নতুন রাজনৈতিক দিশা চিহ্নিত করার বছর by ফরহাদ মজহার
সবাইকে ঈসায়ী নববর্ষের শুভেচ্ছা। নতুন
বছরের শুরুতে অল্প কিছু কথা বলব। বরং সবাইকে বলব, ভাবুন, আমরা কোনদিকে
যাচ্ছি। চরম দুর্নীতি, লুটপাট, নাগরিক ও মানবিক অধিকার লংঘন এবং ভোটের
তামাশা সত্ত্বেও আমি মনে করি না বাংলাদেশের জনগণ ভুল পথে যাচ্ছে। গত বছরের
(২০১৫) শেষে পৌরসভার নির্বাচন গিয়েছে। নির্বাচনে কারচুপি ঘটেছে, একে কোনো
অর্থেই নির্বাচন বলা যায় না। ইসির ভূমিকা নিন্দনীয়। বিএনপি যথারীতি তা
প্রত্যাখ্যান করেছে। পৌর নির্বাচনের ফলাফল দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির
চরিত্রে বদল ঘটল কিনা অনেকে সেই প্রশ্ন তুলছেন। আদৌ কোনো বদল হয়েছে কিনা
বুঝতে পারব কি? আমার ধারণা, বুঝব। কিন্তু সবার আগে বুঝতে হবে, শেখ হাসিনার
অধীনে বিরোধী রাজনৈতিক জোটের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত ছিল সঠিক
সিদ্ধান্ত। কিন্তু এরপর রাজনীতিতে নির্ণায়ক শক্তি হয়ে উঠতে হলে কী ধরনের
নীতি ও কৌশল দরকার, খালেদা জিয়া সেক্ষেত্রে তার দলের ভেতর থেকে কারও
সহযোগিতা পাননি। বরং একটি ধারা গড়ে উঠেছে, যারা নির্বাচন বর্জনের ছুতা ধরে
দলের অভ্যন্তরে বিরোধ তৈরি এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাতের চেষ্টা চালিয়ে
যাচ্ছে। সম্ভবত এদের চাপেই খালেদা জিয়া পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন।
অন্য যুক্তি হচ্ছে, তৃণমূলে কর্মীদের রাজনীতিতে সক্রিয় রাখারও দরকার ছিল।
কিন্তু এখন স্পষ্ট হয়ে যাওয়া উচিত, স্রেফ নির্বাচন দিয়ে অবৈধ ক্ষমতাকে
মোকাবেলা করা হাস্যকর। সেটাই পৌর নির্বাচনে প্রমাণিত হল। ক্ষমতাসীনরা
সুষ্ঠু নির্বাচনী পন্থায় ক্ষমতা ছাড়বে না। এটা নিশ্চিত। কিন্তু এরপরও জাতীয়
নির্বাচন বর্জনের জন্য বিএনপিকে দোষারোপ করে যারা বিএনপিকে কোণঠাসা করতে
চাইছে, পৌর নির্বাচনে নগ্ন কারচুপি ও তামাশা তাদের জন্য খালেদা জিয়ার উত্তর
হিসেবে আমরা পাঠ করতে পারি। এরপরও ফ্যাসিস্ট শক্তির পক্ষে দালাল সাফাই
গানেওয়ালাদের অভাব হবে না। তাতে আমাদের চিন্তিত হওয়ার কিছু নাই।
পৌর নির্বাচনে কী ঘটেছে তার পুরো ছবি আমাদের কাছে নাই। এ অভাব বাংলাদেশের জনগণের এখনকার রাজনৈতিক মানসিকতা বোঝার ক্ষেত্রে বড় ধরনের কোনো বাধা নয়। সন্দেহ নাই, পৌর নির্বাচনে এক ধরনের নির্বাচনী তামাশা হয়েছে। কিন্তু সত্য হল, এটাই যে ঘটবে এ ব্যাপারে আগাম কোনো সন্দেহ ছিল না। বিএনপি এই নির্বাচনে নগ্ন কারচুপি হবে সে ‘আশংকা’ ব্যক্ত করেই অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু এ নির্বাচন থেকে তারা কী অর্জন করতে চেয়েছে এবং তারা তা পেরেছে কি-না সেটা একমাত্র ভবিষ্যতই বলতে পারবে।
বিএনপির মধ্যে কিছু মধুর স্মৃতি কাজ করে থাকতে পারে। মনে আছে কি-না যে, ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ১৯৩ আসন পেয়েছিল। তবে ২০০৮ সালে তারা মাত্র ২৯ আসন পেয়েছিল। কিন্তু ভোটের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে তা কোনো বিপর্যয় ছিল না। আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছিল ৪৯ ভাগ; বিপরীতে বিএনপি ভোট পেয়েছিল ৩৩.২ ভাগ। ক্ষমতায় আসার ৫ বছরের মধ্যে আওয়ামী লীগ তার ক্ষমতার ভিত্তি পোক্ত করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু দুর্নীতি, মানবাধিকার লংঘন, একনায়কতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট শাসনকে সাংবিধানিক চরিত্র দেয়ার কারণে তার বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভও ছিল। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আওয়ামী সেক্যুলার রাজনীতির রাজনীতি নিয়ে কূটচাল। আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে বিবর্তিত হয়ে আসা আওয়ামী লীগের ধ্র“পদী চরিত্রের সঙ্গে যা ছিল একদমই বেমানান। সেকুলারিজম ও মুক্তিযুদ্ধের নামে আওয়ামী লীগের ঘাড়ে চড়ে একটি হীনশক্তি বাংলাদেশকে বিভক্ত ও বিভাজিত করে চলেছে। এ শক্তির ওপর ভর করে আওয়ামী লীগ কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে যেভাবে যুদ্ধে নেমে পড়েছিল, তাতে দলটি ইসলামবিরোধী শক্তি হিসেবে নিজেকে জাহির করেছে। সেই কলংক থেকে আওয়ামী লীগের মুক্তি পাওয়া কঠিন।
