দুর্নীতি : প্রতিরোধ ও প্রতিকার by শেখ আকরাম আলী
দক্ষিণ-পূর্ব
এশিয়ার কয়েকটি দেশে গিয়েছি এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে তাদের কর্মতৎপরতার সাথে
পরিচিত হয়েছি। সেসব অভিজ্ঞতার আলোকে পাঠকদের কৌতূহল নিবৃত্ত করতে চাই।
কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য দলিলের অভাব। তাই দুর্নীতির ইতিহাস জানতে হবে এবং
সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে প্রতিরোধ ও প্রতিকার।
গত ৯ ডিসেম্বর ছিল আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস। খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছে একটি খবর। শিরোনাম ‘সরকারদলীয়দের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কথা পায় না দুদক।’ দুর্নীতি দমন ব্যুরোর নাম এখন ‘স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন’। স্বাধীন মানে, স্বাধীনতা। স্বাধীনের উল্টো পিঠে পরাধীন। পরাধীন থাকতে থাকতে স্বাধীন মানসিকতা নিয়ে কাজ করা কষ্টকর। মনের গোপন বন্দরে অধীনতার যে ছায়া লুকানো থাকে, মনোজগতের কন্দরে যে ‘দাসসুলভ’ ছবি আঁকা থাকে, সেখানে যে মনোছবি তৈরি হয় সেখান থেকে বেরিয়ে আসা সহজ নয়। আমলাতন্ত্রে টেলিফোন ধরে বড় কর্তার অমৃত বচন শুনতে শুনতে ‘জি স্যার, হ্যাঁ স্যার’ কতবার যে বলা হয়; বাড়ির ছেলেমেয়ে স্ত্রী এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। ‘স্বাধীন’ বললেই স্বাধীনতা আসে না। এখান থেকে উত্তরণে সময় লাগবে। তাই কবি নির্মলেন্দু গুণ কবিতা লিখেছেন- ‘স্বাধীনতা পেলে আমি পরাধীন হতে ভালবাসি।’
দাসসুলভ মানসিকতা আমরা অর্জন করেছি পলাশী যুদ্ধের পরে। সুবেহ বাংলায় মানুষ ও জমির প্রভুত্ব দুই স্তরে ছিল। ওপরের স্তরে মোগল শাসক শ্রেণী এবং নিচের স্তরে বড় বড় পরগনার রাজস্ব আদায়কারী ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, পাঠান, রাজপুত ও ক্ষেত্রী জমিদারেরা। কিন্তু মূলে যাদের স্পষ্ট দেখা যায়, তারা হলেন মোগল। মোগল মনসবদার শ্রেণীভুক্ত প্রধান প্রধান মুসলমান ও হিন্দু রাজপুরুষ এবং জগৎ শেঠ গোষ্ঠী। তারা খাল কেটে কুমির আনায় দীর্ঘ দিন ইংরেজ আমাদের শাসন ও শোষণ করতে পেরেছে। এর ধারাবাহিকতায় এলো ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। ভয়াবহ জমি এবং খাজনা দুর্নীতির প্রথম সোপান, যা আজো চলছে। মহাভারতের কবি বক্তা এবং শাস্ত্রকাব্যের অবতার কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন সম্পর্কে বলা হয়, মহাভারতের ইতিহাস তার পক্ষে লেখা