পরাশক্তিদের সংঘাত এড়াতে হবে by রবার্ট ফিস্ক
সিরিয়ার
‘ইসলামি খিলাফত’ যতটা দীর্ঘমেয়াদি মনে হতো, সেটা এখন আর অতটা দীর্ঘমেয়াদি
মনে হচ্ছে না। সে কারণেই কি সুন্নি সৌদিরা হঠাৎ করেই সিরিয়াতে স্থলসেনা
পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছে? আবার তুর্কিরাই বা এতটা বিচলিত কেন?
পাঁচ বছর ধরে আইএসের সঙ্গে যুদ্ধ করে ৬০ হাজার সেনা হারিয়ে সিরীয় সেনাবাহিনী হঠাৎ করেই এ যুদ্ধের সবচেয়ে বড় জয় অর্জন করেছে, তারা আলেপ্পো শহরের আশপাশে জাবাত আল-নুসরাসহ অন্য বিদ্রোহীদের গুঁড়িয়ে দিয়ে নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করে ফেলেছে। ওদিকে শহরের বাইরে রুশ বিমান হামলা তো ছিলই।
তুরস্ক থেকে আলেপ্পো পর্যন্ত বিদ্রোহীদের সরবরাহ লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, কিন্তু এটাই গল্পের শেষ নয়। বেশ কয়েক মাস ধরে সিরিয়ার সেনা কর্তৃপক্ষ আরও লাখ খানেক বেসামরিক মানুষসহ আলেপ্পো শহরের মধ্যে আটকা পড়েছিল, তারা একরকমভাবে নুসরা যোদ্ধাদের বোমা ও মর্টার গোলার মধ্যেই তাদের দয়ায় বেঁচে ছিল। এই বিদ্রোহীরা তাদের ঘিরে রেখেছিল, যতক্ষণ সেনাবাহিনী দক্ষিণমুখী মহাসড়কটি খুলে দেয়।
সে সময় আলেপ্পোতে যাওয়ার একমাত্র উপায় ছিল বিমানযাত্রা, কারণ বিমানবন্দরে যাওয়ার খুবই ছোট একটা উপদ্বীপ সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। এক রাতে আমি সিরিয়ার বিমানবাহিনীর একটি বিমানে চড়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম, ওই বিমানে অনেক আহত যোদ্ধা ছিল।
কিন্তু পরিকল্পনা বদলে গেছে। এখন বিদ্রোহীরাই শহরে ঘেরাও হয়ে পড়েছে, যাদের সঙ্গে আছে লাখ খানেক বেসামরিক মানুষ, নিজ নিজ ঘরবাড়িতেই তারা আটকা পড়েছে। কিন্তু তাদের টিকিয়ে রাখতে পারে, এমন কোনো বিমানবন্দরও নেই, যেটা সেনাবাহিনীর ছিল।
এই আতঙ্কজনক যুদ্ধে আনুষঙ্গিক যেসব লড়াই হয়েছে তার ভিত্তিতে বলা যায়, এই শহরের কেন্দ্রে তেমন জোরালো হামলা হবে না। উল্লেখ্য, এটিই সিরিয়ার মহত্তম শহর। সিরিয়ার সেনাবাহিনী হয়তো সেখানে তীব্র হামলা না চালিয়ে বিদ্রোহীদের বহুদিন ধরে ঘেরাও করে রেখে তাদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করবে।
সিরিয়ায় নুবল ও জারা নামে দুটি শিয়া-অধ্যুষিত গ্রাম রয়েছে, এই গ্রাম দুটি এত দিন বিদ্রোহীদের দ্বারা ঘেরাও ছিল, টানা তিন বছর সেখানকার অধিবাসীরা খাদ্যাভাবে ভুগেছে। সে সময় সিরিয়ার সেনাবাহিনী বিমান থেকে যে খাদ্য ফেলত, সেটা দিয়েই ওই দুটি গ্রামের মানুষ খাবারের চাহিদা পূরণ করত। সেই দুটি গ্রাম এখন সিরিয়ার সেনাবাহিনীর দখলে, এটাকে সাম্প্রতিক ইতিহাসের উল্টো রথযাত্রা হিসেবে অভিহিত করা যায়।
সেখানকার শিয়ারা আলাওয়াইট গোত্রভুক্ত, দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদও ওই গোত্রের মানুষ। ওই অঞ্চলের বেশ কয়েকটি গ্রামে শিয়ারা কোণঠাসা হয়ে গেছে, যদিও তাদের দুরবস্থার কথা এখন পর্যন্ত গণমাধ্যমে উঠে আসেনি।
আবার আলেপ্পোর বিদ্রোহী-অধ্যুষিত অঞ্চলের মানুষেরও এখন একই অবস্থা হবে, সেই একই বিচ্ছিন্নতার বোধ অনুভব করছে তারা। আর তার সঙ্গে ঘেরাওকারীদের বোমা তো আছেই। এই শহরের দুটি অংশের মানুষের মধ্যে সব সময়ই যোগাযোগ ছিল, সেই পথ কি এখন বন্ধ হয়ে যাবে? আর যে লাখো শরণার্থী উত্তরে তুরস্কের দিকে যাচ্ছে, তাদের কী হবে?
