দলভিত্তিক ইউপি নির্বাচন কতটা যৌক্তিক by বদিউল আলম মজুমদার
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পৌরসভার মেয়র পদে
দলভিত্তিক নির্বাচনের পর ইউনিয়ন পরিষদেও চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে
নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। এ লক্ষ্যে ইউনিয়ন পরিষদ আইনে প্রয়োজনীয়
সংশোধনী আনা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনও ইতিমধ্যে আচরণবিধি চূড়ান্ত করে
ফেলেছে বলে শোনা যায়। কিন্তু বিশেষত পৌর নির্বাচনের অভিজ্ঞতার আলোকে
আমরা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহারের কোনো যৌক্তিকতা
খুঁজে পাই না।
তবে দলভিত্তিক ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন যৌক্তিক হতে পারে, যদি এর মাধ্যমে: (১) গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা তৃণমূল পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়; (২) জনকল্যাণ সাধনে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়; এবং/ অথবা (৩) ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর দলের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়, যা তাঁদের দায়বদ্ধ আচরণ নিশ্চিত করবে।
স্থানীয় সরকারব্যবস্থা, বিশেষত ইউনিয়ন পরিষদ হলো জনগণের দোরগোড়ার সরকার। তাই এর মাধ্যমেই ‘গ্রাস রুট ডেমোক্রেসি’ বা তৃণমূলে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। আর নির্বাচনের মাধ্যমেই তা ঘটে থাকে। তবে এ ক্ষেত্রে নির্বাচন দলভিত্তিক না হলে কিছু আসে-যায় না। কারণ, গণতন্ত্র হলো জনগণের সম্মতির শাসন এবং এই সম্মতি অর্জিত হয় জনগণের ভোটের মাধ্যমে। তাই তৃণমূলে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য দলীয় প্রতীকে নির্বাচন অনাবশ্যক।
অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, সম্পদ, দায়-দায়িত্ব ও ক্ষমতা যত জনগণের দোরগোড়ার সরকারের হাতে পৌঁছায়, তত বেশি তা তাদের কল্যাণে আসে। এর জন্য প্রয়োজন একটি বলিষ্ঠ বিকেন্দ্রীকরণ ও সম্পদ হস্তান্তর কর্মসূচি। তাই স্থানীয় সরকারপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পদ, ক্ষমতা ও স্বায়ত্তশাসন প্রদানের মাধ্যমে শক্তিশালী ও কার্যকর করা হলেই এগুলো জনগণকে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান এবং তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, দলভিত্তিক নির্বাচনের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গে বিকেন্দ্রীকরণ তথা নীতি-কাঠামোর এ ধরনের প্রয়োজনীয় সংস্কারের কোনো উদ্যোগই লক্ষ করা যায় না। এ ছাড়া বিকেন্দ্রীকরণ ও সম্পদ হস্তান্তর কর্মসূচির জন্য দলভিত্তিক নির্বাচনের প্রয়োজন হয় না।
দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর দলীয় শৃঙ্খলা আরোপের অভিজ্ঞতাও আমাদের ইতিবাচক নয়। দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একটি অংশ বর্তমানে অনেক গুরুতর গর্হিত কাজের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, দলের পক্ষ থেকে এসব অপকর্মের হোতাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া তেমন কোনো দৃষ্টান্ত আমাদের দেশে নেই। বস্তুত, অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, দলীয় শৃঙ্খলা বলতেই আমাদের দেশে কিছু নেই। বরং রাজনৈতিক দলের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই আমাদের দেশে অধিকাংশ দুর্নীতি ও অপকর্ম হয়ে থাকে। আবার অনেকের মতে, আমাদের দেশে যথাযথ গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ রাজনৈতিক দলই গড়ে ওঠেনি এবং আমাদের প্রধান দলগুলো অনেকটা ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটের মতোই আচরণ করে। প্রসঙ্গত, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ আফসোস করে বলেছিলেন, বাঙালি দলাদলিই করতে পারে, দল গড়ে তুলতে পারে না। তাই দলভিত্তিক নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের দেশে দলীয় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার যুক্তিও হালে পানি পায় না।