সম্ভব হয়েছে এ কারণেই যে, কুরু বংশের সাথে তার নিজের জীবনের যোগ ছিল। তিনি ক্ষেত্রজ নিয়োগ প্রথার মাধ্যমে হস্তিনাপুরের অন্ধরাজা ধৃতরাষ্ট্রের জনক এবং বেশ কিছু দিন হস্তিনাপুরে ছিলেন। সোজা কথা, যিনি ঘটনার সাথে যুক্ত থাকেন তিনিই পারেন ঘটনার সত্যিকারের মূল্যায়ন করতে এবং ইতিহাস তুলে ধরতে। বানিয়ে বানিয়ে লেখা এবং ঘটনায় নিজে সম্পৃক্ত থেকে লেখার মধ্যে অনেক পার্থক্য। আমি নিজে রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করেছি। ৩১-০৮-১৯৯১ দুর্নীতি দমন ব্যুরোর এসিও/পরিদর্শকদের অতিথি বক্তা ছিলাম। প্রথম নিয়োগকৃত টিএনওদের আইনসংক্রান্ত ক্লাস, নিরাপত্তা ও দুর্নীতি বিষয়ে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অ্যাকাডেমিতে অতিথি বক্তা ছিলাম। জেলা দুর্নীতি দমন অফিস পরিদর্শন করেছি এবং প্রতিবেদন দিয়েছি। তাই বলতে পারি, যা লিখেছি তা আমার কর্মের অভিজ্ঞতা ও বিশ্বাসের প্রতিফলন। আমার লেখা ‘আমলাতন্ত্র এবং আমার আমলা জীবন’ প্রকাশিতব্য বইতে দলিলগুলো সন্নিবেশিত হবে।’
বর্তমান সময়ে একটি বড় কাহিনী হলো গণশুনানি। বিগত ১১ ডিসেম্বর খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছে- ‘সাবরেজিস্ট্রারদের ঘাম ছুটিয়ে দিলো গণশুনানি।’
টিভিতে মন দিয়ে প্রোগ্রামটা দেখছিলাম। মনে পড়ল, ১৯৮৪ সালে জেলা প্রশাসক হিসেবে গণশুনানির অভিজ্ঞতা। কাজে যোগ দিয়ে দেখলাম, যারা ডিসি অফিসে কাজের জন্য আসেন তারা অফিসের বারান্দায় ঘোরাঘুরি করছেন। ডিসি সাহেবের সাথে দেখা করা ‘দিল্লি হনুজ দূর অস্ত’। দিল্লি অনেক দূর। অফিস কক্ষে ৪০টি চেয়ার রাখলাম। তারপর বারান্দায় বের হয়ে বললাম, ডিসি সাহেবের সাথে দেখা করবেন? আমার সাথে আসুন। আমি নতুন; তাই তারা আমাকে চেনেন না। তাদের সবাইকে চেয়ারে বসিয়ে বসলাম নিজের চেয়ারে।
বললাম, কেন এসেছেন? সমস্যা কী? একজন করে কথা বলছেন। সাথে সাথেই ফাইল তলব। সংশ্লিষ্ট কর্মচারী ফাইল নিয়ে হাজির। সাথে সাথে সিদ্ধান্ত এবং বিদায়। এক ঘণ্টার মধ্যেই কাজ শেষ। একজন ফটোগ্রাফি স্টুডিওর মালিক বললেন, স্যার, প্রশাসন আয়োজিত স্বাধীনতা দিবসের ছবি তুলেছিলাম। বহুবার ডিসি অফিসে বিলের টাকার জন্য ঘুরেছি, টাকা পাইনি।
নাজির সাহেবকে ডাকলাম।
বললাম, টাকা নাই?
নাজির : আছে স্যার।
আমি : ১০ মিনিটের মধ্যে টাকা দিয়ে দেবেন?
ফটোগ্রাফারকে বললাম : উনার সাথে যান। টাকা পেলে আমাকে জানিয়ে যাবেন।
১০ মিনিটের মধ্যে ফটোগ্রাফার ফিরে এলেন।
আমি : টাকা পেয়েছেন?
ফটোগ্রাফার : হ্যাঁ, স্যার। তবে ... (আমতা আমতা)।
আমি: তবে টা কী?
