খুনের আসামির সাংসদ থাকা কি বৈধ? by মিজানুর রহমান খান
দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য রাখছেন ফারুক আহমেদের স্ত্রী নাহার আহমেদ |
টাঙ্গাইলের
মানুষ মুক্তির নিশ্বাস ফেলেছেন। তাঁরা সরকারের প্রতি সন্তোষ প্রকাশ
করেছেন। যাঁরা হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন, তাঁরা আস্থা ফিরে পেয়েছেন। অবশ্য দ্রুত
বিচারের ফলাফল না দেখা পর্যন্ত অনেকেই সন্দিগ্ধ থাকবেন। আওয়ামী লীগের সাংসদ
রানার বিরুদ্ধে চার্জশিটের খবরে তাঁরা খুব অবাক হয়েছেন। এর আগে রানাদের
বিরুদ্ধে থাকা অর্ধশত মামলা তাঁদের দমাতে পারেনি। সরকার নিজেই ‘রাজনৈতিক
বিবেচনায়’ মামলা তুলেছে। তাই অভিযোগপত্রের পর থেকে গোটা অঞ্চলে বলাবলি
চলছে, সত্য তাহলে পরিণামে জয়ী হয়!
টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যা মামলাটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর সুপারিশ করেছেন। আইন বলেছে, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলা স্থানান্তরের ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে বিচার শেষ হবে। ‘অনিবার্য’ কারণে না পারলে কারণ দর্শিয়ে ও সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়ে পরের ৩০ দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে। এরপরও বিলম্বের ‘যুক্তিসংগত’ কারণ দেখিয়ে শেষবারের মতো আরও ১৫ দিন মিলবে। সর্বোচ্চ ১৩৫ দিনের মধ্যে আমরা কি সত্যিই সাংসদ রানার বিচার অনুষ্ঠান দেখব? এই বাংলাদেশ আমরা কি গড়েছি? একজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার বিচার ১৩৫ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করার সর্বোচ্চ অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করছে। আওয়ামী লীগের একজন সাংসদ আওয়ামী লীগের একজন মুক্তিযোদ্ধা নেতাকে হত্যার অভিযোগের বিচার আগামী ৯০ থেকে ১৩৫ কার্যদিবসে আমরা দেখতে চাই। রাকিব-রাজনের হত্যার দ্রুত বিচারের সাফল্যের মডেলে ফারুক খুনেরও বিচার চাই। কারণ, এই খুনের বহুমাত্রিক রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। সব থেকে বড় তাৎপর্য আওয়ামী লীগের দলীয় শৃঙ্খলার জন্য। অভিযোগপত্র মতে, জেলা সাধারণ সম্পাদকের পদের লড়াইয়ে ফারুককে খুন হতে হয়েছে। ২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারি রাতে ফারুক আহমেদের গুলিবিদ্ধ দেহ পড়ে ছিল টাঙ্গাইল শহরের কলেজপাড়া এলাকায় তাঁর বাসার কাছের রাস্তায়।
এখন প্রশ্ন হলো, রানার সংসদ সদস্য পদ তাহলে কখন খোয়া যাবে? অভিযোগপত্র দায়ের হয়েছে তো কী হয়েছে? সংবিধান বলছে, দুই বছর দণ্ডিত হলে সংসদ সদস্য পদ খোয়া যাবে। কিন্তু এই পোড়া দেশে রুগ্ণ রেওয়াজ তৈরি হয়ে আছে যে এই ‘দণ্ডিত’ মানে চূড়ান্ত দণ্ডিত নয়। এটা একেবারে হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট হয়ে একেবারে রিভিউ কোর্ট পর্যন্ত যেতে হবে। তার আগ পর্যন্ত সবাই ধোয়া তুলসী পাতা। তার আগ পর্যন্ত কাউকে সন্দেহভাজন হিসেবে কোনো কিছু থেকে বারিত করা যাবে না। এ রকম ব্যাখ্যা করে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ লোক আমাদের চোখের সামনে