কিন্তু এর কিছুই বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট নিজের পক্ষে ব্যবহার করতে পারেনি। বিএনপি-জোটের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামপন্থী দলগুলো থাকা সত্ত্বেও ইসলাম প্রশ্নে বিএনপির অবস্থান ছিল দোদুল্যমান। ধর্ম নিয়ে কৌশলী আওয়ামী মার্কা রাজনীতির বিপরীতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শক্তি হিসেবে বিএনপি তার ভাবমূর্তি রক্ষা করতে পারেনি। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তার সম্পর্কটাকেই আওয়ামী প্রচারণা প্রধান করে তুলতে পেরেছে। কিন্তু কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক দেওবন্দি ধারার ইসলামপন্থী দলগুলোও বিরোধী জোটে ছিল। ঔপনিবেশিক ইংরেজবিরোধী এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এ ধারার সমর্থন পেয়েও বিএনপি তাকে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারেনি। এখানে মনে রাখা দরকার যে, হাফেজ্জী হুজুর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে বলছিলেন জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই। ইসলামের জায়গা থেকে জাতীয়তাবাদী বিকারে পদস্খলিত না হয়ে মজলুমের পক্ষে বাংলাদেশের বহু আলেম-ওলামা দাঁড়িয়েছিলেন। তারা বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু বিএনপি একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকার ভার বহন করতে গিয়ে আওয়ামী প্রচারণার মুখে নিজেকে খামাখা বিপর্যস্ত হতে দিয়েছে।
আসলে ধর্মবিদ্বেষী কিংবা তথাকথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ না হয়েও কী ধরনের রাজনৈতিক চর্চা বিএনপিকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য দল হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারে, সে সম্পর্কে বিএনপির মধ্যে চিন্তাভাবনার অনুপস্থিতি অবিশ্বাস্যই বলতে হবে। বিএনপি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট বেঁধে চলে, ইসলামপন্থীদের তার সঙ্গে রাখে। এর নীতিগত ভিত্তি সম্পর্কে বিএনপির সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নাই। উপমহাদেশে ইসলামের ভূমিকা ব্যাখ্যার মধ্য দিয়েই উপনিবেশবিরোধী মুক্তি সংগ্রামের ঐতিহাসিক ধারার সঙ্গে বিএনপি নিজেকে যুক্ত রাখতে পারত। কিন্তু বিএনপির বুদ্ধিজীবী বা প্রচারকদের মধ্যে সেই বুদ্ধিবৃত্তিক হিম্মত আমরা দেখিনি। ফলে বিএনপি মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের সঙ্গে আঁতাত করা একটি দল হিসেবে নিজের পরিচয়কে বাড়তে দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পাল্টা প্রচার আজও গড়ে তুলতে পারেনি।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট মূলত নির্বাচনী জোট, পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে তা নাজায়েজ কিছু নয়। কিন্তু এ জোট নিয়েই বিএনপি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচন নয়, আন্দোলন করেছে; হরতাল ডেকেছে, রাস্তায় লড়েছে। দুই পক্ষের হানাহানিতে মানুষ মরেছে, মানুষ পুড়েছে। বিএনপি পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছে, ইসলামপন্থীদের সঙ্গে বিএনপির জোট নির্বাচনী জোট নয়, এটা আন্দোলন-সংগ্রামের রাজনৈতিক জোট। কিন্তু এ জোটের নৈতিক ভিত্তি বিএনপি স্পষ্ট করতে পারেনি। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সঙ্গে জোট কেন? দ্বিতীয়ত, ইসলামপন্থীদের সঙ্গেই বা তার জোটের আদর্শিক ভিত্তি কি? বিএনপি ইসলামকে কী চোখে দেখে? এসব প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বিএনপি রাজনীতি করতে চেয়েছে। তার ফল ভালো হয়নি।