ফটোগ্রাফার : টাকা দিয়ে উনি বললেন ... (আমতা আমতা) আমার ধৈর্য হারানোর অবস্থা।
বললাম : আমতা আমতা করে নামতা পড়ছেন কেন? উনি কী বললেন? ভয়ের কিছু নেই। ঝেড়ে কাশুন।
ফটোগ্রাফার : উনি বললেন : এখন ফকিরনির পুতরাও সরাসরি ডিসি সাহেবের কাছে চলে যায়।
আমি অবাক, হতবাক, রুদ্ধবাক। মনে পড়ল সেই আপ্তবাক্য ‘শুনহ মানুষ, যে জানহ সন্ধান’। সব কিছু খুলে বলার দরকার নেই। সমঝদারের জন্য ইশারাই কাফি। থলের কালো বেড়াল বের হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হলে চিত্র পরিচালক অমন কাট কাট করে। এখানে সঞ্চালক ‘কাট কাট’ করে বিজ্ঞাপন বিরতিতে চলে যাবেন। আমরা বিখ্যাত থলে থেকে কালো বিড়াল বের হওয়ার গল্প শুনেছি। কিন্তু এখনো কালো বেড়াল থলে থেকে বের হচ্ছে না।
একটা বিখ্যাত গল্পে আছে, বাবা ছেলের বাসায় থাকেন এবং গভীর রাতে মুদ্রা গোনেন। পুত্রবধূ ভাবেন, শ্বশুর পরলোকে যাত্রা করলে অনেক টাকা পাবেন। সে জন্য শ্বশুর যেন ছেলের বাসা ছেড়ে মেয়ের বাসায় না যান, তাই জোরেশোরে বিপত্নীক শ্বশুরের যত্নআত্তি করতে থাকেন। শ্বশুর একদিন পরলোকে যাত্রা করলেন। তার পুত্রবধূ সবার আগে তার ঘরে প্রবেশ করে থলি খুলে দেখেন মাত্র কতগুলো তামার মুদ্রা। গভীর রাতে এগুলো গুনতেন তিনি। পুত্রবধূর মনে আশার আলো জ্বালাতেন।
দুর্নীতি যখন সমাজের শিরায় শিরায় বসন্তবাতাসের মতো বয়ে যায়, সে সময় শিক্ষা থেকে দীক্ষা, পদক থেকে মাদক, খবরের কাগজ থেকে সংস্কৃতি সবখানে ঘাপটি মেরে থাকে দুর্নীতি। গোলটেবিল থেকে মিটিং মিছিল করে দুর্নীতি রোধ করা যাবে না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির জন্য বুকের রক্ত দিয়েছেন, কিন্তু বিদেশ থেকে আসা পর্যাপ্ত কম্বল থেকে তার নিজের প্রাপ্ত কম্বল খুঁজে পাননি। বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতুর মূল কাজ উদ্বোধন করতে যেয়ে বলেছেন, ‘বিশ্বব্যাংকের পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’ আসলে, গরিবের গরিব হওয়া বড় অপরাধ। আবার বড় শক্তির মুখোমুখি হয়ে প্রতিবাদ করা আরো বড় অপরাধ।
সব সময় বিশ্বাস করে এসেছি। 'Knowledge is Power' মানে জ্ঞান মানুষকে সাহস জোগায়। আর ‘জ্ঞান’ পুঁথিপড়া জ্ঞান নয়। তা সমাজ থেকে, অভিজ্ঞতা থেকে, জীবন থেকে আহৃত হয়।
যে সময়ের কথা বলছি, সে সময় রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ে সরকারপ্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ সমাসীন। ওই সচিবালয়ে আমার এক সময়ের সহকর্মী তখন দুর্নীতি দমন ব্যুরোর নগর শাখার দায়িত্বে। তিনি আমার অফিসে এসে বললেন, এরশাদ সাহেব হেলিকপ্টারে আটরশি যাওয়া-আসায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রের ১৮ লাখ টাকা ক্ষতি করেছেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলার অনুমোদন চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে।
আমি : গতকাল ব্যুরোর চিঠি পেয়েছি। স্টাডি করেছি। মামলা হবে না।
কর্মকর্তা : কী বলছেন! বিচারপতি সাহাবুদ্দীন শুধু রাষ্ট্রপতি নন। তিনি এখনো দেশের প্রধান বিচারপতি।
