কারা নাগরিকত্ব হারাচ্ছেন? by মাসুদ মজুমদার
দেশ পরিচিতি পাল্টায়। অনেক ক্ষেত্রে মানচিত্রও পাল্টে যায়। প্রাকৃতিক কারণে ভূগোলেও পরিবর্তন আসে। সামষ্টিক সিদ্ধান্ত ও গণসম্মতির ভিত্তিতে দেশের নাম, পতাকা এবং অবয়বও পাল্টে যেতে পারে। কিন্তু স্বেচ্ছায় বর্জন না করলে জন্মগত নাগরিকত্ব পাল্টায় না। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সক্রেটিসকে বিষপানে মৃত্যুবরণ, নয়তো দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছিল। সক্রেটিস দেশত্যাগ করতে রাজি হলেন না, বিষপান করে মৃত্যুর সাথে আলিঙ্গন করলেন। তখনো জাতিরাষ্ট্রের ধারণা এতটা পুষ্ট ছিল কি না জানি না, তবে নগররাষ্ট্রের ধারণা শতভাগ কার্যকর ছিল। এ কালের মতো দেশপ্রেমের ধারণা যুক্তিনির্ভর না বিশ্বাসনির্ভর ছিল, সেটাও স্পষ্ট নয়। মানুষ বিশ্বনাগরিক আবার একটি দেশেরও। ইকবাল ভেবেছেন, ‘সারাজাহান আমাদের’। আরবি প্রবাদে ‘দেশপ্রেমকে বিশ্বাসের অংশ ভাবা হয়েছে’। হালে নাগরিকত্ব জন্মগত মৌলিক অধিকার কি না, সেই প্রশ্ন তোলা হলেও বিষয়টি মীমাংসিত। এ ব্যাপারে ক’জন বিজ্ঞ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ইতোমধ্যে তাদের অভিমত জানিয়ে দিয়েছেন। সবার মত, কাউকে রাষ্ট্রহীন করা এবং জন্মসূত্রে পাওয়া নাগরিকত্ব বাতিল করা যায় না। ডক্টর রেজোয়ান সিদ্দিকীসহ কয়েকজন কলামিস্টও নাগরিক অধিকার হরণের মতো অসাংবিধানিক উদ্যোগ না নিতে পরামর্শ দিয়েছেন। ভিন্ন আঙ্গিকে আমরা প্রসঙ্গটির ওপর আরো একটু দৃষ্টিপাত করতে পারি।
‘মৃত্যুর চেয়ে কঠিন হচ্ছে জীবন। কেননা দুঃখকষ্ট, বিপদ-আপদ কেবল জীবনকেই ভোগ করতে হয়। এসব থেকে মানুষকে মুক্তি দেয় মৃত্যু।’ এই নীতিকথাটিও সক্রেটিসের নামে প্রচারিত হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, সক্রেটিসের নামে যত নীতিকথা প্রচারিত হয়, তার ভিত্তি কী? দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, সক্রেটিস কি নিজের জীবনের কোনো গ্লানি বা যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে মৃত্যুকে শ্রেয় ভেবেছেন? এত কিছুর পরও নাগরিকত্ব হারাতে চাইলেন না কেন?