ধর্মকে কেন্দ্র করে রাজনীতি হতে পারে না কেন? অবশ্যই হতে পারে এবং হচ্ছেও বটে। সারা দুনিয়াতে হচ্ছে, বাংলাদেশেও ধর্ম রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সেটা ইসলামপন্থী হতে পারে, নাও হতে পারে। এমনকি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর বয়ান অনুযায়ী ‘ইসলামী সমাজতন্ত্র’ও হতে পারে। দ্বিতীয়ত, ঔপনিবেশিক আমলে এ দেশের জনগণের আন্দোলন-সংগ্রাম ঐতিহাসিক কারণে ধর্মকে কেন্দ্র করেই হয়েছিল। সেটা সফলও হয়েছিল। দেশের মানুষ জমিদার-মহাজনদের হাত থেকে মুক্তি চেয়েছিল। পাকিস্তান আমলে তারা তা পেয়েছেও বটে। তদুপরি পাকিস্তান না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতে পারত না। দিল্লির অধীন একটি রাজ্য হিসেবে থাকতে হতো, যেখানে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যালঘু। বাংলাদেশের জনগণের সার্বভৌমত্ব এবং আত্মমর্যাদার প্রশ্ন তার ধর্ম চেতনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। সাধারণ মানুষ মনে করে, একাত্তরে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র জন্য মানুষ যুদ্ধ করেনি, সেটা স্বাধীনতার ঘোষণাতেও নাই। এটা দিল্লির চাপিয়ে দেয়া নীতি। যার উদ্দেশ্য এ দেশের জনগণের বিশ্বাস ও চর্চা- অর্থাৎ তাদের সংস্কৃতি, ঈমান ও আকিদার সরাসরি বিরোধিতা। তারা একে ইউরোপীয় এনলাইটমেন্টের প্রস্তাব হিসেবে গ্রহণ করেনি। ইসলামবিরোধী রাজনীতির আদর্শ হিসেবে বুঝেছে।
এটা স্পষ্ট বোঝা দরকার, ইসলাম এ দেশের জনগণের রাজনীতির প্রধান আকর্ষণের বিষয়। একে উপেক্ষা করার সুযোগ নাই। ভাসানী ন্যাপ পুরোটা নিয়েই জিয়াউর রহমান বিএনপি গড়ে তুলেছিলেন। ধর্মবাদীদেরও বাইরে রাখেননি। ভাসানী ধর্মকে রাজনীতি থেকে পৃথক না করেও কমিউনিস্টদের সঙ্গে জালিমের বিরুদ্ধে মজলুম জনগণের লড়াই-সংগ্রাম করে গিয়েছেন। কমিউনিস্টদের সঙ্গে যে কারণে তিনি কাজ করেছেন। যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন বলে জিয়াউর রহমানের রাজনীতির কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য গণমানুষের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ভারতীয় আধিপত্যবাদবিরোধী শক্তির ঐক্য গড়ে তোলা এবং বাকশালী অর্থনীতির বিপরীতে গতিশীল অর্থনৈতিক বিকাশ ও উন্নয়ন। দ্বিতীয়ত, ছোট দেশ হলেও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিপরীতে দক্ষিণ এশিয়ায় বহুপাক্ষিক সম্পর্ক বিকশিত করে ভারতের সঙ্গে শক্তির অসমতা সামাল দেয়ার শর্ত বিকশিত করা। ভুলে যাওয়ার কথা নয়, এ লক্ষ্যেই দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক জোট ‘সার্ক’ জিয়াউর রহমানই গড়ে তুলেছিলেন।
আফসোস, বর্তমান বিএনপির মধ্যে জিয়াউর রহমানের দূরদৃষ্টির ছিটেফোঁটা আছে কিনা সন্দেহ। মুখে বিএনপি নিজেকে জামায়াতের রাজনীতি থেকে আলাদা বলে বারবার দাবি করেছে। কিন্তু রাস্তার আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপির মূল সাংগঠনিক শক্তি ছিল জামায়াত ও শিবির। হেফাজতে ইসলামের ছায়ায় সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের বিশাল বিক্ষোভ ও আন্দোলনকেও বিএনপি কাজে লাগাতে পারেনি। কারণ ইসলাম কিংবা ধর্মনিরপেক্ষতা কোনো বিষয়েই বিএনপি সুস্পষ্ট নয়। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন উঠলেও বিএনপি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জায়গা থেকে কোনো সমালোচনা-পর্যালোচনা করেনি। দুই এক কলি নাম কা ওয়াস্তে কথা বললেও তা বিচারিক প্রক্রিয়ার কোনো পর্যালোচনা ছিল না। চুপ থেকে বিএনপি ভেবেছে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির সঙ্গে ‘আন্দোলনের আঁতাত’-এর দাহ নিজের গা থেকে সহজে ঝেড়ে ফেলতে পারবে। আফসোস, সেটা ঘটেনি। এর পূর্ণ সুযোগ আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিয়েছে। দল হিসেবে বিএনপির বিপর্যয় এতে ত্বরান্বিত হয়েছে। ইসলামপন্থীদের সঙ্গে জোট বাঁধার জন্য এ বিপর্যয় ঘটেনি। ইসলাম প্রশ্নে অস্পষ্টতার জন্যই এ বিপর্যয় ঘটেছে।
বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের দল। সত্য হচ্ছে এই যে, জিয়াউর রহমান একাত্তরের নয় মাস সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমান নন। তবে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে জিয়ার আবির্ভাবের কারণ হচ্ছে জিয়াউর রহমান সৈনিক ও জনতার মৈত্রীর চিহ্ন হিসেবে হাজির হয়েছিলেন। দিল্লির আধিপত্যবাদ, আগ্রাসন ও বাকশালী রাজনীতির বিপরীতে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে এ মৈত্রী বাংলাদেশের একমাত্র সম্বল, সাধারণ মানুষ তা বুঝেছিল।
