টয়লেট ছাড়া এই বাড়ির ভাড়া কত?
কারও বাসায় নেমন্তন্ন খেতে গেলে যা হয়, টেবিলের আইটেমগুলোর কোন্টা রেখে কোন্টা তুলি, এই মুহূর্তে আমার অবস্থা অনেকটা তেমন। এত সাবজেক্ট, ঘনঘটাই বটে, আবার সবই গুরুত্বপূর্ণ, লটারির মাধ্যমে পিক করার জোগাড়। সপ্তাহে একটাই তো কলাম লিখি, অনেক ভাবনাই কিল করতে হয়, পরে আর প্রাসঙ্গিকতা থাকে না বলে। ডেড হর্সের মুখ কে দেখতে চায়? তো এবার দুটি আলাদা বিষয় ছোট ছোট করে লিখছি। সাবজেক্ট দুটি যে আলাদা, বলার দরকার ছিল না। কিন্তু আমি এমন পাঠকও দেখেছি, কোনো কলাম ১ ও ২- এভাবে স্পষ্ট ভাগ করা থাকলেও তারা উপর-নিচের পরম্পরা খোঁজেন এবং তা না পেয়ে ভাবেন আমি আবোল-তাবোল বকছি।
১. আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলীয় স্টেট কলোরাডোয় বছর ত্রিশেক আগে ক্যাথেলিন নামের এক মেয়েকে ধর্ষণের দায়ে ধর্ষকের ৮ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। ৪ বছর পর, অর্ধেক দণ্ডভোগ শেষ হয়েছে যখন তার, এক কান-দু’কান হতে হতে সারা আমেরিকায় চাউর হয়ে গেল যে, ক্যাথেলিন তার বান্ধবীদের কাছে বলেছে তাকে ধর্ষণ করা হয়নি, দুজনের সম্মতিতেই ঘটেছিল ব্যাপারটি। সে আসলে কিছুদিন আগের বিশেষ এক ঘটনায় মনে মনে রাগ পুষে রেখেছিল দণ্ডপ্রাপ্তের প্রতি এবং প্রতিশোধ নিতেই ধর্ষণের অভিযোগ এনেছিল। বাক্যের শুরুতে ‘বলা বাহুল্য’ লিখতে নেই, সেক্ষেত্রে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন বলাটা যদি বাহুল্যই হয়, তাহলে লিখলাম কেন? তারপরও লিখছি- বলা বাহুল্য, আমেরিকার সমাজে সম্মতির এক্সট্রা-ম্যারিটাল সেক্স কোনো অপরাধের মধ্যেই পড়ে না। দেশটির এক প্রেসিডেন্ট কেনেডি অন্তত একবার ১৯৬২ সালের কোনো এক রাতে ক্যালিফোর্নিয়ার চমৎকার শহর পাম স্প্রিংসে যৌনাবেদনময়ী চিত্রনায়িকা মেরিলিন মনরোর সঙ্গে এ ধরনের সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন। সেটা উভয়েরই সম্মতিতে ঘটেছিল বলেই অসংখ্য সারকামাসটেন্সিয়াল এভিডেন্স থাকার পরও সবাই ছিল ‘স্পিকটি নট’।
১. আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলীয় স্টেট কলোরাডোয় বছর ত্রিশেক আগে ক্যাথেলিন নামের এক মেয়েকে ধর্ষণের দায়ে ধর্ষকের ৮ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। ৪ বছর পর, অর্ধেক দণ্ডভোগ শেষ হয়েছে যখন তার, এক কান-দু’কান হতে হতে সারা আমেরিকায় চাউর হয়ে গেল যে, ক্যাথেলিন তার বান্ধবীদের কাছে বলেছে তাকে ধর্ষণ করা হয়নি, দুজনের সম্মতিতেই ঘটেছিল ব্যাপারটি। সে আসলে কিছুদিন আগের বিশেষ এক ঘটনায় মনে মনে রাগ পুষে রেখেছিল দণ্ডপ্রাপ্তের প্রতি এবং প্রতিশোধ নিতেই ধর্ষণের অভিযোগ এনেছিল। বাক্যের শুরুতে ‘বলা বাহুল্য’ লিখতে