আমি : ১০ মিনিট দয়া করে বসুন। আপনার সামনে ডিকটেশন দিচ্ছি।
স্টেনোগ্রাফারকে ডাকলাম, ডিকটেশন দিলাম। প্রথম কথা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময় President's Priviledge Act 1975 অনুযায়ী বাংলাদেশের ভূখণ্ডে রাষ্ট্রপতি এবং তার স্ত্রী যে যানবাহন ব্যবহার করবেন, তার খরচ সরকারের। আইনটি সংযুক্ত করলাম। এতেই মামলা খতম হওয়ার কথা। কিন্তু এটা তো গলা টিপে ধরা। তাই নম্বরে যুক্ত করলাম, একজন সাবেক মন্ত্রী গাড়ির জ্বালানি অপব্যবহার করে রাষ্ট্রের ১৬ লাখ টাকার ক্ষতি করেছেন। সেই মামলায় রাষ্ট্রপতি আদেশ দিয়েছেন ‘টাকা PDR ACT (Public Demand Recovery) অনুযায়ী আদায় করা হোক'। তিন নম্বরে লিখলাম, তেল হেলিকপ্টারে ব্যবহার করা হোক বা মোটরগাড়িতে ব্যবহার করা হোক, তেল হচ্ছে তেল।
রাষ্ট্রপতির আদেশের ধারাবাহিকতায় এরশাদ সাহেবের বিরুদ্ধে 'PDR ACT' অনুযায়ী, অর্থ আদায় করা যেতে পারে। এক যাত্রায় পৃথক ফল হয় না। ফাইল রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হলো এবং তিনি তিন নম্বর প্রস্তাব 'PDR ACT' অনুযায়ী টাকা আদায় অনুমোদন করলেন।
অ্যামস্টারডামে অনুষ্ঠিত পঞ্চম দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্মেলনে বলেছিলাম, উন্নয়নশীল দেশের জন্য দুর্নীতি প্রতিরোধে আলাদা ফর্মুলা দিতে হবে। এখন যদি কোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তব্য রাখার সুযোগ পাই, বলব আলাদা ফর্মুলার প্রয়োজন নেই। একই ফর্মুলা। আমরা এখন ব্যাংক বানাচ্ছি, দুর্নীতি করছি। কোম্পানি বানাচ্ছি, জালিয়াতি করছি। আমরা আর উন্নয়নশীল দেশ নই- ওপরে উঠেছি। ক্রমাগত ওপরে উঠব। একদিন ধনী দেশের কাতারে নাম লেখা হবে। ধনী দেশ হবো অথচ ধনী দেশের দুর্নীতি হবে না! ‘আমার যেমন বেণী তেমনি রবে, চুল ভিজাবো না’; তা কি হয়?
গত ৯ ডিসেম্বর ছিল আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস। খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছে একটি খবর। শিরোনাম ‘সরকারদলীয়দের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কথা পায় না দুদক।’ দুর্নীতি দমন ব্যুরোর নাম এখন ‘স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন’। স্বাধীন মানে, স্বাধীনতা। স্বাধীনের উল্টো পিঠে পরাধীন। পরাধীন থাকতে থাকতে স্বাধীন মানসিকতা নিয়ে কাজ করা কষ্টকর। মনের গোপন বন্দরে অধীনতার যে ছায়া লুকানো থাকে, মনোজগতের কন্দরে যে ‘দাসসুলভ’ ছবি আঁকা থাকে, সেখানে যে মনোছবি তৈরি হয় সেখান থেকে বেরিয়ে আসা সহজ নয়। আমলাতন্ত্রে টেলিফোন ধরে বড় কর্তার অমৃত বচন শুনতে শুনতে ‘জি স্যার, হ্যাঁ স্যার’ কতবার যে বলা হয়; বাড়ির ছেলেমেয়ে স্ত্রী এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। ‘স্বাধীন’ বললেই স্বাধীনতা আসে না। এখান থেকে উত্তরণে সময় লাগবে। তাই কবি নির্মলেন্দু গুণ কবিতা লিখেছেন- ‘স্বাধীনতা পেলে আমি পরাধীন হতে ভালবাসি।’
