সম্পূরক শুল্ক বসছে ৮শ’ পণ্যে
আসন্ন ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে প্রায় আটশ’ পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক বসছে। দেশীয় শিল্প সুরক্ষার জন্যই সম্পূরক শুল্ক আরোপিত পণ্য সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। নতুন ভ্যাট আইনে ১৭০টি পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এতে দেশীয় শিল্পে ধস নামার আশঙ্কা আছে। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশীয় শিল্প সুরক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পণ্যের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। এছাড়া ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য ভ্যাট অব্যাহতির সীমা ৩০ লাখ টাকা থেকে বাড়ানো হচ্ছে। করমুক্ত আয় সীমা বাড়ছে। নির্দেশ দেয়া হয়েছে নতুন ভ্যাট আইন সংশোধনের। রোববার রাতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গণভবনে অর্থমন্ত্রী ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ৪ ঘণ্টাব্যাপী বাজেট বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ভ্যাট ইস্যুতে আলোচনা শেষে এসব বিষয়ে নির্দেশনা দেন। এর ভিত্তিতে কাজ শুরু করেছে এনবিআর। ওই রাতের বৈঠকে ভ্যাট হার নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। ২৪ মে বিদেশ সফর শেষে দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন বলে জানা গেছে। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সূত্র জানায়, ১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, নতুন অর্থবছর থেকেই নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন শুরু হবে। তবে সব শ্রেণী-পেশার জনগণ ও ব্যবসায়ীদের স্বস্তি দিতে নতুন আইনে ১৫ শতাংশ একক ভ্যাট হার রাখা হবে, নাকি সেটি কমানো হবে- সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেননি।
২৪ মে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হতে পারে। বৈঠকে এনবিআর থেকে ভ্যাট হার কমানোর একটি প্রস্তাব দেয়া হয়। এতে ভ্যাট কমালে কত টাকার রাজস্ব ক্ষতি হবে তা প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হয়। এনবিআর থেকে বলা হয়েছে ১৯৯১ সালের ভ্যাট আইনের আওতায় গ্যাস, সিগারেট, মোবাইল অপারেট, সিমেন্ট খাত ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট পরিশোধ করছে। এ ধরনের বড় খাত থেকে মোট ভ্যাটের ৬০ শতাংশ আদায় করা হয়। এ হার ১ শতাংশ কমালে ৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব কম আদায় হবে। তাছাড়া রেয়াত নিতে অসামর্থ্য সেবা খাত যেমন জুয়েলারি ও কম্পিউটারের মতো সেবার ওপর ভ্যাট হারের বিরূপ প্রভাবের কথা জানান। ১৫ শতাংশ সমহারে (ফ্ল্যাট রেট) ভ্যাট বহাল রেখে এসব ক্ষেত্রে ছাড় দিলে দেড় থেকে ২ হাজার কোটি টাকার কম রাজস্ব আদায় হবে। সে ক্ষেত্রে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক রাখার জন্য বড় খাতের ওপর ১৫ শতাংশ এবং রেয়াত নিতে অসামর্থ্য খাতের জন্য আলাদা ভ্যাট রেট নির্ধারণের বিষয় আলোচনা হয়। তবে এ বৈঠকে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। প্রধানমন্ত্রী ২৪ মে বিদেশ সফর শেষে দেশে ফিরেই বিষয়টি নিয়ে আবার বৈঠকে বসতে পারেন। তখন ভ্যাট হারের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। যে ধরনের সিদ্ধান্ত হবে তাতে নতুন ভ্যাট আইন সংশোধনের প্রয়োজন হবে। সেদিক বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভ্যাট আইন সংশোধনের নির্দেশ দেন। রোববারের বৈঠকে আলোচনার বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সোমবার সচিবালয়ে যুগান্তরকে বলেন, ‘ভ্যাট হার নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্তে ব্যবসায়ী মহল খুশি হবেন বলে আশা করছি। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় কোনো ব্যবসায়ীর ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে না। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে, সবদিক বিবেচনা করেই ভ্যাট আইন কার্যকর করা হবে। আমরা (সরকার) মনে করছি, এতে সন্তুষ্ট হবেন ব্যবসায়ীরা। কারণ ভ্যাটের আওতায় কিছু নতুন যোগ হবে। এতে ব্যবসায়ীদের অসন্তুষ্ট হওয়ার কোনো কারণ নেই। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে ভ্যাট, কাস্টমস ও আয়কর- এই তিনটি বিষয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।