আলেপ্পো বেশ দেরি করেই এ যুদ্ধে যোগ দিল। এটা একধরনের ঐতিহাসিক অলৌকিক ব্যাপার, তারা ২০১২ সাল পর্যন্ত এই যুদ্ধ থেকে দূরে ছিল। ২০১২ সালে বিদ্রোহীরা দামেস্কের পথ ভেবে এই প্রাচীন শহরে ঢুকে পড়ে। কয়েক মাসের যুদ্ধে সেখানকার রাস্তায় রাস্তায় আগুন জ্বলেছে। তবে এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কোনো শহর সরকারের হাতে এল, কিন্তু এরপর কী হবে? রোমান শহর পালমিরার পুনর্দখল নেবে সরকার? দিরার আশপাশের ভূমি থেকে অবাঞ্ছিত মানুষের অপসারণ?
এদিকে আরও নাটকীয় ব্যাপার ঘটবে তখন, যখন কথা হচ্ছে, ওয়াশিংটন ও মস্কো যদি যুদ্ধ লাগায়, তাহলে আবারও বিশ্বযুদ্ধ সৃষ্টি হবে, যেটা আমাদের এড়াতে হবে।
হিজবুল্লাহ সহযোগীদের নিয়ে সিরিয়ার সেনাবাহিনী ও রুশ বিমানবাহিনী আইএসের ‘রাজধানী’ রাকা দখলের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে?
গত কয়েক দিনে যেসব অসাধারণ ব্যাপার ঘটেছে আইএস নিশ্চয়ই তা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করেছে, যদিও পালমিরা এখনো তাদের দখলেই আছে। সিরিয়ার ‘ইসলামি খিলাফত’ যতটা দীর্ঘমেয়াদি মনে হতো, সেটা এখন আর অতটা দীর্ঘমেয়াদি মনে হচ্ছে না। সে কারণেই কি সুন্নি সৌদিরা হঠাৎ করেই সিরিয়াতে স্থলসেনা পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছে? আবার তুর্কিরাই বা এতটা বিচলিত কেন? আমার মনে সন্দেহ, শিয়া ইরানে কেউ চোখের পানি ফেলছে কি না।
যা-ই হোক না কেন, অপমানজনক ইয়েমেন যুদ্ধ থেকে সৌদিরা ইতিমধ্যে পাততাড়ি গুটিয়ে নিচ্ছে। তুরস্ক সিরিয়ায় নিজের ন্যাটো সেনা পাঠালে সেটা এক দুঃস্বপ্নের মতো হবে, যদিও সেটা করলে তারা সম্ভবত রুশ হামলার মুখে পড়বে, কিন্তু ওয়াশিংটন ও মস্কো উভয়কেই তা এড়াতে হবে। গাভরিলো প্রিনসিপ নামের এক সার্ব ১৯১৪ সালে অস্ট্রিয়ার আর্চডিউক ফার্দিনান্দ ও তাঁর স্ত্রী সোফিকে হত্যা করেছিলেন, আর তার ফলে কী হয়েছিল আমরা সবাই জানি: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। কথা হচ্ছে, ওয়াশিংটন ও মস্কো যদি যুদ্ধ লাগায়, তাহলে আবারও বিশ্বযুদ্ধ সৃষ্টি হবে, যেটা আমাদের এড়াতে হবে।
দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া,
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি।
পাঁচ বছর ধরে আইএসের সঙ্গে যুদ্ধ করে ৬০ হাজার সেনা হারিয়ে সিরীয় সেনাবাহিনী হঠাৎ করেই এ যুদ্ধের সবচেয়ে বড় জয় অর্জন করেছে, তারা আলেপ্পো শহরের আশপাশে জাবাত আল-নুসরাসহ অন্য বিদ্রোহীদের গুঁড়িয়ে দিয়ে নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করে ফেলেছে। ওদিকে শহরের বাইরে রুশ বিমান হামলা তো ছিলই।
