কার স্বার্থে ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধন? by জি. মুনীর
গত
১৬ জানুয়ারি, ২০১৮ মন্ত্রিসভার প্রস্তাব অপরিবর্তিত রেখেই জাতীয় সংসদে পাস
হয়েছে ‘ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধনী) আইন ২০১৮’। ওই দিন ডেপুটি স্পিকার
অ্যাডভোকেট মো: ফজলে রাব্বি মিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রাতের অধিবেশনে এই
সংশোধনী পাস হয়। সংশোধনীটি পাস হওয়ার আগে তুমুল হট্টগোলের মধ্য দিয়ে সংসদ
থেকে ওয়াক আউট করেন সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ও স্বতন্ত্র সংসদ
সদস্যরা। তারা সংসদে কঠোর ভাষায় এই সংশোধনীর সমালোচনা করেন। তারা এই
সংশোধনীকে ব্যাংক খাত ধ্বংসের একটি ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করেন। সংসদে এই
বিলটি পাসের জন্য উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। পরে
কণ্ঠভোটে বিলটি সংসদে পাস হয়।
বিলটি পাসের আগে এর ওপর বিরোধীদলীয় সংসদ
সদস্য মো: ফখরুল ইমাম, নুরুল ইসলাম ওমর, নুরুল ইসলাম মিলন, বেগম রওশন আরা
মান্নান ও স্বতন্ত্র সদস্য ডা: রুস্তুম আলী ফরাজীর আনা জনমত যাচাই ও বাছাই
কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। বিলের ওপর জনমত যাচাই ও
বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব উত্থাপনের পর অর্থমন্ত্রী সে প্রস্তাব
গ্রহণে আপত্তি জানান। এ সময় বিরোধীদলীয় সদস্যরা বিলটির ওপর আলোচনার জন্য
আরো সময় চান। কিন্তু স্পিকারের আসনে থাকা ডেপুটি স্পিকার সময় দিতে অপারগতা
প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বিল পাসের এই প্রক্রিয়ায় সময় দেয়ার আর কোনো সুযোগ
নেই। এ নিয়ে বিরোধীদলীয় সদস্যরা হট্টগোল শুরু করেন। তখন স্পিকার সংশোধনী
প্রস্তাব নিয়ে কথা বলার জন্য বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান।
কিন্তু সে আহ্বানে বিরোধীদলীয় সদস্যরা সাড়া না দিয়ে সংসদ থেকে ওয়াক আউট
করেন। বিরোধীদলীয় চিপ হুইপের নেতৃত্বে তারা ওয়াক আউট করে চলে যাওয়ার পর,
স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বিলটি পাস হয়। আলোচ্য এই সংশোধিত আইনের মাধ্যমে
ব্যাংক কোম্পানির পরিচালকের মেয়াদ ও এক পরিবারে পরিচালক পদেও
সংখ্যাসংক্রান্ত বিষয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এই সংশোধনীর বিধান অনুযায়ী, এখন
থেকে একটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একই সাথে একই পরিবারের
সর্বোচ্চ চারজন পরিচালক হিসেবে থাকার সুযোগ পাবেন। সেই সাথে একই ব্যক্তি
একটানা ৯ বছর অর্থাৎ তিন মেয়াদে পরিচালক হিসেবে থাকতে পারবেন। এই ৯ বছর
পরিচালক পদে থাকার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তিন বছর অতিবাহিত না হলে তিনি আবার
পরিচালক হতে পারবেন না।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মূল ব্যাংক কোম্পানি আইন পাস হয়
১৯৯১ সালে। এর পরবর্তী সময়ে এই আইনের বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের
পরিচালকদের মেয়াদ সম্পর্কিত ধারাটি ছয়বার সংশোধন করা হলো। সর্বশেষ আলোচ্য
সংশোধনীর আগের সংশোধনীটি করা হয় ২০১৩ সালে। সে সংশোধনীর মতে, একই পরিবার
থেকে একটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে সর্বোচ্চ দু’জন পরিচালক
