চা: একটি শব্দের ইতিবৃত by মাহমুদ ফেরদৌস
কিছু
ছোটখাটো ব্যতিক্রম বাদে, পৃথিবীর সকল ভাষায় চা-কে বোঝানোর জন্য দু’টি শব্দ
(বা কাছাকাছি ধাঁচের শব্দ) ব্যবহার করা হয়। একটি হলো ইংরেজিতে যেটা
পরিচিত, অর্থাৎ ‘টি’ দিয়ে। যেমন, স্প্যানিশ ভাষায় চাকে বলা হয় ‘টে’ আর
আফ্রিকান্সে বলা হয় ‘টী’। আরেকটি শব্দ হলো ‘চা’। যেমন, বাংলাতে বলা হয় ‘চা’
আর হিন্দিতে ‘চায়ে’।
‘টি’ ও ‘চা’ দু’টিই কিন্তু চীনা শব্দ। এই শব্দ দু’টি পৃথিবীতে কীভাবে ছড়িয়েছে তার দিকে খেয়াল করলে বোঝা সম্ভব যে, ‘বিশ্বায়ন’ শব্দটি কেউ ব্যবহারের আগে পৃথিবীতে বিশ্বায়ন কীভাবে ঘটেছিল।
‘চা’ শব্দটি মূলত ছড়িয়েছে প্রাচীন সিল্ক রোডের ভূমি পথে।
অপরদিকে ‘টি’ শব্দটি ছড়িয়েছে সমুদ্র বা পানি পথে। চাকে ‘টি’ হিসেবে পরিচিত করার পেছনে ওলন্দাজ (ডাচ) বণিকদের বড় ভূমিকা ছিল। তারাই সুদূর চীন থেকে চা নিয়ে যান ইউরোপে।
‘চা’ শব্দটি চীনা ভাষার বহু সংস্করণেই ব্যবহৃত হয়। চীন থেকে চা যখন সড়ক পথে মধ্য এশিয়ায় ঢুকে পড়ে, তখন একে ‘চা’ই বলা হতো। ফার্সি ভাষায় এটি হয়ে যায় ‘চায়’। এটি নিশ্চিতভাবেই সিল্ক বাণিজ্য পথের বদৌলতে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, সিল্ক রোডে ২০০০ বছর আগেও চা নিয়ে বাণিজ্য হতো।
ধীরে ধীরে পারস্য ছাড়িয়ে ‘চা’ শব্দটি পৌঁছে যায় অন্যত্র। হিন্দির মতো উর্দু আর রাশিয়ান ভাষায়ও এটি হয়ে উঠে ‘চায়ে,’ আরবিতে হয়ে যায় ‘সায়ে’। এমনকি সাব-সাহারান আফ্রিকান দেশগুলোতে চা ছড়িয়ে পড়ে। সাহিলি ভাষায় একে ‘চাই’ বলা হতে থাকে। জাপান ও কোরিয়ান ভাষায়ও চাকে সেই ‘চা’-ই বলা হয়। তবে পারস্য হয়ে অন্যত্র ‘চা’ শব্দটি ছড়িয়ে পড়ারও অনেক আগে থেকেই কোরিয়া ও জাপানে ‘চা’ শব্দটি ব্যবহৃত হতো।
এতক্ষণ তো ‘চা’র উপাখ্যান বলা হলো। কিন্তু চাকে ‘টি’ বলা হয় কেন? চীনা ভাষায় চা-কে একই বর্ণ দিয়েই লেখা হয়। কিন্তু এই ভাষার কিছু সংস্করণে ওই বর্ণকে বা অক্ষরকে উচ্চারণ করা হয় ভিন্নভাবে। এই কারণে একই শব্দকে বেশিরভাগ সংস্করণে ‘চা’ হিসেবে উচ্চারণ করা হলেও, কিছু সংস্করণে ‘টে’ বলা হতো। বর্তমান যুগের মান্দারিন (চীনা) ভাষায় একে ‘চা’ বলা হয়। তবে ভাষাটির ‘মিন নান’ সংস্করণে, যেটি চীনের উপকূলীয় ফুজিয়ান প্রদেশের মানুষ ব্যবহার করে, সেখানে চা-কে বলা হয় ‘টে’।
স্বাভাবিকভাবেই, সাগর তীরবর্তী উপকূলীয় অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্য সমুদ্রপথে হতো। আর উপকূলীয় অঞ্চলের চীনা ভাষায় ‘টে’ শব্দটি ব্যবহার হওয়ায়, সমুদ্রপথের বণিকরা চাকে ‘টে’ হিসেবেই বর্ণনা করা শুরু করলেন। গোলন্দাজ বণিকরা তখন সমুদ্রপথেই চীনের সঙ্গে বাণিজ্য করতেন। ফলে, তাদের বদৌলতে ওই উপকূলীয় শব্দটি অর্থাৎ ‘টি’ পরিচিত হয়ে উঠে ইউরোপে। এটি সপ্তদশ শতকের কথা। ওয়ার্ল্ড আটলাস অব ল্যাঙ্গুয়েজ স্ট্রাকচার বইয়ে এটির বিস্তারিত বর্ণনা আছে।
এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য তখন গোলন্দাজরাই করতো। পূর্ব এশিয়ায় গোলন্দাজদের প্রধান বন্দর ছিল ফুজিয়ান ও তাইওয়ান। এই দুই উপকূলীয় প্রদেশের চীনারা চাকে ‘টে’ হিসেবে উচ্চারণ করতো। আর তাই গোলন্দাজরা যখন ব্যপক হারে চা নিয়ে গেল ইউরোপে, তখন ফরাসি ভাষায় এটি হয়ে উঠে ‘টেঁ’, জার্মান ভাষায় ‘টী’ আর ইংরেজিতে ‘টি’।
আবার এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে বেশি ব্যবসা ওলন্দাজরা করলেও সবার আগে ব্যবসাটা শুরু করে কিন্তু পর্তুগিজরা। তাইওয়ান যখন ইউরোপের উপনিবেশ ছিল তখন দেশটির নাম ছিল ফরমোসা। এই নাম কিন্তু পর্তুগিজদের দেওয়া। পর্তুগিজ বণিকরা আবার ওলন্দাজদের মতো ফুজিয়ান দিয়ে বাণিজ্য করতো না। তারা ব্যবহার করতো ম্যাকাও। আর ম্যাকাওয়ে চা-কে ‘চাঁ’ বলা হতো। তাই ইউরোপে শুধু পর্তুগিজ ভাষাতেই চাকে ‘চা’ বলা হয়।
অর্থাৎ, যেসব অঞ্চলে চা সমুদ্রপথে পৌঁছালো, সেসব দেশে একে বলা হয় ‘টে’। শুধু পর্তুগিজ ব্যতিক্রম। আর যেসব দেশে সড়ক পথে বা সিল্ক রোডে ছড়িয়েছে চা, সেখানে একে ‘চা’-ই বলা হয়।
পৃথিবীতে খুল অল্প ভাষাই আছে যেখানে চা-কে ‘চা’ অথবা ‘টি’ বা এদের কাছাকাছি কিছু বলা হয় না। এসব ভাষাগুলো এমন সব অঞ্চলের ভাষা যেখানে চা প্রাকৃতিকভাবেই জন্মাতো। এ কারণে স্থানীয়রা নিজেরাই এই উদ্ভিদের নিজেদের মতো করে নাম দিয়েছিল। যেমন, বার্মিজ ভাষায় চা পাতাকে বলা হয় ‘লাকফাক’।
(কোয়ার্টজ অবলম্বনে)
‘টি’ ও ‘চা’ দু’টিই কিন্তু চীনা শব্দ। এই শব্দ দু’টি পৃথিবীতে কীভাবে ছড়িয়েছে তার দিকে খেয়াল করলে বোঝা সম্ভব যে, ‘বিশ্বায়ন’ শব্দটি কেউ ব্যবহারের আগে পৃথিবীতে বিশ্বায়ন কীভাবে ঘটেছিল।
‘চা’ শব্দটি মূলত ছড়িয়েছে প্রাচীন সিল্ক রোডের ভূমি পথে।
অপরদিকে ‘টি’ শব্দটি ছড়িয়েছে সমুদ্র বা পানি পথে। চাকে ‘টি’ হিসেবে পরিচিত করার পেছনে ওলন্দাজ (ডাচ) বণিকদের বড় ভূমিকা ছিল। তারাই সুদূর চীন থেকে চা নিয়ে যান ইউরোপে।
‘চা’ শব্দটি চীনা ভাষার বহু সংস্করণেই ব্যবহৃত হয়। চীন থেকে চা যখন সড়ক পথে মধ্য এশিয়ায় ঢুকে পড়ে, তখন একে ‘চা’ই বলা হতো। ফার্সি ভাষায় এটি হয়ে যায় ‘চায়’। এটি নিশ্চিতভাবেই সিল্ক বাণিজ্য পথের বদৌলতে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, সিল্ক রোডে ২০০০ বছর আগেও চা নিয়ে বাণিজ্য হতো।
ধীরে ধীরে পারস্য ছাড়িয়ে ‘চা’ শব্দটি পৌঁছে যায় অন্যত্র। হিন্দির মতো উর্দু আর রাশিয়ান ভাষায়ও এটি হয়ে উঠে ‘চায়ে,’ আরবিতে হয়ে যায় ‘সায়ে’। এমনকি সাব-সাহারান আফ্রিকান দেশগুলোতে চা ছড়িয়ে পড়ে। সাহিলি ভাষায় একে ‘চাই’ বলা হতে থাকে। জাপান ও কোরিয়ান ভাষায়ও চাকে সেই ‘চা’-ই বলা হয়। তবে পারস্য হয়ে অন্যত্র ‘চা’ শব্দটি ছড়িয়ে পড়ারও অনেক আগে থেকেই কোরিয়া ও জাপানে ‘চা’ শব্দটি ব্যবহৃত হতো।