নেই, সেক্ষেত্রে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন বলাটা যদি বাহুল্যই হয়, তাহলে লিখলাম কেন? তারপরও লিখছি- বলা বাহুল্য, আমেরিকার সমাজে সম্মতির এক্সট্রা-ম্যারিটাল সেক্স কোনো অপরাধের মধ্যেই পড়ে না। দেশটির এক প্রেসিডেন্ট কেনেডি অন্তত একবার ১৯৬২ সালের কোনো এক রাতে ক্যালিফোর্নিয়ার চমৎকার শহর পাম স্প্রিংসে যৌনাবেদনময়ী চিত্রনায়িকা মেরিলিন মনরোর সঙ্গে এ ধরনের সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন। সেটা উভয়েরই সম্মতিতে ঘটেছিল বলেই অসংখ্য সারকামাসটেন্সিয়াল এভিডেন্স থাকার পরও সবাই ছিল ‘স্পিকটি নট’।
বিপরীত চিত্রটি দেখুন। আরেক প্রেসিডেন্ট ক্লিনটকে ইমপিচমেন্টের মুখোমুখি হতে হয়েছিল মনিকা লিউনিস্কির সঙ্গে এক্সট্রা-ম্যারিটাল সেক্সের কারণে। তিনি ২২ বছর বয়সী মনিকাকে পরিকল্পিতভাবে হোয়াইট হাউসে ইন্টার্ন হিসেবে নিয়োগ দিয়ে ম্যানিপুলেট করে তাকে ফাঁদে ফেলেছিলেন। চ্যানেল টুয়েন্টি-টুয়েন্টিতে বারবারা ওয়াল্টার্সকে দেয়া মনিকার সাক্ষাৎকারটি আমি আমেরিকায় বসেই দেখেছিলাম। ঘণ্টাধিককালের সেই ইন্টারভিউয়ের এক পর্যায়ে তিনি তার চাপা কান্না চেপে রাখতে পারেননি, উদগত কান্না খুব কষ্টে সংবরণ করতে পারলেও হৃদয়বানদের ফাঁকি দিতে পারেননি। ক্লিনটনের প্রতি তখনও আবেগের রেশ ছিল বলে তিনি সত্য-মিথ্যার মাঝামাঝি হেঁটেছিলেন সাক্ষাৎকারে। সে যাক। ক্যাথেলিনের সম্মতিতেই যৌনসম্পর্ক হয়েছে, এটা জানাজানির পর তোলপাড় শুরু হয়ে গেল দেশটির সর্বত্র। তার নতুন কথার মানে এই যে, আমেরিকার মতো দেশেও নিরপরাধ জেল খাটতে পারে। বিচারব্যবস্থায় এত ফাঁক থাকার পরও কেন এই AnsKvi- We, the American! নিলীমিত চোখের মতোই মুদিতে হইবে এই ফাঁক। বিষয়টা চলে গেল লিগ্যাল এক্সপার্টদের কাছে। তারা অবশ্য আগে থেকেই জানতেন, ধর্ষণের যেহেতু প্রত্যক্ষ সাক্ষী থাকে না (ভারত কিংবা বাংলাদেশেও প্রকাশ্যে ট্রেন-বাসের ধর্ষণের ঘটনাগুলো সংঘটিত মোট ধর্ষণের অতি ক্ষুদ্রাংশ। এই social phenomenonwটির বয়সও খুব বেশি নয়), সেহেতু অভিযোগকারিণীর স্টেটমেন্ট, মেডিকেল রিপোর্ট ও সারকামাসটেন্সিয়াল এভিডেন্সের ভিত্তিতেই বিচারকার্য সম্পন্ন করতে হয়। তো ডাক্তারি পরীক্ষায় জানার উপায় থাকে না যৌনমিলনটি উভয়ের সম্মতিতে ঘটেছে, নাকি male sex খাটিয়েছিল জবরদস্তি। বর্তমানে অবশ্য two finger testmn আরও কিছু পরীক্ষার দ্বারা এ প্রশ্নের মীমাংসা করা যাচ্ছে, ত্রিশ বছর আগে পৃথিবীর কোথাও ছিল না এই সুবিধা।