থাকার বিধান ছিল। তা ছাড়া কোনো পরিচালক একটানা দুই মেয়াদ তথা ছয় বছরের বেশি
সময় পরিচালক পদে বহাল থাকতে পারতেন না। ২০১৩ সালের সে সংশোধনীটিও আনে
আওয়ামী লীগ সরকারই। এখন তা আবার সংশোধন করল এই আওয়ামী সরকারই। কার স্বার্থে
এই সংশোধন করা হলো সে প্রশ্নটি এখন ব্যাংকপাড়ায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তেমনি তা
আলোচিত হচ্ছে সচেতন আমানতকারীদের মধ্যেও। প্রসঙ্গত উল্লেখ, যেকোনো বেসরকারি
ব্যাংকে সাধারণত ৯০ শতাংশ অর্থের মালিক সাধারণ মানুষ তথা আমানতকারীর। বাকি
১০ শতাংশের মালিক ব্যাংক মালিকেরা। সরকার এই ১০ শতাংশের মালিকের স্বার্থ
রক্ষা করতেই এবার আবারো ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে বাড়িয়ে তুলল
পরিচালকদের সুযোগ-সুবিধা। এই আইনের ফলে বর্তমানে যারা বেসরকারি ব্যাংকের
পরিচালক আছেন, তাদের ৯ বছরের মেয়াদের গণনা এখন থেকে নতুন করে শুরু হবে।
দেখা গেছে, প্রতিবার এ ধরনের সংশোধনীর সময় এই মেয়াদের গণনা নতুন করে শুরু
করা হয়। তা ছাড়া অর্থমন্ত্রী পরিবারের সংজ্ঞাও আরো সম্প্রসারিত করেছেন।
তিনি বলেছেন, কোনো পরিবারের কেউ আলাদা ব্যবসায় করলে এবং নিজেই করদাতা হলে
তাকে পরিবারের ওপর নির্ভরশীল বলা যাবে না।
এর অর্থ তাকে আলাদা পরিবার
হিসেবে গণ্য করা হবে। বিলটি সংসদে উত্থাপন করে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, এই
সংশোধনীর ফলে ব্যাংক খাতে গতিশীলতা আসবে এবং নতুন ব্যাংকগুলো যথাযথভাবে
পরিচালনায় তা সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা তার এই
অভিমতের সাথে একমত নন। বরং তারা বলছেন, এই সংশোধনী ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র
কায়েমের পথকেই আরো সুপ্রশস্ত করবে। আইন করে এভাবে ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র
প্রতিষ্ঠার তীব্র সমালোচনা করেছেন আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন,
ব্যাংক আইনের এ সংশোধন সুশাসনের পরিপন্থী, আমানতকারীর স্বার্থ ক্ষুণ্ন হতে
পারে, ব্যাংক খাতের পরিণতি আরো খারাপ হবে। আমানতকারীরা বলছেন, এই সংশোধন
জনবিরোধী। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা
আজিজুল ইসলাম তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ব্যাংক খাত এমনিতেই নানা সমস্যায়
জর্জরিত। এর মধ্যে এক পরিবার থেকে চারজন পরিচালক এবং টানা ৯ বছর পরিচালক
পদে থাকার সুযোগ দিতে আইনের এই সংশোধন অনাকাক্সিক্ষত। এটি ব্যাংক খাতের
সুশাসনের পরিপন্থী। এর ফলে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ
আরো বাড়বে, যা সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে বাধা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
ড. সালেহ উদ্দিন বলেছেন, ব্যাংক ও অন্যান্য কোম্পানি এক নয়। অন্যান্য
কোম্পানিতে উদ্যোক্তারা নিজেদের টাকায় ব্যবসায় পরিচালিত হয়। আর ব্যাংকের
টাকার বেশির ভাগই আমানতকারীদের। ফলে কোনো ব্যাংকে পুরোপুরি পারিবারিক
নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হলে, দীর্ঘ সময় কেউ ব্যাংকের পরিচালক থাকলে
আমানতকারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ কারণে তিনি ব্যাংক
কোম্পানি আইন এভাবে সংশোধন না করতে পরামর্শ দিয়ে আসছেন। তিনি বলেন, যেহেতু
