যৌতুকের জন্য লাশ হলেন মনিষা
২০ বছরের তরুণী ফাতেমা তুজ জোহুরা মনিষা লালমাটিয়া কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী। সেনাবাহিনীর এক মেজরের সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ের কথাবার্তা চলছিল তার। এর আগে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক গুলশান শাখার কর্মকর্তা এসএম খালেকুজ্জমান তারেকের সঙ্গে বিয়ের আলোচনা হয়। কিন্তু মনিষার পরিবার রাজি হয়নি। এ কারণে ওই বিয়ে হয়নি। কিন্তু মেজরের সঙ্গে যখন মনিষার বিয়ে পাকাপাকি, তখন মনিষাকে ফোন করে নানা প্রলোভন দেখায় তারেক। তাই মনিষা মেজরের সঙ্গে বিয়েতে রাজি হননি। একপর্যায়ে গত বছরের ২১ জানুয়ারি ব্যাংকার তারেকের সঙ্গেই মনিষার বিয়ে হয়। কিন্তু এর ১৬ মাসের মাথায় স্বামীর বাড়ি থেকে লাশ হয়ে ফিরেন মনিষা। রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকার এ গৃহবধূর স্বজনদের অভিযোগ, স্বামী তারেকই তাকে গলা টিপে হত্যা করেছে। ১০ লাখ টাকা ও একটি প্রাইভেট কার যৌতুকের জন্য প্রতিনিয়ত হুমকি-ধমকি দিচ্ছিলেন তিনি। মনিষার ওপর চলছিল অব্যাহত নির্যাতন। ১ মে তাকে দুই লাখ টাকা দেয়াও হয়।
কিন্তু পুরো টাকা না দেয়ায় ৫ মে মনিষাকে হত্যা করা হয়েছে। মনিষার বাবার দাবি, তার মেয়ের ঘাতকরা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাল্টে ফেলার চেষ্টা করছেন। একই কারণে আসামিদের গ্রেফতারেও আগ্রহ নেই পুলিশের। এদিকে মনিষার লাশ উদ্ধারের পর ১০ দিন ধরে পলাতক তার স্বামী তারেক, তারেকের বাবা মো. আখতারুজ্জামান, মা নাজমিন জামান এবং ভাই ওয়ালিদ। হাসপাতালে লাশ রেখেই তারা লাপাত্তা হয়ে যান। এ চারজনের নামে ৬ মে মামলা করা হলেও এখন পর্যন্ত কাউকেই গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দক্ষিণখান থানার এসআই কবির হোসেন যুগান্তরকে জানান, ঘটনার পর প্রথমে হাসপাতালে তারেক ও তার পরিবারের সদস্যরা বিষয়টিকে আত্মহত্যার চেষ্টা বলে উল্লেখ করে। পরে মনিষাকে মৃত ঘোষণার পর হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যায় তারা। এ থেকে মনে হচ্ছে, এটি একটি হত্যাকাণ্ড। তবে ময়না তদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার আগে এ বিষয়ে চূড়ান্ত মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তিনি জানান, পলাতক থাকায় আসামিদের গ্রেফতার করা যাচ্ছে না। তবে তাদের গ্রেফতারে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। প্রযুক্তির পাশপাশি মেন্যুয়াল পদ্ধতি কাজে লাগানো হচ্ছে। পর্যাপ্ত সোর্স নিয়োগ করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কে প্রভাবশালী, আর কে প্রভাবশালী নয়, তা দেখার দায়িত্ব আমার না। আমি দেখব আসামি। আসামিকে পেলেই গ্রেফতার করা হবে। আসামি যাতে দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে, সেজন্য ইমিগ্রেশনকে চিঠি দিয়েছি।’
