প্রতীক্ষা ও প্রাপ্তি by উম্মে মুসলিমা
আমাদের মধ্যে শৈশব-কৈশোর যাদের গ্রামে-মফস্বলে কেটেছে, তাদের কাছে ঈপ্সিত জিনিসটি পাওয়ার আনন্দ ছিল অপরিমেয়। আর অপ্রত্যাশিত হলে তো অনির্বচনীয়। মনে আছে, কচি ও কাঁচা বলে একটা কিশোর মাসিক ম্যাগাজিন নিয়ে আসতেন বাবা মাসের ৭ থেকে ১০ তারিখের মধ্যে, সন্ধের দিকে। হাতে না আসা পর্যন্ত ওই তিন দিন দুপুরের ঘুম হারাম, বিকেলে গোল্লাছুটের আসর পানসে, সন্ধেয় হোমওয়ার্ক বিরক্তিকর। শাহরিয়ার কবির এবার কী লিখবেন, রাহাত খানের ‘দিলুর গল্প’-এ দিলু আবার কী সব কাণ্ড করবে, আলী ইমামের নতুন রহস্য থাকবে তো, আবু কায়সারের রায়হানের রাজহাঁস শেষ হয়ে যাবে না তো?—এসব আলোচনায় ভাইবোনেরা অনেক সময় খেলাধুলাকেও তুচ্ছ করেছি। পত্রিকা এসে গেলে বয়সে অপেক্ষাকৃত বড় আগে পড়বে, ক্রমান্বয়ে অন্যরা। সেই বড় কখন গোসলে যাবে, কখন নিজের জামা ইস্তিরি করবে, সেই সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হতো। প্রায় ২০–২৫ দিন গল্পের চরিত্রদের নিয়েও আমাদের সময় কাটত। একবার কচি ও কাঁচা-র প্যাকেট হাতে পেয়ে বেশ ভারী ভারী লাগছিল। তাহলে কি আরও বড় কলেবরে? প্যাকেট খুলতেই একই সঙ্গে দুটো পত্রিকা বেরিয়ে এল। অন্যটার নাম টাপুরটুপুর। অপ্রত্যাশিত পাওয়া। এ আনন্দের সঙ্গে তুলনা করা যায় কেবল আর একটি নতুন দেশ দেখার আনন্দের।
আজকাল ঈদ-পূজা-পার্বণে ছেলেমেয়েদের কার কত বেশি জামা-কাপড়ের সংগ্রহ, সেটাই যেন আনন্দের মূল উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। অথচ ৩০-৩৫ বছর আগেও একটা বা বড়জোর দুটো কাপড় পেলেই আনন্দের আর সীমা থাকত না। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অবশ্যই বেড়েছে। ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে ভোগবাদিতাও সমানতালে চলবে, এ তো অর্থনীতিই বলে। কিন্তু বড় বড় মানুষের অনেকেই নিজেদের সন্তানের বেলায় এটাকে প্রশ্রয় দেন না। বিল গেটস তাঁর ছেলেমেয়েদের উদ্দেশে বলেছেন, তিনি তাঁর বাচ্চাদের ইচ্ছাগুলোকে গভীরভাবে হৃদয়ঙ্গম করেন। তবে চান যে তারা তাঁর সম্পদের ওপর ভরসা না করে নিজেদের মতো বেড়ে উঠুক।
পাওয়ার যে অনাবিল আনন্দ, আজকালকার ছেলেমেয়েরা সে আনন্দ থেকে বঞ্চিত। কারণ, তারা হয় না চাইতেই পাচ্ছে আর নাহয় চাওয়ামাত্র হাতে এসে যাচ্ছে। আবার যা পাচ্ছে সেগুলোর পরবর্তী আকর্ষণীয় ভার্সন এত দ্রুত বাজারে চলে আসছে যে আগেরটায় মগ্ন থাকলে নিজেকে আর আধুনিক ভাবা যাচ্ছে না। সেই কৌতুকটা মনে পড়ে গেল। এক ভদ্রলোক তাঁর ছেলের জন্য দোকান থেকে জুতা কিনে জুতার বাক্স হাতে বাড়ির দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছেন। কেন ওভাবে দৌড়াচ্ছেন জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি না থেমে বলতে বলতে এগোলেন, ‘ভাই, বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে এ জুতার ফ্যাশন আর থাকবে কি না, সেই জন্য।... ’ জীবনে ঈপ্সিত জিনিস পাওয়ার প্রতীক্ষা এবং পাওয়ার আনন্দ মনোজগতে একধরনের সৃষ্টিশীলতার জন্ম দিতে থাকে, একধরনের কাব্যময়তার আবেশ সৃষ্টি করে। এর থেকেই তৈরি হয় মানবিক মূল্যবোধ, ভেতর প্রস্তুত হতে থাকে সহমর্মিতার চেতনায়। প্রতীক্ষা না থাকলে সে কেমন করে বুঝবে পাওয়ার আনন্দ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সেই ছেলেবেলায় সব পেয়ে গেলে ‘কেউ কথা রাখেনি’র মতো কালজয়ী কবিতা কি রচিত হতো?
