পাকিস্তানের এজেন্ট : বিএনপি বনাম আওয়ামী লীগ by এবনে গোলাম সামাদ
বেগম
জিয়া সম্প্রতি তার এক বক্তৃতায় বলেছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে কতগুলো মানুষ
মারা গিয়েছে তার হিসাব এখনো জানা যায়নি। তিনি কী পটভূমিতে কথাটি বলেছেন, তা
আমার জানা নেই। তবে ১৯৭১ সালে ঠিক কতগুলো লোক মারা গিয়েছেন তার সঠিক তথ্য
যে আছে অজানা, সেটা কোনো বিতর্কের বিষয় হয়ে নেই। বিশেষ করে শর্মিলা বসুর
‘ডেট রেকনিং’ বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর। ১৯৭১-এ অনেক ব্যক্তিই মারা গিয়েছেন।
তারা যে সবাই ছিলেন বাংলাভাষী, তা নয়। একমাত্র শান্তাহারেই নাকি মারা
গিয়েছেন ১৫ হাজার বিহারি বা উর্দুভাষী। ১৯৭১ সালের মৃত্যুর হিসাব নিতে হলে
অবাঙালিদেরও মৃত্যুর হিসাব নিতে হবে। কেননা এ সময় সবাই ছিলেন পাকিস্তানের
নাগরিক, বাংলাদেশের নাগরিক নন। বেগম জিয়া ইতঃপূর্বে ছিলেন বাংলাদেশের
প্রধানমন্ত্রী। তিনি তার প্রধানমন্ত্রিত্বের কালে এ বিষয়ে একটি জরিপ করতে
পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। হঠাৎ করেই কেন তিনি প্রসঙ্গটি টেনে আনা
প্রাসঙ্গিক মনে করলেন, তা আমি জানি না। যা হয়ে গিয়েছে তা হলো অতীতের ঘটনা।
অতীত নিয়ে জাবর কেটে আমাদের কোনো লাভ হবে না। আমাদের এখন যা ভাবা দরকার তা
হলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যা করণীয় সে সম্বন্ধে।
কেননা আমাদের বেঁচে থাকতে হবে বর্তমানে; অতীতে নয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক Leopold Von Ranke (1795-1886) বলেছেন যে, একজন ইতিহাসবিদকে ইতিহাস লিখতে হবে ঘটনা নির্ভরভাবে; মতবাদ নির্ভরভাবে নয়। কারণ মানুষ যদি প্রকৃত তথ্য না জানে, তবে ইতিহাস পাঠ করে সে কিছু শিখতে পারবে না। আসবে বিভ্রান্তিকর উপসংহারের মধ্যে। তিনি আরো বলেন, প্রত্যেক জাতি বা রাষ্ট্রের স্বাধীন অস্তিত্ব নির্ভর করে তার অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতির ওপর। ভুল পররাষ্ট্রনীতি তাকে জড়িয়ে ফেলতে পারে ক্ষতিকর যুদ্ধে। একটা জাতির জীবনে তার নিজের ইতিহাস পর্যালোচনার গুরুত্ব আছে নানা দিক থেকেই। এর মধ্যে একটি হলো তার নিজের উপযোগী পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ। ভুল ইতিহাস একটা জাতিকে তার পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে করে তুলতে পারে বিভ্রান্ত। কিন্তু আমাদের ইতিহাসবিদেরা যেভাবে ইতিহাস রচনা করছেন, তাতে কেবলই থাকছে ১৯৭১-এর আবেগ; ১৯৭১-এর ঘটনাবলির প্রকৃত বিবরণ নয়। ১৯৭১-এর যুদ্ধ ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর দ্বারা পরিচালিত যুদ্ধ। ১৯৭১-এ বাঙালি-বিহারি সঙ্ঘাতে ইন্ধন জুগিয়েছিল ভারতীয় গোয়েন্দাচক্র। এসব কথা আমাদের ইতিহাসবিদেরা তাদের লেখায় বিবৃত করতে চাচ্ছেন না। ফলে আমরা জানছি কার্যত ভুল ইতিহাস। আর তা থেকে পেতে পারছি নীতি নির্ধারণে ভুল নির্দেশ।
বর্তমান পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে আছে ১৭০০ কিলোমিটার দূরে। বাংলাদেশে নেই কোনো খান সেনা। ভারত ডিঙিয়ে এসে পাঞ্জাবি খান সেনারা এখন আর কোনোভাবেই বাংলাদেশকে দখল করতে সক্ষম হবে না, এটা ধরে নেয়া যায় স্বতঃসিদ্ধভাবেই। ভারতঘেরা বাংলাদেশ দখল করার চেষ্টা করতে পারে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত, পাকিস্তান নয়। কিন্তু আমরা যেন ভারতকে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে সেভাবে গুরুত্ব না দিয়ে দিতে চাচ্ছি বর্তমান পাকিস্তানকে। যেটা অবশ্যই বলতে হবে বিভ্রান্তিকর বিশ্লেষণ। সম্প্রতি সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, খালেদা জিয়া হলেন পাকিস্তানের এজেন্ট। তার উচিত পাকিস্তানে চলে যাওয়া (আলোকিত বাংলাদেশ, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৫)। কিন্তু ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বলছেন, ভারত পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ চায় না। সে পাকিস্তানের সাথে গড়ে তুলতে চায় মসৃণ সম্পর্ক। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানে নিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে জড়িয়ে ধরেছিলেন বুকে। ভারত কেন এটা করছে আমরা তা জানি না। তবে মনে হচ্ছে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে আসছে পরিবর্তন। কেননা বিশ্বে শুরু হতে পারে একটা বড় রকমের যুদ্ধ। ভারত চাচ্ছে না সে যুদ্ধে জড়িত হতে। সে চাচ্ছে না দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশ এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ুক। আর যুদ্ধ এসে যাক ভারতের দুয়ারে। ভারত চাচ্ছে, তার প্রতিবেশী সার্কভুক্ত রাষ্ট্রগুলোকে পক্ষে নিয়ে একটি বিশেষ ব্লক তৈরি করতে; যা তাকে শক্তি জোগাবে বিশ্ব রাজনীতির ধারা নিয়ন্ত্রণে।
১৯৭১-এর বিশ্ব পরিস্থিতি আর আজকের বিশ্ব এক নয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি তাই হয়ে উঠতে চাচ্ছে অনেক ভিন্ন। কিন্তু আমাদের দেশের ক্ষমতাসীন দল পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে যেন আঁকড়ে থাকতে চাচ্ছে সাবেক ধ্যান ধারণাকে নিয়ে। হতে চাচ্ছে না এ ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠ। রাজনীতি করতে চাচ্ছে কেবলই পাকিস্তানকে সমালোচনা করে। অথচ পাকিস্তান এখন ভৌগোলিক কারণেই আমাদের শত্রু বলে বিবেচিত হতে পারে না। ভূ-রাজনৈতিক বিশেষতাকে নির্ভর করেই শেষ পর্যন্ত গঠিত হওয়া উচিত একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতি। ভারতে মোদির সমালোচনা উঠেছে পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য। একই রকম সমালোচনা উঠছে বিএনপি পাকিস্তানের সাথে অতীত বিবাদ বজায় রাখতে চাচ্ছে না বলে। ভারতে কংগ্রেস যেভাবে মোদির সমালোচনামুখর হয়ে উঠেছে, এ দেশে আওয়ামী লীগ যেন খালেদা জিয়ার সমালোচনায় অনুসরণ করতে চাচ্ছে একই বাগধারা। মনে হচ্ছে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে চাচ্ছে ভারতের কংগ্রেসের অনুসরণে। কিন্তু ভারতে কংগ্রেস এখন আর ক্ষমতায় নেই। ক্ষমতায় আসার আশু সম্ভাবনা অনুমান করা যাচ্ছে না। ভারতে কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকলে আওয়ামী লীগ কংগ্রেসের নীতি অনুসরণ করে শক্তি সঞ্চয় করতে পারত, কিন্তু এখন কংগ্রেসের সাথে একসূত্রে রাজনীতি করতে গেলে সে পেতে পারবে না বর্তমান ভারত সরকারের সাহায্য ও সভানুভূতি। তাই বলতে হয় দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ভুল পথে হাঁটছে। আর এর ফলে এ দেশের রাজনীতিতে হয়ে পড়তে পারে একদিকে যেমন জনবিচ্ছিন্ন, তেমনি অন্য দিকে হয়ে পড়তে পারে তার শক্তির আদি উৎস ভারত থেকেও যথেষ্ট বিচ্ছিন্ন।
