ধর্মীয় মৌলবাদ বনাম বাঙালি সংস্কৃতি
ধর্মীয় মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদ এক ভয়াবহ বিপদ হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। তবে আমি মনে করি, একে মোকাবিলা করা ও পরাস্ত করা কঠিন কিছু নয়। কারণ, বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধর্মীয় মৌলবাদের অনুকূলে নয়। ধর্মীয় মৌলবাদের, বিশেষ করে ইসলামি মৌলবাদের একটা আন্তর্জাতিক চরিত্র আছে। ইসলামি মৌলবাদের উৎস হচ্ছে আরব জগৎ ও মধ্যপ্রাচ্য। কিন্তু সেখানকার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সমাজ থেকে বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সমাজ একেবারে ভিন্ন। আমাদের আছে একটি সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, যার মধ্যে রয়েছে মানবতাবোধ ও ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি উদার দৃষ্টিভঙ্গি। আরব দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য তেমন কখনোই ছিল না। আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের পাশাপাশি আরও ছিল বামপন্থী ও সাম্যবাদী রাজনৈতিক আন্দোলন, যা একসময় যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। এই সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গিও আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির মধ্যে ভালোভাবেই দেখা যাবে, যা মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস ও সংস্কৃতির মধ্যে দেখা যাবে না। তবে মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামি মৌলবাদের ক্ষেত্রে অন্য একটি জিনিস দেখা যাচ্ছে। কোনো কোনো ধর্মীয় সংগঠন মৌলবাদের চর্চা করলেও পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদবিরোধী উপাদানও তার মধ্যে দেখা যায় এবং সেই কারণে তারা জনপ্রিয়ও বটে। যেমন লেবাননে হিজবুল্লাহ অথবা গাজায় হামাস। তারা সশস্ত্রও বটে।
১৯৯৯ সালে ইউএনডিপি এক রিপোর্টে উল্লেখ করেছিল: ‘বিশ্বজোড়া ভোগবাদী সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক সমসত্ত্বতা গড়ে তোলার জেরে মৌলবাদী তৎপরতা বেড়েছে। স্থানীয় আঞ্চলিক সংস্কৃতিচর্চায় ফের উৎসাহ দেখা দিচ্ছে। রাজনৈতিক আন্দোলনে স্থানীয় সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয় রক্ষার প্রশ্নটি গুরুত্ব পাচ্ছে। মৌলবাদী আন্দোলনগুলোর বিকাশের মধ্যে তা প্রতিফলিত হয়।’ মধ্যপ্রাচ্যে পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে স্বজাতীয় সংস্কৃতি ধরে রাখার ও আত্মপরিচয় তুলে ধরার প্রবণতার মধ্যে জাতীয়তাবাদী উপাদান আছে, যার সঙ্গে ইসলামকে এক করে দেখার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে কোনো মৌলবাদী সংগঠন, তা জামায়াত, হেফাজত, জেএমবি—যে-ই হোক, কারও কথায় বা কাজে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী উপাদান নেই। জাতীয়তাবাদী উপাদানও নেই। বরং এই ধরনের সব ধর্মীয় রাজনৈতিক দল ও সংগঠন বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাঙালি সংস্কৃতিকেই অস্বীকার করতে চায়। ঠিক এই কারণেই ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠনগুলো এই দেশে কোনো গণভিত্তি অর্জন করতে আগেও পারেনি, এখনো পারবে না। ধর্মীয় মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদ খুবই বিপজ্জনক। তারা বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি করতে পারে। তারা মানুষ খুন করেছে, হয়তো ভবিষ্যতে আরও করবে। তাদের অবশ্যই পুলিশ-প্রশাসন দ্বারা দমন করতে হবে। কিন্তু তাদের পরাজিত করার প্রধান অস্ত্র হলো মতাদর্শ ও সংস্কৃতি। যারা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিই মানে না, তারা কী করে বিস্তার লাভ করবে? অন্যদিকে আমাদের সাংস্কৃতিক শক্তি প্রবল। লেখক-সাংবাদিক আনিসুল হক গত ১১ এপ্রিল প্রথম আলোয় ‘ফুল তোমাকে ফুটিতেই হইবে’ শীর্ষক এক নিবন্ধের শেষে লিখেছেন: ‘আমরা জানি, আমাদের মুক্ত সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে বাধা আছে। বাধা আছে এবং আক্রমণও আছে। তা সত্ত্বেও সরকার বা রাষ্ট্রের শক্তি নয়, আমরা আমাদের সমাজের শক্তির ওপরই আস্থা রাখতে পারি।