‘একটাও রয়েল গুলি কিনতে পারিনি কখনো
কাঠি লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্করবাড়ির ছেলেরা
ভিখারির মতন চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি
ভিতরে রাস-উৎসব
—আমার দিকে তারা ফিরেও চায়নি
বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন দেখিস, একদিন, আমরাও...’
আজকাল নাগরিক জীবনের খুদে পরিবারে একটা-দুটোর বেশি সন্তান নেওয়া সম্ভব হয় না। স্বভাবতই পিতামাতার সব মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পড়ে ওই সবেধনেরা। তারা চাহিবামাত্র আলাদিনের দৈত্য এসে যেন তাদের সব শখের জিনিস হাতের ওপর ফেলে যায়। সব ধরনের গেজেটের মডেল পরিবর্তন হচ্ছে রাতারাতি। নতুন মডেল আসছে, পুরোনোটি বাতিলের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। যে যতই বলুক, প্রযুক্তির সুবিধা বই পড়াকেও সহজ করে দিয়েছে। আজকাল আর কাগজের পাতায় লেখা বই কিনে ঘরের পরিসর ছোট করার কোনো দরকার নেই, ট্যাব টিপলেই ফরফর করে সব বই এসে যাবে কিন্তু বাস্তবতা তো তা বলে না। ট্যাবে বই-টই পড়ে কি না বেশ কজন কিশোরকে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলে, খুব কম। ট্যাবে তো রয়েছে। পড়ে নেবখন পরে। তারা ল্যাপটপে মুভিই দেখে বেশি, হয় তা ইউটিউব থেকে, না হলে সিডি লাগিয়ে।
গোল্ডেন ফাইভ না পেয়েও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় পাস করেছে এমন কিছু ছেলেমেয়ের মধ্যে জরিপ চালিয়ে দেখা গেল তাদের বেশির ভাগই পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তক-বহির্ভূত বই পড়তে পটু। তারা মনেও করে, এ অভ্যাসই তাদের সাফল্য এনে দিয়েছে। ছেলে পরিবারসুদ্ধ আমেরিকায় চলে যাওয়ার আগে তিন বছরের পৌত্রের জন্য বর্ণমালার বই কিনে এনেছিলাম। পুত্রবধূ বললেন, ‘খামোখা বাক্স ভারী করার কী দরকার! আজকাল অনলাইনেই সব পাওয়া যায়। ল্যাপটপ খুলেই ওকে শেখানো যাবে।’ স্কাইপে কথা হয় এখন ওদের সঙ্গে। জানতে পারি আমার দুঃখিনী বর্ণমালা মহাপ্রতাপশালী এবিসিডির থাবার নিচে খাবি খাচ্ছে।
একবার এক বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠানের পর উপহারের পর্বতের সামনে বসে এক এক করে প্যাকেটের মোড়ক খোলা হচ্ছিল। বেরিয়ে আসছিল তৈজসপত্র, শোপিস, কাপড়চোপড়, ইলেকট্রনিক সামগ্রী। হঠাৎ লাজ-নম্র নতুন বধূটি ‘ওয়াও’ বলে চেঁচিয়ে উঠলে সবাই ঝুঁকে পড়ে উপহার দেখতে গিয়ে দেখলেন একগাদা বই। বই দেখে কেউ কেউ ঠোঁট বাঁকালেন, কেউ নিঃশব্দে বিদুষী বউয়ের পছন্দের তারিফও করলেন।
