ভয় পায়নি ছাত্রজনতা by আহমদ রফিক
রংপুর জেলার অন্তর্গত মহকুমা শহর নীলফামারী। বিভাগ–পূর্বকালের শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্তপ্রধান শহরগুলো রাজনীতি ও সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বিশিষ্ট অবস্থানে ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এসব স্থানে প্রগতিশীল চেতনা পিছিয়ে পড়তে দেখা যায়। এর কারণ দেশভাগের পর শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্তের ব্যাপক হারে স্বদেশত্যাগ। সে শূন্যস্থান পূরণ করে স্থানীয় ও ভারত থেকে আগত স্বাতন্ত্র্যবাদী মুসলিম মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণি। ফলে সেসব স্থানের গণতান্ত্রিক ও বাম প্রগতিবাদী রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ধারা দুর্বল হয়ে পড়ে। নীলফামারী তেমন একটি শহর।
এ ধরনের শহরগুলোয় প্রায়ই দেখা গেছে ১৯৪৮ সালের মার্চের ভাষা আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠেনি কিংবা আদৌ আন্দোলন শুরু করা যায়নি। নীলফামারীর ঘটনাবলির বিবরণ দিতে গিয়ে ফিরোজ আহমেদ লিখেছেন: ‘যে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়, তা মূলত সাম্প্রদায়িক চিন্তা, ধর্মীয় উগ্রতাসমৃদ্ধ ছিল। ১৯৪৮ সালে দেশের বিভিন্ন এলাকার মতোই নীলফামারীতে এর প্রভাব বিস্তৃত হয়। ফলে প্রগতিশীল রাজনৈতিক চিন্তাধারার প্রসার ঘটেনি।’
তা সত্ত্বেও এ কথা ঠিক যে এ অবস্থায়ও কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের একাধিক অঞ্চল থেকে আগতদের বসবাসের কারণে কোনো কোনো স্থানে সীমাবদ্ধ বৃত্তে প্রগতি চেতনার একটি পরিবেশ তৈরি হয়। নীলফামারীতে ১৯৪৮ সালের মার্চের ভাষা আন্দোলন সাংগঠনিক রূপ পায়নি। এমনকি ১৯৫০-এর মূলনীতি কমিটিবিরোধী ভাষা বিক্ষোভেও অংশ নিতে পারেনি নীলফামারী; যদিও সে সময় খয়রাত হোসেন প্রমুখ রাজনীতিবিদের চেষ্টায় নীলফামারীতে আওয়ামী মুসলিম লীগের মহকুমা কমিটি এবং পূর্ববঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের শাখা গঠিত হয়েছিল।
প্রকৃতপক্ষে নীলফামারীতে ভাষা আন্দোলনের সূচনা ১৯৫২ সালে শিক্ষায়তনকে কেন্দ্র করে। তত দিনে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে আওয়ামী মুসলিম লীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ। সিদ্ধান্ত, ৪ ফেব্রুয়ারি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট, সেই সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের সমাবেশ ও মিছিল। কিন্তু ৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে সরকারি ছাত্র সংগঠনের বিরোধিতায় সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কিন্তু হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের হস্তক্ষেপে সংঘাত এড়ানো সম্ভব হয় এবং ধর্মঘট ও মিছিল যথারীতি চলে। ছাত্রীদের তরফে এ কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দেন হালিমা খাতুন, জাহেদা বেগম, জাকিয়া সুলতানা, সালমা বেগম প্রমুখ ছাত্রী। আর ছাত্রদের নেতৃত্বে মোহাম্মদ আলী, শওকত আলী, শামসুল হক প্রমুখ।
নীলফামারীতে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির নির্ধারিত কর্মসূচি যথাযথভাবে পালিত হয় শিক্ষায়তনে ধর্মঘট, প্রতিবাদ সভা ও মিছিলের মাধ্যমে। স্লোগান ওঠে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। প্রতিবাদ সভায় সব মতের ছাত্রনেতাদের বক্তব্য দিতে দেখা যায়। অনেকটা ঢাকার মতো সর্বদলীয় চরিত্রের ধারায়।
কিন্তু ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ঘটনাবলির খবর শহরে পৌঁছালে ছাত্রজনতার মধ্যে বিপুল প্রতিবাদী আবেগ জন্ম নেয়। ছাত্রজনতার স্বতঃস্ফূর্ত এক মিছিল পূর্বোক্ত নেতৃত্বকে উপেক্ষা করেই পথে নেমে আসে। শহর প্রদক্ষিণ করার সময় বিভিন্ন স্তরের ও পেশার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিছিলে শামিল হয়। মিছিলের আয়তন বিশাল হয়ে ওঠে।