তুরস্ক থেকে আলেপ্পো পর্যন্ত বিদ্রোহীদের সরবরাহ লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, কিন্তু এটাই গল্পের শেষ নয়। বেশ কয়েক মাস ধরে সিরিয়ার সেনা কর্তৃপক্ষ আরও লাখ খানেক বেসামরিক মানুষসহ আলেপ্পো শহরের মধ্যে আটকা পড়েছিল, তারা একরকমভাবে নুসরা যোদ্ধাদের বোমা ও মর্টার গোলার মধ্যেই তাদের দয়ায় বেঁচে ছিল। এই বিদ্রোহীরা তাদের ঘিরে রেখেছিল, যতক্ষণ সেনাবাহিনী দক্ষিণমুখী মহাসড়কটি খুলে দেয়।
সে সময় আলেপ্পোতে যাওয়ার একমাত্র উপায় ছিল বিমানযাত্রা, কারণ বিমানবন্দরে যাওয়ার খুবই ছোট একটা উপদ্বীপ সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। এক রাতে আমি সিরিয়ার বিমানবাহিনীর একটি বিমানে চড়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম, ওই বিমানে অনেক আহত যোদ্ধা ছিল।
কিন্তু পরিকল্পনা বদলে গেছে। এখন বিদ্রোহীরাই শহরে ঘেরাও হয়ে পড়েছে, যাদের সঙ্গে আছে লাখ খানেক বেসামরিক মানুষ, নিজ নিজ ঘরবাড়িতেই তারা আটকা পড়েছে। কিন্তু তাদের টিকিয়ে রাখতে পারে, এমন কোনো বিমানবন্দরও নেই, যেটা সেনাবাহিনীর ছিল।
এই আতঙ্কজনক যুদ্ধে আনুষঙ্গিক যেসব লড়াই হয়েছে তার ভিত্তিতে বলা যায়, এই শহরের কেন্দ্রে তেমন জোরালো হামলা হবে না। উল্লেখ্য, এটিই সিরিয়ার মহত্তম শহর। সিরিয়ার সেনাবাহিনী হয়তো সেখানে তীব্র হামলা না চালিয়ে বিদ্রোহীদের বহুদিন ধরে ঘেরাও করে রেখে তাদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করবে।
সিরিয়ায় নুবল ও জারা নামে দুটি শিয়া-অধ্যুষিত গ্রাম রয়েছে, এই গ্রাম দুটি এত দিন বিদ্রোহীদের দ্বারা ঘেরাও ছিল, টানা তিন বছর সেখানকার অধিবাসীরা খাদ্যাভাবে ভুগেছে। সে সময় সিরিয়ার সেনাবাহিনী বিমান থেকে যে খাদ্য ফেলত, সেটা দিয়েই ওই দুটি গ্রামের মানুষ খাবারের চাহিদা পূরণ করত। সেই দুটি গ্রাম এখন সিরিয়ার সেনাবাহিনীর দখলে, এটাকে সাম্প্রতিক ইতিহাসের উল্টো রথযাত্রা হিসেবে অভিহিত করা যায়।
সেখানকার শিয়ারা আলাওয়াইট গোত্রভুক্ত, দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদও ওই গোত্রের মানুষ। ওই অঞ্চলের বেশ কয়েকটি গ্রামে শিয়ারা কোণঠাসা হয়ে গেছে, যদিও তাদের দুরবস্থার কথা এখন পর্যন্ত গণমাধ্যমে উঠে আসেনি।
আবার আলেপ্পোর বিদ্রোহী-অধ্যুষিত অঞ্চলের মানুষেরও এখন একই অবস্থা হবে, সেই একই বিচ্ছিন্নতার বোধ অনুভব করছে তারা। আর তার সঙ্গে ঘেরাওকারীদের বোমা তো আছেই। এই শহরের দুটি অংশের মানুষের মধ্যে সব সময়ই যোগাযোগ ছিল, সেই পথ কি এখন বন্ধ হয়ে যাবে? আর যে লাখো শরণার্থী উত্তরে তুরস্কের দিকে যাচ্ছে, তাদের কী হবে?