দাসসুলভ মানসিকতা আমরা অর্জন করেছি পলাশী যুদ্ধের পরে। সুবেহ বাংলায় মানুষ ও জমির প্রভুত্ব দুই স্তরে ছিল। ওপরের স্তরে মোগল শাসক শ্রেণী এবং নিচের স্তরে বড় বড় পরগনার রাজস্ব আদায়কারী ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, পাঠান, রাজপুত ও ক্ষেত্রী জমিদারেরা। কিন্তু মূলে যাদের স্পষ্ট দেখা যায়, তারা হলেন মোগল। মোগল মনসবদার শ্রেণীভুক্ত প্রধান প্রধান মুসলমান ও হিন্দু রাজপুরুষ এবং জগৎ শেঠ গোষ্ঠী। তারা খাল কেটে কুমির আনায় দীর্ঘ দিন ইংরেজ আমাদের শাসন ও শোষণ করতে পেরেছে। এর ধারাবাহিকতায় এলো ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। ভয়াবহ জমি এবং খাজনা দুর্নীতির প্রথম সোপান, যা আজো চলছে। মহাভারতের কবি বক্তা এবং শাস্ত্রকাব্যের অবতার কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন সম্পর্কে বলা হয়, মহাভারতের ইতিহাস তার পক্ষে লেখা সম্ভব হয়েছে এ কারণেই যে, কুরু বংশের সাথে তার নিজের জীবনের যোগ ছিল। তিনি ক্ষেত্রজ নিয়োগ প্রথার মাধ্যমে হস্তিনাপুরের অন্ধরাজা ধৃতরাষ্ট্রের জনক এবং বেশ কিছু দিন হস্তিনাপুরে ছিলেন। সোজা কথা, যিনি ঘটনার সাথে যুক্ত থাকেন তিনিই পারেন ঘটনার সত্যিকারের মূল্যায়ন করতে এবং ইতিহাস তুলে ধরতে। বানিয়ে বানিয়ে লেখা এবং ঘটনায় নিজে সম্পৃক্ত থেকে লেখার মধ্যে অনেক পার্থক্য। আমি নিজে রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করেছি। ৩১-০৮-১৯৯১ দুর্নীতি দমন ব্যুরোর এসিও/পরিদর্শকদের অতিথি বক্তা ছিলাম। প্রথম নিয়োগকৃত টিএনওদের আইনসংক্রান্ত ক্লাস, নিরাপত্তা ও দুর্নীতি বিষয়ে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অ্যাকাডেমিতে অতিথি বক্তা ছিলাম। জেলা দুর্নীতি দমন অফিস পরিদর্শন করেছি এবং প্রতিবেদন দিয়েছি। তাই বলতে পারি, যা লিখেছি তা আমার কর্মের অভিজ্ঞতা ও বিশ্বাসের প্রতিফলন। আমার লেখা ‘আমলাতন্ত্র এবং আমার আমলা জীবন’ প্রকাশিতব্য বইতে দলিলগুলো সন্নিবেশিত হবে।’
বর্তমান সময়ে একটি বড় কাহিনী হলো গণশুনানি। বিগত ১১ ডিসেম্বর খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছে- ‘সাবরেজিস্ট্রারদের ঘাম ছুটিয়ে দিলো গণশুনানি।’
টিভিতে মন দিয়ে প্রোগ্রামটা দেখছিলাম। মনে পড়ল, ১৯৮৪ সালে জেলা প্রশাসক হিসেবে গণশুনানির অভিজ্ঞতা। কাজে যোগ দিয়ে দেখলাম, যারা ডিসি অফিসে কাজের জন্য আসেন তারা অফিসের বারান্দায় ঘোরাঘুরি করছেন। ডিসি সাহেবের সাথে দেখা করা ‘দিল্লি হনুজ দূর অস্ত’। দিল্লি অনেক দূর। অফিস কক্ষে ৪০টি চেয়ার রাখলাম। তারপর বারান্দায় বের হয়ে বললাম, ডিসি সাহেবের সাথে দেখা করবেন? আমার সাথে আসুন। আমি নতুন; তাই তারা আমাকে চেনেন না। তাদের সবাইকে চেয়ারে বসিয়ে বসলাম নিজের চেয়ারে।
বললাম, কেন এসেছেন? সমস্যা কী? একজন করে কথা বলছেন। সাথে সাথেই ফাইল তলব। সংশ্লিষ্ট কর্মচারী ফাইল নিয়ে হাজির। সাথে সাথে সিদ্ধান্ত এবং বিদায়। এক ঘণ্টার মধ্যেই কাজ শেষ। একজন ফটোগ্রাফি স্টুডিওর মালিক বললেন, স্যার, প্রশাসন আয়োজিত স্বাধীনতা দিবসের ছবি তুলেছিলাম। বহুবার ডিসি অফিসে বিলের টাকার জন্য ঘুরেছি, টাকা পাইনি।
নাজির সাহেবকে ডাকলাম।
বললাম, টাকা নাই?