বাংলাদেশের মানুষের পরাজয় নেই, কারণ তার সংস্কৃতি আছে।’ আমাদের এই সংস্কৃতির ভিত্তি বা উৎস ধর্ম নয়, বরং লোকায়ত চিন্তা ও ভাবাদর্শ, যা প্রজন্ম–পরম্পরায় চলে আসছে। সেই চর্যাপদের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত। শুধু আধুনিক লিখিত সাহিত্যে নয়, পালা, পল্লিগান, যাত্রা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতির প্রকাশ ও বিস্তার আমরা দেখি, যার মধ্যে কিছু ধর্মীয় বিষয় ও কখনো কখনো রাজপুরুষদের কাহিনি থাকলেও (মহাকবি ও শ্রেষ্ঠ নাট্যকার শেক্সপিয়ারের নাটকেও রাজরাজড়ার ও ভূত-প্রেতের কাহিনি আছে) মর্মবস্তুর মধ্যে যা প্রধান ছিল, তা হলো মানুষের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও উদারপন্থী মতবাদ। ঐতিহাসিক সুজিত আচার্য ‘বাংলায় ইসলাম ধর্মের আদিপর্ব’ নামক রচনায় বলেছেন, এ দেশে ইসলাম ধর্ম বিস্তার লাভ করেছিল তরবারির জোরে নয়, বরং সুফি মতবাদী ধর্ম প্রচারকদের দ্বারা। তাঁদের মতবাদের সঙ্গে এই দেশের শোষিত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা তাদের সহজিয়া মতবাদের অনেক সামঞ্জস্য খুঁজে পেয়েছিল। ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের অনেক আগেই যে বৌদ্ধধর্মের সহজিয়া মতবাদ ও বেদবিরোধী লোকায়ত দর্শন জনমনে গভীরভাবে স্থান করে নিয়েছিল, তার মানবিক দিক ছিল অনেক বেশি। সহজিয়া সাহিত্যে বৈদিক ধর্ম, পৌরাণিক পূজাপদ্ধতি, এমনকি বৌদ্ধধর্মের অনেক আচার-নিষ্ঠাকে কটাক্ষ করা হতো। বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক মহাপুরুষ শ্রীচৈতন্য (জন্ম ১৪৮৬ সাল) এবং কবি চণ্ডীদাস ছিলেন সহজিয়া মতবাদের সগুণ ধারার প্রতিনিধি। শ্রীচৈতন্য নিজে ব্রাহ্মণ হলেও জাতিভেদের বিরুদ্ধে ছিলেন এবং তাঁর অনেক মুসলমান শিষ্য ছিল। কবি চণ্ডীদাসই বলেছিলেন, ‘সবার উপর মানুষ সত্য,
তাহার উপর নাই।’ সহজিয়া নির্গুণ ধারার প্রতিনিধি ছিলেন বাউল সাধকেরা। তাঁদের গানে কিছু আধ্যাত্মিক বিষয় থাকলেও মানবিক দিকটাই ছিল প্রধান। এবং তা ছিল হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সংগীত সাধনা। বাউলসংগীতের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু-মুসলমানের কণ্ঠ মিলেছে। কোরআন-পুরাণ ঝগড়া করেনি। এই মিলনেই ভারতের সভ্যতার সত্য পরিচয়, বিবাদ বিরোধে বর্বরতা।’ (মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন কর্তৃক বাউল সংকলন হারামনির ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য)। ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র কৃষক সংগ্রাম (যথা অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধজুড়ে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ), ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ, নীলকরবিরোধী কৃষক বিদ্রোহ, উনিশ শতকের পাবনা ও অন্যান্য অঞ্চলে প্রজা বিদ্রোহ—এই সবই ছিল এই দেশের সাধারণ কৃষক ও শ্রমজীবীর সংগ্রাম, হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সংগ্রাম। অবশ্য এসব সংগ্রামের সঙ্গে ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগ্রত উচ্চবর্ণের হিন্দু অথবা নবাব আবদুল লতিফের মতো অভিজাত মুসলমানদের কোনো সংশ্রব ছিল না। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে হিন্দু পুনর্জাগরণবাদের প্রবাহ দেখা দিয়েছিল, যার প্রধান প্রবক্তা ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। অন্যদিকে প্রায় একই সময় নবাব আবদুল লতিফ প্রমুখের নেতৃত্বে মুসলিম জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ঘটে, যাঁরা জাতীয়তাবাদের উৎস খুঁজতেন দেশের বাইরে আরব, ইরান ও তুরস্কে। নবাব আবদুল লতিফ মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি মোহামেডান সোসাইটি গঠন করেছিলেন, যেখানে ইংরেজি ভাষার চর্চা হতো, কিন্তু বাংলা ভাষা নিষিদ্ধ ছিল। তখন থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তথাকথিত অভিজাত মুসলমানরা ঘরে উর্দু বলত। পরবর্তী সময়ে ভাষা আন্দোলন সেই আভিজাত্য ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। জিন্নাহ ও মুসলিম লিগের নেতারা তথাকথিত অভিজাত মুসলমানদের জানতেন ও চিনতেন। সাধারণ মুসলমান জনগণের সঙ্গে পরিচয় ছিল না। তাই বাংলা ভাষাকে তাচ্ছিল্য করার এবং উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার মতো ঔদ্ধত্য দেখাতে পেরেছিলেন, যার উপযুক্ত জবাব তিনি সঙ্গে সঙ্গেই পেয়েছিলেন। পাকিস্তানি শাসকেরাও নানাভাবে চেষ্টা করেছিলেন বাংলা ভাষা বিকৃত করার এবং বাঙালির সংস্কৃতি ধ্বংস করার। কিন্তু পারেননি।
কারণ, এই সংস্কৃতির অভ্যন্তরীণ বল অনেক বেশি। বরং পাকিস্তানি ভাবাদর্শ ছিল বড়ই ঠুনকো, তাই তা টিকতে পারেনি। তবে এ কথা সত্য যে গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তান আন্দোলনের জোয়ারে সাময়িকভাবে হলেও ভেসে গিয়েছিল এই দেশের মুসলিম জনগণ। তারা ভুল বুঝেছিল। কৃষক ভেবেছিলেন জমিদারি শোষণ থেকে মুক্তি পাবেন। মধ্যবিত্ত ভেবেছিল তাদের শ্রেণিগত উন্নতি হবে। দ্রুতই তাদের স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছিল। পাকিস্তান আমলে ধর্মীয় সুড়সুড়ি দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু কাজে আসেনি। এখনো যারা মনে করে, মুসলমানিত্ব পরিচয়ের জন্য বাঙালিত্ব ঘুচিয়ে দিতে হবে, তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করে। তারাই পয়লা বৈশাখের বিরোধিতা করে, আলপনা আঁকাকে সুন্দর আর্ট হিসেবে না দেখে আলপনার গায়ে কালি লাগায়, ভাস্কর্যের সৌন্দর্য উপভোগ করতে জানে না। আমাদের দেশে ধর্মীয় সংস্কারভিত্তিক সামাজিক আন্দোলন হয়েছিল ইংরেজ আমলেও। ওয়াহাবি আন্দোলন ও ফরায়েজি আন্দোলন ইতিহাসবিখ্যাত। এসব আন্দোলন ইসলাম ধর্মের সংস্কার দিয়ে শুরু হলেও তা ব্রিটিশ রাজবিরোধী ও জমিদারবিরোধী শ্রেণিসংগ্রাম ও জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে পরিণত হয়েছিল। শহীদ বীর তিতুমীর মুসলমান কৃষককে ধর্মশিক্ষা দিতেন, আরবি-ফারসি শব্দে নাম রাখা ও ‘আকিকা’ করার কথা বলতেন। তিনি দাড়ি রাখার গুরুত্বও তুলে ধরেছিলেন। ফরায়েজি আন্দোলনের নেতা পীর মহসিন উদ্দিন দুদু মিয়া পোশাকপরিচ্ছদে হিন্দু থেকে মুসলমানদের স্বতন্ত্র হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি ধুতিকে হিন্দুর পোশাক বলে ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু ওয়াহাবি নেতা তিতুমীর অথবা ফরায়েজি আন্দোলন জনপ্রিয় হয়েছিল এসব কারণে নয়। তাদের জমিদারবিরোধী সংগ্রামেই হিন্দু-মুসলমাননির্বিশেষে সব কৃষক ও গরিব মানুষ যোগদান করেছিল। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, আমাদের সংস্কৃতিতে ধর্মীয় চেতনা কখনোই প্রাধান্য বিস্তার করেনি। বরং অসাম্প্রদায়িক চেতনা, মানবিক মূল্যবোধ ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি—যা আমাদের লোকায়ত সংস্কৃতির উপাদান হিসেবে ছিল এবং এখনো আছে, তা খুবই শক্তিশালী। তাই আনিসুল হকের কথার প্রতিধ্বনি করে আবারও বলব, ‘বাংলাদেশের মানুষের পরাজয় নেই, কারণ তার আছে সংস্কৃতি।’ হায়দার আকবর খান রনো: রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।
No comments