আলেপ্পো বেশ দেরি করেই এ যুদ্ধে যোগ দিল। এটা একধরনের ঐতিহাসিক অলৌকিক ব্যাপার, তারা ২০১২ সাল পর্যন্ত এই যুদ্ধ থেকে দূরে ছিল। ২০১২ সালে বিদ্রোহীরা দামেস্কের পথ ভেবে এই প্রাচীন শহরে ঢুকে পড়ে। কয়েক মাসের যুদ্ধে সেখানকার রাস্তায় রাস্তায় আগুন জ্বলেছে। তবে এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কোনো শহর সরকারের হাতে এল, কিন্তু এরপর কী হবে? রোমান শহর পালমিরার পুনর্দখল নেবে সরকার? দিরার আশপাশের ভূমি থেকে অবাঞ্ছিত মানুষের অপসারণ?
এদিকে আরও নাটকীয় ব্যাপার ঘটবে তখন, যখন কথা হচ্ছে, ওয়াশিংটন ও মস্কো যদি যুদ্ধ লাগায়, তাহলে আবারও বিশ্বযুদ্ধ সৃষ্টি হবে, যেটা আমাদের এড়াতে হবে।
হিজবুল্লাহ সহযোগীদের নিয়ে সিরিয়ার সেনাবাহিনী ও রুশ বিমানবাহিনী আইএসের ‘রাজধানী’ রাকা দখলের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে?
গত কয়েক দিনে যেসব অসাধারণ ব্যাপার ঘটেছে আইএস নিশ্চয়ই তা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করেছে, যদিও পালমিরা এখনো তাদের দখলেই আছে। সিরিয়ার ‘ইসলামি খিলাফত’ যতটা দীর্ঘমেয়াদি মনে হতো, সেটা এখন আর অতটা দীর্ঘমেয়াদি মনে হচ্ছে না। সে কারণেই কি সুন্নি সৌদিরা হঠাৎ করেই সিরিয়াতে স্থলসেনা পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছে? আবার তুর্কিরাই বা এতটা বিচলিত কেন? আমার মনে সন্দেহ, শিয়া ইরানে কেউ চোখের পানি ফেলছে কি না।
যা-ই হোক না কেন, অপমানজনক ইয়েমেন যুদ্ধ থেকে সৌদিরা ইতিমধ্যে পাততাড়ি গুটিয়ে নিচ্ছে। তুরস্ক সিরিয়ায় নিজের ন্যাটো সেনা পাঠালে সেটা এক দুঃস্বপ্নের মতো হবে, যদিও সেটা করলে তারা সম্ভবত রুশ হামলার মুখে পড়বে, কিন্তু ওয়াশিংটন ও মস্কো উভয়কেই তা এড়াতে হবে। গাভরিলো প্রিনসিপ নামের এক সার্ব ১৯১৪ সালে অস্ট্রিয়ার আর্চডিউক ফার্দিনান্দ ও তাঁর স্ত্রী সোফিকে হত্যা করেছিলেন, আর তার ফলে কী হয়েছিল আমরা সবাই জানি: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। কথা হচ্ছে, ওয়াশিংটন ও মস্কো যদি যুদ্ধ লাগায়, তাহলে আবারও বিশ্বযুদ্ধ সৃষ্টি হবে, যেটা আমাদের এড়াতে হবে।
দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া,
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি।
No comments