বরং দলীয় প্রতীকে নির্বাচন ভালোর পরিবর্তে মন্দই বয়ে আনতে পারে। সাম্প্রতিক পৌরসভা নির্বাচনের অভিজ্ঞতা অন্তত তা–ই বলে। দলীয়ভাবে নির্বাচন হলে শুধু যে এক দলের সঙ্গে অন্য দলের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ হয় তা নয়, একই দলের অভ্যন্তরেও বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে চরম হানাহানি সৃষ্টি করতে পারে। গত পৌরসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০ দিনে ৫০টি সহিংস ঘটনা ঘটেছে এবং এক দিনেই ঘটেছে ১১টি। সাধারণত জয়-পরাজয়ের উত্তাপে নির্বাচনের দিনেই সহিংসতা ঘটে থাকে, কিন্তু গত পৌর নির্বাচনে অনেক আগ থেকেই তা শুরু হয়। আর বিএনপি যদি দুর্বল অবস্থানে না থাকত এবং গ্রেপ্তার ও বিভিন্ন ধরনের মামলা-হামলা, ভয়ভীতির কারণে তারা যদি পলায়নপর না হতো, তাহলে আমাদের প্রধান দুই দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব-হানাহানি আরও অনেক বেশি হতো বলে অনেকের আশঙ্কা। অত্যন্ত ক্ষমতাধর সরকার তার প্রবল শক্তি ব্যবহার করে বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ন্ত্রণ না করলে সরকারি দলের অভ্যন্তরেও সহিংসতা আরও ব্যাপক হতো। আমাদের আশঙ্কা, চেয়ারম্যান পদে দলভিত্তিক মনোনয়নের কারণে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে।
ক্ষমতাসীন দল থেকে চেয়ারম্যান পদে গড়ে অন্তত পাঁচজন প্রার্থী দলীয় মনোনয়নের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে, (প্রথম আলো, ৩০ জানুয়ারি ২০১৬)। এটা দলের মধ্যে হানাহানি ব্যাপকভাবে উসকে দিতে পারে। সারা দেশে ৪ হাজার ৫৫৩টি ইউনিয়নে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের কারণে সহিংসতা ঘরে ঘরে পৌঁছাতে পারে, যা নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন হবে বলে অনেকের ধারণা। ইতিমধ্যে অনেক জায়গায় বলপ্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে মাঠছাড়া করার অশুভ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কয়েক দিন আগে নারায়ণগঞ্জের আলীরটেক ইউনিয়নে বর্তমান ও সাবেক চেয়ারম্যানের সমর্থকদের মধ্যে সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে সংঘর্ষে ৩০ জন আহত হয়েছে (মানবজমিন, ২৬ জানুয়ারি ২০১৬)। প্রতিপক্ষ দলের সঙ্গে এবং একই দলের অভ্যন্তরে এ ধরনের অনৈক্য ও হানাহানি তৃণমূলে অহেতুক অস্থিরতাই সৃষ্টি করবে এবং সামাজিক সম্প্রীতি বিনষ্ট করবে।
দলীয় প্রতীকে নির্বাচন নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথেও বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমাদের দেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হলো প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক দলীয়করণ। দুর্ভাগ্যবশত, পক্ষপাতদুষ্টতার গুরুতর অভিযোগ আমাদের নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেও রয়েছে। অতীতে অধিকাংশ প্রার্থীর দলীয় পরিচিতি থাকলেও ভোট গ্রহণের ক্ষেত্রে দলীয় প্রতীক ব্যবহৃত হতো না। তাই নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত দলবাজ কর্মকর্তারাও তাঁদের দলীয় প্রার্থীদের প্রতি একধরনের নিরপেক্ষতা প্রদর্শন করতেন। ফলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ সুগম হতো। কিন্তু দলভিত্তিক নির্বাচনে দলান্ধ কর্মকর্তারা তাঁদের দল মনোনীত প্রার্থীদের জিতিয়ে আনা অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন, যা নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