এখানেই থেমে থাকে না প্রতিবাদী কর্মতৎপরতা। ঢাকায় পুলিশি বর্বরতা সুদূর নীলফামারীতে রক্তবর্ণ পতাকা উড়িয়ে ভাষার দাবি আদায়ে গভীর প্রেরণা সৃষ্টি করে। মিছিল, স্লোগান, আবেগ ও উত্তেজনা সংহত হয় শেষবিকেলে পাবলিক লাইব্রেরি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ছাত্র জনসভায়। এসব মিছিলে শহরের বাইরে আশপাশের স্থানীয় মানুষ শামিল হয়। এমনকি গ্রামের লোকও।
আন্দোলন শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে মূলত সভা ও মিছিলে জনসাধারণের অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে। ইতিমধ্যে পুলিশও তৎপর হয়ে ওঠে। আন্দোলনের কয়েকজন নেপথ্য নায়ককে গ্রেপ্তার করা হয়। ক্ষুব্ধ ছাত্রজনতা তাঁদের মুক্তির দাবিতে থানা এলাকায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। সেই সঙ্গে ২৬ ফেব্রুয়ারি নীলফামারীতে সাধারণ ধর্মঘট, তথা হরতাল ও বিক্ষোভ মিছিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ উপলক্ষে পুলিশ ছাত্রনেতা শফিয়ার রহমান ও শামসুল হককে গ্রেপ্তার করে। ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী শফিয়ার রহমানকে শেষ পর্যন্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে আপন নিয়মে আন্দোলনের অবসান ঘটে।
কিন্তু এ আন্দোলনের প্রভাব ছড়িয়ে যায় নানা শ্রেণির মানুষের মধ্যে। ১৯৫৩ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসমাজ শহীদ দিবস পালনের উদ্যোগ নিলে তাতে সাধারণ মানুষের আন্তরিক সমর্থন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে ছাত্রনেতাদের চেষ্টায় নীলফামারী ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণে ছোটখাটো আকৃতির একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। শহরের সব অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে শহীদ মিনার।
পরে ‘১৯৭২ সালে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন প্রভৃতি সংগঠনের সম্মিলিত উদ্যোগে পৌরপার্কে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে নীলফামারীতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার তৈরি করা হয়।’ স্বভাবতই পরবর্তী সময় থেকে নতুন এই শহীদ মিনারই হয়ে ওঠে শহরের সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মূল কেন্দ্র।
ভয় পায়নি নীলফামারীর ছাত্রজনতা। বাঙালিবিদ্বেষী প্রশাসন ও অনুরূপ বিহারি ছাত্রদের বাধা অতিক্রম করে তারা ভাষার দাবি পূরণ করতে একুশের দায় মিটিয়েছে।
এ ধরনের শহরগুলোয় প্রায়ই দেখা গেছে ১৯৪৮ সালের মার্চের ভাষা আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠেনি কিংবা আদৌ আন্দোলন শুরু করা যায়নি। নীলফামারীর ঘটনাবলির বিবরণ দিতে গিয়ে ফিরোজ আহমেদ লিখেছেন: ‘যে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়, তা মূলত সাম্প্রদায়িক চিন্তা, ধর্মীয় উগ্রতাসমৃদ্ধ ছিল। ১৯৪৮ সালে দেশের বিভিন্ন এলাকার মতোই নীলফামারীতে এর প্রভাব বিস্তৃত হয়। ফলে প্রগতিশীল রাজনৈতিক চিন্তাধারার প্রসার ঘটেনি।’
তা সত্ত্বেও এ কথা ঠিক যে এ অবস্থায়ও কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের একাধিক অঞ্চল থেকে আগতদের বসবাসের কারণে কোনো কোনো স্থানে সীমাবদ্ধ বৃত্তে প্রগতি চেতনার একটি পরিবেশ তৈরি হয়। নীলফামারীতে ১৯৪৮ সালের মার্চের ভাষা আন্দোলন সাংগঠনিক রূপ পায়নি। এমনকি ১৯৫০-এর মূলনীতি কমিটিবিরোধী ভাষা বিক্ষোভেও অংশ নিতে পারেনি নীলফামারী; যদিও সে সময় খয়রাত হোসেন প্রমুখ রাজনীতিবিদের চেষ্টায় নীলফামারীতে আওয়ামী মুসলিম লীগের মহকুমা কমিটি এবং পূর্ববঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের শাখা গঠিত হয়েছিল।
