। আমাদের এত সুন্দর একটা বইমেলা, সেটা শুধু বই ছাপানোর মাঝে আটকে থাকবে, তা তো হতে পারে না। পাঠক, প্রকাশক, লেখক মিলে বইমেলার সত্যিকারের যে উদ্দেশ্য সেটাকেও তো সত্যি করে তুলতে হবে।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল : অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়; লেখক
২. এবারের বইমেলায় আমার জন্য একটা অত্যন্ত চমকপ্রদ ব্যাপার ঘটেছে। সেটা হচ্ছে, সায়েন্স ফিকশন ক্যাটাগরিতে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার দেয়া। দিন দশেক আগে আমি কলকাতা গিয়েছিলাম। সেখানে খুব জাঁকজমক করে কলকাতা লিট ফেস্টিভেল হয়। সেখান থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল পরাবাস্তব লেখার জন্য। মঞ্চে আমি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের পাশে বসেছিলাম যা আমার জন্য অনেক বড় একটি অভিজ্ঞতা। সেখানে ওরা আমার কাছে বাংলাদেশের সায়েন্স ফিকশন লেখালেখি নিয়ে জানতে চেয়েছিল। আমি অনেক জোর গলায় বলে এসেছি, বাংলাদেশের পাঠক নিশ্চয়ই সায়েন্স ফিকশন পড়তে খুব পছন্দ করে, কারণ আমাদের দেশে অনেক সায়েন্স ফিকশন লেখক। শুধু তাই নয়, তারা একটা সোসাইটি করেছেন এবং বইমেলায় তারা র্যালি করে গিয়ে দলবেঁধে একসঙ্গে সায়েন্স ফিকশন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন! তবে কলকাতার মানুষকে যেটা বলিনি, সেটা হচ্ছে দেশের সাহিত্যের মূলধারার মানুষরা সায়েন্স ফিকশনকে গুরুত্ব দিয়ে দেখে না। সবাই ধরেই নেয় সাহিত্যের কিছু সম্ভ্রান্ত এলাকা আছে; যারা সেই এলাকায় ঘোরাঘুরি করতে পারে তারাই প্রকৃত সাহিত্যিক! অন্যদের ক্ষেত্রে লেখক, দলিল লেখক কিংবা সায়েন্স ফিকশন লেখকের মাঝে বড় কোনো পার্থক্য নেই। আজকাল অনেকরকম সাহিত্য পুরস্কার দেয়া হয়, প্রায় সব ক্ষেত্রেই একজন প্রবীণ এবং একজন নবীন লেখক নেয়া হয়। নবীন লেখকদের বেলায় কখনও একজন সায়েন্স ফিকশন লেখককে বেছে নিতে দেখিনি! যদিও অনেকেই আছেন যারা খুব চমৎকার লেখেন। এরকম একটা অবস্থায় যদি হঠাৎ করে আবিষ্কার করি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটা পুরস্কার সায়েন্স ফিকশন ক্যাটাগরিতে দেয়া হয়েছে, তাহলে অবশ্যই আনন্দিত হওয়ার কারণ আছে। মনে হচ্ছে সাহিত্যের জগৎটা কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে রাখা ছিল। শুধু সম্ভ্রান্ত কিছু মানুষ সেখানে যেতে পারত, হঠাৎ করে কাঁটাতার তুলে দিয়ে সেখানে অন্যদেরও ঢুকতে দেয়া হয়েছে। সায়েন্স ফিকশন লেখক ঢুকেছেন, তাদের পিছু পিছু ভৌতিক গল্প লেখকরা ঢুকে যাবেন, তার পিছু পিছু রহস্য উপন্যাসের লেখক এবং সবার শেষে শিশুসাহিত্যিকরা! এ বছর সায়েন্স ফিকশনের জন্য পুরস্কার পেয়েছেন মোশতাক আহমেদ। তাকে আমি অনেকদিন থেকে চিনি! চেনা মানুষটি পুরস্কার পেলে আনন্দ বেশি হয়। বেশ কয়েক বছর আগে তিনি মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পুলিশদের অবদান নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন, বইটির নাম নক্ষত্রের রাজারবাগ। মোশতাক আহমেদ আমাকে অনুরোধ করেছিলেন বইটির মোড়ক উন্মোচন করে দিতে এবং আমি আনন্দের সঙ্গে রাজি হয়েছিলাম। কোনো একটা কারণে নির্দিষ্ট সময়ে মোশতাক আহমেদ জরুরি কাজে আটকা পড়ে গেলেন এবং বইটির মোড়ক উন্মোচন করা হল না। আমি সেদিনই ঢাকা থেকে সিলেট চলে এসেছি। পরদিন ভোরে আমি অফিসে গিয়েছি। গিয়ে দেখি মোশতাক আহমেদ আমার অফিসের সামনে অপেক্ষা করছেন, তার হাতে রঙিন কাগজে মোড়ানো একটি বই। আমাকে বললেন বইটির মোড়ক উন্মোচন করানোর জন্য তিনি রাতের ট্রেনে ঢাকা থেকে সিলেট চলে এসেছেন! তিনি ঠিক করেছিলেন আমাকে দিয়ে মোড়ক উন্মোচন করাবেন, কাজেই সেটি তিনি করে ছাড়বেন। আমি সবসময়ই দেখে এসেছি মোড়ক উন্মোচন হয় দশজনের সামনে, রীতিমতো একটা আনন্দঘন অনুষ্ঠান। কিন্তু নক্ষত্রের রাজারবাগ বইয়ের মোড়ক উন্মোচনটি হল আমার অফিসে। আমি আর মোশতাক আহমেদ ছাড়া কেউ নেই। আমি মোড়কটি উন্মোচন করলাম, তিনি আমার হাতে বইটি তুলে দিয়ে তক্ষুনি ছুটলেন ঢাকা। আমার জীবনে এর চেয়ে বিচিত্র মোড়ক উন্মোচন আর কখনও হয়নি, মনে হয় আর কখনও হবে না। ২০১২ সালে এই বইটি যখন কালি ও কলম সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিল, তখন আমার চেয়ে বেশি খুশি মনে হয় আর কেউ হয়নি।
৩. আমি প্রতিবছরই ভাবি বইমেলার আগে কয়েকজন নতুন লেখকের বই নিয়ে কিছু লিখব; কিন্তু কখনও সেটি ঠিক করে করতে পারিনি। এ বছরেও সেটি করা হল না, কারণ মেলার আগে নতুন লেখকদের বইগুলো খুঁজে পড়তে পারিনি। বইটি পড়া হয়নি, কিন্তু বইমেলায় গিয়ে যে বইটি কিনব বলে ঠিক করে রেখেছি সেই বইটি নিয়ে দু-একটি লাইন অন্তত লিখি। দুই বছর আগে একজন মা আমাকে একটা ই-মেইল পাঠিয়েছিল। তার শিশুসন্তানটি কোনো একটি রক্তজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে। অপ্রতিরোধ্য শোকে দিশেহারা হয়ে সেই মা শিশুটির শেষ কয়েকটি দিনের কথা লিখে আমাকে অনুরোধ করেছিল, যদি সম্ভব হয় তাহলে আমি যেন এ ধরনের শিশুদের নিয়ে কিছু একটা লিখি। একজন লেখক যখন কোনো গল্প বা উপন্যাস লিখে সেটি পড়ে, অনেক সময়েই আমরা ব্যাকুল হয়ে যাই, কখনও কখনও সেই কাল্পনিক চরিত্রের দুঃখ-কষ্টে আমাদের চোখে পানি চলে আসে। কিন্তু বইপড়া শেষ হলে আমরা চোখ মুছে হাসিমুখে নিজের কাজে ফিরে যাই, কেননা আমরা জানি আমাদের দুঃখটা সত্যিকারের দুঃখ নয়, কারণ চরিত্রগুলো কাল্পনিক। কিন্তু একজন মা যখন তার শিশুসন্তানের জীবনের শেষ মুহূর্তের ঘটনাগুলো গভীর মমতা দিয়ে লিখে পাঠায়, সেটি পড়ে চোখ মুছে আবার হাসিমুখে নিজের কাজে ফিরে যাওয়া যায় না। কারণ চরিত্রগুলো কাল্পনিক নয়, তারা সত্যি। বুকের ভেতর কোথায় জানি ব্যথা টনটন করতে থাকে। আমি এরকম মৃত্যুপথযাত্রী কিন্তু প্রাণোচ্ছল হাসিখুশি একটি শিশুকে নিয়ে লিখতে পারব বলে মনে হয় না। তাই আমি ভাবছিলাম মা’টিকে চিঠি লিখে বলব, তোমার এই অচিন্তনীয় কষ্টের কথাটুকু