মহামতি সক্রেটিস- আসলে কোন স্তরের মানুষ ছিলেন- তা এখনো অকাট্যভাবে নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। তার সম্পর্কে যেসব তথ্য আমাদের জানানো হয়- সেগুলো তার ক’জন কৃতী ছাত্রের বরাতে পাওয়া। তার মধ্যে প্লেটো এবং জেনোফোনের কথাই উল্লেখযোগ্য।
সক্রেটিসের জন্ম গ্রিসের এথেন্সে। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৭০ অব্দে তার জন্ম। মৃত্যু ৩৯৯ অব্দে। এ হিসাব সত্য হলে, সক্রেটিস ৭১ বছর জীবিত ছিলেন। প্লেটো এবং জেনোফোনই ‘সক্রেটিক মেথড’ এর রূপকার। এই চিন্তা গ্রিসের সমাজকাঠামোর ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। তাতে রাজনৈতিক পরিস্থিতিও পাল্টে দেয়। এর দায় নিতে হয় সক্রেটিসকে। হেমলক বিষ পান করিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নির্দেশ দেয়া হয়। একই রায়ের বিকল্প ছিল, মৃত্যুদণ্ড এড়াতে হলে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে। সক্রেটিস দেশছাড়ার পরিবর্তে হেমলক পানের ব্যাপারেই ইতিবাচক মত দিলেন, যা আগেই উল্লেখ করেছি।
সক্রেটিস ধনী পিতামাতার আদরের দুলাল ছিলেন না। বাবা ছিলেন একজন পাথর খোদাইকার বা পাথরে নকশা তৈরির শিল্পী। মা ছিলেন ধাত্রী। বিয়ে করেছিলেন তার তুলনায় কম বয়সী এক তরুণীকে। নাম ছিল জেনথেপি। তিনি ছিলেন কলহপ্রবণ ও অবাধ্য প্রকৃতির। তাদের তিন পুত্র সন্তান ছিল। স্ত্রী মনে করতেন সক্রেটিস সুপুরুষ নন। তবে ভক্তদের কাছে সক্রেটিস ছিলেন আকর্ষণীয় ও প্রভাবক প্রকৃতির। তাদের সংসারজীবন সুখের ছিল না বলেই মনে করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, স্ত্রী সন্তান লালন পালনের চেয়ে তিনি এথেন্সের ভবিষ্যৎ বুদ্ধিজীবী সৃষ্টিতে বেশি আগ্রহী ছিলেন। তারুণ্যে সক্রেটিস তার দেশের হয়ে যুদ্ধে লড়েছেন। উল্লেখ্য, এথেন্সের সেই সময়কার রাষ্ট্রিক ধারণায় গণবাহিনী বা ‘সিটিজেন সোলজার’ হওয়া জরুরি ছিল। ১৮ থেকে ৬০ বছরের সব নাগরিকই দেশের পক্ষে যুদ্ধে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল। সক্রেটিস কমপক্ষে তিনটি সামরিক অভিযানে অংশ নিয়েছেন। তার দৃঢ়তা ও সাহস প্রশংসিত হয়েছিল। তবে সক্রেটিস যুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার বিপক্ষে ছিলেন।
সক্রেটিসের ছাত্ররা তাকে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, তার যে প্রতিকৃতি বা ভাস্কর্য অনুমোদন করেছেন, দার্শনিক ও চিন্তক হিসেবে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, সেটাই আমাদের কাছে সক্রেটিস। তা ছাড়া তিনি সবার দৃষ্টিতে পড়ার মতো লোক ছিলেন না। তার আশপাশের লোকদের কাছে তিনি সব সময় ক’টি প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইতেন। জিজ্ঞাসা করতেন ‘স্রষ্টার ভীতি এবং প্রীতি কী জিনিস’, ‘প্রজ্ঞা কী,’ ‘সৌন্দর্য বা সুন্দর কাকে বলে’, ‘ঠিক কাজ কোনটি’। এই সময়টিতে তার বয়স ছিল ৪০। অনেকেই তাকে এড়িয়ে চলত। তবে ক’জন ছাত্র তাকে বুঝেছিল; তাদের কাছে সক্রেটিস এসব প্রশ্নের জবাব নিজেই দিতেন। সেই জবাবের মধ্য দিয়ে তার চিন্তা, দর্শন ও বুদ্ধিবৃত্তির গভীরতা বুঝা যেত। সাধারণ লোকেরা তাকে মতিভ্রষ্ট মানুষ মনে করে নির্যাতন করার চেষ্টাও করেছে। একদল তরুণ তার কাছে দীক্ষা নিয়েছিল বলে জানা যায়। এদের সংখ্যা ৪০ জনের মতো হবে। প্লেটো এদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না বলেই মনে করা হয়। কেউ বলেছেন, সক্রেটিস জ্ঞান বিতরণ করে কিছু পয়সা নিতেন। অবশ্য প্লেটোর মতো তিনি কখনো কারো কাছে পয়সা দাবি করার প্রমাণ নেই। এক সময় বাবার সাথে পাথর খোদাই করে, পরে যুদ্ধে গিয়ে, তাকে সংসার টানতে হয়েছে। যা হোক, এক ধরনের ধ্যান বা ঔদাসীন্য তাকে সব সময় ঘিরে থেকেছে।