এটি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে এসবের প্রতিফলন থাকবে।অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, এনবিআর থেকে ভ্যাট হার নিয়ে আলাদা প্রস্তাবনা তৈরি করা হচ্ছে। একক হারের পরিবর্তে একাধিক হার হলে রাজস্ব আদায় হ্রাস-বৃদ্ধির প্রভাব হিসাব-নিকাশ করছে সংশ্লিষ্টরা। ১৫ শতাংশের পরিবর্তে বেশ কয়েকটি পণ্য ও সেবার জন্য আলাদা ভ্যাট হারও করা হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার পর অনুষ্ঠেয় বৈঠকেই সব পরিষ্কার হবে। সূত্র জানায়, রোববারের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সামনে নির্বাচন আসছে। এ মুহূর্তে ভ্যাট নিয়ে কাউকে কষ্ট দেয়া যাবে না। ব্যবসায়ীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন সেদিক বিবেচনা করে ভ্যাট হার নির্ধারণ করতে বলেন। এ ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী এবং বাণিজ্যমন্ত্রীকে একটি গাইডলাইন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বৈঠকে প্যাকেজ ভ্যাটের আওতাভুক্ত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দাবির বিষয়টিও আলোচনায় এসেছে। এ সময় এনবিআর থেকে বলা হয়, এ খাতে একশ’ কোটি টাকার কম রাজস্ব আদায় হয়। ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী টার্নওভার সীমা বাড়ানো হলেও রাজস্ব আয়ে খুব প্রভাব পড়বে না। তখন প্রধানমন্ত্রী টার্নওভার বাড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে এফবিসিসিআই-এনবিআর যৌথ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী টার্নওভার ট্যাক্সের সীমা বাড়ানোর কাজ শুরু করেছে। এছাড়া দেশীয় শিল্প সুরক্ষার ক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক আরোপযোগ্য পণ্যের সংখ্যা বাড়ানোর ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রী দেশীয় শিল্পের সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এনবিআরকে নির্দেশ দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর নতুন ভ্যাট আইনের দ্বিতীয় তফসিল সংশোধন করে সম্পূরক শুল্ক আরোপযোগ্য পণ্যের সংখ্যা ১৭০টি থেকে বাড়িয়ে ৮০০-র কাছাকাছি নেয়ার কাজ শুরু করছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ভ্যাট হার ছাড়া অন্যান্য ইস্যু নিয়ে সোমবার থেকেই কাজ শুরু করেছে এনবিআর।
নতুন আইন-বিধি পর্যালোচনা করে এসআরও’র খসড়া চূড়ান্ত করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর বিদেশ সফরের আগে সেটি চূড়ান্ত করে তাদের সম্মতি নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ে পাঠানো হবে। অন্যদিকে আয়কর খাতে করদাতাদের স্বস্তি দিতে করমুক্ত আয় সীমা বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি ভ্যাটের প্রভাবে যেন কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে জন্য কর্পোরেট ট্যাক্স কমানোর বিষয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। একই সঙ্গে শিল্পবান্ধব রাজস্ব নীতি গ্রহণের জন্য এনবিআর কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। শিল্পের কাঁচামাল ও মেশিনারি আমদানিতে শুল্ক হ্রাস-বৃদ্ধির বিষয় নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার শিল্পায়ন চাচ্ছে। তাই আগামী বাজেটের রাজস্ব নীতি শিল্পবান্ধব হতে হবে। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন- অর্থ সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন, আয়কর নীতির সদস্য পারভেজ ইকবাল, প্রথম সচিব শব্বির আহমেদ, ভ্যাট নীতির সদস্য ব্যারিস্টার জাহাঙ্গীর হোসেন, প্রথম সচিব ফায়জুর রহমান ও শুল্ক নীতির সদস্য লুৎফর রহমান, প্রথম সচিব ফখরুল আলম প্রমুখ। ভ্যাট আইন সংশোধনের বিষয়ে জানতে চাইলে এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, দেশের বড় বড় কোম্পানি অনলাইনের আওতায় ভ্যাট দিচ্ছে। ভ্যাট থেকে আসা মোট রাজস্বে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই বড় কোম্পানিগুলো দিয়ে থাকে। এখন ভ্যাট আইন কার্যকরের ক্ষেত্রে হার ১৫ শতাংশের কথা বলা হচ্ছে। আমরা সর্বজনীনভাবে এটি ৭ শতাংশ প্রস্তাব করেছি। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এ হার কোনোভাবেই ১০ শতাংশের উপরে যাবে না। আর ছোটদের জন্য ভ্যাট অব্যাহতির সীমা দেড় কোটি টাকা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। আশা করছি সরকার সেটিও বিবেচনায় নেবে।
No comments