প্রকৃতপক্ষে নীলফামারীতে ভাষা আন্দোলনের সূচনা ১৯৫২ সালে শিক্ষায়তনকে কেন্দ্র করে। তত দিনে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে আওয়ামী মুসলিম লীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ। সিদ্ধান্ত, ৪ ফেব্রুয়ারি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট, সেই সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের সমাবেশ ও মিছিল। কিন্তু ৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে সরকারি ছাত্র সংগঠনের বিরোধিতায় সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কিন্তু হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের হস্তক্ষেপে সংঘাত এড়ানো সম্ভব হয় এবং ধর্মঘট ও মিছিল যথারীতি চলে। ছাত্রীদের তরফে এ কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দেন হালিমা খাতুন, জাহেদা বেগম, জাকিয়া সুলতানা, সালমা বেগম প্রমুখ ছাত্রী। আর ছাত্রদের নেতৃত্বে মোহাম্মদ আলী, শওকত আলী, শামসুল হক প্রমুখ।
নীলফামারীতে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির নির্ধারিত কর্মসূচি যথাযথভাবে পালিত হয় শিক্ষায়তনে ধর্মঘট, প্রতিবাদ সভা ও মিছিলের মাধ্যমে। স্লোগান ওঠে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। প্রতিবাদ সভায় সব মতের ছাত্রনেতাদের বক্তব্য দিতে দেখা যায়। অনেকটা ঢাকার মতো সর্বদলীয় চরিত্রের ধারায়।
কিন্তু ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ঘটনাবলির খবর শহরে পৌঁছালে ছাত্রজনতার মধ্যে বিপুল প্রতিবাদী আবেগ জন্ম নেয়। ছাত্রজনতার স্বতঃস্ফূর্ত এক মিছিল পূর্বোক্ত নেতৃত্বকে উপেক্ষা করেই পথে নেমে আসে। শহর প্রদক্ষিণ করার সময় বিভিন্ন স্তরের ও পেশার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিছিলে শামিল হয়। মিছিলের আয়তন বিশাল হয়ে ওঠে।
এখানেই থেমে থাকে না প্রতিবাদী কর্মতৎপরতা। ঢাকায় পুলিশি বর্বরতা সুদূর নীলফামারীতে রক্তবর্ণ পতাকা উড়িয়ে ভাষার দাবি আদায়ে গভীর প্রেরণা সৃষ্টি করে। মিছিল, স্লোগান, আবেগ ও উত্তেজনা সংহত হয় শেষবিকেলে পাবলিক লাইব্রেরি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ছাত্র জনসভায়। এসব মিছিলে শহরের বাইরে আশপাশের স্থানীয় মানুষ শামিল হয়। এমনকি গ্রামের লোকও।
আন্দোলন শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে মূলত সভা ও মিছিলে জনসাধারণের অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে। ইতিমধ্যে পুলিশও তৎপর হয়ে ওঠে। আন্দোলনের কয়েকজন নেপথ্য নায়ককে গ্রেপ্তার করা হয়। ক্ষুব্ধ ছাত্রজনতা তাঁদের মুক্তির দাবিতে থানা এলাকায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। সেই সঙ্গে ২৬ ফেব্রুয়ারি নীলফামারীতে সাধারণ ধর্মঘট, তথা হরতাল ও বিক্ষোভ মিছিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ উপলক্ষে পুলিশ ছাত্রনেতা শফিয়ার রহমান ও শামসুল হককে গ্রেপ্তার করে। ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী শফিয়ার রহমানকে শেষ পর্যন্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে আপন নিয়মে আন্দোলনের অবসান ঘটে।
কিন্তু এ আন্দোলনের প্রভাব ছড়িয়ে যায় নানা শ্রেণির মানুষের মধ্যে। ১৯৫৩ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসমাজ শহীদ দিবস পালনের উদ্যোগ নিলে তাতে সাধারণ মানুষের আন্তরিক সমর্থন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে ছাত্রনেতাদের চেষ্টায় নীলফামারী ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণে ছোটখাটো আকৃতির একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। শহরের সব অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে শহীদ মিনার।
পরে ‘১৯৭২ সালে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন প্রভৃতি সংগঠনের সম্মিলিত উদ্যোগে পৌরপার্কে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে নীলফামারীতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার তৈরি করা হয়।’ স্বভাবতই পরবর্তী সময় থেকে নতুন এই শহীদ মিনারই হয়ে ওঠে শহরের সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মূল কেন্দ্র।
ভয় পায়নি নীলফামারীর ছাত্রজনতা। বাঙালিবিদ্বেষী প্রশাসন ও অনুরূপ বিহারি ছাত্রদের বাধা অতিক্রম করে তারা ভাষার দাবি পূরণ করতে একুশের দায় মিটিয়েছে।
No comments