বিল গেটসের মতো বিশ্বের এক নম্বর ধনী মানুষটিও বলেন, ‘অফিস, বাড়ি অথবা রাস্তা—আমি যেখানেই থাকি না কেন, পড়ার জন্য আমার সঙ্গে সব সময় একগাদা বই থাকে।’ মাইক্রোসফটের জনকও ট্যাবে বই পড়েন না, তো আমরা কোন ছার? তবে বিল গেটসের সন্তানেরা ট্যাবে পড়ছেন কি না, সেটা ভাবার বিষয়। ট্যাবে হোক আর কাগজে, মানবিক ও মানবিক উন্নয়নে বই পড়ার অন্য কোনো বিকল্প এখনো হাতের নাগালে নেই।
উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক ও জেন্ডার সমতাবাদী লেখক।
muslima.umme@gmail.com
আজকাল ঈদ-পূজা-পার্বণে ছেলেমেয়েদের কার কত বেশি জামা-কাপড়ের সংগ্রহ, সেটাই যেন আনন্দের মূল উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। অথচ ৩০-৩৫ বছর আগেও একটা বা বড়জোর দুটো কাপড় পেলেই আনন্দের আর সীমা থাকত না। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অবশ্যই বেড়েছে। ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে ভোগবাদিতাও সমানতালে চলবে, এ তো অর্থনীতিই বলে। কিন্তু বড় বড় মানুষের অনেকেই নিজেদের সন্তানের বেলায় এটাকে প্রশ্রয় দেন না। বিল গেটস তাঁর ছেলেমেয়েদের উদ্দেশে বলেছেন, তিনি তাঁর বাচ্চাদের ইচ্ছাগুলোকে গভীরভাবে হৃদয়ঙ্গম করেন। তবে চান যে তারা তাঁর সম্পদের ওপর ভরসা না করে নিজেদের মতো বেড়ে উঠুক।
পাওয়ার যে অনাবিল আনন্দ, আজকালকার ছেলেমেয়েরা সে আনন্দ থেকে বঞ্চিত। কারণ, তারা হয় না চাইতেই পাচ্ছে আর নাহয় চাওয়ামাত্র হাতে এসে যাচ্ছে। আবার যা পাচ্ছে সেগুলোর পরবর্তী আকর্ষণীয় ভার্সন এত দ্রুত বাজারে চলে আসছে যে আগেরটায় মগ্ন থাকলে নিজেকে আর আধুনিক ভাবা যাচ্ছে না। সেই কৌতুকটা মনে পড়ে গেল। এক ভদ্রলোক তাঁর ছেলের জন্য দোকান থেকে জুতা কিনে জুতার বাক্স হাতে বাড়ির দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছেন। কেন ওভাবে দৌড়াচ্ছেন জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি না থেমে বলতে বলতে এগোলেন, ‘ভাই, বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে এ জুতার ফ্যাশন আর থাকবে কি না, সেই জন্য।... ’ জীবনে ঈপ্সিত জিনিস পাওয়ার প্রতীক্ষা এবং পাওয়ার আনন্দ মনোজগতে একধরনের সৃষ্টিশীলতার জন্ম দিতে থাকে, একধরনের কাব্যময়তার আবেশ সৃষ্টি করে। এর থেকেই তৈরি হয় মানবিক মূল্যবোধ, ভেতর প্রস্তুত হতে থাকে সহমর্মিতার চেতনায়। প্রতীক্ষা না থাকলে সে কেমন করে বুঝবে পাওয়ার আনন্দ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সেই ছেলেবেলায় সব পেয়ে গেলে ‘কেউ কথা রাখেনি’র মতো কালজয়ী কবিতা কি রচিত হতো?