দায়িত্বশীল পদে কাজ করে গেছেন এবং যাচ্ছেন। মুখ লুকিয়ে বা কাঁচুমাচু করে নয়, বীরদর্পে করছেন। প্রভাবশালী হলে কারও কোনো অসুবিধা হয়নি বা হচ্ছে না। এর দুটো দিক আছে। যদি সাজানো মামলা হয় তাহলে পরে বিচার–প্রক্রিয়ার বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ থাকবে। আর যেখানে তা থাকবে না, সেখানে এই প্রশ্ন থাকবে না। সাংসদ রানা খুনের দায়ে যে প্রক্রিয়ায় অভিযুক্ত হয়েছেন, তা গ্রহণযোগ্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা মানব যে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁর নিজেকে নির্দোষ দাবি করার অধিকার আছে। তাঁর এই অধিকারের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু প্রশ্নটি হলো, তিনি যেহেতু একটি স্পর্শকাতর সাংবিধানিক পদে আছেন, তিনি কি বিচার শেষের আগ পর্যন্ত সংসদের বৈঠকে বসবেন? সামাজিক অনুষ্ঠানে তিনি অতিথি হবেন? নাকি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবেন আর নির্দোষ প্রমাণিত হলে আবার জনগণের কাছে ভোট চাইবেন? এসব নৈতিক প্রশ্ন ভারতে অনেক বড় মাপে উঠেছে। প্রায় ৩০ শতাংশ সাংসদ ও এমএলএ প্রার্থীর ফৌজদারি অভিযোগ মোকাবিলা করার প্রেক্ষাপটে পাবলিক ইন্টারেস্ট নামে একটি ফাউন্ডেশন ভারতের সুপ্রিম কোর্টে মামলা ঠুকে দিল। তারা বিবিধ প্রতিকার চাইল। তার অন্যতম ছিল কারও বিরুদ্ধে কোনো আদালত অভিযোগপত্র গঠন করলে নির্বাচনে তাঁকে অযোগ্য ঘোষণা করা। তাঁদের দ্রুত বিচারের জন্য গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে তারা নতুন বিধান আনতে বলল। তারা বলল, তাঁদের বিচার হতে হবে স্পেশাল ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে। টাঙ্গাইলের এসপি তাই ইতিমধ্যে ঠিক পদক্ষেপটি নিয়েছেন। ইন্দিরা গান্ধী বনাম রাজনারায়ণ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বলেছিলেন, নির্বাচিত সাংসদ অভিযুক্ত হলে সব কাজ ফেলে এটা আগে নিষ্পত্তি করতে হবে।
সামগ্রিক নির্বাচনী অযোগ্যতা বিষয়ে আইন কমিশনের মতামত চেয়েছিলেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। আমাদের নির্বাচন কমিশনকে এ বিষয়ে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। গত পৌর নির্বাচনে বহুসংখ্যক ব্যক্তি ফৌজদারি মামলা নিয়ে নির্বাচন করেছেন বা অযোগ্য হয়েছেন। আবার আসন্ন ইউপি নির্বাচনেও একই সমস্যা আমরা আরও ব্যাপকভাবে দেখতে পাব। বিচারপতি এ পি সাহার নেতৃত্বাধীন ভারতীয় আইন কমিশন ২০১৪ সালের রিপোর্টে উল্লেখ করে যে ‘আমরা একটি বিকল্প প্রস্তাব পেয়েছি, যেখানে গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত, যার অন্তত পাঁচ বছরের দণ্ডলাভের আশঙ্কা আছে, তাঁকে নির্বাচনে প্রার্থী হতে দেওয়া উচিত। যেখানে তাঁরা এমপি বা এমএলএ হবেন, সেখানে তাঁরা নির্বাচনে অংশ নেবেন ঠিক আছে, তবে তাঁদের বিশেষ ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট মোকাবিলা করতে হবে। এ রকম বিধান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে ঢোকাতে হবে। আর নির্বাচিত সাংসদদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে। অভিযুক্ত হিসেবে তিনি স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। দণ্ডিত হওয়া মাত্র আপনাআপনি স্পিকার ও নির্বাচন কমিশন দণ্ডিতের পদ শূন্য ঘোষণা করবে। আপিল করেছেন কি করেননি সেটা দেখার জন্য স্পিকার বা ইসি অপেক্ষায় থাকবে না। কিন্তু গভীর পরিতাপের বিষয় হলো এই বিষয়ে আমাদের দেশে যা ঘটে চলেছে, তা হৃদয়বিদারক বললে কম বলা হয়।