তো ডাক্তারি পরীক্ষার সীমাবদ্ধতার কারণে এবং সারকামাসটেন্সিয়াল এভিডেন্স যেহেতু কম গুরুত্বের পরোক্ষ সাক্ষ্য, সেহেতু এক্সপার্টরা বললেন, একটাই উপায় আছে আর তা হল অভিযোগকারিণী আদালতে মিথ্যা বলছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার কার্যকর পদ্ধতি বের করতে হবে। লিগ্যাল এক্সপার্টদের পাট চুকে গিয়ে এবার সমস্যাটা ঠাঁই নিল মনোবিজ্ঞানীদের দরবারে। মিথ্যা ধরতে হবে। তারা বললেন- মিথ্যা বলার সময় কিছু সিম্পটম থাকে বলার ভঙ্গিতে। কথা বলতে বলতে কথক NbNb pause নেয় (কিছুক্ষণ থেমে থাকা), rhetoric (বাক্যালঙ্কার) ব্যবহার করে, যেমন-‘টু বি ভেরি ফ্র্যাংক’, ‘আই মিন’, ‘সো টু সে’ ইত্যাদি। চেহারায় ফুটে ওঠে এক ধরনের বিশেষ বিষণ্ণতাও। মনোবিজ্ঞানীদের এসব রিকমেন্ডেশনের পরও সমস্যাটি troubling questionB থেকে যায় দুটি কারণে। প্রথম কারণটা lie detector যে কারণে নিখুঁতভাবে মিথ্যা শনাক্ত করতে পারে না, তেমন। মিথ্যা শনাক্তকারী এই যন্ত্রের সামনে একজন সৎ লোকও নার্ভাস হয়ে পড়তে পারে, আবার অসৎ থাকতে পারে নিরুদ্বিগ্ন। ফলে তার ফিজিওলজিক্যাল ফাংশনগুলো সত্য বা মিথ্যার পক্ষে সঠিক রিডিং না-ও দিতে পারে। তেমনি আদালতের কাঠগড়ায়ও অভিযোগকারিণী নিরুদ্বেগে মিথ্যা বলে যেতে পারে এবং সেক্ষেত্রে আগে বলা সিম্পটমগুলো না-ও দেখা দিতে পারে। দ্বিতীয় কারণটি খুব উচ্চমার্গের চিন্তা। কথিত ধর্ষণের সময়টি ও বিচারকার্য চলার সময়- দুটি আলাদা প্রেক্ষিত।
এই মুহূর্তে যা সত্য বলে মনে হয়, আরেকটা সময়ে সেটাই মনে হতে পারে মিথ্যা। মনিকা লিউনিস্কির ক্ষেত্রে যেমনটা আংশিক ঘটেছিল। গল্পটা বড় হয়ে গেল। এর প্রয়োজন ছিল। ফরহাদ মজহারকেন্দ্রিক সাম্প্রতিক কথাবার্তা ও ঘটনাপ্রবাহে একটি কঠিন চিন্তা আমাদের আরও বেশি করে ভাবাচ্ছে যে, বাংলাদেশে এখন সত্যের সন্ধান পাওয়া ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভের মতোই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, প্রকৃত দোষীও যদি আইনের জালে আটকা পড়ে আদালতের রায়ে শাস্তি পায়, সন্দেহ জাগে মামলা সাজানোর কারসাজিতে বিচারক বিভ্রান্ত হয়েছিলেন কিনা। ইলিয়াস আলী রহস্য, সাগর-রুনী ও পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী হত্যার সত্য এখনও জানতে পারিনি; জঙ্গিদের পাকড়াও অভিযানের পর র্যাব-পুলিশের সব ভার্সনই যে সত্য, সে ব্যাপারেও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। ব্যক্তিগতভাবে আমি এমন এক মানসিক স্তরে রয়েছি যে, ইসলামের ইতিহাসের ছদ্মাবরণে ওয়াজ-মাহফিলে রাজনৈতিক স্বার্থে বানানো সাঈদীর গল্পগুলো যেমন বিশ্বাস করি না, তেমনি সাক্ষাৎ-প্রমাণ ছাড়া বিতর্কিত কোনো বিষয়েই নিজের মতামত দিতে মন সায় দেয় না। অবস্থাটা লক্ষ করুন। ইংরেজিতেই বলি- truth does not necessarily lie in between, it may lie somewhere else- কোনো বিষয়ে দুই বা ততোধিক পরস্পরবিরোধী মন্তব্য করা হয় যখন, আমরা সেগুলোর মধ্য থেকেই সত্য বাছাই করে আলাদা করতে চাচ্ছি, অথচ এমনও হতে পারে সব পক্ষই মিথ্যা, সত্য চৌধুরী লুকিয়ে আছেন অন্য কোথাও।