প্রতিটি দেশের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারিত হয় সে দেশের পার্লামেন্ট অথবা যথাযথভাবে আলোচনার মধ্য দিয়ে। কিন্তু আমাদের বর্তমান সরকার সেটা করতে চাচ্ছে না। যদিও পার্লামেন্ট আছে, আর হচ্ছে তার অধিবেশন। কিন্তু সব সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে যেন প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায়। রাষ্ট্র ও প্রধানমন্ত্রী হয়ে পড়েছেন সমার্থক। যা আমাদের রাজনৈতিক সঙ্কটকে করে তুলছে ঘনীভূত। দল হিসেবে আওয়ামী লীগের মধ্যে পররাষ্ট্রনীতিতে দেখা যাচ্ছে দু’টি ভাগ। এক ভাগ হয়ে উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচক। তারা বলছেন, ইসলামি স্টেটপন্থীরা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্ট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের শত্রুরাষ্ট্র নয়। কিন্তু মন্ত্রীপর্যায়ে হতে পারছে তার সমালোচনা। যেটা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে আমাদের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে। এভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ক্ষতি করে বাংলাদেশ কিভাবে লাভবান হবে সেটা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। বাংলাদেশ সিরিয়ার সন্নিকটের দেশ নয়। সিরিয়া সম্পর্কে আমরা যথেষ্ট জ্ঞাতও নই। অথচ আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলছেন, আমরা সিরিয়ার ব্যাপারে থাকব সৌদি আরবের সাথে। পাকিস্তানও বলছে যে, সে সৌদি আরবের সাথে থাকবে। কিন্তু এমন কিছু করবে না, যা পাকিস্তানের সাথে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইরানের মিত্রতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। সে কোথায় সৈন্য পাঠাবে না পাঠাবে, সেটা ঠিক করবে নিজের জাতি ও স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এ রকম কিছু চাচ্ছে না বলতে।
আসলে পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে বর্তমান সরকার ভুগছে স্ববিরোধিতায়। আওয়ামী লীগের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা বামচক্র সমর্থন করতে চাচ্ছে রাশিয়াকে। অন্য দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন অংশ করতে চাচ্ছে এর বিরোধিতা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রুশ দ্বন্দ্ব চলেছে আওয়ামী লীগের মধ্যে। পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে এভাবে বিভক্ত একটি দল দেশের স্বার্থে যে একটি সুষ্ঠু পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে চলতে পারবে, তা মনে হচ্ছে না। একটি অংশ বলছে, তারা আইএসবিরোধী। আইএস হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা সৃষ্ট। আর মার্কিন স্বার্থে পারিচালিত। অন্য অংশ বলছে, বাংলাদেশে কোনো আইএস নেই। আইএস বাংলাদেশের কোনো সমস্যা নয়। ‘প্রথম আলো’র খবরে প্রকাশ (৩০ নভেম্বর ২০১৫) : কামরাঙ্গীচরে মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিমদের সাথে এক আলোচনা সভায় খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন, ‘বাংলাদেশকে জঙ্গিরাষ্ট্র বানিয়ে কোনোভাবে এ দেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র।’ ওই একই সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন- ‘বাংলাদেশে আইএস-এর কোনো কার্যকলাপ বা অস্তিত্ব নেই।’ অর্থাৎ দুই মন্ত্রীর বক্তব্য এ সভাতেই হতে পারছে দুই রকম। পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কথা বলতে পারেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অথবা প্রধানমন্ত্রী, অন্য মন্ত্রীরা নন। কিন্তু এখন অনেক মন্ত্রী কথা বলছেন পররাষ্ট্র বিষয়ে। মনে হচ্ছে, পররাষ্ট্র বিষয়ে এই কলরব হচ্ছে না আমাদের সংবিধানসম্মত। আওয়ামী লীগের পররাষ্ট্রনীতি দেশকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে পারে এক গভীর বিপদের মধ্যে। খালেদা জিয়াকে পাকিস্তানের এজেন্ট বলে সমালোচনা করে সে বিপদকে কোনোভাবেই এড়ানো যাবে না।