তুমি নিজেই কষ্ট করে লিখো। তোমার মতো অন্য যারা আছে তারা হয়তো তোমার লেখাটি থেকেই সান্ত্বনা পাবে। আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ করার আগেই সেই কমবয়সী মা আমাকে লিখে জানাল, সে বুকে পাথর বেঁধে কাহিনীটি লিখেছে। সে একা নয়, তার মতো আরও যারা দুর্ভাগা মা রয়েছেন, তারাও লিখেছেন। এ বইটি দিয়ে তারা এরকম অসহায় মা’দের মাঝে একটা যোগসূত্র তৈরি করতে চাইছে যেন শেষ মুহূর্তে তাদের সন্তানরা সত্যিকার চিকিৎসা পেতে পারে, সম্ভব হলে শিশুটিকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে। বইমেলায় গিয়ে আমি বইটি কিনব। বইটির নাম ‘ওরা নেই ওরা আছে’। শোকাতুর মায়ের নাম সায়মা সাফিজ সুমী।
৪. এ বছর বইমেলায় গিয়ে আমি আরও একটি বই সংগ্রহ করব। কিন্তু আমি মোটামুটিভাবে নিশ্চিত সেই বইটি আমি নেড়েচেড়ে দেখব, চোখ বুলাব, কিন্তু পড়ার সাহস পাব না। বইটির নাম ‘বীরাঙ্গনা রচনা সমগ্র’, লেখিকার নাম সুরমা জাহিদ, প্রকাশকের নাম অন্বেষা। সুরমা জাহিদ এবারে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক লেখার জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। এর চেয়ে যথার্থ পুরস্কার আর কিছু হতে পারে কিনা আমার জানা নেই। সুরমা জাহিদের জন্ম ১৯৭০ সালে। একাত্তরে তিনি একজন অবোধ শিশু ছিলেন, তারপরও একাত্তর সালের বীরাঙ্গনাদের জন্য তার ভেতরে একধরনের গভীর মমতা রয়েছে। সেই মমতা ও ভালোবাসায় তিনি বীরাঙ্গনাদের নিয়ে সাতটি বই লিখেছেন। সেই বইগুলোকে সংকলিত করে ৫৫টি ভিন্ন ভিন্ন জেলার মোট ৩৬১ জন বীরাঙ্গনাকে নিয়ে ‘বীরাঙ্গনা রচনা সমগ্র’ বইটি দাঁড় করেছেন। একদিকে মানুষের নিষ্ঠুরতার অন্যদিকে নারীদের দুঃখ-কষ্ট এবং বেদনার ইতিহাসের এর চেয়ে বড় কোনো দলিল আছে বলে আমার জানা নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি মুক্তিযুদ্ধ কর্নার আছে। সেখানে আমরা সুরমা জাহিদের বীরাঙ্গনাদের ওপর লেখা বইগুলো সংগ্রহ করেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের যে কোনো ইতিহাস আমি খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ি, কিন্তু তারপরও সুরমা জাহিদের লেখা এই বইগুলো আমি পড়তে পারি না। বুকের ভেতর একধরনের রক্তক্ষরণ হয়। তারপরও আমি হৃদয়ের রক্তক্ষরণের এই বইটি বইমেলা থেকে সংগ্রহ করব।
৫. বইমেলা নিয়ে লিখতে গিয়ে আমি এবারে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বিষয় নিয়ে লিখি। সেটি হচ্ছে নতুন লেখক এবং তাদের প্রকাশিত বই। আমি মোটেও জানতাম না যে, আমাদের বইমেলায় নতুন লেখকরা যে বই প্রকাশ করেন সেই বইগুলো তারা নিজেদের পকেটের টাকা দিয়ে ছাপান। বিষয়টি জানার পর আমি প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা আমাকে জানিয়েছেন বইমেলায় প্রকাশিত ৭০ থেকে ৮০ ভাগ বই নাকি এরকম নিজের পকেটের টাকায় ছাপানো বই। অন্যরা বলেছেন, সংখ্যাটি নাকি আরও বড়। যদি একজন লেখক নিজের পকেটের টাকা দিয়ে কোনো একজন প্রকাশককে দিয়ে তার বই বের করেন, তাহলে সেই প্রকাশককে ‘প্রকাশক’ বলা যাবে না, তাকে ‘মুদ্রক’ বা এ ধরনের কিছু বলতে হবে। প্রকাশক তিনি, যিনি কোনো একজন লেখক-গবেষকের কাজটুকু নিজের দায়িত্বে পাঠকদের সামনে তুলে ধরবেন। সেই কাজটুকু করার জন্য তার যদি অর্থের প্রয়োজন হয় সেই অর্থটুকু প্রকাশকের নিজের জোগাড় করতে হবে। যদি প্রকাশকের সেই অর্থ না থাকে, তাহলে বুঝতে হবে প্রকাশনার বিষয়টি তার জন্য নয়- তাকে অন্য কোনো কাজ খুঁজে নিতে হবে। ঠিত একইভাবে নতুন লেখকের জন্যও বলতে হবে, যদি কোনো লেখক নিজের পকেটের টাকা দিয়ে একটা বই প্রকাশ করে থাকেন তাহলে বুঝতে হবে তার বইটি এখনও প্রকাশের উপযোগী হয়ে ওঠেনি। কেউ যদি সত্যি সত্যি লেখালেখি করতে চায়, তাহলে তাকে কোনোভাবেই নিজের টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করা চলবে না। এটি এক ধরনের অসম্মান। একজন সত্যিকারের লেখক কোনোভাবেই নিজেকে অসম্মানিত করতে পারে না। নতুন লেখকদের সবসময়ই বলতে শোনা যায়- তারা নতুন লেখক বলে কেউ তাদের লেখা ছাপতে চায় না। এ অভিযোগটি অনেক পুরনো, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সেটি মানতে রাজি ছিলেন না, তার বন্ধুদের বলেছিলেন, অভিযোগটি সত্যি নয়, ভালো লেখা হলেই ছাপা হবে। শুধু তাই নয়, বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে একেবারেই অপরিচিত নতুন লেখক হিসেবে তিনি ‘অতসী মামী’ নামে একটি গল্প লেখে সেই সময়কার সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত ম্যাগাজিনে ছাপিয়েছিলেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো উদাহরণ আমাদের দেশেও অনেক আছে। সবচেয়ে বড় কথা- এখন যারা প্রতিষ্ঠিত লেখক তারা সবাই একসময় নতুন লেখক ছিলেন, অপরিচিত লেখক ছিলেন। কাজেই নতুন লেখককে কেউ গুরুত্ব দেয় না এমন অভিযোগ আমি শুনতে রাজি নই। এখন ইন্টারনেট ও ব্লগ আছে, কাজেই নতুন লেখকরা সেখানে লেখালেখি করতে পারেন। সেখানে বুঝতে পারবেন তার লেখালেখি কতটুকু মানসম্মত হয়েছে। যদি লেখক হিসেবে তার একটা পরিচিতি হয়, তখন প্রকাশকরা আনন্দের সঙ্গে তার বই ছাপতে রাজি হবেন। আমি মনে করি, প্রতিষ্ঠিত লেখক, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক- তাদেরও একটা দায়িত্ব আছে। তাদের সবসময় ভালো তরুণ লেখকের খোঁজ করতে হবে। যদি কাউকে খুঁজে পান তাকে দশজনের সামনে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। বইমেলার আগেই যদি এই কাজটি করা যেত, তাহলে আরও ভালো হতো। নতুন ভালো লেখকরা অনুপ্রেরণা পেতেন, উৎসাহ পেতেন। আমাদের এত সুন্দর একটা বইমেলা, সেটা শুধু বই ছাপানোর মাঝে আটকে থাকবে, তা তো হতে পারে না। পাঠক, প্রকাশক, লেখক মিলে বইমেলার সত্যিকারের যে উদ্দেশ্য সেটাকেও তো সত্যি করে তুলতে হবে।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল : অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়; লেখক
No comments