বিএনপির বর্তমান গভীর রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সুনির্দিষ্ট তিনটি কারণ রয়েছে : এক. জিয়াউর রহমানের ঐতিহাসিক তাৎপর্য বুঝতে অক্ষম হওয়া এবং তার রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি হারিয়ে ফেলা; দুই. ইসলাম প্রশ্নে অস্পষ্টতা, যা একইভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কেও চরম অজ্ঞতা এবং তিন. রাজনৈতিক নীতিহীনতা ও হিপক্রেসি। যার কারণে জনগণের বিশ্বাস বিএনপি ধরে রাখতে পারছে না। বাংলাদেশের জনগণ বর্তমান অবস্থা থেকে মুক্তি চায়, কিন্তু খোলামনে এ সংকটের মোকাবেলা না করলে বিএনপির ওপর বাংলাদেশের জনগণ ভরসা করবে না।
গত এক দশকে নব্য আওয়ামী রাজনীতির ইসলাম বিদ্বেষ প্রকট আকার ধারণ করে। ইসলামের প্রতি আওয়ামী লীগের দৃষ্টিভঙ্গি আওয়ামী লীগের জন্যও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এর কিছুই বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট নতুন গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা তৈরির কাজে ব্যবহার করতে পারেনি। অর্থাৎ বিএনপি পাল্টা এমন কোনো নীতিগত দাবি নিয়ে আসেনি যার কারণে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট বাংলাদেশকে বিকল্প পথের সন্ধান দিতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি ছাড়া আর কোনো রেকর্ড বিএনপির কাছ থেকে আমরা শুনিনি।
শেখ হাসিনার প্রকট ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের অধীনে থেকেও আওয়ামী লীগের শাসনামলে ২০১১ সালে বিএনপি পৌর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তার জাতীয় চরিত্র অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছিল। ২৩৬টি পৌরসভার মধ্যে বিএনপির সমর্থকরা ৯২টি আর আওয়ামী লীগ সমর্থকরা ৮৮টি পৌরসভায় জয়ী হয়েছিলেন। আর এখন তা উল্টে দাঁড়াল ১৭৮ বনাম ২২। তখন অধিকাংশ পৌরসভায় নির্বাচন হয়েছিল তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ। ২০১১ সালের সফলতার পেছনে ছিল বিএনপির ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনেও বিএনপি এভাবে বিপর্যস্ত হয়নি। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে বিএনপি কতটা ভালো করেছে, সেই পরিসংখ্যান তুলে ধরেছিলেন। পৌরসভার নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে সন্দেহ নাই। আওয়ামী লীগ ধরে নিয়েছে বিএনপিকে রাজনীতি করার সুযোগ না দিয়ে এভাবেই তারা ‘নির্বাচন’ নামক প্রহসন চালিয়ে যাবে।
বিএনপির ওপর জনগণের হতাশা স্থায়ী কিছু বলে আমি মনে করি না। দ্বিতীয়ত, বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট ক্ষমতার বিপরীতে জাতীয় রাজনীতিতে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর জোটের গুরুত্বকে কোনোভাবেই হালকা করে ভাবা উচিত নয়। বিরোধী জোটের কঠোর সমালোচনা দরকার। কিন্তু মনে করি না বিএনপি দুর্বল বা বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে তাতে এ মুহূর্তে বাংলাদেশের কোনো উপকার হবে। এতে হাততালি দেয়ার যেমন কিছু নাই, হতাশ হওয়ারও কোনো কারণ দেখি না। এর কারণ খুবই সোজা। আগামী দিনে যে রাজনীতি প্রবল শক্তি নিয়ে সামনে আসবে, তা তিনটি প্রশ্নের মোকাবেলা করার জন্যই আসবে।
এক. সার্বভৌমত্ব বোধের সঙ্গে সৈনিকতা এবং নাগরিকতার মৈত্রী- আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য যা জরুরি। জিয়াউর রহমানের ঐতিহাসিক উত্থান ও তাৎপর্য ব্যাখ্যার মাধ্যমে বিএনপি তা এখনও বোঝাতে সক্ষম।
দুই. ইসলাম প্রশ্নে স্পষ্টতা অর্জন, যা একইভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার পর্যালোচনা। ইসলামকে ধর্ম ও ধর্মতত্ত্ব হিসেবে না বুঝে উপমহাদেশে ইসলামের ইতিহাস মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করা। ধর্ম প্রসঙ্গে সেই অবস্থানই জরুরি আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে যা খামাখা অন্য রাষ্ট্র বা অন্য রাষ্ট্রের জনগণের মনে কোনো সন্দেহ বা আশংকার সৃষ্টি না করে। নীতিগত দিক অস্পষ্ট রেখে শক্তিশালী রাষ্ট্রের সমর্থনের জন্য দালালি করলে কোনো ফল নাই, এটাও বোঝা দরকার; এবং তিন. রাজনৈতিক নীতিহীনতা ও হিপক্রেসি পরিহার।