এখন আইন পাস হয়েই গেছে সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে
আরো কঠোর হতে হবে। একজন পরিচালক বা ব্যবস্থাপক অন্যায় করলে তাকে শুধু বিদায়
করলেই হবে না, তার বিরুদ্ধে কঠোর প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
ব্যাংক আইনের এই সংশোধনের উদ্যোগ নেয়ার পর থেকে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। তার মতে,
এই সংশোধনীর পক্ষে ছিলেন ব্যাংকের মুষ্টিমেয় কয়েকজন পরিচালক।
শেয়ার মালিক,
গ্রাহক কিংবা ব্যাংক কর্মীদের কারো সমর্থন এতে ছিল না। দেশব্যাপী বিভিন্ন
মহলের প্রতিবাদ সত্ত্বেও এ আইন পাস করার কী প্রয়োজন ছিল, তা বোধগম্য নয়। এ
আইন পাসের ফলে ব্যাংক খাতের পরিণতি আরো খারাপ হবে বলে তিনি মনে করেন। তার
এই বক্তব্যের সারকথা দাঁড়ায়- ব্যাংক মালিকদের স্বার্থ রক্ষা করতেই ব্যাংক
আইন সংশোধনের এ ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে। সার্বিক ব্যাংক খাতের স্বার্থ কিংবা
আমানতকারীদের স্বার্থকে সামনে রেখে তা করা হয়নি। তিনি আরো বলেন, ‘একই
পরিবারে দুইজন পরিচালক থাকার সময় বেসরকারি ব্যাংক ‘ন্যাশনাল ব্যাংক’ একটি
শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক ছিল। যখনই ওই পরিবার থেকে পরিচালক হলেন পাঁচজন, তখন
থেকেই ব্যাংকটির পতনের শুরু হলো। আসলে আমরা যদি নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে এই
বিষয়টিকে দেখি, তবে বলতেই হবে- এই সংশোধনী কিছু ব্যক্তি বা পরিবারবিশেষের
স্বার্থকেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হয়েছে। সাধারণ মানুষ ও ব্যাংকের সাধারণ
গ্রাহকের কোনো উপকার বয়ে আনবে না। তা ছাড়া নিশ্চিতভাবে তা ব্যাংক খাতের
পেশাজীবীদের নিজস্ব পরিসরকে আরো সঙ্কুচিত করে ফেলবে। এর ফলে ব্যাংক
প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়বে। পরিবারতান্ত্রিক প্রবণতা
ব্যাংকের সার্বিক কার্যক্রমে স্বেচ্ছাচারিতা আরো বাড়িয়ে তুলবে। এই সংশোধনী
প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী বলছেন, এর ফলে কোনো ব্যাংকে পারিবারিক প্রাধান্য
বাড়াবে না। কিন্তু গত বছরের নভেম্বরে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, চট্টগ্রামের এস
আলম গ্রুপ ব্যাংক খাতকে কব্জায় নেয়ার চেষ্টা করছে। এই উদ্যোগকে তিনি
‘ন্যাস্টি স্টেপস’ বলে অভিহিত করেছিলেনন। তিনি বলেছিলেন, এই গ্রুপ
প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ গ্রুপের সংশ্লিষ্ট লোকজনের মাধ্যমে কমপক্ষে
পাঁচটি ব্যাংকের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। এমনটি ঘটেছিল তখন, যখন এক
পরিবার থেকে কোনো বেসরকারি ব্যাংকে দুইয়ের বেশি পরিচালক থাকার কোনো বিধান
ছিল না, একজন পরিচালক একটানা ছয় বছরের বেশি পরিচালক পদে থাকার কোনো সুযোগ
ছিল না। এখন এক পরিবার থেকে চারজন পরিচালক থাকা ও একটানা একজন পরিচালক ৯
বছর এ পদে থাকার নয়া সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়ে অর্থমন্ত্রী এস আলম গ্রুপের মতো
আরো কোনো গ্রুপের জন্য ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করার ‘ন্যাস্টি স্টেপস’ আরো
বাড়িয়ে দেয়ার নয়া পথ করে দিলেন কি না, তা তাকে ভেবে দেখতে হবে। আসলে ব্যাংক
মালিকেরা সবসময় সুযোগের সন্ধানে থাকেন, কী করে ব্যাংকগুলোতে পরিবারের