নাজির : আছে স্যার।
আমি : ১০ মিনিটের মধ্যে টাকা দিয়ে দেবেন?
ফটোগ্রাফারকে বললাম : উনার সাথে যান। টাকা পেলে আমাকে জানিয়ে যাবেন।
১০ মিনিটের মধ্যে ফটোগ্রাফার ফিরে এলেন।
আমি : টাকা পেয়েছেন?
ফটোগ্রাফার : হ্যাঁ, স্যার। তবে ... (আমতা আমতা)।
আমি: তবে টা কী?
ফটোগ্রাফার : টাকা দিয়ে উনি বললেন ... (আমতা আমতা) আমার ধৈর্য হারানোর অবস্থা।
বললাম : আমতা আমতা করে নামতা পড়ছেন কেন? উনি কী বললেন? ভয়ের কিছু নেই। ঝেড়ে কাশুন।
ফটোগ্রাফার : উনি বললেন : এখন ফকিরনির পুতরাও সরাসরি ডিসি সাহেবের কাছে চলে যায়।
আমি অবাক, হতবাক, রুদ্ধবাক। মনে পড়ল সেই আপ্তবাক্য ‘শুনহ মানুষ, যে জানহ সন্ধান’। সব কিছু খুলে বলার দরকার নেই। সমঝদারের জন্য ইশারাই কাফি। থলের কালো বেড়াল বের হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হলে চিত্র পরিচালক অমন কাট কাট করে। এখানে সঞ্চালক ‘কাট কাট’ করে বিজ্ঞাপন বিরতিতে চলে যাবেন। আমরা বিখ্যাত থলে থেকে কালো বিড়াল বের হওয়ার গল্প শুনেছি। কিন্তু এখনো কালো বেড়াল থলে থেকে বের হচ্ছে না।
একটা বিখ্যাত গল্পে আছে, বাবা ছেলের বাসায় থাকেন এবং গভীর রাতে মুদ্রা গোনেন। পুত্রবধূ ভাবেন, শ্বশুর পরলোকে যাত্রা করলে অনেক টাকা পাবেন। সে জন্য শ্বশুর যেন ছেলের বাসা ছেড়ে মেয়ের বাসায় না যান, তাই জোরেশোরে বিপত্নীক শ্বশুরের যত্নআত্তি করতে থাকেন। শ্বশুর একদিন পরলোকে যাত্রা করলেন। তার পুত্রবধূ সবার আগে তার ঘরে প্রবেশ করে থলি খুলে দেখেন মাত্র কতগুলো তামার মুদ্রা। গভীর রাতে এগুলো গুনতেন তিনি। পুত্রবধূর মনে আশার আলো জ্বালাতেন।
দুর্নীতি যখন সমাজের শিরায় শিরায় বসন্তবাতাসের মতো বয়ে যায়, সে সময় শিক্ষা থেকে দীক্ষা, পদক থেকে মাদক, খবরের কাগজ থেকে সংস্কৃতি সবখানে ঘাপটি মেরে থাকে দুর্নীতি। গোলটেবিল থেকে মিটিং মিছিল করে দুর্নীতি রোধ করা যাবে না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির জন্য বুকের রক্ত দিয়েছেন, কিন্তু বিদেশ থেকে আসা পর্যাপ্ত কম্বল থেকে তার নিজের প্রাপ্ত কম্বল খুঁজে পাননি। বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতুর মূল কাজ উদ্বোধন করতে যেয়ে বলেছেন, ‘বিশ্বব্যাংকের পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’ আসলে, গরিবের গরিব হওয়া বড় অপরাধ। আবার বড় শক্তির মুখোমুখি হয়ে প্রতিবাদ করা আরো বড় অপরাধ।
সব সময় বিশ্বাস করে এসেছি। 'Knowledge is Power' মানে জ্ঞান মানুষকে সাহস জোগায়। আর ‘জ্ঞান’ পুঁথিপড়া জ্ঞান নয়। তা সমাজ থেকে, অভিজ্ঞতা থেকে, জীবন থেকে আহৃত হয়।
