চকবাজারের ভয়ঙ্কর সেই কেয়ারটেকার
রাজধানীর চকবাজারের সোয়ারীঘাট ৩০/৬ কামালবাগের বাড়ির সেই কেয়ারটেকার বাবুলের বিষয়ে ভয়ঙ্কর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ভাড়া তোলার নাম করে সে হানা দিত ভাড়াটিয়াদের ঘরে ঘরে। পুরুষদের অনুপস্থিতে সে তরুণী ও গৃহবধূদের সর্বনাশ করত। ওই বাড়িতে ১৪টি টিশশেড ঘরে তুলনামূলক নিন্ম আয়ের লোকজন থাকত। বাড়ির সামনে একাধিক পিতল কারখানার মালিক-শ্রমিকরাও ছিল তার কাছে জিম্মি। ওই বাড়ি ও আশপাশের জমিজমার মালিক স্থানীয় জাফর। কিন্তু জাফর সেখানে থাকতেন না। জাফরের সবকিছুই দেখাশোনা করত বাবুল। বাবুলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে ভুক্তভোগীরা জাফরের কাছে অভিযোগ দিলেও তিনি বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতেন না। উল্টো ভুক্তভোগীদের বলতেন- ‘এভাবে থাকতে পারলে থাক, না হলে বাড়ি চেড়ে চলে যাও।’
বাবুলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ার কারণ হিসেবে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জাফর জানিয়েছেন, ‘ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করা কঠিন। এ কঠিন কাজটি বাবুল সহজেই করতে পারত। ঠিকমতো ভাড়া আদায় করে দিত। এ কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।’ পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, কামালবাগের ওই বাড়ির একটি টিনশেড ঘরের ভাড়াটিয়া সিরাজ উদ্দিন মাতব্বরের মেয়ে শিউলির ওপর কুদৃষ্টি পড়ে বাবুলের। বিভিন্ন সময় শিউলিকে অনৈতিক প্রস্তাবও দেয় বাবুল। কিন্তু শিউলি এতে রাজি হয়নি। সবার সঙ্গে হেসে কথা বলতেন শিউলি। কারখানা শ্রমিক শাকিলের সঙ্গেও মাঝেমধ্যে কথা বলতেন। সোমবার রাতে পুতুল কারখানা থেকে কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে পিতল কারাখানা শ্রমিক শাকিলের সঙ্গে রাস্তায় দেখা হয় শিউলির। এ সময় তারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। বিষয়টি দেখে বাবুল তাদের দু’জনকে ধরে নিয়ে যায় তার ঘরে। পরে দু’জনকে বিয়ের জন্য চাপ দেয়। বাবুলের পরিকল্পনা ছিল ওই দু’জনকে বিয়ে দিতে পারলে পরে সুবিধাজনক সময়ে বাবুল তার হীন ইচ্ছা চরিতার্থ করতে পারবে। কিন্তু শাকিল এবং শিউলির কেউই বিয়েতে রাজি হয়নি। বিয়েতে রাজি করাতে শাকিলকে মারধর করে বাবুল। শিউলিকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার ভয় দেখায়। অপবাদ দেয়া, এমনকি পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার হুমকি দেয়। পরে গভীর রাতে আশপাশের ঘরের সব ভাড়াটিয়াকে ডেকে তুলে কাজী এনে শাকিল এবং শিউকে জোর করে বিয়ে দেয় বাবুল। রাত ৩টার দিকে তাদের একটি ঘরে থাকতে দেয়া হয়। এর তিন ঘণ্টা পর ভোর ৬টার দিকে শিউলি চিৎকার করতে করতে জানায়, তার অস্বস্তি লাগছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। এরপর তাকে প্রথমে মিডফোর্ট হাসপাতাল ও পরে দুপুর পৌনে ১২টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনার পর বাবুলের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করে ভাড়াটিয়া, কারখানা শ্রমিক ও স্থানীয় ভুক্তভোগীরা। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চকবাজার থানার এসআই আসম আতিকুর রহমান জানান, ঘটনার দিন শিউলির বাবা সিরাজ উদ্দিন মাতব্বর চন্দ্রপাড়ায় ওরসে চলে যান। তার ভাই হৃদয় রাতে জুতার করাখানায় কাজে চলে যান।