অনেক বিশেষজ্ঞ তাকে আল্লাহর মনোনীত পয়গম্বর কি-না, সংশয় নিয়েও ইতিবাচক মত দিয়েছেন এ ব্যাপারে। এর কারণ, সক্রেটিস অকাজের বা বাহুল্য কোনো কথা কখনো বলেননি। তিনি মিথ্যা কিংবা শঠতার আশ্রয় নিয়েছেন, এমন কোনো নজিরও নেই। রাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিল কোনো নীতিগর্হিত পাপ কিংবা অপরাধের জন্য নয়, তারুণ্যের মনে চিন্তাগত আলোড়ন তোলার জন্য। তার জিজ্ঞাসাগুলো এবং এর জবাব কিছুটা প্রত্যাদেশের মতো মনে হয়। তার সব বক্তব্য কালজয়ী, নীতি বিধৌত এবং সত্যাশ্রয়ী। মূর্তিপূজা না করার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। তাকে অনুসরণকারী যুবকদের দেবতাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার বিষয়টিকে তার ধর্মহীনতার প্রমাণ হিসেবে খাড়া করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে বলা যেতে পারে, সক্রেটিস একত্ববাদী ছিলেন কি না সে ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করা হলেও, মূর্তিপূজারী ছিলেন না, এ কথা নিশ্চিত হওয়া যায়। গ্রিসের দেব-দেবী নিয়ে তার কোনো আগ্রহ ছিল বলে মনে হয় না।
মৃত্যু নিয়ে তার স্পষ্ট ধারণা কী ছিল, সেটা গবেষণার বিষয়। মৃত্যু জীবনের পরিসমাপ্তি- এটা সরল কথা। একত্ববাদীদের ধর্মবিশ্বাসে মৃত্যু অবশ্যই জীবনের পরিসমাপ্তি। তবে সেটা দুনিয়ার জীবনের। এরপর কবর থেকে হাশর নশর পর্যন্ত সময় জীবন বা রুহ সৃষ্টিকর্তার নির্ধারিত স্থানে অবস্থান করে। তারপর আদালতে আখেরাতের পর জান্নাত-জাহান্নাম বা স্বর্গ-নরকের ফয়সালা আসে।
একত্ববাদীরা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করেন, আদম আ: থেকে হজরত মুহাম্মদ সা: পর্যন্ত কমপক্ষে লক্ষাধিক নবী-রাসূল আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর সমসাময়িক মানুষকে তৌহিদ, আখেরাত, রিসালাতসহ মৌলিক সব জীবনাচার শিক্ষা দিয়েছেন। একই সময় বিভিন্ন গোত্র, ভাষাভাষী ও এলাকায় নবী-রাসূলগণ সক্রিয় ছিলেন। শেষ নবী ছিলেন একক এবং বিশ্বজাহানের। সব নবী-রাসূলের বিরুদ্ধে তো বটেই, শেষ নবীর বিরুদ্ধেও অনেক অভিযোগের মধ্যে অন্যতম ছিল, তিনি আরবের লোকদের বাপ-দাদার ধর্ম- মূর্তিপূজা থেকে বিচ্যুত করছেন। তাদের দেব-দেবীদের অবজ্ঞা করছেন। অতএব, আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ নবী-রাসূল নন, ধর্মদ্রোহী। এ ধরনের অভিযোগ থেকে কোনো নবীই বাদ পড়েননি। ওল্ড ও নিউটেস্টামেন্ট তথা বাইবেলেও এ ব্যাপারে স্বীকৃত শ্লোক রয়েছে। ঈশ্বর একক ও অদ্বিতীয়- হিন্দুদের মৌলিক গ্রন্থেও এটাই রয়েছে।
আমরা এত বিজ্ঞ নই যে, সক্রেটিস নবী কি নবী নন- তা নিয়ে বিতর্কের সূচনা করতে পারি। সক্রেটিস কত বড় দার্শনিক কিংবা পণ্ডিত সেটা মূল্যায়নের মতো পাণ্ডিত্যও নেই। তবে সক্রেটিসকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ্যসূচিতে বন্দী রেখে প্লেটো, অ্যারিস্টটল ও জেনোফোনকে তার ভাষ্যকার বানানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের কাজ হতে পারে। প্রাচ্য এটা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা উচিত নয়।
