গ্রীন ডেল্টা হাউজিং হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা
‘২০১০ সালের শেষের দিকে বাহারি ও চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করা হয়। কুমিল্লার ঝাউতলা এলাকায় গ্রামীণফোন অফিসের সঙ্গে একটি বাড়িতে গ্রীন ডেল্টা শেহনাজ ভিলা প্রজেক্টের সাইনবোর্ডও টানানো হয়। নগরীর প্রাণকেন্দ্র হওয়ায় ৯ তলা ওই ভবনে ফ্ল্যাট নেয়ার জন্য আমরা কয়েকজন যোগাযোগ করি। জানতে পারি, জমির মালিকের সঙ্গে গ্রীন ডেল্টা হাউজিংয়ের চুক্তি হয়েছে। পছন্দের লোকেশন ও ডেভেলপার কোম্পানিটি রিহ্যাব সদস্য হওয়ায় একটি ফ্ল্যাট নেয়ার জন্য এককালীন ১০ লাখ টাকা ও ডাউন পেমেন্ট হিসেবে আরও এক লাখ টাকা প্রদান করি। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বেলাল হোসেন আমার স্ত্রীর নামে ওই ফ্ল্যাটটি কেনার চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। ২০১২ সাল পর্যন্ত কিস্তিতে ১৮ লাখ টাকা পরিশোধ করি। চুক্তি অনুযায়ী ৩ বছরের মধ্যে ওই ফ্ল্যাটটি আমাদের বুঝিয়ে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২০১২ সালের পর তাদের অফিস নেই, তারা উধাও। এ নিয়ে আদালতে মামলা করলেও এ পর্যন্ত তাদের খুঁজে পায়নি পুলিশ।’- এভাবেই ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন ফ্ল্যাট কিনে প্রতারণার শিকার হওয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঝাউতলার একটি প্রাইভেট হাসপাতালের চিকিৎসক। ফ্ল্যাট বিক্রির নামে সংঘবদ্ধ কয়েকটি চক্র মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক কোটি টাকা। শুধু ওই চিকিৎসক নন, এভাবে আরও অনেক গ্রাহক চুক্তি করে হয়রানিসহ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। আবার অনেকে হয়েছেন সর্বস্বান্ত। কুমিল্লা শহরে এ ধরনের প্রতারণা করছে অর্ধশতাধিক ডেভেলপার কোম্পানি। গ্রীন ডেল্টা হাউজিং ছাড়াও প্রতারণার শীর্ষে রয়েছে বন্ধন হাউজিং, মিশন-খেয়া, গাংচিল, নগর হোমস ইত্যাদি। গ্রীন ডেল্টা শেহনাজ ভিলা প্রজেক্টে সরেজমিন দেখা যায়, পুরনো ভবন ভেঙে পরিষ্কার করা হলেও পরে আর কাজ হয়নি। এভাবেই পড়ে আছে এ প্রজেক্ট। জানা যায়, বাড়ির মালিকের সঙ্গে গ্রীন ডেল্টা হাউজিংয়ের চুক্তি ছিল ফ্ল্যাট নির্মাণের পর মালিক ৪০ ভাগ ও ডেভেলপার কোম্পানি (গ্রীন ডেল্টা) ৬০ ভাগ মালিকানা পাবে। ৮ শতাংশের এ বাড়ির মালিক লন্ডন প্রবাসী। শনিবার সন্ধ্যায় প্রজেক্ট এলাকায় এ প্রতিবেদক অবস্থানকালীন সময়ে স্থানীয় এক ব্যক্তি মোবাইল ফোনে কাতার প্রবাসী মনজিল হোসেনের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন। যুগান্তরকে মনজিল হোসেন বলেন, আমি ৩০ লাখ টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট বুকিং দিয়েছিলাম। কোথায় গেলে কিভাবে এ টাকা উদ্ধার হবে তা বুঝতে পারছি না। এদিকে মাসিক আয় থেকে ফ্ল্যাট কিনে স্ত্রীকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলেন এক চিকিৎসক। কিন্তু ২১ লাখ টাকা নেয়ার পর ডেভেলপার কোম্পানি লাপাত্তা হয়ে উল্টো তাকেই সারপ্রাইজ (!) দিয়েছে। আইনের আশ্রয় নিয়েও তাদের কোনো কূল-কিনারা হয়নি। টাকা হাতিয়ে নেয়ার পর প্রতারকরা লাপাত্তা হয়েছে; তাদের কথিত ফ্ল্যাট, সাজানো অফিস, চুক্তিপত্র, দলিল সব কিছুই রাতারাতি শেষ হয়ে গেছে। গত কয়েকদিন কুমিল্লার বিভিন্ন এলাকায় যুগান্তরের অনুসন্ধানে ফ্ল্যাট কেনাবেচার নামে চলমান ভয়ঙ্কর প্রতারণার বিভিন্ন চিত্র বেরিয়ে এসেছে। অভিজাত এলাকায় নির্মাণাধীন অত্যাধুনিক অ্যাপার্টমেন্টকে পুঁজি করে, চটকদার বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে সহজ-সরল মানুষকে ধোঁকা দেয়ার পথ বের করা হয়। সংবাদপত্র ও ক্যাবল টিভিতে বিজ্ঞাপনে অপেক্ষাকৃত কম দামে, বিশেষ কিস্তি সুবিধায় এমনকি ব্যাংক ঋণে ফ্ল্যাটের দাম পরিশোধের সুবর্ণ সুযোগের লোভ দেখানো হয়। গ্রীন ডেল্টা হাউজিং নামের রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠানের এমডি বেলাল হোসেনের প্রতারণার স্টাইল ছিল আরও অভিনব। ভুক্তভোগীরা জানান, নগরীর ঝাউতলা এলাকায় গ্রীন ডেল্টা শেহনাজ ভিলা নামের ওই বাড়ির মালিকের সঙ্গে চুক্তি করার পরপরই পুরনো বাড়িটি ভেঙে ফেলা হয়। পরে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ফ্ল্যাটের চটকদার বিজ্ঞাপন দেয় এ প্রতিষ্ঠানটি। বিভিন্ন মোড়ে, দেয়ালে বিরাট বিলবোর্ডে প্রচারণা চালানো হয়। পছন্দের লোকেশনে চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে অনেকেই হাজির হন নগরীর ঝাউতলা এলাকায় গ্রীন ডেল্টা হাউজিং অফিসে। নিজ অফিসের রিসিট বা দলিলের মাধ্যমে চাহিদামাফিক টাকা হাতিয়ে নিয়ে সবাইকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দেন। এ সুযোগে ওই অফিসে তালা ঝুলিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান কর্মকর্তারা। ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেতে ওই প্রতিষ্ঠানের এমডি বেলাল হোসেনের কাছে ২০ লাখ টাকা থেকে শুরু করে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত পরিশোধ করেছেন অনেক গ্রাহক। কিন্তু ফ্ল্যাট নির্মাণ না করেই কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে যান বেলাল হোসেন। বর্তমানে তার ব্যবহৃত সব মোবাইল ফোন বন্ধ। শুধু তাই নয়, ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের কোথাও খুঁজে পাচ্ছেন না প্রতারিতরা। ধূর্ত বেলালের নানাবিধ অপকৌশলের বেড়াজালে ধরাশায়ী হয়েছেন অনেকেই। নগরীর মিশন হাসপাতালের ডা. কামাল হোসেন, ব্যাংক কর্মকর্তা খাজা, মেডিনোভা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ম্যানেজার শংকর দেব, নগরীর মুন হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আবদুল্লাহ আল-হাসানসহ আরও অনেকেই। যুগান্তরের কাছে প্রতারিত গ্রাহক ডা. আবদুল্লাহ আল-হাসান অভিযোগ করেন, তিনি ২০১১ সালের প্রথম দিকে ১২শ’ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট বুকিং দিয়েছিলেন ১০ লাখ টাকায়। পরে ২ বছরে ২১ লাখ টাকা প্রদান করেন। চুক্তি অনুযায়ী আরও ৩ বছর আগে তার ফ্ল্যাটটি পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ফ্ল্যাট তো দূরের বিষয়, যারা বুকিং মানি নিয়েছেন তাদের কাউকেই এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফ্ল্যাট বুঝে পেতে তিনি এখন আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। একাধিক গ্রাহক জানান, গ্রীন ডেল্টা হাউজিংয়ের প্রতারণায় তারা সর্বস্বান্ত হয়েছেন। গ্রীন ডেল্টা ৮-৯ জন গ্রাহকের বিভিন্ন কিস্তিতে আনুমানিক ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। রিহ্যাব সদস্য কুমিল্লার শিল্পপতি ফারুক আহমেদের কাছে গ্রীন ডেল্টা হাউজিংয়ের প্রতারণার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। কুমিল্লার জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ডেভেলপার কোম্পানিগুলো রিহ্যাবের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। তবে ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ পেলে তাদের আইনগত সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করব। কুমিল্লা সিটি মেয়র মনিরুল হক সাক্কু বলেন, ডেভেলপার কোম্পানিগুলো গ্রাহক ও জমির মালিকদের সঙ্গে রেজিস্ট্রির মাধ্যমে চুক্তি করে থাকেন, তাই এক্ষেত্রে আদালতের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া কোনো পথ থাকে না। তিনি বলেন, সম্প্রতি এ ধরনের বেশ কয়েকটি অভিযোগ আমার কাছে এসেছে, আমি চিন্তাভাবনা করে দেখছি তাদের কিভাবে সহযোগিতা করা যায়। রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট লিয়াকত আলী ভূঁইয়া যুগান্তরকে বলেন, গ্রীন ডেল্টা হাউজিং রিহ্যাব সদস্য নয়। তাই এ ব্যাপারে আমাদের কিছু করণীয় নেই।
No comments