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, lie detector দিয়ে কোনো লাভ তো হবেই না, truth detectorI ফলদায়ক হতে পারবে না, কারণ এই ডিটেক্টরের সামনে সত্য উপস্থাপিত না হলে সেটা কী ডিটেক্ট করবে? হাস্যরস হলেও বলতে হচ্ছে, এখন প্রয়োজন পড়েছে আসলে truth searcher যন্ত্র, সত্য যেখানেই লুকিয়ে থাকুক না কেন, যাতে তা খুঁজে বের করা যায়। মিথ্যা শনাক্ত করে আমাদের কী লাভ, আমরা তো জানতে চাই সত্য। বাংলাদেশে কত অসংখ্য ঘটনা বা বিষয়ে আমরা বিভ্রান্ত হয়েছি, সত্যকে আদর করতে পারিনি, সেই তালিকা অনেক দীর্ঘ। সেগুলো বলতে গেলে পরের সাবজেক্টের জন্য স্পেস কমে যাবে। আমরা দ্রুত শেষ করতে চাই। আমার এ কথাটি আরেক কলামে লিখেছিলাম- মিথ্যার একটি গুণ এই যে, সে শ্রোতার কাছ থেকে বিশ্বাসযোগ্যতা দাবি করে। যে মিথ্যায় বিশ্বাসযোগ্যতার কণামাত্র উপাদান নেই, তা মিথ্যা নয়, উদ্ভট। আবার সত্যের একটি দোষ হল, সে কখনও কখনও মিথ্যার মতো বেজে ওঠে। দেশে এক ধরনের রাজনৈতিক যুদ্ধ চলছে, যে যুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্রের বদলে ব্যবহৃত হচ্ছে জিহ্বার শক্তি। এ অবস্থায় সত্যের সন্ধান করতে চাওয়া গণ্ডমূর্খতাই বটে। কারণ যুদ্ধবিগ্রহের পুরনো এই পৃথিবীতে অনেক আগেই কেউ একজন বলে রেখেছেন- Mr. truth is the first casualty of war- যুদ্ধে সবচেয়ে আগে নিহত হন সত্যবাবু। অতঃপর চলমান যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সত্য ও মিথ্যার দোলাচলেই দুলতে হবে আমাদের।
২. এক ভদ্রলোক বাড়ি ভাড়া ঠিক করতে গেছেন। পছন্দসই একটি ফ্ল্যাটের ভাড়া কত জিজ্ঞেস করায় মালিক বললেন, ১৮ হাজার টাকা। ভদ্রলোক বললেন, আপনার ফ্ল্যাটগুলো তো সুন্দর, তা টয়লেট ছাড়া ভাড়া কত? মালিককে অপ্রস্তুত দেখে তিনি বলেই চলেন- আমি বেতন পাই ৩০ হাজার টাকা, এক ছেলে ও এক মেয়ের স্কুলে যাতায়াত ও তাদের টিউটর মিলিয়ে খরচ হয় ৬ হাজার, আমার কনভেন্স ২ হাজার, বউয়ের ওষুধ ১ হাজার, বিপদে পড়ে অফিস থেকে লোন নিয়েছিলাম, সেজন্য কাটা হয় ৩ হাজার, আপনাকে যদি ১৮ হাজার দেই, তাহলে টাকা শেষ। এরপর আমি খাব কী? আর যদি না-ই খাই, কাঁচামাল ছাড়া ফিনিশড প্রোডাক্ট উৎপন্ন হবে কীভাবে? পেট তো সবসময় খালিই পড়ে থাকবে। টয়লেট দিয়ে কী করব আমি? ভদ্রলোকের হিসাবটা কোনো চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট দিয়ে অডিট করানো যেতে পারে। হিসাব পাক্কা, একটাও দু’নম্বরী ভাউচার নয়। এখন তিনি কী সিদ্ধান্ত নেবেন? ১২ হাজার টাকার বাসায় উঠবেন?