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি ভারতের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে করতে চাচ্ছেন পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন। অন্য দিকে আমরা রাজনীতি করতে চাচ্ছি যেন কেবলই পাকিস্তানের সমালোচনা করে। কিন্তু পাকিস্তান এখন আর আমাদের কোনো সমস্যা নয় ভৌগোলিক দূরত্বের কারণেই। বিএনপি এখন ক্ষমতায় নেই, নেই বিরোধী দলেও। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র বিএনপিকে দিচ্ছে যথেষ্ট গুরুত্ব। খালেদা জিয়াকে কাবু করতে হলে তার পেছন থেকে এই আন্তর্জাতিক সমর্থন সরিয়ে নিতে হবে। কিন্তু যেভাবে বিএনপির সমালোচনা করা হচ্ছে, তাতে তার গুরুত্ব আন্তর্জাতিক দৃষ্টিতে না কমে বৃদ্ধি পাওয়াই হবে সম্ভব।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক Leopold Von Ranke (1795-1886) বলেছেন যে, একজন ইতিহাসবিদকে ইতিহাস লিখতে হবে ঘটনা নির্ভরভাবে; মতবাদ নির্ভরভাবে নয়। কারণ মানুষ যদি প্রকৃত তথ্য না জানে, তবে ইতিহাস পাঠ করে সে কিছু শিখতে পারবে না। আসবে বিভ্রান্তিকর উপসংহারের মধ্যে। তিনি আরো বলেন, প্রত্যেক জাতি বা রাষ্ট্রের স্বাধীন অস্তিত্ব নির্ভর করে তার অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতির ওপর। ভুল পররাষ্ট্রনীতি তাকে জড়িয়ে ফেলতে পারে ক্ষতিকর যুদ্ধে। একটা জাতির জীবনে তার নিজের ইতিহাস পর্যালোচনার গুরুত্ব আছে নানা দিক থেকেই। এর মধ্যে একটি হলো তার নিজের উপযোগী পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ। ভুল ইতিহাস একটা জাতিকে তার পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে করে তুলতে পারে বিভ্রান্ত। কিন্তু আমাদের ইতিহাসবিদেরা যেভাবে ইতিহাস রচনা করছেন, তাতে কেবলই থাকছে ১৯৭১-এর আবেগ; ১৯৭১-এর ঘটনাবলির প্রকৃত বিবরণ নয়। ১৯৭১-এর যুদ্ধ ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর দ্বারা পরিচালিত যুদ্ধ। ১৯৭১-এ বাঙালি-বিহারি সঙ্ঘাতে ইন্ধন জুগিয়েছিল ভারতীয় গোয়েন্দাচক্র। এসব কথা আমাদের ইতিহাসবিদেরা তাদের লেখায় বিবৃত করতে চাচ্ছেন না। ফলে আমরা জানছি কার্যত ভুল ইতিহাস। আর তা থেকে পেতে পারছি নীতি নির্ধারণে ভুল নির্দেশ।
বর্তমান পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে আছে ১৭০০ কিলোমিটার দূরে। বাংলাদেশে নেই কোনো খান সেনা। ভারত ডিঙিয়ে এসে পাঞ্জাবি খান সেনারা এখন আর কোনোভাবেই বাংলাদেশকে দখল করতে সক্ষম হবে না, এটা ধরে নেয়া যায় স্বতঃসিদ্ধভাবেই। ভারতঘেরা বাংলাদেশ দখল করার চেষ্টা করতে পারে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত, পাকিস্তান নয়। কিন্তু আমরা যেন ভারতকে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে সেভাবে গুরুত্ব না দিয়ে দিতে চাচ্ছি বর্তমান পাকিস্তানকে। যেটা অবশ্যই বলতে হবে বিভ্রান্তিকর বিশ্লেষণ। সম্প্রতি সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, খালেদা জিয়া হলেন পাকিস্তানের এজেন্ট। তার উচিত পাকিস্তানে চলে যাওয়া (আলোকিত বাংলাদেশ, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৫)। কিন্তু ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বলছেন, ভারত পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ চায় না। সে পাকিস্তানের সাথে গড়ে তুলতে চায় মসৃণ সম্পর্ক। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানে নিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে জড়িয়ে ধরেছিলেন বুকে। ভারত কেন এটা করছে আমরা তা জানি না। তবে মনে হচ্ছে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে আসছে পরিবর্তন। কেননা বিশ্বে শুরু হতে পারে একটা বড় রকমের যুদ্ধ। ভারত চাচ্ছে না সে যুদ্ধে জড়িত হতে। সে চাচ্ছে না দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশ এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ুক। আর যুদ্ধ এসে যাক ভারতের দুয়ারে। ভারত চাচ্ছে, তার প্রতিবেশী সার্কভুক্ত রাষ্ট্রগুলোকে পক্ষে নিয়ে একটি বিশেষ ব্লক তৈরি করতে; যা তাকে শক্তি জোগাবে বিশ্ব রাজনীতির ধারা নিয়ন্ত্রণে।