‘একটাও রয়েল গুলি কিনতে পারিনি কখনো
কাঠি লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্করবাড়ির ছেলেরা
ভিখারির মতন চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি
ভিতরে রাস-উৎসব
—আমার দিকে তারা ফিরেও চায়নি
বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন দেখিস, একদিন, আমরাও...’
আজকাল নাগরিক জীবনের খুদে পরিবারে একটা-দুটোর বেশি সন্তান নেওয়া সম্ভব হয় না। স্বভাবতই পিতামাতার সব মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পড়ে ওই সবেধনেরা। তারা চাহিবামাত্র আলাদিনের দৈত্য এসে যেন তাদের সব শখের জিনিস হাতের ওপর ফেলে যায়। সব ধরনের গেজেটের মডেল পরিবর্তন হচ্ছে রাতারাতি। নতুন মডেল আসছে, পুরোনোটি বাতিলের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। যে যতই বলুক, প্রযুক্তির সুবিধা বই পড়াকেও সহজ করে দিয়েছে। আজকাল আর কাগজের পাতায় লেখা বই কিনে ঘরের পরিসর ছোট করার কোনো দরকার নেই, ট্যাব টিপলেই ফরফর করে সব বই এসে যাবে কিন্তু বাস্তবতা তো তা বলে না। ট্যাবে বই-টই পড়ে কি না বেশ কজন কিশোরকে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলে, খুব কম। ট্যাবে তো রয়েছে। পড়ে নেবখন পরে। তারা ল্যাপটপে মুভিই দেখে বেশি, হয় তা ইউটিউব থেকে, না হলে সিডি লাগিয়ে।
গোল্ডেন ফাইভ না পেয়েও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় পাস করেছে এমন কিছু ছেলেমেয়ের মধ্যে জরিপ চালিয়ে দেখা গেল তাদের বেশির ভাগই পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তক-বহির্ভূত বই পড়তে পটু। তারা মনেও করে, এ অভ্যাসই তাদের সাফল্য এনে দিয়েছে। ছেলে পরিবারসুদ্ধ আমেরিকায় চলে যাওয়ার আগে তিন বছরের পৌত্রের জন্য বর্ণমালার বই কিনে এনেছিলাম। পুত্রবধূ বললেন, ‘খামোখা বাক্স ভারী করার কী দরকার! আজকাল অনলাইনেই সব পাওয়া যায়। ল্যাপটপ খুলেই ওকে শেখানো যাবে।’ স্কাইপে কথা হয় এখন ওদের সঙ্গে। জানতে পারি আমার দুঃখিনী বর্ণমালা মহাপ্রতাপশালী এবিসিডির থাবার নিচে খাবি খাচ্ছে।
একবার এক বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠানের পর উপহারের পর্বতের সামনে বসে এক এক করে প্যাকেটের মোড়ক খোলা হচ্ছিল। বেরিয়ে আসছিল তৈজসপত্র, শোপিস, কাপড়চোপড়, ইলেকট্রনিক সামগ্রী। হঠাৎ লাজ-নম্র নতুন বধূটি ‘ওয়াও’ বলে চেঁচিয়ে উঠলে সবাই ঝুঁকে পড়ে উপহার দেখতে গিয়ে দেখলেন একগাদা বই। বই দেখে কেউ কেউ ঠোঁট বাঁকালেন, কেউ নিঃশব্দে বিদুষী বউয়ের পছন্দের তারিফও করলেন।
বিল গেটসের মতো বিশ্বের এক নম্বর ধনী মানুষটিও বলেন, ‘অফিস, বাড়ি অথবা রাস্তা—আমি যেখানেই থাকি না কেন, পড়ার জন্য আমার সঙ্গে সব সময় একগাদা বই থাকে।’ মাইক্রোসফটের জনকও ট্যাবে বই পড়েন না, তো আমরা কোন ছার? তবে বিল গেটসের সন্তানেরা ট্যাবে পড়ছেন কি না, সেটা ভাবার বিষয়। ট্যাবে হোক আর কাগজে, মানবিক ও মানবিক উন্নয়নে বই পড়ার অন্য কোনো বিকল্প এখনো হাতের নাগালে নেই।
উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক ও জেন্ডার সমতাবাদী লেখক।
muslima.umme@gmail.com
No comments