২. এক ভদ্রলোক বাড়ি ভাড়া ঠিক করতে গেছেন। পছন্দসই একটি ফ্ল্যাটের ভাড়া কত জিজ্ঞেস করায় মালিক বললেন, ১৮ হাজার টাকা। ভদ্রলোক বললেন, আপনার ফ্ল্যাটগুলো তো সুন্দর, তা টয়লেট ছাড়া ভাড়া কত? মালিককে অপ্রস্তুত দেখে তিনি বলেই চলেন- আমি বেতন পাই ৩০ হাজার টাকা, এক ছেলে ও এক মেয়ের স্কুলে যাতায়াত ও তাদের টিউটর মিলিয়ে খরচ হয় ৬ হাজার, আমার কনভেন্স ২ হাজার, বউয়ের ওষুধ ১ হাজার, বিপদে পড়ে অফিস থেকে লোন নিয়েছিলাম, সেজন্য কাটা হয় ৩ হাজার, আপনাকে যদি ১৮ হাজার দেই, তাহলে টাকা শেষ। এরপর আমি খাব কী? আর যদি না-ই খাই, কাঁচামাল ছাড়া ফিনিশড প্রোডাক্ট উৎপন্ন হবে কীভাবে? পেট তো সবসময় খালিই পড়ে থাকবে। টয়লেট দিয়ে কী করব আমি? ভদ্রলোকের হিসাবটা কোনো চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট দিয়ে অডিট করানো যেতে পারে। হিসাব পাক্কা, একটাও দু’নম্বরী ভাউচার নয়। এখন তিনি কী সিদ্ধান্ত নেবেন? ১২ হাজার টাকার বাসায় উঠবেন?
সেক্ষেত্রেও তার বেতন ছোট কাঁথার মতো হবে, মাথা ঢাকলে পা উদাম, পা ঢাকলে মাথা উজাড়। ১৮ থেকে ১২-তে নামলে বাকি ৬ হাজার দিয়ে খেতে পারবেন কোনোমতে, তবে দুধ-পত্রিকা-বিদ্যুৎ-গ্যাস-দুই সন্তানের টুকটাক চাহিদা-বুয়া এবং মাঝে-মধ্যে কাপড়-স্যান্ডেল ইত্যাদিসহ আরও অনেক খাতের বিল মেটাতে পারবেন না। তাহলে কি তিনি বস্তিসদৃশ কোথাও উঠবেন? কিন্তু তার বাবা যে জেলা শহরের নামকরা উকিল, তিনি নিজে মাস্টার্স! আমাদের এখনকার সাবজেক্ট ছোট ছোট আর্থিক দুর্নীতি (দুর্নীতির নানা প্রকারভেদ হয়)। বড় বড় দুর্নীতি বড় বড় বিশ্লেষকরা লিখুন গে, সেগুলো ডিল করুক লার্জ সাইজের প্রতিষ্ঠান দুদক। আমি ছোট লেখক, গাছের বড় ডাল পর্যন্ত হাত যায় না। যা হোক, প্রথমে আমরা ‘সততা’ প্রপঞ্চটি বোঝার চেষ্টা করব। সততা মানুষের এক অখণ্ড মানবিক গুণ। একে খণ্ডন করা যায় না, এ হল সুসংহত চারিত্রিক একক কাঠামো। সততার কোনো পার্সেন্টেজ হয় না যে, অমুক ৮০ ভাগ সৎ আর ২০ ভাগ অসৎ। অন্যদিকে দুর্নীতি দুর্নীতিই। এর ছোট-মাঝারি-বড় ভাগ নেই। বৃত্তসংক্রান্ত জ্যামিতিক কোনো উপপাদ্য বড় বৃত্ত এঁকে প্রমাণ করা যায়, আবার ছোট বৃত্ত এঁকেও। দুর্নীতি বোঝার জন্য তেমন ছোট-বড় কোনো মাপ নেই। আবার আমি মানসিকভাবে সৎ; কিন্তু নেহায়েত বাঁচার তাগিদে ছোট্ট দুর্নীতিটা