সক্রেটিস নিয়ে এ লেখা আজকের কলামের মূল প্রতিপাদ্য নয়। আমাদের আসল বক্তব্য, নাগরিকত্ব প্রশ্নে নতুন আইনের প্রস্তাবের ওপর একটা ঋজু মন্তব্য করা। রাষ্ট্রের আদালতের দৃষ্টিতে অপরাধী সাব্যস্ত হলে জেল-ফাঁসি দেয়া যায়। যাবজ্জীবনও হতে পারে; কিন্তু নাগরিকত্ব হরণ করা কিভাবে সম্ভব! জাতিরাষ্ট্রের এই যুগে একজন মানুষকে রাষ্ট্রহীন করা মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের সাথে কতটা সাযুজ্যপূর্ণ? আন্তর্জাতিক রীতিনীতি এটাকে অনুমোদন করেনি। কেউ স্বেচ্ছায় নাগরিকত্ব বর্জন করলে কিংবা দেশত্যাগ করে অন্য কোথাও চলে গেলে আলাদা প্রশ্ন। সক্রেটিসের যুগে জাতিরাষ্ট্রের ধারণার চেয়ে নগররাষ্ট্রের ধারণা অধিকতর পরিচিত ছিল বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সেই যুগেও সক্রেটিস বিষ পান করে মৃত্যুবরণ করতে রাজি হলেন, শাস্তি হিসেবে দেশ ছাড়তে সম্মত হলেন না। বাংলাদেশের সংবিধানেও নাগরিকত্ব বাতিলের এমন আইনি অনুমোদন নেই। সংবিধানে শুধু বলা আছে, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে ৬(১)। জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব এর ঊর্ধ্বে। অনুমোদনসূত্রে নাগরিকত্ব পাওয়া আলাদা আইনি প্রক্রিয়ার বিষয়। তারপরও নতুন বিতর্কে জড়িয়ে যাওয়ার একটা পথ খোলা হচ্ছে কি না সেটাই প্রশ্ন।
প্রস্তাবিত ‘নাগরিকত্ব আইন-২০১৬’ জাতীয় সংসদে পাস হলেই মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত এবং তাদের সন্তানরা নাগরিকত্ব হারাতে পারেন, এখনো এটি আশঙ্কা মাত্র। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মত, এমনটি হলে নতুন আইন অনেক বিতর্কের জন্ম দেবে। যাদের বিচার করা হয়েছে তারা দেশের নাগরিক হিসেবে বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। তাদের সন্তানেরা কেন জন্মের আগের দায় নেবেন? তা ছাড়া, অনেক সাংবিধানিক জটিলতাও সৃষ্টি হতে পারে। আদালতে এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। যারা ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং সর্বোচ্চ আদালত থেকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত হয়েছেন, প্রস্তাবিত আইনের একটি ধারা অনুযায়ী তাদের এবং তাদের সন্তানদের নাগরিকত্ব থাকছে না বলে যে খবর বেরিয়েছে, সেটা কতটা সঠিক জানি না। তা ছাড়া প্রস্তাব বা মুসাবিদা হলেই তা আইন হয়ে যায় না। বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন-২০১৬ এর খসড়া কিছু পরিবর্তন ও পরিমার্জন সাপেক্ষে অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মন্ত্রিসভায় এই আইনটি উত্থাপন করেছে। প্রস্তাবিত আইনের ৫(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি বা তার পিতা বা মাতা বাংলাদেশের নাগরিক হবেন না যদি বিদেশী কোন সামরিক বা আধা সামরিক বাহিনী বা অন্য কোন বিশেষ বাহিনীতে যোগদানপূর্বক বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন বা করে থাকেন বা বাংলাদেশের অস্তিত্ব অস্বীকার বা বাংলাদেশবিরোধী কোন কর্মকণ্ডে লিপ্ত থাকেন।’ বাস্তবে এ প্রস্তাব স্বব্যাখ্যাতও নয়।
খসড়া আইনের ১৮ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার বা থাকার যোগ্য হবেন না, যদি তিনি (ক) দ্বৈত নাগরিকত্বের ক্ষেত্র ব্যতীত কোন বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আনুগত্য প্রকাশ করেন; (খ) বিদেশী রাষ্ট্রের কোন বাহিনীতে যোগদান করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা অন্য কোনভাবে উক্ত বাহিনীকে সহায়তা করে থাকেন এবং এই আইন বলবৎ হওয়ার অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস না করেন (গ) এমন কোন রাষ্ট্রের নাগরিক বা অধিবাসী, যে রাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল বা আছে এবং (ঘ) বাংলাদেশে বেআইনিভাবে অভিবাসী হিসেবে বসবাস করেন বা করে থাকেন।’