দলভিত্তিক নির্বাচন প্রার্থীর সংখ্যাও কমিয়ে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত পৌরসভা মেয়র পদে গড় প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ৫ দশমিক ১১। সাম্প্রতিক পৌর নির্বাচনে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ০৩ শতাংশে। এর বড় কারণ নির্দলীয় প্রার্থীর অনুপস্থিতি। অতীতে স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় অনেক ব্যক্তিকে স্থানীয় জনগণই নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দিতেন। কিন্তু পৌরসভা নির্বাচনে তাঁদের অনেকেই ভোটারদের প্রতীকের প্রতি আনুগত্যের কারণে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে উৎসাহিত বোধ করেননি। প্রার্থীর সংখ্যা কমে গেলে ভোটারদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিধি ছোট হয়ে যায়, কম যোগ্য প্রার্থী নির্বাচিত হন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া দলভিত্তিক নির্বাচনের সবচেয়ে বড় ভিকটিম হবেন নারীরা। কারণ প্রধান দলগুলোর মনোনয়নপ্রাপ্তদের বাইরে খুব কম নারীই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে এগিয়ে আসবেন।
পরিশেষে, দলভিত্তিক নির্বাচন একটি অত্যন্ত অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত। গত পৌরসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে আমরা দেশের একাধিক জায়গায় নাগরিকদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে সংলাপ করেছিলাম। সব ক্ষেত্রেই সংলাপে অংশগ্রহণকারীরা, যার মধ্যে সরকারদলীয় নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিও ছিলেন, বিপুলভাবে দলভিত্তিক নির্বাচনের বিপক্ষে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন। উদাহরণস্বরূপ, গত ১৯ অক্টোবর ২০১৫ রংপুরে অনুষ্ঠিত একটি সংলাপে ২৮ জন বক্তার মধ্যে ২০ জনই পৌর নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের বিরোধিতা করেন, চারজন দলভিত্তিক নির্বাচনের পক্ষে মত দেন আর অন্য চারজনের মধ্যে দুজন বিষয়টি সম্পর্কে জনমত যাচাইয়ের পরামর্শ দেন। জনমতের কথা বলতে গেলে, ১৩ জানুয়ারি ২০১৬ তারিখে প্রথম আলোয় অনুষ্ঠিত একটি অনলাইন জরিপে অংশগ্রহণকারী ৩ হাজার ২০৮ জনের মধ্যে ৭৩ শতাংশই দলভিত্তিক ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের বিপক্ষে মতামত দেন। আশা করি, আমাদের সম্মানিত রাজনীতিবিদেরা বিষয়টি আমলে নেবেন এবং জাতিকে আরও বিভক্ত করা থেকে বিরত থাকবেন। বিভক্তি কারও জন্যই কল্যাণ বয়ে আনবে না।
বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজন।
তবে দলভিত্তিক ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন যৌক্তিক হতে পারে, যদি এর মাধ্যমে: (১) গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা তৃণমূল পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়; (২) জনকল্যাণ সাধনে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়; এবং/ অথবা (৩) ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর দলের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়, যা তাঁদের দায়বদ্ধ আচরণ নিশ্চিত করবে।
স্থানীয় সরকারব্যবস্থা, বিশেষত ইউনিয়ন পরিষদ হলো জনগণের দোরগোড়ার সরকার। তাই এর মাধ্যমেই ‘গ্রাস রুট ডেমোক্রেসি’ বা তৃণমূলে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। আর নির্বাচনের মাধ্যমেই তা ঘটে থাকে। তবে এ ক্ষেত্রে নির্বাচন দলভিত্তিক না হলে কিছু আসে-যায় না। কারণ, গণতন্ত্র হলো জনগণের সম্মতির শাসন এবং এই সম্মতি অর্জিত হয় জনগণের ভোটের মাধ্যমে। তাই তৃণমূলে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য দলীয় প্রতীকে নির্বাচন অনাবশ্যক।
অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, সম্পদ, দায়-দায়িত্ব ও ক্ষমতা যত জনগণের দোরগোড়ার সরকারের হাতে পৌঁছায়, তত বেশি তা তাদের কল্যাণে আসে। এর জন্য প্রয়োজন একটি বলিষ্ঠ বিকেন্দ্রীকরণ ও সম্পদ হস্তান্তর কর্মসূচি। তাই স্থানীয় সরকারপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পদ, ক্ষমতা ও স্বায়ত্তশাসন প্রদানের মাধ্যমে শক্তিশালী ও কার্যকর করা হলেই এগুলো জনগণকে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান এবং তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, দলভিত্তিক নির্বাচনের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গে বিকেন্দ্রীকরণ তথা নীতি-কাঠামোর এ ধরনের প্রয়োজনীয় সংস্কারের কোনো উদ্যোগই লক্ষ করা যায় না। এ ছাড়া বিকেন্দ্রীকরণ ও সম্পদ হস্তান্তর কর্মসূচির জন্য দলভিত্তিক নির্বাচনের প্রয়োজন হয় না।
দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর দলীয় শৃঙ্খলা আরোপের অভিজ্ঞতাও আমাদের ইতিবাচক নয়। দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একটি অংশ বর্তমানে অনেক গুরুতর গর্হিত কাজের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, দলের পক্ষ থেকে এসব অপকর্মের হোতাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া তেমন কোনো দৃষ্টান্ত আমাদের দেশে নেই। বস্তুত, অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, দলীয় শৃঙ্খলা বলতেই আমাদের দেশে কিছু নেই। বরং রাজনৈতিক দলের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই আমাদের দেশে অধিকাংশ দুর্নীতি ও অপকর্ম হয়ে থাকে। আবার অনেকের মতে, আমাদের দেশে যথাযথ গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ রাজনৈতিক দলই গড়ে ওঠেনি এবং আমাদের প্রধান দলগুলো অনেকটা ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটের মতোই আচরণ করে। প্রসঙ্গত, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ আফসোস করে বলেছিলেন, বাঙালি দলাদলিই করতে পারে, দল গড়ে তুলতে পারে না। তাই দলভিত্তিক নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের দেশে দলীয় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার যুক্তিও হালে পানি পায় না।
বরং দলীয় প্রতীকে নির্বাচন ভালোর পরিবর্তে মন্দই বয়ে আনতে পারে। সাম্প্রতিক পৌরসভা নির্বাচনের অভিজ্ঞতা অন্তত তা–ই বলে। দলীয়ভাবে নির্বাচন হলে শুধু যে এক দলের সঙ্গে অন্য দলের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ হয় তা নয়, একই দলের অভ্যন্তরেও বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে চরম হানাহানি সৃষ্টি করতে পারে। গত পৌরসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০ দিনে ৫০টি সহিংস ঘটনা ঘটেছে এবং এক দিনেই ঘটেছে ১১টি। সাধারণত জয়-পরাজয়ের উত্তাপে নির্বাচনের দিনেই সহিংসতা ঘটে থাকে, কিন্তু গত পৌর নির্বাচনে অনেক আগ থেকেই তা শুরু হয়। আর বিএনপি যদি দুর্বল অবস্থানে না থাকত এবং গ্রেপ্তার ও বিভিন্ন ধরনের মামলা-হামলা, ভয়ভীতির কারণে তারা যদি পলায়নপর না হতো, তাহলে আমাদের প্রধান দুই দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব-হানাহানি আরও অনেক বেশি হতো বলে অনেকের আশঙ্কা। অত্যন্ত ক্ষমতাধর সরকার তার প্রবল শক্তি ব্যবহার করে বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ন্ত্রণ না করলে সরকারি দলের অভ্যন্তরেও সহিংসতা আরও ব্যাপক হতো। আমাদের আশঙ্কা, চেয়ারম্যান পদে দলভিত্তিক মনোনয়নের কারণে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে।
ক্ষমতাসীন দল থেকে চেয়ারম্যান পদে গড়ে অন্তত পাঁচজন প্রার্থী দলীয় মনোনয়নের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে, (প্রথম আলো, ৩০ জানুয়ারি ২০১৬)। এটা দলের মধ্যে হানাহানি ব্যাপকভাবে উসকে দিতে পারে। সারা দেশে ৪ হাজার ৫৫৩টি ইউনিয়নে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের কারণে সহিংসতা ঘরে ঘরে পৌঁছাতে পারে, যা নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন হবে বলে অনেকের ধারণা। ইতিমধ্যে অনেক জায়গায় বলপ্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে মাঠছাড়া করার অশুভ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কয়েক দিন আগে নারায়ণগঞ্জের আলীরটেক ইউনিয়নে বর্তমান ও সাবেক চেয়ারম্যানের সমর্থকদের মধ্যে সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে সংঘর্ষে ৩০ জন আহত হয়েছে (মানবজমিন, ২৬ জানুয়ারি ২০১৬)। প্রতিপক্ষ দলের সঙ্গে এবং একই দলের অভ্যন্তরে এ ধরনের অনৈক্য ও হানাহানি তৃণমূলে অহেতুক অস্থিরতাই সৃষ্টি করবে এবং সামাজিক সম্প্রীতি বিনষ্ট করবে।