করতে হয়েছে- এই সান্ত্বনা আত্মপ্রবঞ্চনারই নামান্তর। আমার দৃষ্টিতে বর্তমান দুনিয়ার সেরা হিউমারিস্ট জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবের কথা- তুমি যদি দেখতে কুৎসিৎ, তাহলে তুমি কুৎসিৎই, কারণ কেউ কপালের নিচে এক্স-রে চোখ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে না যে, তোমার ভেতরের সৌন্দর্য দেখতে পাবে।
দেশের অর্থনীতিটা আমরা এমন করে রেখেছি যে, শিক্ষিত শ্রেণীর একটি বড় অংশের যারা স্বল্প বেতনের (আপার লিমিট ৫০ হাজার ধরছি) চাকরি করছেন, তারা যদি তাদের সম্ভ্রম রক্ষা করে একটা কমফোর্টেবল জীবন নির্বাহ করতে চান, তাহলে তাদের সামনে একটাই পথ খোলা আছে- কিছু না কিছু দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া। অতঃপর একটি ভ্যালিড প্রশ্ন তোলাই যায়। তবে তার আগে একজন সৎ মানুষের একটা ঘটনা বলতে হবে, আমাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল ভাইয়ের কাছে শোনা। ‘বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা’র একসময়কার এমডি সাংবাদিক আমানউল্লাহ ভাই একবার তার ছোট ছেলেসহ স্টিমারে বরিশাল গিয়েছিলেন। প্রখ্যাত বি ডি হাবিবুল্লাহর ছেলে হিসেবে বরিশাল এলাকার অনেকেই তাকে সরাসরি চেনেন। চার-পাঁচ দিন পর তিনি যখন ফিরছিলেন, টিকিট চেকার তার হাত থেকে দুটি টিকিট নিয়ে চেক করতে করতে বললেন, স্যার যাওয়ার সময় আপনার ছেলের হাফ টিকিট দেখলাম, এখন ফুল টিকিট যে? আমানউল্লাহ ভাই উত্তর দিলেন, এরই মধ্যে ছেলের জন্মদিন পালন করেছি বরিশালে। ওর বয়স ১২ পেরিয়ে ১৩-তে পড়ে গেছে! প্রশ্নটা এবার ওঠাই। সমাজে আমানউল্লাহর মতো সৎ মানুষ যে একেবারে নেই, তা তো নয়। যদি একজনও থাকেন এবং তিনি যদি হন সম্ভ্রান্ত পরিবারের, তাহলে ছোট বললাম না, মাঝারি চাকরির মাধ্যমেই তিনি বর্তমান বাংলাদেশে সৎ জীবন যাপন করে সামাজিক মর্যাদা ও স্বচ্ছন্দ জীবন নিশ্চিত করতে পারবেন না যেহেতু, তাই ছোটখাটো দুর্নীতি জায়েজ করে দেয়া যায় না কি? সেক্ষেত্রে সেই লোকটির একটা সান্ত্বনা তো থাকবে যে, রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আছে যেহেতু, তাতে কোনো অন্যায় হবে না।