বিচারপতি বি পি জীবন রেড্ডি ও আইনজীবী ফলি এস নরিম্যানের দৃঢ় সুপারিশ ছিল মনোনয়নপত্র জমার তারিখের ছয় মাস আগে যদি কারও বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ গঠন হয়, তাহলে তিনি আপনাআপনি অযোগ্য হবেন। আইন কমিশন মতামত নিতে যত বিশেষজ্ঞ ডেকেছিলেন, সবাই এর সপক্ষে মত দেন। আইন কমিশনও তা-ই মেনে নেয়। তারা অবশ্য বলেছে, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার এক বছর আগে অভিযোগ গঠন হলে তাঁরা অযোগ্য হবেন না। খালাস পাওয়া বা ছয় বছর পার হওয়ায় এর মধ্যে যেটা আগে ঘটে, সেই মেয়াদের পরে কারও অযোগ্যতা চলে যাবে। অনেকে অবশ্য অভিযোগপত্র দাখিল হলেই অযোগ্য করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। সেটা টিকল না। কারণ, পুলিশ সেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে না শুনে শুধু তথ্যের বিবরণ দেয়। আর অভিযোগ গঠনে বিচারিক মনের প্রতিফলন ঘটে। কিন্তু সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা যথারীতি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু সেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এসেছিল, যা আমি আমাদের দলগুলোকে মানতে বলব। সেটা হলো, গুরুতর অপরাধে কেউ অভিযুক্ত হওয়ামাত্র দলেও তাঁর সদস্যপদ স্থগিত থাকবে। কিন্তু এ ধরনের নিয়ম আমরা চালু করতে পারব না, যতক্ষণ না আমরা জনপ্রতিনিধিদের জন্য দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে পারি। আর এই সুপারিশ সরকার মানলেও বিপদ। কারণ, বিরোধী বা ক্ষমতাসীন দলের প্রতিপক্ষরা প্রমাদ গুনতে পারেন এই আশঙ্কায় যে তাঁরাই আবার শিকারে পরিণত হন কি না। কিন্তু আমি বলব, অপব্যবহারের আশঙ্কায় সংস্কারের রথ থামানো সমীচীন হবে না। ভারতের আইন কমিশনের সুরেই বলব, অভিযোগ গঠন পর্যায়ে অযোগ্যতার বিধান আনা যাবে, তবে তার অপব্যবহার যাতে না ঘটে সে বিষয়ে উপযুক্ত রক্ষাকবচ থাকতে হবে।
এর আগে অনেকের কিছু হয়নি বলে রানারও কিছুই হবে না, সেটা হলফ করে বলা যায় না। তবে কতগুলো বিষয় দেখার মতো। প্রচলিত আইন এ রকম একজন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে রক্ষায় কিন্তু সব রকম ফাঁক তৈরি করে রেখেছে বলে প্রতীয়মান হয়। এমনকি টাঙ্গাইল শহরেও যেখানে আমাদের প্রিয় নিহত মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক ফারুকের প্রতি প্রচণ্ড সহানুভূতি রয়েছে, সেখানেও তাঁর সন্দেহভাজন ঘাতককে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্ঠান বরখাস্ত করার ঝুঁকি নেয়নি। গত রাতে ফারুকের স্ত্রী আমাকে বলেন, ‘আমি আমার মুক্তিযোদ্ধা স্বামী হত্যার বিচার চাই এবং দল থেকে তাঁর (সাংসদ রানা) বহিষ্কার চাই।’ আওয়ামী লীগ এর আগে টাঙ্গাইলের সাংসদ আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে বহিষ্কার করেছিল। এবার আরও বেশি স্পর্শকাতর কারণে রানাকে তাদের বহিষ্কার করা উচিত। ক্ষমতাসীন দলের উচিত নয় ‘আইনের আপন গতি’ অবলোকনে আরও অপেক্ষা করা। এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ, নির্বাচন কমিশন কিংবা সংসদ অর্থাৎ এই রাষ্ট্র বা তার কোনো অঙ্গ প্রতিষ্ঠান রানার বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। তিন বছর সময় লেগেছে কেবল একটি অভিযোগপত্র পেতে। আমরা অনেক সময় ‘তাদের’ দ্বারা সংঘটিত কালচার অব ইম্পিউনিটির কথা বলে ক্ষোভ প্রকাশ করি, এখন সময় এসেছে ‘আমাদের’ দ্বারা সংঘটিত দায়মুক্তির সংস্কৃতির দিকে নজর দেওয়া।
আমাদের সবাইকে মিলে অনুশোচনা ও লজ্জিত হতে হবে, যদি আমরা এ থেকে সাংস্কৃতিকভাবে নিস্তার চাই। শুধু আদালতের দণ্ড আমাদের বাঁচাতে পারবে না। দ্রুত বিচার আইন কার্যকর করতে ন্যূনতম সাংস্কৃতিক মান থাকতে হবে। ৬৫ কার্যদিবস পলাতক থাকার পরেও সংসদের হাজিরা খাতায় গোপনে একটি সই দিয়ে তিনি ‘সংবিধান মান্য’ করার প্রমাণ রাখতে পেরেছেন। মুক্তিযোদ্ধা ফারুক খুন হওয়ার প্রায় দুই বছর পরও সাংসদ রানা জেলার ধর্ম-বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। একটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় তিনি সেদিনও সক্রিয় ছিলেন, এই মুহূর্তে দুটি মাদ্রাসার পরিচালনা–দণ্ড তাঁরই হাতে। কেউ তাঁকে বরখাস্ত করার হিম্মত দেখায়নি। এ রকম একটি নির্জীব সমাজে সজীব সচল বিচার কি শুধু আইনের জোরে সম্ভব?
তদুপরি সুপারিশ করি, আমাদের নির্বাচনী আইনে ভারতীয় আইন কমিশনের সুপারিশ, যা ২০১৪ সালের মার্চে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট অনুমোদন করেছেন, তার আলোকে নতুন বিধান আনা হোক, নির্বাচিত সাংসদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ গঠনের এক বছরের মধ্যে বিচার শেষ করতে হবে। এক বছরের মধ্যে বিচার শেষ না হলে সম্মানী, ভাতাসহ সংসদে ভোটদানের অধিকার স্থগিত থাকবে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যা মামলাটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর সুপারিশ করেছেন। আইন বলেছে, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলা স্থানান্তরের ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে বিচার শেষ হবে। ‘অনিবার্য’ কারণে না পারলে কারণ দর্শিয়ে ও সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়ে পরের ৩০ দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে। এরপরও বিলম্বের ‘যুক্তিসংগত’ কারণ দেখিয়ে শেষবারের মতো আরও ১৫ দিন মিলবে। সর্বোচ্চ ১৩৫ দিনের মধ্যে আমরা কি সত্যিই সাংসদ রানার বিচার অনুষ্ঠান দেখব? এই বাংলাদেশ আমরা কি গড়েছি? একজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার বিচার ১৩৫ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করার সর্বোচ্চ অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করছে। আওয়ামী লীগের একজন সাংসদ আওয়ামী লীগের একজন মুক্তিযোদ্ধা নেতাকে হত্যার অভিযোগের বিচার আগামী ৯০ থেকে ১৩৫ কার্যদিবসে আমরা দেখতে চাই। রাকিব-রাজনের হত্যার দ্রুত বিচারের সাফল্যের মডেলে ফারুক খুনেরও বিচার চাই। কারণ, এই খুনের বহুমাত্রিক রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। সব থেকে বড় তাৎপর্য আওয়ামী লীগের দলীয় শৃঙ্খলার জন্য। অভিযোগপত্র মতে, জেলা সাধারণ সম্পাদকের পদের লড়াইয়ে ফারুককে খুন হতে হয়েছে। ২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারি রাতে ফারুক আহমেদের গুলিবিদ্ধ দেহ পড়ে ছিল টাঙ্গাইল শহরের কলেজপাড়া এলাকায় তাঁর বাসার কাছের রাস্তায়।