১৯৭১-এর বিশ্ব পরিস্থিতি আর আজকের বিশ্ব এক নয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি তাই হয়ে উঠতে চাচ্ছে অনেক ভিন্ন। কিন্তু আমাদের দেশের ক্ষমতাসীন দল পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে যেন আঁকড়ে থাকতে চাচ্ছে সাবেক ধ্যান ধারণাকে নিয়ে। হতে চাচ্ছে না এ ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠ। রাজনীতি করতে চাচ্ছে কেবলই পাকিস্তানকে সমালোচনা করে। অথচ পাকিস্তান এখন ভৌগোলিক কারণেই আমাদের শত্রু বলে বিবেচিত হতে পারে না। ভূ-রাজনৈতিক বিশেষতাকে নির্ভর করেই শেষ পর্যন্ত গঠিত হওয়া উচিত একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতি। ভারতে মোদির সমালোচনা উঠেছে পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য। একই রকম সমালোচনা উঠছে বিএনপি পাকিস্তানের সাথে অতীত বিবাদ বজায় রাখতে চাচ্ছে না বলে। ভারতে কংগ্রেস যেভাবে মোদির সমালোচনামুখর হয়ে উঠেছে, এ দেশে আওয়ামী লীগ যেন খালেদা জিয়ার সমালোচনায় অনুসরণ করতে চাচ্ছে একই বাগধারা। মনে হচ্ছে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে চাচ্ছে ভারতের কংগ্রেসের অনুসরণে। কিন্তু ভারতে কংগ্রেস এখন আর ক্ষমতায় নেই। ক্ষমতায় আসার আশু সম্ভাবনা অনুমান করা যাচ্ছে না। ভারতে কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকলে আওয়ামী লীগ কংগ্রেসের নীতি অনুসরণ করে শক্তি সঞ্চয় করতে পারত, কিন্তু এখন কংগ্রেসের সাথে একসূত্রে রাজনীতি করতে গেলে সে পেতে পারবে না বর্তমান ভারত সরকারের সাহায্য ও সভানুভূতি। তাই বলতে হয় দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ভুল পথে হাঁটছে। আর এর ফলে এ দেশের রাজনীতিতে হয়ে পড়তে পারে একদিকে যেমন জনবিচ্ছিন্ন, তেমনি অন্য দিকে হয়ে পড়তে পারে তার শক্তির আদি উৎস ভারত থেকেও যথেষ্ট বিচ্ছিন্ন।
প্রতিটি দেশের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারিত হয় সে দেশের পার্লামেন্ট অথবা যথাযথভাবে আলোচনার মধ্য দিয়ে। কিন্তু আমাদের বর্তমান সরকার সেটা করতে চাচ্ছে না। যদিও পার্লামেন্ট আছে, আর হচ্ছে তার অধিবেশন। কিন্তু সব সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে যেন প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায়। রাষ্ট্র ও প্রধানমন্ত্রী হয়ে পড়েছেন সমার্থক। যা আমাদের রাজনৈতিক সঙ্কটকে করে তুলছে ঘনীভূত। দল হিসেবে আওয়ামী লীগের মধ্যে পররাষ্ট্রনীতিতে দেখা যাচ্ছে দু’টি ভাগ। এক ভাগ হয়ে উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচক। তারা বলছেন, ইসলামি স্টেটপন্থীরা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্ট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের শত্রুরাষ্ট্র নয়। কিন্তু মন্ত্রীপর্যায়ে হতে পারছে তার সমালোচনা। যেটা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে আমাদের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে। এভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ক্ষতি করে বাংলাদেশ কিভাবে লাভবান হবে সেটা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। বাংলাদেশ সিরিয়ার সন্নিকটের দেশ নয়। সিরিয়া সম্পর্কে আমরা যথেষ্ট জ্ঞাতও নই। অথচ আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলছেন, আমরা সিরিয়ার ব্যাপারে থাকব সৌদি আরবের সাথে। পাকিস্তানও বলছে যে, সে সৌদি আরবের সাথে থাকবে। কিন্তু এমন কিছু করবে না, যা পাকিস্তানের সাথে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইরানের মিত্রতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। সে কোথায় সৈন্য পাঠাবে না পাঠাবে, সেটা ঠিক করবে নিজের জাতি ও স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এ রকম কিছু চাচ্ছে না বলতে।
আসলে পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে বর্তমান সরকার ভুগছে স্ববিরোধিতায়। আওয়ামী লীগের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা বামচক্র সমর্থন করতে চাচ্ছে রাশিয়াকে। অন্য দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন অংশ করতে চাচ্ছে এর বিরোধিতা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রুশ দ্বন্দ্ব চলেছে আওয়ামী লীগের মধ্যে। পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে এভাবে বিভক্ত একটি দল দেশের স্বার্থে যে একটি সুষ্ঠু পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে চলতে পারবে, তা মনে হচ্ছে না। একটি অংশ বলছে, তারা আইএসবিরোধী। আইএস হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা সৃষ্ট। আর মার্কিন স্বার্থে পারিচালিত। অন্য অংশ বলছে, বাংলাদেশে কোনো আইএস নেই। আইএস বাংলাদেশের কোনো সমস্যা নয়। ‘প্রথম আলো’র খবরে প্রকাশ (৩০ নভেম্বর ২০১৫) : কামরাঙ্গীচরে মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিমদের সাথে এক আলোচনা সভায় খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন, ‘বাংলাদেশকে জঙ্গিরাষ্ট্র বানিয়ে কোনোভাবে এ দেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র।’ ওই একই সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন- ‘বাংলাদেশে আইএস-এর কোনো কার্যকলাপ বা অস্তিত্ব নেই।’ অর্থাৎ দুই মন্ত্রীর বক্তব্য এ সভাতেই হতে পারছে দুই রকম। পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কথা বলতে পারেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অথবা প্রধানমন্ত্রী, অন্য মন্ত্রীরা নন। কিন্তু এখন অনেক মন্ত্রী কথা বলছেন পররাষ্ট্র বিষয়ে। মনে হচ্ছে, পররাষ্ট্র বিষয়ে এই কলরব হচ্ছে না আমাদের সংবিধানসম্মত। আওয়ামী লীগের পররাষ্ট্রনীতি দেশকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে পারে এক গভীর বিপদের মধ্যে। খালেদা জিয়াকে পাকিস্তানের এজেন্ট বলে সমালোচনা করে সে বিপদকে কোনোভাবেই এড়ানো যাবে না।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি ভারতের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে করতে চাচ্ছেন পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন। অন্য দিকে আমরা রাজনীতি করতে চাচ্ছি যেন কেবলই পাকিস্তানের সমালোচনা করে। কিন্তু পাকিস্তান এখন আর আমাদের কোনো সমস্যা নয় ভৌগোলিক দূরত্বের কারণেই। বিএনপি এখন ক্ষমতায় নেই, নেই বিরোধী দলেও। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র বিএনপিকে দিচ্ছে যথেষ্ট গুরুত্ব। খালেদা জিয়াকে কাবু করতে হলে তার পেছন থেকে এই আন্তর্জাতিক সমর্থন সরিয়ে নিতে হবে। কিন্তু যেভাবে বিএনপির সমালোচনা করা হচ্ছে, তাতে তার গুরুত্ব আন্তর্জাতিক দৃষ্টিতে না কমে বৃদ্ধি পাওয়াই হবে সম্ভব।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
No comments