মনিষার বাবা মোস্তফা কামাল বলেন, তারেকের মামা দেওয়ান মো. শামীম ঢাকা উত্তর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক। ময়নাতদন্তের রিপোর্টের ক্ষেত্রে শামীম প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করছেন। আসামিরা শামীমের ছত্রছায়ায় আছেন বলেও তিনি অভিযোগ করেন। মোস্তফা কামাল জানান, বিয়ের কাবিনের পর তারেককে ১০ ভরি স্বর্ণালংকার, ডায়মন্ডের আংটি এবং ঘড়িসহ অন্যান্য আসবাবপত্র দেয়া হয়। এর কিছুদিন পর থেকেই তারেক ১০ লাখ টাকা ও একটি এফ প্রিমিও প্রাইভেট কার যৌতুক হিসেবে দাবি করেন। ঘটনার ১০ দিন আগে তারেক এই বলে হুমকি দেন, যৌতুকের টাকা না দিলে মনিষাকে মেরে ফেলা হবে। মেয়ের সংসার ও সুখের কথা চিন্তা করে তাকে ১ মে দুই লাখ টাকা দেয়া হয়। বাকি টাকা দ্রুত দেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়। কিন্তু দুই লাখ টাকা নেয়ার চার দিনের মধ্যে তার মেয়েকে গলা টিপে হত্যা করে তারেক। তিনি আরও জানান, ৫ এপ্রিল রাত আড়াইটার দিকে তারেকের বাবা আখতারুজ্জামান তাকে ফোন করে জানায়, মনিষা অসুস্থ, তাকে উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনি হাসপাতালে গিয়ে দেখেন, তার মেয়ে কথা বলছে না। পরে দ্রুত তাকে টঙ্গী হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক জানান, হাসপাতালে আনার আগেই রোগী মারা গেছে। এ কথা জানার পর তারেক ও তার পরিবার হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যান। পরে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বিষয়টিকে এখন আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা চলছে বলে মোস্তফা কামাল অভিযোগ করেন। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট প্রভাবিত করার চেষ্টা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. প্রণয় ভূষণ দাস যুগান্তরকে বলেন, একটা ঘটনা ঘটলে বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন আসতেই পারে। এসব ওভারকাম করেই চাকরি করতে হয়। যত চাপই আসুক না কেন, ঘটনা যা ঘটেছে রিপোর্টে তাই উল্লেখ থাকবে। আগামী সপ্তাহেই ময়নাতদন্তের রিপোর্ট দেয়া হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন,
‘রিপোর্টে যদি কোনো ভুল হয় তবে তা হবে আমার জ্ঞানের অভাবে। কোনো চাপ বা প্রলোভন আমাকে টলাতে পারবে না।’ এদিকে তারেক, তার বাবা, মা ও ভাইয়ের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাদের নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। তারেকের মামা ঢাকা উত্তর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান মো. শামীম জানান, যেহেতু একটি ঘটনা ঘটেছে তাই সংশ্লিষ্ট পরিবারের সদস্যরা অনেক কথাই বলবে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার পরই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ময়নাতন্তের রিপোর্ট পাল্টানো যায় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কোনো প্রভাব খাটানোর চেষ্টা চলছে না। তার দাবি, হত্যাকাণ্ড ঘটানোর মতো ছেলে তারেক নয়। যেহেতু মামলা হয়েছে তাই পরিস্থিতি তারেকের পরিবারের সদস্যদের বিপক্ষে গেছে। এ কারণে তারা প্রকাশ্যে থাকছেন না। ঘটনার দুই-তিন দিন পর পর্যন্ত তারেকের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল উল্লেখ করে দেওয়ান মো. শামীম বলেন, ওই রাতে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তারেকের সঙ্গে মনিষার ঝগড়া হয়েছিল। পরে মনিষা বাথরুমে চলে যায়। দীর্ঘ সময়েও সে বের না হওয়ায় তারেক বাথরুমে গিয়ে দেখে, গলায় ওড়না পেঁচানো অবস্থায় মনিষা ঝুলছে। পরে তারেকের ভাই এবং মা-বাবার সহযোগিতায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হাসপাতালে সাংবাদিক আসায় তারেক ও তার পরিবারের সদস্যরা ভয় পেয়েছিল। এ কারণে তারা হাসপাতাল থেকে চলে যায়।
No comments