এ তিনটি দিকে বিএনপি মনোযোগী হবে কি-না আমরা জানি না। কিন্তু ফ্যাসিস্ট রাজনীতি ও রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে জনগণের একটি লড়াই চলছে, যা বিএনপি বা তার জোটভুক্ত দলের অধীন নয়। এ রাজনীতি দুর্বল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নাই। বিএনপি ‘জাতীয়তাবাদ’ বলতে যদি এ ধারাটিকে সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারে এবং জনগণের রাজনৈতিক ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ওপর দাঁড়ায়, জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসেবে বিএনপির ফিরে আসা কয়েক মাসের ব্যাপার মাত্র।
আমি নিশ্চিত ২০১৬ সাল হবে নতুন রাজনৈতিক দিশা চিহ্নিত করার বছর।
১৮ পৌষ, ১৪২২, ১ জানুয়ারি, ২০১৬/ শ্যামলী
পৌর নির্বাচনে কী ঘটেছে তার পুরো ছবি আমাদের কাছে নাই। এ অভাব বাংলাদেশের জনগণের এখনকার রাজনৈতিক মানসিকতা বোঝার ক্ষেত্রে বড় ধরনের কোনো বাধা নয়। সন্দেহ নাই, পৌর নির্বাচনে এক ধরনের নির্বাচনী তামাশা হয়েছে। কিন্তু সত্য হল, এটাই যে ঘটবে এ ব্যাপারে আগাম কোনো সন্দেহ ছিল না। বিএনপি এই নির্বাচনে নগ্ন কারচুপি হবে সে ‘আশংকা’ ব্যক্ত করেই অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু এ নির্বাচন থেকে তারা কী অর্জন করতে চেয়েছে এবং তারা তা পেরেছে কি-না সেটা একমাত্র ভবিষ্যতই বলতে পারবে।
বিএনপির মধ্যে কিছু মধুর স্মৃতি কাজ করে থাকতে পারে। মনে আছে কি-না যে, ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ১৯৩ আসন পেয়েছিল। তবে ২০০৮ সালে তারা মাত্র ২৯ আসন পেয়েছিল। কিন্তু ভোটের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে তা কোনো বিপর্যয় ছিল না। আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছিল ৪৯ ভাগ; বিপরীতে বিএনপি ভোট পেয়েছিল ৩৩.২ ভাগ। ক্ষমতায় আসার ৫ বছরের মধ্যে আওয়ামী লীগ তার ক্ষমতার ভিত্তি পোক্ত করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু দুর্নীতি, মানবাধিকার লংঘন, একনায়কতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট শাসনকে সাংবিধানিক চরিত্র দেয়ার কারণে তার বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভও ছিল। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আওয়ামী সেক্যুলার রাজনীতির রাজনীতি নিয়ে কূটচাল। আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে বিবর্তিত হয়ে আসা আওয়ামী লীগের ধ্র“পদী চরিত্রের সঙ্গে যা ছিল একদমই বেমানান। সেকুলারিজম ও মুক্তিযুদ্ধের নামে আওয়ামী লীগের ঘাড়ে চড়ে একটি হীনশক্তি বাংলাদেশকে বিভক্ত ও বিভাজিত করে চলেছে। এ শক্তির ওপর ভর করে আওয়ামী লীগ কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে যেভাবে যুদ্ধে নেমে পড়েছিল, তাতে দলটি ইসলামবিরোধী শক্তি হিসেবে নিজেকে জাহির করেছে। সেই কলংক থেকে আওয়ামী লীগের মুক্তি পাওয়া কঠিন।
কিন্তু এর কিছুই বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট নিজের পক্ষে ব্যবহার করতে পারেনি। বিএনপি-জোটের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামপন্থী দলগুলো থাকা সত্ত্বেও ইসলাম প্রশ্নে বিএনপির অবস্থান ছিল দোদুল্যমান। ধর্ম নিয়ে কৌশলী আওয়ামী মার্কা রাজনীতির বিপরীতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শক্তি হিসেবে বিএনপি তার ভাবমূর্তি রক্ষা করতে পারেনি। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তার সম্পর্কটাকেই আওয়ামী প্রচারণা প্রধান করে তুলতে পেরেছে। কিন্তু কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক দেওবন্দি ধারার ইসলামপন্থী দলগুলোও বিরোধী জোটে ছিল। ঔপনিবেশিক ইংরেজবিরোধী এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এ ধারার সমর্থন পেয়েও বিএনপি তাকে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারেনি। এখানে মনে রাখা দরকার যে, হাফেজ্জী হুজুর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে বলছিলেন জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই। ইসলামের জায়গা থেকে জাতীয়তাবাদী বিকারে পদস্খলিত না হয়ে মজলুমের পক্ষে বাংলাদেশের বহু আলেম-ওলামা দাঁড়িয়েছিলেন। তারা বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু বিএনপি একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকার ভার বহন করতে গিয়ে আওয়ামী প্রচারণার মুখে নিজেকে খামাখা বিপর্যস্ত হতে দিয়েছে।