এখন প্রশ্ন হলো, রানার সংসদ সদস্য পদ তাহলে কখন খোয়া যাবে? অভিযোগপত্র দায়ের হয়েছে তো কী হয়েছে? সংবিধান বলছে, দুই বছর দণ্ডিত হলে সংসদ সদস্য পদ খোয়া যাবে। কিন্তু এই পোড়া দেশে রুগ্ণ রেওয়াজ তৈরি হয়ে আছে যে এই ‘দণ্ডিত’ মানে চূড়ান্ত দণ্ডিত নয়। এটা একেবারে হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট হয়ে একেবারে রিভিউ কোর্ট পর্যন্ত যেতে হবে। তার আগ পর্যন্ত সবাই ধোয়া তুলসী পাতা। তার আগ পর্যন্ত কাউকে সন্দেহভাজন হিসেবে কোনো কিছু থেকে বারিত করা যাবে না। এ রকম ব্যাখ্যা করে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ লোক আমাদের চোখের সামনে দায়িত্বশীল পদে কাজ করে গেছেন এবং যাচ্ছেন। মুখ লুকিয়ে বা কাঁচুমাচু করে নয়, বীরদর্পে করছেন। প্রভাবশালী হলে কারও কোনো অসুবিধা হয়নি বা হচ্ছে না। এর দুটো দিক আছে। যদি সাজানো মামলা হয় তাহলে পরে বিচার–প্রক্রিয়ার বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ থাকবে। আর যেখানে তা থাকবে না, সেখানে এই প্রশ্ন থাকবে না। সাংসদ রানা খুনের দায়ে যে প্রক্রিয়ায় অভিযুক্ত হয়েছেন, তা গ্রহণযোগ্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা মানব যে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁর নিজেকে নির্দোষ দাবি করার অধিকার আছে। তাঁর এই অধিকারের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু প্রশ্নটি হলো, তিনি যেহেতু একটি স্পর্শকাতর সাংবিধানিক পদে আছেন, তিনি কি বিচার শেষের আগ পর্যন্ত সংসদের বৈঠকে বসবেন? সামাজিক অনুষ্ঠানে তিনি অতিথি হবেন? নাকি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবেন আর নির্দোষ প্রমাণিত হলে আবার জনগণের কাছে ভোট চাইবেন? এসব নৈতিক প্রশ্ন ভারতে অনেক বড় মাপে উঠেছে। প্রায় ৩০ শতাংশ সাংসদ ও এমএলএ প্রার্থীর ফৌজদারি অভিযোগ মোকাবিলা করার প্রেক্ষাপটে পাবলিক ইন্টারেস্ট নামে একটি ফাউন্ডেশন ভারতের সুপ্রিম কোর্টে মামলা ঠুকে দিল। তারা বিবিধ প্রতিকার চাইল। তার অন্যতম ছিল কারও বিরুদ্ধে কোনো আদালত অভিযোগপত্র গঠন করলে নির্বাচনে তাঁকে অযোগ্য ঘোষণা করা। তাঁদের দ্রুত বিচারের জন্য গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে তারা নতুন বিধান আনতে বলল। তারা বলল, তাঁদের বিচার হতে হবে স্পেশাল ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে। টাঙ্গাইলের এসপি তাই ইতিমধ্যে ঠিক পদক্ষেপটি নিয়েছেন। ইন্দিরা গান্ধী বনাম রাজনারায়ণ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বলেছিলেন, নির্বাচিত সাংসদ অভিযুক্ত হলে সব কাজ ফেলে এটা আগে নিষ্পত্তি করতে হবে।