ছোটখাটো দুর্নীতি কিন্তু জায়েজ হয়েই আছে। দেশ নৈতিকভাবে এতটাই দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে যে, দু’-চার-দশ হাজার টাকার দুর্নীতি এখন আর গায়ে মাখে না কেউ। দু’হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছে? ওটা আবার টাকা হল নাকি! অথচ প্রশ্নটা কিন্তু আদর্শিক, টাকার অ্যামাউন্ট অবান্তর। আমানউল্লাহ ভাই হাফ টিকিট কিনে অনায়াসে কিছু টাকা বাঁচাতে পারতেন কিংবা সাংবাদিক ও বি ডি হাবিবুল্লাহর ছেলে হিসেবে ওইটুকু ছেলের টিকিট না কাটলেই বা কী হতো। কিন্তু আগেই বলেছি, সততাকে খণ্ড করা যায় না, ওটা সবসময়, সর্বত্রই সমগ্র। হলমার্কের ৪ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি এবং স্যারের সঙ্গে দেখা করানোর ব্যবস্থা করে দিয়ে সাক্ষাৎপ্রার্থীর কাছ থেকে বখশিশের নামে ৫০ টাকা ঘুষ নেয়া- এ দু’য়ের পার্থক্য টানার পেনসিল বাজারে পাওয়া যায় না। আমরা যখন দেখতে পাই, বিধিবদ্ধ উপার্জন, তা স্বল্প অথবা সীমিত, যা দিয়ে এই বাজারে ভদ্রস্থভাবে সংসার চালানো সম্ভব নয় অথচ সেটা চলছে নির্বিঘ্নে, কখনও বা ঠাটবাটের সঙ্গে এবং আরও যখন দেখি এ ধরনের পরিবারের সংখ্যা অনেক, তখন এ দেশের অর্থনীতির কোনো কূলকিনারা পাওয়া যায় না। কীভাবে সম্ভব- এমন একটি প্রশ্ন জোলো হয়ে গেছে এখন। হচ্ছে তো সম্ভব এবং কেউ যদি এই অসম্ভব কীভাবে সম্ভব হল এমন প্রশ্ন তোলেন, একইসঙ্গে তিনি যদি বিধিবদ্ধভাবেই যারা প্রচুর আয় করেন- ব্যবসায়ী, ডাক্তার, উকিল, মোটা বেতনের চাকরিজীবী ইত্যাদি- তাদের মতো কেউ না হন, তাহলে তাকেও হয়তো একই প্রশ্ন করবেন অন্য কেউ। টাকার মূল্যমান এত কমে গেছে যে, একশ’ টাকার নোটটাই হতে পারে লিগ্যাল টেন্ডার, মুদ্রার ক্ষুদ্রতম একক। অথচ বেতন পাচ্ছি ৪০ কী ৫০ হাজার, আটকাচ্ছে না কোনোকিছুতেই। সিএনজি ডাক দিয়ে তাকালেই দেখা যায় সেটা অকুপাইড, ঘরের ১০-১২ বছরের ছেলের হাতে স্মার্টফোন, চাইনিজ তো চাইনিজ, বারগুলোয়ও টেনে নেয়ার মতো চেয়ার পাওয়া যায় না। এদের সবারই বৈধ আয় কি সাপোর্ট করে এসব? কলকাতার লোক এই মাসে কতটা ইলিশ খাবে, ২০০ নাকি ৪০০ গ্রাম; শাহরুখের ছবিটা দেখবে, না সালমানেরটা; যদি লাইগ্যা যায় এই আশায় কয়টা লটারির টিকিট কিনবে, সবই ঠিক হয়ে যায় বেতন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। কেউ কেউ হয়তো এমনও ভাবে- আহা ঘুম থেকে জেগেই যদি দেখতে পেতাম ক্যালেন্ডারে ফুটে আছে ১ তারিখ! হ্যাঁ, কোত্থেকে আসে টাকা?