প্রভাব-প্রতিপত্তি আরো বাড়িয়ে তোলা যায়, কী করে ব্যাংকগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ
নিরঙ্কুশ করা যায়, ব্যাংক প্রতিষ্ঠানের ওপর পরিবারতন্ত্রকে স্থায়ী রূপ দেয়া
যায়। আলোচ্য সংশোধনীর পেছনে কলকাঠিটি প্রধানত নেড়েছেন ব্যাংক মালিকেরাই।
অন্য কোনো মহল থেকে এই সংশোধনীর জন্য সরকারের কাছে দাবি করেনি কিংবা
সরকারকে এ ধরনের পরামর্শ দেয়নি। ব্যাংক মালিকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস’ (বিএবি) গত বছরের মার্চে ব্যাংক কোম্পানি আইনের
বিভিন্ন ধারা সংশোধনের দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে
একটি প্রস্তাব পেশ করে। তাতে এ ধরনের সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছিল। আর এই
প্রস্তাবের বিষয়ে মতামত চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি পাঠায় অর্থ
মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। জানা যায়, ব্যাংক খাতের এই
নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ ধরনের সংশোধনীর বিপক্ষে মত দেয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের
মতামত উপেক্ষা করে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভা থেকে সংশোধনের প্রস্তাব পাস হয়।
তা ছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় বৈঠকের কার্যপত্র থেকে জানা যায়,
কমিটির সভাপতি আবদুর রাজ্জাক গত বছরের ২৯ অক্টোবর কমিটির বৈঠকে বলেছিলেন-
এক পরিবার থেকে চারজন একটানা ৯ বছর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন, এ
সুযোগ সৃষ্টির বিষয়গুলো পুনর্বিবেচিত হওয়া দরকার। কমিটির অন্য সদস্যরাও
কমিটির সভাপতির বক্তব্য সমর্থন করেছিলেন। বৈঠকে কমিটির সদস্য ফরহাদ হোসেন
বলেছিলেন, এই বিলটি পাস হলে ব্যাংক খাত আরো পরিবারকেন্দ্রিক হয়ে উঠবে। অন্য
আরেক সদস্য বেগম আখতার জাহানের অভিমত ছিল, বিলটি পাস হলে ব্যাংক খাত
পরিবারকেন্দ্রিক হবে, মানুষের আস্থা হারাবে এবং এ খাতে স্বৈরতন্ত্র
প্রতিষ্ঠা হবে। কিন্তু সংসদীয় কমিটির সদস্যদের এসব মতামতের প্রতি কোনো
গুরুত্ব না দিয়েই গত বছরের ২১ নভেম্বর কোনো ধরনের পরিবর্তন ছাড়াই বিলটি
পাসের সুপারিশ করে দেয় সংসদীয় কমিটি। কী অবাক করা বৈপরীত্য। বিলটি পাসের
দিনে সংসদ সদস্যদের বক্তব্যের মূল সুরটি ছিল ব্যাংক খাতে পরিবারতন্ত্র তথা
পারিবারিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এই প্রয়াসের বিরুদ্ধেই। তাদের উদ্বেগের
ক্ষেত্রটি ছিল এখানেই। সংসদে স্বতন্ত্র সদস্য ডা: রুস্তম আলী ফরাজী এই
বিলের বিরোধিতা করে বলেন, ব্যাংকগুলোতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়ার
পরিকল্পনা চলছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এর বিরুদ্ধে ছিলেন। পাকিস্তানের ২২
পরিবারের হাত থেকে অর্থ উদ্ধারে তিনি লড়াই করেছিলেন। কিন্তু সেই চেতনার
বিরুদ্ধে গিয়ে ব্যক্তিস্বার্থে এই আইনটি করা হচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন। অপর
দিকে, সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম সংসদে দাবি করেন, এর মাধ্যমে একটি পরিবারকেই
একটি ব্যাংকের মালিক করা হচ্ছে। তিনি বলেন, বিলটি পাস না করে প্রত্যাহার
করা হলে আমরা খুশি হবো। সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম ওমর বিলটি পাসের আগে জনমত