সামগ্রিক নির্বাচনী অযোগ্যতা বিষয়ে আইন কমিশনের মতামত চেয়েছিলেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। আমাদের নির্বাচন কমিশনকে এ বিষয়ে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। গত পৌর নির্বাচনে বহুসংখ্যক ব্যক্তি ফৌজদারি মামলা নিয়ে নির্বাচন করেছেন বা অযোগ্য হয়েছেন। আবার আসন্ন ইউপি নির্বাচনেও একই সমস্যা আমরা আরও ব্যাপকভাবে দেখতে পাব। বিচারপতি এ পি সাহার নেতৃত্বাধীন ভারতীয় আইন কমিশন ২০১৪ সালের রিপোর্টে উল্লেখ করে যে ‘আমরা একটি বিকল্প প্রস্তাব পেয়েছি, যেখানে গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত, যার অন্তত পাঁচ বছরের দণ্ডলাভের আশঙ্কা আছে, তাঁকে নির্বাচনে প্রার্থী হতে দেওয়া উচিত। যেখানে তাঁরা এমপি বা এমএলএ হবেন, সেখানে তাঁরা নির্বাচনে অংশ নেবেন ঠিক আছে, তবে তাঁদের বিশেষ ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট মোকাবিলা করতে হবে। এ রকম বিধান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে ঢোকাতে হবে। আর নির্বাচিত সাংসদদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে। অভিযুক্ত হিসেবে তিনি স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। দণ্ডিত হওয়া মাত্র আপনাআপনি স্পিকার ও নির্বাচন কমিশন দণ্ডিতের পদ শূন্য ঘোষণা করবে। আপিল করেছেন কি করেননি সেটা দেখার জন্য স্পিকার বা ইসি অপেক্ষায় থাকবে না। কিন্তু গভীর পরিতাপের বিষয় হলো এই বিষয়ে আমাদের দেশে যা ঘটে চলেছে, তা হৃদয়বিদারক বললে কম বলা হয়।
বিচারপতি বি পি জীবন রেড্ডি ও আইনজীবী ফলি এস নরিম্যানের দৃঢ় সুপারিশ ছিল মনোনয়নপত্র জমার তারিখের ছয় মাস আগে যদি কারও বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ গঠন হয়, তাহলে তিনি আপনাআপনি অযোগ্য হবেন। আইন কমিশন মতামত নিতে যত বিশেষজ্ঞ ডেকেছিলেন, সবাই এর সপক্ষে মত দেন। আইন কমিশনও তা-ই মেনে নেয়। তারা অবশ্য বলেছে, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার এক বছর আগে অভিযোগ গঠন হলে তাঁরা অযোগ্য হবেন না। খালাস পাওয়া বা ছয় বছর পার হওয়ায় এর মধ্যে যেটা আগে ঘটে, সেই মেয়াদের পরে কারও অযোগ্যতা চলে যাবে। অনেকে অবশ্য অভিযোগপত্র দাখিল হলেই অযোগ্য করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। সেটা টিকল না। কারণ, পুলিশ সেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে না শুনে শুধু তথ্যের বিবরণ দেয়। আর অভিযোগ গঠনে বিচারিক মনের প্রতিফলন ঘটে। কিন্তু সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা যথারীতি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু সেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এসেছিল, যা আমি আমাদের দলগুলোকে মানতে বলব। সেটা হলো, গুরুতর অপরাধে কেউ অভিযুক্ত হওয়ামাত্র দলেও তাঁর সদস্যপদ স্থগিত থাকবে। কিন্তু এ ধরনের নিয়ম আমরা চালু করতে পারব না, যতক্ষণ না আমরা জনপ্রতিনিধিদের জন্য দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে পারি। আর এই সুপারিশ সরকার মানলেও বিপদ। কারণ, বিরোধী বা ক্ষমতাসীন দলের প্রতিপক্ষরা প্রমাদ গুনতে পারেন এই আশঙ্কায় যে তাঁরাই আবার শিকারে পরিণত হন কি না। কিন্তু আমি বলব, অপব্যবহারের আশঙ্কায় সংস্কারের রথ থামানো সমীচীন হবে না। ভারতের আইন কমিশনের সুরেই বলব, অভিযোগ গঠন পর্যায়ে অযোগ্যতার বিধান আনা যাবে, তবে তার অপব্যবহার যাতে না ঘটে সে বিষয়ে উপযুক্ত রক্ষাকবচ থাকতে হবে।