দলীয় প্রতীকে নির্বাচন নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথেও বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমাদের দেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হলো প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক দলীয়করণ। দুর্ভাগ্যবশত, পক্ষপাতদুষ্টতার গুরুতর অভিযোগ আমাদের নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেও রয়েছে। অতীতে অধিকাংশ প্রার্থীর দলীয় পরিচিতি থাকলেও ভোট গ্রহণের ক্ষেত্রে দলীয় প্রতীক ব্যবহৃত হতো না। তাই নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত দলবাজ কর্মকর্তারাও তাঁদের দলীয় প্রার্থীদের প্রতি একধরনের নিরপেক্ষতা প্রদর্শন করতেন। ফলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ সুগম হতো। কিন্তু দলভিত্তিক নির্বাচনে দলান্ধ কর্মকর্তারা তাঁদের দল মনোনীত প্রার্থীদের জিতিয়ে আনা অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন, যা নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
দলভিত্তিক নির্বাচন প্রার্থীর সংখ্যাও কমিয়ে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত পৌরসভা মেয়র পদে গড় প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ৫ দশমিক ১১। সাম্প্রতিক পৌর নির্বাচনে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ০৩ শতাংশে। এর বড় কারণ নির্দলীয় প্রার্থীর অনুপস্থিতি। অতীতে স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় অনেক ব্যক্তিকে স্থানীয় জনগণই নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দিতেন। কিন্তু পৌরসভা নির্বাচনে তাঁদের অনেকেই ভোটারদের প্রতীকের প্রতি আনুগত্যের কারণে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে উৎসাহিত বোধ করেননি। প্রার্থীর সংখ্যা কমে গেলে ভোটারদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিধি ছোট হয়ে যায়, কম যোগ্য প্রার্থী নির্বাচিত হন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া দলভিত্তিক নির্বাচনের সবচেয়ে বড় ভিকটিম হবেন নারীরা। কারণ প্রধান দলগুলোর মনোনয়নপ্রাপ্তদের বাইরে খুব কম নারীই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে এগিয়ে আসবেন।
পরিশেষে, দলভিত্তিক নির্বাচন একটি অত্যন্ত অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত। গত পৌরসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে আমরা দেশের একাধিক জায়গায় নাগরিকদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে সংলাপ করেছিলাম। সব ক্ষেত্রেই সংলাপে অংশগ্রহণকারীরা, যার মধ্যে সরকারদলীয় নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিও ছিলেন, বিপুলভাবে দলভিত্তিক নির্বাচনের বিপক্ষে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন। উদাহরণস্বরূপ, গত ১৯ অক্টোবর ২০১৫ রংপুরে অনুষ্ঠিত একটি সংলাপে ২৮ জন বক্তার মধ্যে ২০ জনই পৌর নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের বিরোধিতা করেন, চারজন দলভিত্তিক নির্বাচনের পক্ষে মত দেন আর অন্য চারজনের মধ্যে দুজন বিষয়টি সম্পর্কে জনমত যাচাইয়ের পরামর্শ দেন। জনমতের কথা বলতে গেলে, ১৩ জানুয়ারি ২০১৬ তারিখে প্রথম আলোয় অনুষ্ঠিত একটি অনলাইন জরিপে অংশগ্রহণকারী ৩ হাজার ২০৮ জনের মধ্যে ৭৩ শতাংশই দলভিত্তিক ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের বিপক্ষে মতামত দেন। আশা করি, আমাদের সম্মানিত রাজনীতিবিদেরা বিষয়টি আমলে নেবেন এবং জাতিকে আরও বিভক্ত করা থেকে বিরত থাকবেন। বিভক্তি কারও জন্যই কল্যাণ বয়ে আনবে না।
বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজন।
No comments