অপর ভাই বিপ্লব মাণ্ডায় থাকেন। ওই রাতে শিউলির অন্য কোনো অভিভাবক না থাকায় মা নার্গিস বেগম ও শাকিলের ভাই কারখানা শ্রমিক দাদনকে চাপে ফেলে বিয়েতে রাজি করান বাবুল। এ সময় শিউলি জানায়, বিয়ে দেয়া হলে তিনি বিষপানে আত্মহত্যা করবেন। শাকিলও এ বিয়েতে রাজি ছিল না। কিন্তু মাওলানা ছাড়াই কাজী ডেকে জোর করে তাদের বিয়ে দেয়া হয়। এ ব্যাপারে শিউলি আক্তারের মা নার্গিস বেগম চারজনকে আসামি করে মামলা করলে মঙ্গলবার রাতে বাড়ির কেয়ারটেকার বাবুল, কারখানা শ্রমিক ও বিয়ের সাক্ষী শাহজাহান, বিয়ের উকিল মা মাকসুদা ও বিয়ের কাজী মো. জাহাঙ্গীরকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর জোর করে বিয়ে দেয়ার কথা স্বীকার করেছে বাবুল। শাহজাহান জানায়, বাবুল স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় তিনি বাবুলের কথায় সাক্ষী হয়েছেন। একই ধরনের কথা জানান উকিল মা মাকসুদা। কাজী জাহাঙ্গীর জানান, চাপের মুখে তিনি গভীর রাতে বিয়ের ব্যবস্থা করেন। বাবুলের ভয়ে তিনি ছেলে-মেয়ের অভিভাবকের খোঁজ নেননি। এসআই আরও জানান, চার আসামিকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। প্রধান সাক্ষী হিসেবে ১৬৪ ধারায় শাকিলের জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে। চকবাজার থানার ওসি শামীম অর রশিদ তালুকদার জানান, বিয়ের পর জোর করে শিউলি ও শাকিলকে এক ঘরে থাকতে দেয়া হয়। তবে তারা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে জাড়াননি। দু’জনকে এক ঘরে দেয়ার পর থেকেই শিউলি কাঁদতে থাকেন। একপর্যায়ে শাকিল ঘুমিয়ে যায়। ভোরে শিউলির অবস্থা খারাপ দেখে শিউলির মাকে খবর দেয় শাকিল। এরপর শিউলিকে হাসপাতালে নেয়া হয়। ওসি জানান, বিয়ের আগে শিউলি বিষ খাওয়ার হুমকি দিলেও সুরতহাল করার সময় বিষ খাওয়ার আলামত পাওয়া যায়নি। তবে লাশের চোখ দুটি অস্বাভাবিক কালো ছিল। নাকে লালার মতো তরল পদার্থ ছিল। শামীম অর রশিদ তালুকদার জানান, কেয়ারটেকার বাবুলের স্বাভাব-চরিত্রও খুবই খারাপ ছিল। তিনি আরও জানান, চকবাজার থানার কাজের বুয়া ওই বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। কেয়ারটেকারের অসৌজন্যমূলক আচরণের কারণে মাস ছয়েক আগে তিনি ওই বাড়ি ছেড়ে দেন। স্থানীয় তিন সন্তানের জননী জুতার কারখানার এক শ্রমিক বলেন, বাবুলের স্বভাব খুবই খারাপ ছিল। তিনি জানান, এক মেয়ের সর্বনাশ হয়েছে বাবুলের হাতে। তাকেও বাবুল বেশ কয়েকবার কুপ্রস্তাব দিয়েছে। বাড়ির মালিক জাফরের কাছে নালিশ করেছিলাম। কোনো লাভ হয়নি।
বুধবার বিকালে কামালবাগের ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ভেতর থেকে মূল গেটে তালা ঝুলছে। বিকল্প পথে (কারখানার গেট দিয়ে) ওই বাড়ি প্রবেশ করা হয়। সেখানে গিয়ে জানা যায়, কারখানায় কাজ শেষে উপরে মাচায় ঘুমাত শাকিল। কারখানার পেছনের টিনশেট ঘরগুলোর একটি ঘরে মা-বাবা ও এক ভাইয়ের সঙ্গে থাকতেন শিউলি। ওই টিনশেট ঘরগুলোর দু’টিতে স্ত্রী সন্তান নিয়ে থাকে কেয়ারটেকার বাবুল। বাড়ি দেখা-শোনার পাশাপাশি ফলের ব্যবসা করত সে। দুই ছেলে ও এক মেয়ের জনক বাবুল। তার বড় ছেলে রকি কলেজে পড়ে। ছোট ছেলে রনি বাবার সঙ্গে ফল বিক্রি করে। স্থানীয় পিতল কারখানার মালিক মামুন বলেন, ‘বাবুলের আচার আচরণ ও চালচলন খুবই খারাপ ছিল। ভাড়া চাওয়ার অজুহাতে যখন তখন যে কারও ঘরে ডুকে যেত সে। এ নিয়ে আমরা খুবই বিব্রতকর অবস্থায় ছিলাম। কিন্তু কারখানার জায়গা ও ঘরগুলোর মালিক জাফর তাকে আশকারা দিতেন। এ কারণে আমরা কেউই তার বিরুদ্ধে কথা বলতে পারতাম না। একই ধরনের তথ্য জানান, কারখানা শ্রমিক কামাল ও আল আমিন এন্টারপ্রাইজের মালিক বাবুল মিনা। ভাড়াটিয়া খাদিয়া এবং ফারজানার কাছে বাবুল মিয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘আমরা নিন্ম আয়ের মানুষ। তুলনামূলক কম টাকায় এখানে ভাড়া থাকি। বাবুল মিয়া খুবই প্রভাবশালী। তাই তার বিরুদ্ধে কিছু বলতে চাই না।’ শিউলির মা নার্গিস বেগম জানান, বাবুলই ষড়যন্ত্র করে তার মেয়েকে হত্যা করেছে।
No comments