আসলে ধর্মবিদ্বেষী কিংবা তথাকথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ না হয়েও কী ধরনের রাজনৈতিক চর্চা বিএনপিকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য দল হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারে, সে সম্পর্কে বিএনপির মধ্যে চিন্তাভাবনার অনুপস্থিতি অবিশ্বাস্যই বলতে হবে। বিএনপি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট বেঁধে চলে, ইসলামপন্থীদের তার সঙ্গে রাখে। এর নীতিগত ভিত্তি সম্পর্কে বিএনপির সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নাই। উপমহাদেশে ইসলামের ভূমিকা ব্যাখ্যার মধ্য দিয়েই উপনিবেশবিরোধী মুক্তি সংগ্রামের ঐতিহাসিক ধারার সঙ্গে বিএনপি নিজেকে যুক্ত রাখতে পারত। কিন্তু বিএনপির বুদ্ধিজীবী বা প্রচারকদের মধ্যে সেই বুদ্ধিবৃত্তিক হিম্মত আমরা দেখিনি। ফলে বিএনপি মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের সঙ্গে আঁতাত করা একটি দল হিসেবে নিজের পরিচয়কে বাড়তে দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পাল্টা প্রচার আজও গড়ে তুলতে পারেনি।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট মূলত নির্বাচনী জোট, পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে তা নাজায়েজ কিছু নয়। কিন্তু এ জোট নিয়েই বিএনপি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচন নয়, আন্দোলন করেছে; হরতাল ডেকেছে, রাস্তায় লড়েছে। দুই পক্ষের হানাহানিতে মানুষ মরেছে, মানুষ পুড়েছে। বিএনপি পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছে, ইসলামপন্থীদের সঙ্গে বিএনপির জোট নির্বাচনী জোট নয়, এটা আন্দোলন-সংগ্রামের রাজনৈতিক জোট। কিন্তু এ জোটের নৈতিক ভিত্তি বিএনপি স্পষ্ট করতে পারেনি। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সঙ্গে জোট কেন? দ্বিতীয়ত, ইসলামপন্থীদের সঙ্গেই বা তার জোটের আদর্শিক ভিত্তি কি? বিএনপি ইসলামকে কী চোখে দেখে? এসব প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বিএনপি রাজনীতি করতে চেয়েছে। তার ফল ভালো হয়নি।
ধর্মকে কেন্দ্র করে রাজনীতি হতে পারে না কেন? অবশ্যই হতে পারে এবং হচ্ছেও বটে। সারা দুনিয়াতে হচ্ছে, বাংলাদেশেও ধর্ম রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সেটা ইসলামপন্থী হতে পারে, নাও হতে পারে। এমনকি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর বয়ান অনুযায়ী ‘ইসলামী সমাজতন্ত্র’ও হতে পারে। দ্বিতীয়ত, ঔপনিবেশিক আমলে এ দেশের জনগণের আন্দোলন-সংগ্রাম ঐতিহাসিক কারণে ধর্মকে কেন্দ্র করেই হয়েছিল। সেটা সফলও হয়েছিল। দেশের মানুষ জমিদার-মহাজনদের হাত থেকে মুক্তি চেয়েছিল। পাকিস্তান আমলে তারা তা পেয়েছেও বটে। তদুপরি পাকিস্তান না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতে পারত না। দিল্লির অধীন একটি রাজ্য হিসেবে থাকতে হতো, যেখানে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যালঘু। বাংলাদেশের জনগণের সার্বভৌমত্ব এবং আত্মমর্যাদার প্রশ্ন তার ধর্ম চেতনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। সাধারণ মানুষ মনে করে, একাত্তরে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র জন্য মানুষ যুদ্ধ করেনি, সেটা স্বাধীনতার ঘোষণাতেও নাই। এটা দিল্লির চাপিয়ে দেয়া নীতি। যার উদ্দেশ্য এ দেশের জনগণের বিশ্বাস ও চর্চা- অর্থাৎ তাদের সংস্কৃতি, ঈমান ও আকিদার সরাসরি বিরোধিতা। তারা একে ইউরোপীয় এনলাইটমেন্টের প্রস্তাব হিসেবে গ্রহণ করেনি। ইসলামবিরোধী রাজনীতির আদর্শ হিসেবে বুঝেছে।