কেউ কেউ মনে করছেন, এই আইন যেভাবে আছে সেভাবে পাস হলে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যারা সর্বোচ্চ আদালত থেকে দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন, তারা এবং তাদের সন্তানেরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব হারাচ্ছেন, আপাতত এমনটি মনে করা হচ্ছে। এ ধরনের আইনের এমন ব্যাখ্যা করার সুযোগ আছে। তবুও ভিন্ন ব্যাখ্যার অবকাশও থেকে যায়। আইনজ্ঞদের মতে, কারো কোনো কৃত অপরাধের সাথে নাগরিকত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। কোনো কাজের শাস্তি হিসেবে জন্মগত নাগরিকত্ব হানি করা যায় না। যদি তা করা হয়, তা হবে আন্তর্জাতিক আইনেরও পরিপন্থী। নাগরিকত্ব দু’টি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল- একটি হলো নাগরিকের ইচ্ছা; অন্যটি হলো জন্মসূত্রের অধিকার। এর আগে অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকত্বের মামলায় এটি নিষ্পত্তি হয়েছে যে, জন্মসূত্রে যে নাগরিক, তাকে রাষ্ট্রবিহীন করা যায় না। এখন ‘নাগরিকত্ব আইন ২০১৬’ পাস হয়ে পূর্ণাঙ্গ রূপে এলে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে। তার আগে এটা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা, কারা নাগরিকত্ব হারাচ্ছেন সে প্রশ্ন তোলাকে অনেকেই সমীচীন মনে করেন না।
‘মৃত্যুর চেয়ে কঠিন হচ্ছে জীবন। কেননা দুঃখকষ্ট, বিপদ-আপদ কেবল জীবনকেই ভোগ করতে হয়। এসব থেকে মানুষকে মুক্তি দেয় মৃত্যু।’ এই নীতিকথাটিও সক্রেটিসের নামে প্রচারিত হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, সক্রেটিসের নামে যত নীতিকথা প্রচারিত হয়, তার ভিত্তি কী? দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, সক্রেটিস কি নিজের জীবনের কোনো গ্লানি বা যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে মৃত্যুকে শ্রেয় ভেবেছেন? এত কিছুর পরও নাগরিকত্ব হারাতে চাইলেন না কেন?
মহামতি সক্রেটিস- আসলে কোন স্তরের মানুষ ছিলেন- তা এখনো অকাট্যভাবে নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। তার সম্পর্কে যেসব তথ্য আমাদের জানানো হয়- সেগুলো তার ক’জন কৃতী ছাত্রের বরাতে পাওয়া। তার মধ্যে প্লেটো এবং জেনোফোনের কথাই উল্লেখযোগ্য।
সক্রেটিসের জন্ম গ্রিসের এথেন্সে। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৭০ অব্দে তার জন্ম। মৃত্যু ৩৯৯ অব্দে। এ হিসাব সত্য হলে, সক্রেটিস ৭১ বছর জীবিত ছিলেন। প্লেটো এবং জেনোফোনই ‘সক্রেটিক মেথড’ এর রূপকার। এই চিন্তা গ্রিসের সমাজকাঠামোর ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। তাতে রাজনৈতিক পরিস্থিতিও পাল্টে দেয়। এর দায় নিতে হয় সক্রেটিসকে। হেমলক বিষ পান করিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নির্দেশ দেয়া হয়। একই রায়ের বিকল্প ছিল, মৃত্যুদণ্ড এড়াতে হলে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে। সক্রেটিস দেশছাড়ার পরিবর্তে হেমলক পানের ব্যাপারেই ইতিবাচক মত দিলেন, যা আগেই উল্লেখ করেছি।