এর আগে অনেকের কিছু হয়নি বলে রানারও কিছুই হবে না, সেটা হলফ করে বলা যায় না। তবে কতগুলো বিষয় দেখার মতো। প্রচলিত আইন এ রকম একজন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে রক্ষায় কিন্তু সব রকম ফাঁক তৈরি করে রেখেছে বলে প্রতীয়মান হয়। এমনকি টাঙ্গাইল শহরেও যেখানে আমাদের প্রিয় নিহত মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক ফারুকের প্রতি প্রচণ্ড সহানুভূতি রয়েছে, সেখানেও তাঁর সন্দেহভাজন ঘাতককে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্ঠান বরখাস্ত করার ঝুঁকি নেয়নি। গত রাতে ফারুকের স্ত্রী আমাকে বলেন, ‘আমি আমার মুক্তিযোদ্ধা স্বামী হত্যার বিচার চাই এবং দল থেকে তাঁর (সাংসদ রানা) বহিষ্কার চাই।’ আওয়ামী লীগ এর আগে টাঙ্গাইলের সাংসদ আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে বহিষ্কার করেছিল। এবার আরও বেশি স্পর্শকাতর কারণে রানাকে তাদের বহিষ্কার করা উচিত। ক্ষমতাসীন দলের উচিত নয় ‘আইনের আপন গতি’ অবলোকনে আরও অপেক্ষা করা। এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ, নির্বাচন কমিশন কিংবা সংসদ অর্থাৎ এই রাষ্ট্র বা তার কোনো অঙ্গ প্রতিষ্ঠান রানার বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। তিন বছর সময় লেগেছে কেবল একটি অভিযোগপত্র পেতে। আমরা অনেক সময় ‘তাদের’ দ্বারা সংঘটিত কালচার অব ইম্পিউনিটির কথা বলে ক্ষোভ প্রকাশ করি, এখন সময় এসেছে ‘আমাদের’ দ্বারা সংঘটিত দায়মুক্তির সংস্কৃতির দিকে নজর দেওয়া।
আমাদের সবাইকে মিলে অনুশোচনা ও লজ্জিত হতে হবে, যদি আমরা এ থেকে সাংস্কৃতিকভাবে নিস্তার চাই। শুধু আদালতের দণ্ড আমাদের বাঁচাতে পারবে না। দ্রুত বিচার আইন কার্যকর করতে ন্যূনতম সাংস্কৃতিক মান থাকতে হবে। ৬৫ কার্যদিবস পলাতক থাকার পরেও সংসদের হাজিরা খাতায় গোপনে একটি সই দিয়ে তিনি ‘সংবিধান মান্য’ করার প্রমাণ রাখতে পেরেছেন। মুক্তিযোদ্ধা ফারুক খুন হওয়ার প্রায় দুই বছর পরও সাংসদ রানা জেলার ধর্ম-বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। একটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় তিনি সেদিনও সক্রিয় ছিলেন, এই মুহূর্তে দুটি মাদ্রাসার পরিচালনা–দণ্ড তাঁরই হাতে। কেউ তাঁকে বরখাস্ত করার হিম্মত দেখায়নি। এ রকম একটি নির্জীব সমাজে সজীব সচল বিচার কি শুধু আইনের জোরে সম্ভব?
তদুপরি সুপারিশ করি, আমাদের নির্বাচনী আইনে ভারতীয় আইন কমিশনের সুপারিশ, যা ২০১৪ সালের মার্চে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট অনুমোদন করেছেন, তার আলোকে নতুন বিধান আনা হোক, নির্বাচিত সাংসদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ গঠনের এক বছরের মধ্যে বিচার শেষ করতে হবে। এক বছরের মধ্যে বিচার শেষ না হলে সম্মানী, ভাতাসহ সংসদে ভোটদানের অধিকার স্থগিত থাকবে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
No comments