এটা স্পষ্ট বোঝা দরকার, ইসলাম এ দেশের জনগণের রাজনীতির প্রধান আকর্ষণের বিষয়। একে উপেক্ষা করার সুযোগ নাই। ভাসানী ন্যাপ পুরোটা নিয়েই জিয়াউর রহমান বিএনপি গড়ে তুলেছিলেন। ধর্মবাদীদেরও বাইরে রাখেননি। ভাসানী ধর্মকে রাজনীতি থেকে পৃথক না করেও কমিউনিস্টদের সঙ্গে জালিমের বিরুদ্ধে মজলুম জনগণের লড়াই-সংগ্রাম করে গিয়েছেন। কমিউনিস্টদের সঙ্গে যে কারণে তিনি কাজ করেছেন। যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন বলে জিয়াউর রহমানের রাজনীতির কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য গণমানুষের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ভারতীয় আধিপত্যবাদবিরোধী শক্তির ঐক্য গড়ে তোলা এবং বাকশালী অর্থনীতির বিপরীতে গতিশীল অর্থনৈতিক বিকাশ ও উন্নয়ন। দ্বিতীয়ত, ছোট দেশ হলেও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিপরীতে দক্ষিণ এশিয়ায় বহুপাক্ষিক সম্পর্ক বিকশিত করে ভারতের সঙ্গে শক্তির অসমতা সামাল দেয়ার শর্ত বিকশিত করা। ভুলে যাওয়ার কথা নয়, এ লক্ষ্যেই দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক জোট ‘সার্ক’ জিয়াউর রহমানই গড়ে তুলেছিলেন।
আফসোস, বর্তমান বিএনপির মধ্যে জিয়াউর রহমানের দূরদৃষ্টির ছিটেফোঁটা আছে কিনা সন্দেহ। মুখে বিএনপি নিজেকে জামায়াতের রাজনীতি থেকে আলাদা বলে বারবার দাবি করেছে। কিন্তু রাস্তার আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপির মূল সাংগঠনিক শক্তি ছিল জামায়াত ও শিবির। হেফাজতে ইসলামের ছায়ায় সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের বিশাল বিক্ষোভ ও আন্দোলনকেও বিএনপি কাজে লাগাতে পারেনি। কারণ ইসলাম কিংবা ধর্মনিরপেক্ষতা কোনো বিষয়েই বিএনপি সুস্পষ্ট নয়। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন উঠলেও বিএনপি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জায়গা থেকে কোনো সমালোচনা-পর্যালোচনা করেনি। দুই এক কলি নাম কা ওয়াস্তে কথা বললেও তা বিচারিক প্রক্রিয়ার কোনো পর্যালোচনা ছিল না। চুপ থেকে বিএনপি ভেবেছে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির সঙ্গে ‘আন্দোলনের আঁতাত’-এর দাহ নিজের গা থেকে সহজে ঝেড়ে ফেলতে পারবে। আফসোস, সেটা ঘটেনি। এর পূর্ণ সুযোগ আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিয়েছে। দল হিসেবে বিএনপির বিপর্যয় এতে ত্বরান্বিত হয়েছে। ইসলামপন্থীদের সঙ্গে জোট বাঁধার জন্য এ বিপর্যয় ঘটেনি। ইসলাম প্রশ্নে অস্পষ্টতার জন্যই এ বিপর্যয় ঘটেছে।
বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের দল। সত্য হচ্ছে এই যে, জিয়াউর রহমান একাত্তরের নয় মাস সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমান নন। তবে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে জিয়ার আবির্ভাবের কারণ হচ্ছে জিয়াউর রহমান সৈনিক ও জনতার মৈত্রীর চিহ্ন হিসেবে হাজির হয়েছিলেন। দিল্লির আধিপত্যবাদ, আগ্রাসন ও বাকশালী রাজনীতির বিপরীতে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে এ মৈত্রী বাংলাদেশের একমাত্র সম্বল, সাধারণ মানুষ তা বুঝেছিল।
বিএনপির বর্তমান গভীর রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সুনির্দিষ্ট তিনটি কারণ রয়েছে : এক. জিয়াউর রহমানের ঐতিহাসিক তাৎপর্য বুঝতে অক্ষম হওয়া এবং তার রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি হারিয়ে ফেলা; দুই. ইসলাম প্রশ্নে অস্পষ্টতা, যা একইভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কেও চরম অজ্ঞতা এবং তিন. রাজনৈতিক নীতিহীনতা ও হিপক্রেসি। যার কারণে জনগণের বিশ্বাস বিএনপি ধরে রাখতে পারছে না। বাংলাদেশের জনগণ বর্তমান অবস্থা থেকে মুক্তি চায়, কিন্তু খোলামনে এ সংকটের মোকাবেলা না করলে বিএনপির ওপর বাংলাদেশের জনগণ ভরসা করবে না।