সক্রেটিস ধনী পিতামাতার আদরের দুলাল ছিলেন না। বাবা ছিলেন একজন পাথর খোদাইকার বা পাথরে নকশা তৈরির শিল্পী। মা ছিলেন ধাত্রী। বিয়ে করেছিলেন তার তুলনায় কম বয়সী এক তরুণীকে। নাম ছিল জেনথেপি। তিনি ছিলেন কলহপ্রবণ ও অবাধ্য প্রকৃতির। তাদের তিন পুত্র সন্তান ছিল। স্ত্রী মনে করতেন সক্রেটিস সুপুরুষ নন। তবে ভক্তদের কাছে সক্রেটিস ছিলেন আকর্ষণীয় ও প্রভাবক প্রকৃতির। তাদের সংসারজীবন সুখের ছিল না বলেই মনে করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, স্ত্রী সন্তান লালন পালনের চেয়ে তিনি এথেন্সের ভবিষ্যৎ বুদ্ধিজীবী সৃষ্টিতে বেশি আগ্রহী ছিলেন। তারুণ্যে সক্রেটিস তার দেশের হয়ে যুদ্ধে লড়েছেন। উল্লেখ্য, এথেন্সের সেই সময়কার রাষ্ট্রিক ধারণায় গণবাহিনী বা ‘সিটিজেন সোলজার’ হওয়া জরুরি ছিল। ১৮ থেকে ৬০ বছরের সব নাগরিকই দেশের পক্ষে যুদ্ধে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল। সক্রেটিস কমপক্ষে তিনটি সামরিক অভিযানে অংশ নিয়েছেন। তার দৃঢ়তা ও সাহস প্রশংসিত হয়েছিল। তবে সক্রেটিস যুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার বিপক্ষে ছিলেন।
সক্রেটিসের ছাত্ররা তাকে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, তার যে প্রতিকৃতি বা ভাস্কর্য অনুমোদন করেছেন, দার্শনিক ও চিন্তক হিসেবে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, সেটাই আমাদের কাছে সক্রেটিস। তা ছাড়া তিনি সবার দৃষ্টিতে পড়ার মতো লোক ছিলেন না। তার আশপাশের লোকদের কাছে তিনি সব সময় ক’টি প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইতেন। জিজ্ঞাসা করতেন ‘স্রষ্টার ভীতি এবং প্রীতি কী জিনিস’, ‘প্রজ্ঞা কী,’ ‘সৌন্দর্য বা সুন্দর কাকে বলে’, ‘ঠিক কাজ কোনটি’। এই সময়টিতে তার বয়স ছিল ৪০। অনেকেই তাকে এড়িয়ে চলত। তবে ক’জন ছাত্র তাকে বুঝেছিল; তাদের কাছে সক্রেটিস এসব প্রশ্নের জবাব নিজেই দিতেন। সেই জবাবের মধ্য দিয়ে তার চিন্তা, দর্শন ও বুদ্ধিবৃত্তির গভীরতা বুঝা যেত। সাধারণ লোকেরা তাকে মতিভ্রষ্ট মানুষ মনে করে নির্যাতন করার চেষ্টাও করেছে। একদল তরুণ তার কাছে দীক্ষা নিয়েছিল বলে জানা যায়। এদের সংখ্যা ৪০ জনের মতো হবে। প্লেটো এদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না বলেই মনে করা হয়। কেউ বলেছেন, সক্রেটিস জ্ঞান বিতরণ করে কিছু পয়সা নিতেন। অবশ্য প্লেটোর মতো তিনি কখনো কারো কাছে পয়সা দাবি করার প্রমাণ নেই। এক সময় বাবার সাথে পাথর খোদাই করে, পরে যুদ্ধে গিয়ে, তাকে সংসার টানতে হয়েছে। যা হোক, এক ধরনের ধ্যান বা ঔদাসীন্য তাকে সব সময় ঘিরে থেকেছে।
অনেক বিশেষজ্ঞ তাকে আল্লাহর মনোনীত পয়গম্বর কি-না, সংশয় নিয়েও ইতিবাচক মত দিয়েছেন এ ব্যাপারে। এর কারণ, সক্রেটিস অকাজের বা বাহুল্য কোনো কথা কখনো বলেননি। তিনি মিথ্যা কিংবা শঠতার আশ্রয় নিয়েছেন, এমন কোনো নজিরও নেই। রাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিল কোনো নীতিগর্হিত পাপ কিংবা অপরাধের জন্য নয়, তারুণ্যের মনে চিন্তাগত আলোড়ন তোলার জন্য। তার জিজ্ঞাসাগুলো এবং এর জবাব কিছুটা প্রত্যাদেশের মতো মনে হয়। তার সব বক্তব্য কালজয়ী, নীতি বিধৌত এবং সত্যাশ্রয়ী। মূর্তিপূজা না করার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। তাকে অনুসরণকারী যুবকদের দেবতাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার বিষয়টিকে তার ধর্মহীনতার প্রমাণ হিসেবে খাড়া করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে বলা যেতে পারে, সক্রেটিস একত্ববাদী ছিলেন কি না সে ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করা হলেও, মূর্তিপূজারী ছিলেন না, এ কথা নিশ্চিত হওয়া যায়। গ্রিসের দেব-দেবী নিয়ে তার কোনো আগ্রহ ছিল বলে মনে হয় না।
