ষষ্ঠ শ্রেণীতেই জেএমবিতে নাম লেখায় মাহফুজ
নিষিদ্ধ সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) প্রতিষ্ঠাকালীন (২০০২ সাল) সদস্য ছিলেন সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা সোহেল ওরফে নাসিরুদ্দিন ওরফে ভাগিনা সোহেল। তবে এটি তার সাংগঠনিক নাম। পরিবারের লোকজন হাসান নাম রাখলেও স্কুলে ভর্তির সময় শিক্ষকরা নাম রাখেন আবদুস সবুর খান। প্রথম শ্রেণী থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত স্কুলের কোনো পরীক্ষায় প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হননি। ৫ম শ্রেণীতে পেয়েছিলেন বৃত্তি। পাবনা জিলা স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি পরীক্ষায় মেধা তালিকায়ও ১০ জনের মধ্যে ছিলেন সোহেল মাহফুজ। তার বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার পদ্মা ও গড়াই নদীবেষ্টিত ইউনিয়ন চরসাদিপুরে। এই ইউনিয়নের কাবলিপাড়া গ্রামের দরিদ্র কৃষক রেজাউল করিম ওরফে রাজেম শেখের দশ ছেলেমেয়ের মধ্যে মাহফুজ ওরফে হাসান চতুর্থ। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে ও পুলিশের দেয়া তথ্যে জানা গেছে, ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়াকালীন (২০০২ সাল) গ্রামের দুরন্ত এ কিশোরের চালচলনে হঠাৎ পরিবর্তন আসে। মাঝেমধ্যেই সে কিছুদিনের জন্য হারিয়ে যেত। তবে ২০০৫ সালে দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। ওই বছরেই র্যাব ও পুলিশ তাকে খুঁজতে গ্রামে যায়। তখন গ্রামের লোকজন জঙ্গিবাদে জড়ানোর খবর পায়। এর পর ২০০৮ সালে এক মেয়েকে নিয়ে গ্রামে এলেও পরিবারের সদস্যরা ছাড়া আর কেউ মাহফুজকে দেখতে পায়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, পাবনা জিলা স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়াকালে সাদিপুর আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয় হয় মাহফুজের। তার হাত ধরে শিশু বয়সেই জেএমবিতে নাম লেখায় সোহেল মাহফুজ। সোহেল মাহফুজের ছোট ভাই হাফিজুর রহমান সাকিবও (২৫) একজন জঙ্গি। ভাই মাহফুজের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। ২০১০ সালে সে সাদিপুর আলিয়া মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করে। জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে গত বছর র্যাব-পুলিশ বাড়িতে অভিযান চালিয়ে সাকিবকে গ্রেফতার করে। বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছে সাকিব। জঙ্গি তৎপরতা দমনে গঠিত বিশেষ সংস্থা কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান মনিরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেছেন, জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা বাংলা ভাই ও শায়খ আবদুর রহমানের সান্নিধ্যে সে সময় থেকেই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন সোহেল মাহফুজ। ২০০৪ সালে বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণে একটি হাত উড়ে যায় তার। এরপর পালিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে গিয়ে সেখানেও জঙ্গি সংগঠন জেএমবির শাখা গড়ে তোলেন। ২০০৯ থেকে ২০১৩ জেএমবির ভারতীয় শাখার আমীর ছিলেন তিনি। ওই সময় তিনি নসরুল্লাহ নামে ছদ্মপরিচয়ে ভারতে এক নারীকে বিয়ে করেন। ২০১৪ সালে বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পর তার ছবিসহ নাম প্রকাশ পায়।
সে সময় ভারতীয় সরকার মোস্ট ওয়ান্টেড ঘোষণা করে তাকে ধরতে ১০ লাখ রুপি পুরস্কার ঘোষণা করে। এরপর ওই বছরের ডিসেম্বরে ফের বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন সোহেল মাহফুজ। মাহফুজের বোন রহিমা বেগম জানিয়েছেন, অন্য তিন ভাই স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন। বড় ভাই নজরুল ইসলামের এলাকায় চায়ের দোকান রয়েছে। আরেক ভাই মনিরুল ইসলাম একটি ওষুধ কোম্পানিতে কাজ করেন এবং আরেক ভাই হেলাল কুমিল্লায় কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন। রহিমা বলেন, আমার ভাই ছোটবেলা থেকেই খুব ভালো ছাত্র ছিল। স্কুলের পরীক্ষায় কোনোদিন সে প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয়নি। ৫ম শ্রেণীতে সে বৃত্তি পেয়েছিল। নিজের পড়াশোনার খরচ সে নিজেই চালাত। প্রতিদিন সে বাড়ি থেকে পাবনায় নদী পার হয়ে স্কুলে যাতায়াত করত। সে যে জঙ্গি এটা প্রথম জানতে পারি ২০০৫ সালে যখন র্যাব-পুলিশ তাকে খুঁজতে বাড়িতে আসে। তিনি আরও বলেন, ২০০৮ সালে বউ নিয়ে শেষবারের মতো সে বাড়িতে এসেছিল। এর পর থেকে তার সঙ্গে আর পরিবারের কারও যোগাযোগ নেই। সিটিটিসি প্রধান মনিরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেছেন, এক হাত না থাকলেও শক্তিশালী বোমা তৈরি ও অস্ত্র পরিচালনায় পারদর্শী সোহেল মাহফুজ শূরা সদস্য হিসেবে সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। তিনি বলেন, এযাবৎ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচালিত অভিযানে গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে ভয়ঙ্কর এ জঙ্গির নাম এলেও বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল সোহেল মাহফুজ। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থেকে গ্রেফতার হওয়া উত্তরাঞ্চলীয় জেএমবির কমান্ডার সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ গুলশান হামলায় পলাতক চার জঙ্গির একজন। গত বছরের ১ জুলাই হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলার ঘটনায় যাদের সম্পৃক্ততার তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে তাদের অন্যতম হচ্ছেন সোহেল মাহফুজ। হলি আর্টিজানে হামলার সঙ্গে জড়িত নব্য জেএমবির অন্য যাদের নাম এসেছে তাদের মধ্যে রাশেদ ওরফে র্যাশ, চকোলেট, ছোট মিজান, মামুন, নিহত জঙ্গি নেতা মারজানের ভগ্নিপতি হাদিসুর রহমান ওরফে সাগর পলাতক রয়েছেন।
No comments