এতক্ষণ তো ‘চা’র উপাখ্যান বলা হলো। কিন্তু চাকে ‘টি’ বলা হয় কেন? চীনা ভাষায় চা-কে একই বর্ণ দিয়েই লেখা হয়। কিন্তু এই ভাষার কিছু সংস্করণে ওই বর্ণকে বা অক্ষরকে উচ্চারণ করা হয় ভিন্নভাবে। এই কারণে একই শব্দকে বেশিরভাগ সংস্করণে ‘চা’ হিসেবে উচ্চারণ করা হলেও, কিছু সংস্করণে ‘টে’ বলা হতো। বর্তমান যুগের মান্দারিন (চীনা) ভাষায় একে ‘চা’ বলা হয়। তবে ভাষাটির ‘মিন নান’ সংস্করণে, যেটি চীনের উপকূলীয় ফুজিয়ান প্রদেশের মানুষ ব্যবহার করে, সেখানে চা-কে বলা হয় ‘টে’।
স্বাভাবিকভাবেই, সাগর তীরবর্তী উপকূলীয় অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্য সমুদ্রপথে হতো। আর উপকূলীয় অঞ্চলের চীনা ভাষায় ‘টে’ শব্দটি ব্যবহার হওয়ায়, সমুদ্রপথের বণিকরা চাকে ‘টে’ হিসেবেই বর্ণনা করা শুরু করলেন। গোলন্দাজ বণিকরা তখন সমুদ্রপথেই চীনের সঙ্গে বাণিজ্য করতেন। ফলে, তাদের বদৌলতে ওই উপকূলীয় শব্দটি অর্থাৎ ‘টি’ পরিচিত হয়ে উঠে ইউরোপে। এটি সপ্তদশ শতকের কথা। ওয়ার্ল্ড আটলাস অব ল্যাঙ্গুয়েজ স্ট্রাকচার বইয়ে এটির বিস্তারিত বর্ণনা আছে।
এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য তখন গোলন্দাজরাই করতো। পূর্ব এশিয়ায় গোলন্দাজদের প্রধান বন্দর ছিল ফুজিয়ান ও তাইওয়ান। এই দুই উপকূলীয় প্রদেশের চীনারা চাকে ‘টে’ হিসেবে উচ্চারণ করতো। আর তাই গোলন্দাজরা যখন ব্যপক হারে চা নিয়ে গেল ইউরোপে, তখন ফরাসি ভাষায় এটি হয়ে উঠে ‘টেঁ’, জার্মান ভাষায় ‘টী’ আর ইংরেজিতে ‘টি’।
আবার এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে বেশি ব্যবসা ওলন্দাজরা করলেও সবার আগে ব্যবসাটা শুরু করে কিন্তু পর্তুগিজরা। তাইওয়ান যখন ইউরোপের উপনিবেশ ছিল তখন দেশটির নাম ছিল ফরমোসা। এই নাম কিন্তু পর্তুগিজদের দেওয়া। পর্তুগিজ বণিকরা আবার ওলন্দাজদের মতো ফুজিয়ান দিয়ে বাণিজ্য করতো না। তারা ব্যবহার করতো ম্যাকাও। আর ম্যাকাওয়ে চা-কে ‘চাঁ’ বলা হতো। তাই ইউরোপে শুধু পর্তুগিজ ভাষাতেই চাকে ‘চা’ বলা হয়।
অর্থাৎ, যেসব অঞ্চলে চা সমুদ্রপথে পৌঁছালো, সেসব দেশে একে বলা হয় ‘টে’। শুধু পর্তুগিজ ব্যতিক্রম। আর যেসব দেশে সড়ক পথে বা সিল্ক রোডে ছড়িয়েছে চা, সেখানে একে ‘চা’-ই বলা হয়।
পৃথিবীতে খুল অল্প ভাষাই আছে যেখানে চা-কে ‘চা’ অথবা ‘টি’ বা এদের কাছাকাছি কিছু বলা হয় না। এসব ভাষাগুলো এমন সব অঞ্চলের ভাষা যেখানে চা প্রাকৃতিকভাবেই জন্মাতো। এ কারণে স্থানীয়রা নিজেরাই এই উদ্ভিদের নিজেদের মতো করে নাম দিয়েছিল। যেমন, বার্মিজ ভাষায় চা পাতাকে বলা হয় ‘লাকফাক’।
(কোয়ার্টজ অবলম্বনে)
No comments