মৃত্যু নিয়ে তার স্পষ্ট ধারণা কী ছিল, সেটা গবেষণার বিষয়। মৃত্যু জীবনের পরিসমাপ্তি- এটা সরল কথা। একত্ববাদীদের ধর্মবিশ্বাসে মৃত্যু অবশ্যই জীবনের পরিসমাপ্তি। তবে সেটা দুনিয়ার জীবনের। এরপর কবর থেকে হাশর নশর পর্যন্ত সময় জীবন বা রুহ সৃষ্টিকর্তার নির্ধারিত স্থানে অবস্থান করে। তারপর আদালতে আখেরাতের পর জান্নাত-জাহান্নাম বা স্বর্গ-নরকের ফয়সালা আসে।
একত্ববাদীরা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করেন, আদম আ: থেকে হজরত মুহাম্মদ সা: পর্যন্ত কমপক্ষে লক্ষাধিক নবী-রাসূল আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর সমসাময়িক মানুষকে তৌহিদ, আখেরাত, রিসালাতসহ মৌলিক সব জীবনাচার শিক্ষা দিয়েছেন। একই সময় বিভিন্ন গোত্র, ভাষাভাষী ও এলাকায় নবী-রাসূলগণ সক্রিয় ছিলেন। শেষ নবী ছিলেন একক এবং বিশ্বজাহানের। সব নবী-রাসূলের বিরুদ্ধে তো বটেই, শেষ নবীর বিরুদ্ধেও অনেক অভিযোগের মধ্যে অন্যতম ছিল, তিনি আরবের লোকদের বাপ-দাদার ধর্ম- মূর্তিপূজা থেকে বিচ্যুত করছেন। তাদের দেব-দেবীদের অবজ্ঞা করছেন। অতএব, আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ নবী-রাসূল নন, ধর্মদ্রোহী। এ ধরনের অভিযোগ থেকে কোনো নবীই বাদ পড়েননি। ওল্ড ও নিউটেস্টামেন্ট তথা বাইবেলেও এ ব্যাপারে স্বীকৃত শ্লোক রয়েছে। ঈশ্বর একক ও অদ্বিতীয়- হিন্দুদের মৌলিক গ্রন্থেও এটাই রয়েছে।
আমরা এত বিজ্ঞ নই যে, সক্রেটিস নবী কি নবী নন- তা নিয়ে বিতর্কের সূচনা করতে পারি। সক্রেটিস কত বড় দার্শনিক কিংবা পণ্ডিত সেটা মূল্যায়নের মতো পাণ্ডিত্যও নেই। তবে সক্রেটিসকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ্যসূচিতে বন্দী রেখে প্লেটো, অ্যারিস্টটল ও জেনোফোনকে তার ভাষ্যকার বানানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের কাজ হতে পারে। প্রাচ্য এটা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা উচিত নয়।
সক্রেটিস নিয়ে এ লেখা আজকের কলামের মূল প্রতিপাদ্য নয়। আমাদের আসল বক্তব্য, নাগরিকত্ব প্রশ্নে নতুন আইনের প্রস্তাবের ওপর একটা ঋজু মন্তব্য করা। রাষ্ট্রের আদালতের দৃষ্টিতে অপরাধী সাব্যস্ত হলে জেল-ফাঁসি দেয়া যায়। যাবজ্জীবনও হতে পারে; কিন্তু নাগরিকত্ব হরণ করা কিভাবে সম্ভব! জাতিরাষ্ট্রের এই যুগে একজন মানুষকে রাষ্ট্রহীন করা মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের সাথে কতটা সাযুজ্যপূর্ণ? আন্তর্জাতিক রীতিনীতি এটাকে অনুমোদন করেনি। কেউ স্বেচ্ছায় নাগরিকত্ব বর্জন করলে কিংবা দেশত্যাগ করে অন্য কোথাও চলে গেলে আলাদা প্রশ্ন। সক্রেটিসের যুগে জাতিরাষ্ট্রের ধারণার চেয়ে নগররাষ্ট্রের ধারণা অধিকতর পরিচিত ছিল বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সেই যুগেও সক্রেটিস বিষ পান করে মৃত্যুবরণ করতে রাজি হলেন, শাস্তি হিসেবে দেশ ছাড়তে সম্মত হলেন না। বাংলাদেশের সংবিধানেও নাগরিকত্ব বাতিলের এমন আইনি অনুমোদন নেই। সংবিধানে শুধু বলা আছে, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে ৬(১)। জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব এর ঊর্ধ্বে। অনুমোদনসূত্রে নাগরিকত্ব পাওয়া আলাদা আইনি প্রক্রিয়ার বিষয়। তারপরও নতুন বিতর্কে জড়িয়ে যাওয়ার একটা পথ খোলা হচ্ছে কি না সেটাই প্রশ্ন।