যে সময়ের কথা বলছি, সে সময় রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ে সরকারপ্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ সমাসীন। ওই সচিবালয়ে আমার এক সময়ের সহকর্মী তখন দুর্নীতি দমন ব্যুরোর নগর শাখার দায়িত্বে। তিনি আমার অফিসে এসে বললেন, এরশাদ সাহেব হেলিকপ্টারে আটরশি যাওয়া-আসায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রের ১৮ লাখ টাকা ক্ষতি করেছেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলার অনুমোদন চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে।
আমি : গতকাল ব্যুরোর চিঠি পেয়েছি। স্টাডি করেছি। মামলা হবে না।
কর্মকর্তা : কী বলছেন! বিচারপতি সাহাবুদ্দীন শুধু রাষ্ট্রপতি নন। তিনি এখনো দেশের প্রধান বিচারপতি।
আমি : ১০ মিনিট দয়া করে বসুন। আপনার সামনে ডিকটেশন দিচ্ছি।
স্টেনোগ্রাফারকে ডাকলাম, ডিকটেশন দিলাম। প্রথম কথা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময় President's Priviledge Act 1975 অনুযায়ী বাংলাদেশের ভূখণ্ডে রাষ্ট্রপতি এবং তার স্ত্রী যে যানবাহন ব্যবহার করবেন, তার খরচ সরকারের। আইনটি সংযুক্ত করলাম। এতেই মামলা খতম হওয়ার কথা। কিন্তু এটা তো গলা টিপে ধরা। তাই নম্বরে যুক্ত করলাম, একজন সাবেক মন্ত্রী গাড়ির জ্বালানি অপব্যবহার করে রাষ্ট্রের ১৬ লাখ টাকার ক্ষতি করেছেন। সেই মামলায় রাষ্ট্রপতি আদেশ দিয়েছেন ‘টাকা PDR ACT (Public Demand Recovery) অনুযায়ী আদায় করা হোক'। তিন নম্বরে লিখলাম, তেল হেলিকপ্টারে ব্যবহার করা হোক বা মোটরগাড়িতে ব্যবহার করা হোক, তেল হচ্ছে তেল।
রাষ্ট্রপতির আদেশের ধারাবাহিকতায় এরশাদ সাহেবের বিরুদ্ধে 'PDR ACT' অনুযায়ী, অর্থ আদায় করা যেতে পারে। এক যাত্রায় পৃথক ফল হয় না। ফাইল রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হলো এবং তিনি তিন নম্বর প্রস্তাব 'PDR ACT' অনুযায়ী টাকা আদায় অনুমোদন করলেন।
অ্যামস্টারডামে অনুষ্ঠিত পঞ্চম দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্মেলনে বলেছিলাম, উন্নয়নশীল দেশের জন্য দুর্নীতি প্রতিরোধে আলাদা ফর্মুলা দিতে হবে। এখন যদি কোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তব্য রাখার সুযোগ পাই, বলব আলাদা ফর্মুলার প্রয়োজন নেই। একই ফর্মুলা। আমরা এখন ব্যাংক বানাচ্ছি, দুর্নীতি করছি। কোম্পানি বানাচ্ছি, জালিয়াতি করছি। আমরা আর উন্নয়নশীল দেশ নই- ওপরে উঠেছি। ক্রমাগত ওপরে উঠব। একদিন ধনী দেশের কাতারে নাম লেখা হবে। ধনী দেশ হবো অথচ ধনী দেশের দুর্নীতি হবে না! ‘আমার যেমন বেণী তেমনি রবে, চুল ভিজাবো না’; তা কি হয়?
No comments