গত এক দশকে নব্য আওয়ামী রাজনীতির ইসলাম বিদ্বেষ প্রকট আকার ধারণ করে। ইসলামের প্রতি আওয়ামী লীগের দৃষ্টিভঙ্গি আওয়ামী লীগের জন্যও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এর কিছুই বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট নতুন গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা তৈরির কাজে ব্যবহার করতে পারেনি। অর্থাৎ বিএনপি পাল্টা এমন কোনো নীতিগত দাবি নিয়ে আসেনি যার কারণে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট বাংলাদেশকে বিকল্প পথের সন্ধান দিতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি ছাড়া আর কোনো রেকর্ড বিএনপির কাছ থেকে আমরা শুনিনি।
শেখ হাসিনার প্রকট ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের অধীনে থেকেও আওয়ামী লীগের শাসনামলে ২০১১ সালে বিএনপি পৌর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তার জাতীয় চরিত্র অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছিল। ২৩৬টি পৌরসভার মধ্যে বিএনপির সমর্থকরা ৯২টি আর আওয়ামী লীগ সমর্থকরা ৮৮টি পৌরসভায় জয়ী হয়েছিলেন। আর এখন তা উল্টে দাঁড়াল ১৭৮ বনাম ২২। তখন অধিকাংশ পৌরসভায় নির্বাচন হয়েছিল তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ। ২০১১ সালের সফলতার পেছনে ছিল বিএনপির ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনেও বিএনপি এভাবে বিপর্যস্ত হয়নি। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে বিএনপি কতটা ভালো করেছে, সেই পরিসংখ্যান তুলে ধরেছিলেন। পৌরসভার নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে সন্দেহ নাই। আওয়ামী লীগ ধরে নিয়েছে বিএনপিকে রাজনীতি করার সুযোগ না দিয়ে এভাবেই তারা ‘নির্বাচন’ নামক প্রহসন চালিয়ে যাবে।
বিএনপির ওপর জনগণের হতাশা স্থায়ী কিছু বলে আমি মনে করি না। দ্বিতীয়ত, বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট ক্ষমতার বিপরীতে জাতীয় রাজনীতিতে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর জোটের গুরুত্বকে কোনোভাবেই হালকা করে ভাবা উচিত নয়। বিরোধী জোটের কঠোর সমালোচনা দরকার। কিন্তু মনে করি না বিএনপি দুর্বল বা বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে তাতে এ মুহূর্তে বাংলাদেশের কোনো উপকার হবে। এতে হাততালি দেয়ার যেমন কিছু নাই, হতাশ হওয়ারও কোনো কারণ দেখি না। এর কারণ খুবই সোজা। আগামী দিনে যে রাজনীতি প্রবল শক্তি নিয়ে সামনে আসবে, তা তিনটি প্রশ্নের মোকাবেলা করার জন্যই আসবে।
এক. সার্বভৌমত্ব বোধের সঙ্গে সৈনিকতা এবং নাগরিকতার মৈত্রী- আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য যা জরুরি। জিয়াউর রহমানের ঐতিহাসিক উত্থান ও তাৎপর্য ব্যাখ্যার মাধ্যমে বিএনপি তা এখনও বোঝাতে সক্ষম।
দুই. ইসলাম প্রশ্নে স্পষ্টতা অর্জন, যা একইভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার পর্যালোচনা। ইসলামকে ধর্ম ও ধর্মতত্ত্ব হিসেবে না বুঝে উপমহাদেশে ইসলামের ইতিহাস মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করা। ধর্ম প্রসঙ্গে সেই অবস্থানই জরুরি আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে যা খামাখা অন্য রাষ্ট্র বা অন্য রাষ্ট্রের জনগণের মনে কোনো সন্দেহ বা আশংকার সৃষ্টি না করে। নীতিগত দিক অস্পষ্ট রেখে শক্তিশালী রাষ্ট্রের সমর্থনের জন্য দালালি করলে কোনো ফল নাই, এটাও বোঝা দরকার; এবং তিন. রাজনৈতিক নীতিহীনতা ও হিপক্রেসি পরিহার।
এ তিনটি দিকে বিএনপি মনোযোগী হবে কি-না আমরা জানি না। কিন্তু ফ্যাসিস্ট রাজনীতি ও রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে জনগণের একটি লড়াই চলছে, যা বিএনপি বা তার জোটভুক্ত দলের অধীন নয়। এ রাজনীতি দুর্বল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নাই। বিএনপি ‘জাতীয়তাবাদ’ বলতে যদি এ ধারাটিকে সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারে এবং জনগণের রাজনৈতিক ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ওপর দাঁড়ায়, জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসেবে বিএনপির ফিরে আসা কয়েক মাসের ব্যাপার মাত্র।
আমি নিশ্চিত ২০১৬ সাল হবে নতুন রাজনৈতিক দিশা চিহ্নিত করার বছর।
১৮ পৌষ, ১৪২২, ১ জানুয়ারি, ২০১৬/ শ্যামলী
No comments