যাচাইয়ের প্রস্তাব করেন। তা ছাড়া অপর সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম মিলন দাবি
করেন, বিশেষ মহলের চাপে এ ধরনের আইন পাসের মাধ্যমে ব্যাংক খাত ধ্বংসের
চক্রান্ত চলছে। তিনি সংসদে এই চক্রান্ত বন্ধের দাবি তোলেন। তবে
অর্থমন্ত্রীর দাবি, তাদের আশঙ্কা অমূলক। সম্প্রতি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ
তথা সিপিডি সদ্য সমাপ্ত ২০১৭ সালটিকে বাংলাদেশের জন্য ‘ব্যাংক খাতের
কেলেঙ্কারি বছর’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং সংস্থাটি বলেছে, এই বছরটিতে
ব্যাংকের কুঋণ ও সঞ্চিতির ঘাটতি বেড়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে অপরিশোধিত ঋণ। একে
ব্যাংকগুলোতে গুটিকয়েক লোকের প্রাধান্য সৃষ্টি হয়েছে। আর জনগণের করের
টাকায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়,
রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেয়া নতুন ব্যাংকগুলো সঠিকভাবে কার্যকর না হয়ে
বরং জটিলতার সৃষ্টি করছে।
জড়িয়ে পড়ছে টাকা পাচারের সাথেও। এসব অনিয়মের
ক্ষেত্রে কোনো প্রতিষেধকের ব্যবস্থা না নিয়ে সরকার উল্টো ব্যাংক কোম্পানি
আইন সংশোধন করে সেখানে পরিবারতন্ত্র কায়েমের পথ করে দিয়েছে। সিপিডির এই
মূল্যায়ন যে অহেতুক নয়, তার প্রতিফলন আমরা দেখতে পেয়েছি গত বৃহস্পতিবারের
জাতীয় সংসদ অধিবেশনে। ওই দিন ‘ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনিয়ম ও
ত্রুটিমুক্তভাবে পরিচালিত করার জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা
হোক’ শীর্ষক এক সিদ্ধান্ত প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় সরকার ও বিরোধীদলীয়
এমপিরা এ খাতের বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরেন এবং অর্থমন্ত্রীকে
আত্মপক্ষসমর্থন করে বলতে হয়েছে- ব্যাংক খাতের সব ব্যবস্থা ত্রুটিমুক্ত ছিল
না। উল্লিখিত সিদ্ধান্ত প্রস্তাবের পক্ষ সমর্থন করে সরকারি দলের এমপি আলম
সংসদে বলেন, ‘ব্যাংক খাত ও আর্থিক খাত নিয়ে সব সময় কোনো না কোনো বিতর্কে
আমাদের বিব্রত, বাকরুদ্ধ ও হতাশ হতে হয়। যারা আইন প্রয়োগের দায়িত্বে আছেন,
তাদের ব্যর্থতার কারণে ব্যাংক খাত সঙ্কটে পড়েছে। এতে আওয়ামী লীগকেও বিব্রত
হতে হচ্ছে। ব্যাংক খাতের বিশৃঙ্খলার কারণে দেশের আর্থিক খাত ক্ষতিগ্রস্ত
হচ্ছে। ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। ব্যাংকের পরিচালকেরা
এর সাথে জড়িত, এটি সাদা চোখেই স্পষ্ট হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া
হয়নি।’ শেষ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রীর অনুরোধে ইসরাফিল আলম এই সিদ্ধান্ত
প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেন। জানি না, সদ্য শুরু হওয়া ২০১৮ সালটিকে বছর
শেষে কী নামে সিপিডিকে অভিহিত করতে হয়। তবে শুরুতেই, আশাবাদী হওয়ার মতো
কিছু দেখা যাচ্ছে না। কারণ, ২০১৭ সালের ব্যাংক খাতের সম্পর্কে সিপিডির
মূল্যায়নকে পত্রপাঠ নাকচ করে দিয়েছেন সিপিডির বিরুদ্ধে সমালোচনার তীর ছুড়ে।
তা ছাড়া, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করার বিষয়টি থেকে আন্দাজ অনুমান করা
যায়, সরকার সাধারণ আমানতকারীর স্বার্থ রক্ষা ও ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে
আনার ব্যাপারে মোটেও আগ্রহী নয়।
No comments