নেক ব্লাস্ট কেড়ে নিল রংপুরের কৃষকের হাসি
রংপুর বিভাগের আট জেলায় মাঠ ভরা সোনা রং ধান তবুও কৃষকের মুখে হাসি নেই। তাদের সর্বনাশ করছে নেক ব্লাস্ট রোগ। বোরো ধান কেটে ঘরে তুলে কৃষক বুঝতে পারছেন তার কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। শতকরা ৩০ ভাগ ধানের দানা নেই, যা চিটায় পরিণত হয়েছে। খোদ কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে রংপুর বিভাগের চলতি মৌসুমে বোরো ধানের উৎপাদন কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। যা আগামী আমন ধান উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। চলতি বোরো উৎপাদন মৌসুমে রংপুর-দিনাজপুরের আট জেলায় মহামারী আকারে নেক ব্লাস্ট রোগ ছড়িয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে রংপুর বিভাগে বোরো ধানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা করেছে খোদ কৃষি বিভাগ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের রংপুর ও দিনাজপুর আঞ্চলিক অফিস সূত্র বলছেন প্রায় ২৫ শতাংশ ধানের ক্ষেত নেক ব্লাস্টে আক্রান্ত হয়েছে। বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। আক্রান্ত ক্ষেতের সংখ্যা ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। কৃষকরা এ পরিস্থিতিকে বোরো মৌসুমে খাদ্য সংকটের পূর্বাভাস বলে মনে করছেন। রংপুর বিভাগে সর্বাধিক ধান উৎপাদন হয়ে থাকে দিনাজপুরে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, জেলার প্রায় ১৩টি উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকার বোরো ক্ষেতেই দেখা দিয়েছে নেক ব্লাস্ট। কৃষক পরিবারগুলোর মাঝে চরম উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। কারণ অনেক ধারদেনা করে বোরো ধান উৎপাদন করলেও শেষ পর্যন্ত কাক্সিক্ষত পরিমাণ ধানের উৎপাদন হয়নি। ধান কেটে ঘরে তুলে মাড়াই করার পর কৃষক বুঝতে পারছে যে, কতটা তাদের সর্বনাশ করছে নেক ব্লাস্ট। কৃষি সম্প্রসারণ রংপুর আঞ্চলিক অফিস সূত্রে প্রাপ্ত এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রংপুর বিভাগের বৃহত্তর রংপুরেও প্রায় ১৬১ হেক্টর বোরো ধানের জমি নেক ব্লাস্টে আক্রান্ত। এ জমির ধানের উৎপাদন কমেছে প্রায় ১২ শতাংশ। কিন্তু কৃষকদের বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে ভিন্ন কথা। তাদের বক্তব্য প্রকৃত পক্ষে নেক ব্লাস্টে আক্রান্ত ধানের ক্ষেতের পরিমাণ আরও বেশি হবে। আর তারা ঘরে ধান মাড়াই করার পর দেখছেন ধানের ফলন কমেছে প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চিকন জাতের ধান। কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার দক্ষিণ রামখানা গ্রামের কৃষক চন্দ্রিকা রবি দাস ও যতীশ চন্দ্র তাদের এ বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা জানান। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের রংপুর আঞ্চলিক অফিসের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা রামকৃষ্ণ রায় বলেন, রংপুর অঞ্চলে আক্রান্ত জমির ধানের উৎপাদন কমেছে গড়ে শতকরা ১১ দশমিক ৫৩ ভাগ। বীরগঞ্জ উপজেলার নিজপাড়া ইউনিয়নের আওলাখুড়ী গ্রামের কৃষক রেজাউল করিম জানান, ঠিক যেই মুহূর্তে ফসল ঘরে তোলার আনন্দে বিভোর কৃষক। তখন নেক ব্লাস্ট বোরো ধানের সর্বনাশ করেছে। কৃষকের ঘরে এখন বিষাদের ছায়া ফেলেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর দিনাজপুরের উপপরিচালক মো. গোলাম মোস্তফা জানান, জেলায় চলতি মৌসুমে ১ লাখ ৭৭ হাজার ৮০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ হয়েছে। এর মধ্যে ৯ হেক্টর জমিতে এ রোগ দেখা দিয়েছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ এলাকাভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়েছে।
তিনি সঠিক পরিসংখ্যান বলতে পারেননি। প্রকৃত পক্ষে এ জেলার সিংহভাগ ধানের জমি আক্রান্ত হয়েছে নেক ব্লাস্টে। একই পরিস্থিতি পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও জেলার। এসব জেলার বিভিন্ন উপজেলার কৃষক ও কৃষি বিভাগ সূত্রে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, প্রায় রোপণকৃত বোরো ধানের জমির ৫০ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছে নেক ব্লাস্টে। রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলা গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর ও নীলফামারীতে বোরো মৌসুমে ১৭ লাখ ৮২ হাজার ৩৬ মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩ হাজার ৬৫ হেক্টর বেশি জমিতে বোরোর আবাদ হলেও এবারে ধানের ক্ষেত নেক ব্লাস্টে নষ্ট হয়েছে প্রায় অর্ধেকেরও বেশি। এ পরিস্থিতিতে কৃষক পরিবারগুলো এখন আমন উৎপাদনের পুঁজি নিয়ে সংকটে আছেন। কারণ বোরো ধানের উৎপাদন কমে যাওয়ায় তারা মারাত্মক আর্থিক সংকটে পড়েছেন। তাদের ধান উৎপাদনে ধারদেনার টাকা পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছেন।
No comments