প্রস্তাবিত ‘নাগরিকত্ব আইন-২০১৬’ জাতীয় সংসদে পাস হলেই মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত এবং তাদের সন্তানরা নাগরিকত্ব হারাতে পারেন, এখনো এটি আশঙ্কা মাত্র। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মত, এমনটি হলে নতুন আইন অনেক বিতর্কের জন্ম দেবে। যাদের বিচার করা হয়েছে তারা দেশের নাগরিক হিসেবে বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। তাদের সন্তানেরা কেন জন্মের আগের দায় নেবেন? তা ছাড়া, অনেক সাংবিধানিক জটিলতাও সৃষ্টি হতে পারে। আদালতে এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। যারা ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং সর্বোচ্চ আদালত থেকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত হয়েছেন, প্রস্তাবিত আইনের একটি ধারা অনুযায়ী তাদের এবং তাদের সন্তানদের নাগরিকত্ব থাকছে না বলে যে খবর বেরিয়েছে, সেটা কতটা সঠিক জানি না। তা ছাড়া প্রস্তাব বা মুসাবিদা হলেই তা আইন হয়ে যায় না। বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন-২০১৬ এর খসড়া কিছু পরিবর্তন ও পরিমার্জন সাপেক্ষে অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মন্ত্রিসভায় এই আইনটি উত্থাপন করেছে। প্রস্তাবিত আইনের ৫(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি বা তার পিতা বা মাতা বাংলাদেশের নাগরিক হবেন না যদি বিদেশী কোন সামরিক বা আধা সামরিক বাহিনী বা অন্য কোন বিশেষ বাহিনীতে যোগদানপূর্বক বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন বা করে থাকেন বা বাংলাদেশের অস্তিত্ব অস্বীকার বা বাংলাদেশবিরোধী কোন কর্মকণ্ডে লিপ্ত থাকেন।’ বাস্তবে এ প্রস্তাব স্বব্যাখ্যাতও নয়।
খসড়া আইনের ১৮ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার বা থাকার যোগ্য হবেন না, যদি তিনি (ক) দ্বৈত নাগরিকত্বের ক্ষেত্র ব্যতীত কোন বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আনুগত্য প্রকাশ করেন; (খ) বিদেশী রাষ্ট্রের কোন বাহিনীতে যোগদান করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা অন্য কোনভাবে উক্ত বাহিনীকে সহায়তা করে থাকেন এবং এই আইন বলবৎ হওয়ার অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস না করেন (গ) এমন কোন রাষ্ট্রের নাগরিক বা অধিবাসী, যে রাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল বা আছে এবং (ঘ) বাংলাদেশে বেআইনিভাবে অভিবাসী হিসেবে বসবাস করেন বা করে থাকেন।’
কেউ কেউ মনে করছেন, এই আইন যেভাবে আছে সেভাবে পাস হলে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যারা সর্বোচ্চ আদালত থেকে দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন, তারা এবং তাদের সন্তানেরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব হারাচ্ছেন, আপাতত এমনটি মনে করা হচ্ছে। এ ধরনের আইনের এমন ব্যাখ্যা করার সুযোগ আছে। তবুও ভিন্ন ব্যাখ্যার অবকাশও থেকে যায়। আইনজ্ঞদের মতে, কারো কোনো কৃত অপরাধের সাথে নাগরিকত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। কোনো কাজের শাস্তি হিসেবে জন্মগত নাগরিকত্ব হানি করা যায় না। যদি তা করা হয়, তা হবে আন্তর্জাতিক আইনেরও পরিপন্থী। নাগরিকত্ব দু’টি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল- একটি হলো নাগরিকের ইচ্ছা; অন্যটি হলো জন্মসূত্রের অধিকার। এর আগে অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকত্বের মামলায় এটি নিষ্পত্তি হয়েছে যে, জন্মসূত্রে যে নাগরিক, তাকে রাষ্ট্রবিহীন করা যায় না। এখন ‘নাগরিকত্ব আইন ২০১৬’ পাস হয়ে পূর্ণাঙ্গ রূপে এলে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে। তার আগে এটা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা, কারা নাগরিকত্ব হারাচ্ছেন সে প্রশ্ন তোলাকে অনেকেই সমীচীন মনে করেন না।
No comments