প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই বলবেন, দেশের অর্থনীতি বুম করেছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। অর্থনীতি নিশ্চয়ই বুম করেছে, তবে বৈষম্য কতটা লুম করেছে (ইংরেজি loom শব্দের আরেকটি অর্থ বৃহত্তর আকারে বা ভীতিপ্রদভাবে প্রতীয়মান হওয়া), সেটাও কিন্তু একটা প্রশ্ন এবং বড় প্রশ্ন। সেদিকে যাচ্ছি না, আমরা বলব শুধু ক্রয়ক্ষমতার কথা। বড় দুর্নীতিবাজের টাকায় মেজো দুর্নীতিবাজ, মেজোর টাকায় সেজো আর সেজো দুর্নীতিবাজের টাকায় ভাগ বসাচ্ছে ছোট দুর্নীতিবাজ। এভাবে যারা বাড়াচ্ছে ক্রয়ক্ষমতা, তাদের সংখ্যা কত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী? আমরা বলি কী, হলমার্ক-ডেসটিনিসহ নানা জাতের সিঙ্গল অথবা সিন্ডিকেটেড বড় দুর্নীতিই শেষ কথা নয়। আবার এটাও বুঝি যে, বড়দের দেখেই ছোটরা শেখে; নেতার ব্যবসা নেই, চাকরি নেই, জমিজমা নেই, উত্তরাধিকারের সম্পত্তিও নেই, তিনি কীভাবে গাড়ি কিনলেন কেউ যেহেতু জিজ্ঞেস করছে না, কর্মী আমি মোটরসাইকেল তো কিনতেই পারি; তারপর একদিন আমারও গাড়ি হবে, হবে বাড়ি। ধুর, আমি কেন যে আবার বড় দুর্নীতিতে ঢুকলাম! কথা হচ্ছে, ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে ধীরে ধীরে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়াতে বাধ্য করার যে অর্থনীতি ও শাসনব্যবস্থা- এর বিহিত করতে না পারলে কোনো ধরনের আদর্শের কথাই মুখে তোলা সাজে না রাজনৈতিক নেতৃত্বের। বাধ্য করা হচ্ছে কেন বলছি? দাঁড়ান। আজ যিনি পেনসনে গেলেন, স্কুলে থাকতে তাকে একটা ভাবসম্প্রসারণ করতে দিয়েছিলেন শিক্ষক। রবীন্দ্রনাথের দুই লাইন- অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণ সম দহে। দশে আট পেয়ে ভেবেছিলেন- সারাজীবন মেনে চলবেন এই দীক্ষা। কিন্তু পেনসনের টাকা তুলতে গিয়ে বাধ্য হয়ে তিনি ভুলে থাকলেন কৈশোরের সেই স্মৃতি। ঘুষ দিয়ে ছাড়িয়ে আনলেন টাকা। এই অন্যায়টুকু না করলে না খেয়ে তাকে জীবন থেকেই অবসর নিতে হতো। বড় দুর্নীতি এখনও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা কিংবা অনুমোদন পায়নি, সে অপেক্ষায় আছে কবে মিলবে সেই কৃতিত্ব; কিন্তু ছোটগুলো পেয়ে গেছে প্রতিষ্ঠা, কিছু লোক অনুমোদন দিচ্ছে না তো কী হয়েছে? ডাচ ও ডেনিশদের কথা মনে এলো। একসময় দুর্দান্ত রকমের অসভ্য ও দুর্নীতিবাজ ছিল তারা, সময়ের কষ্টিপাথরে এখন সোনার সার্টিফিকেট পেয়েছে তারা, যদিও সময়টা খুব দীর্ঘ। আমাদের উল্টোরথের যাত্রা কবে শুরু হবে জানি না। হতে পারে ফোঁড়ার পুঁজ বের হওয়ার জন্য যেমন সেটাকে ভালোভাবে পাকতে হয়, তেমনি দুর্নীতির ফুল কোর্স শেষ হওয়ার পরই শুরু হবে চরিত্র সংশোধনের নতুন পাঠ। দীর্ঘকালীন সেই পাঠ শেষে আত্মপ্রকাশ করবে হয়তো এক পরিশুদ্ধ জাতি। তখন ‘এক দেশে ছিল এক রাজা’- এমন ঢংয়ে শিশুতোষ বইয়ে লেখা হবে- একদা এই রাজ্যে রাজা ও রানীগণ, রাজন্যবর্গ ও তাহাদের অনুচরেরা একত্রে মিলিয়া প্রজাদের ভুল পথে পরিচালিত করিয়াছিল।
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক
mahbubkamal08@yahoo.com
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক
mahbubkamal08@yahoo.com
No comments