কে হায় রাজনীতি ছাড়িতে চায়! by এ কে এম জাকারিয়া

অসুস্থতা বা বয়স—বাংলাদেশে রাজনীতির জন্য এসব বাধা নয়। এখানে হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও রাজনীতি চলে। বয়স ৮০ পার হলেও সমস্যা নেই। এখানে রাজনীতিতে অবসর বা অবসরের বয়স বলে কিছু নেই। এখানে রাজনীতি মানে আমৃত্যু রাজনীতি। অতএব রাজনীতি ছাড়ারও কিছু নেই।
অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সমশের মবিন চৌধুরীর রাজনীতি থেকে অবসর এবং দলের সব পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা সেদিক থেকে ব্যতিক্রমই। এমন এক সময়ে তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন, যখন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে রয়েছেন। এই সফরকে যতই ব্যক্তিগত হিসেবে প্রচার করার চেষ্টা হোক, এর রাজনৈতিক গুরুত্বকে কে অস্বীকার করতে পারবে! সমশের মবিন চৌধুরীর পদত্যাগও তেমনি একটি বিষয়। পদত্যাগের ঘোষিত কারণ নিশ্চয়ই ‘অসুস্থতা’। কিন্তু এটাই কি সব? তাঁর পদত্যাগ ও এর পরবর্তী নানা প্রতিক্রিয়াতে অবশ্য তেমন মনে হচ্ছে না।
কূটনীতিক থেকে রাজনীতিক হয়ে যাওয়া সমশের মবিন চৌধুরী কয়েক বছর ধরে বিএনপির রাজনীতিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন। বিশেষ করে বিএনপির কথিত ‘বিদেশনির্ভর’ রাজনীতির কারণে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নানা সমঝোতার চেষ্টায় তিনি দলের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। এ বছর জানুয়ারিতে নির্বাচনের এক বছর পূর্তিতে বিএনপির লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি চলার সময় গত ৮ জানুয়ারি তিনি আটক হন। প্রায় সাড়ে চার মাস আটক থাকার পর মে মাসে তিনি জেল থেকে মুক্তি পান। এরপর থেকে তিনি রাজনীতিতে অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে যান।
এভাবে নিষ্ক্রিয় থাকতে থাকতে রাজনীতি থেকে সরে যাওয়া একটি পথ হতে পারত সমশের মবিন চৌধুরীর জন্য। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিয়ে কাজটি করেছেন। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছে লেখা পদত্যাগপত্র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের কাছে পাঠিয়ে তা গণমাধ্যমেও জানিয়ে দিয়েছেন। এটা পরিষ্কার যে রাজনীতি থেকে তাঁর ‘অবসর’ ও বিএনপির সব পদ ছাড়ার বিষয়টি তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে চেয়েছিলেন। খালেদা জিয়ার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খানের মনে তাই বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, ‘সমশের ভাইয়ের অবসর ঘোষণার সময়টা সঠিক হয়েছে কি না, এ প্রশ্ন আমার মনে খচখচ করছে। তিনি কি আরও কিছুদিন চুপচাপ ও নিষ্ক্রিয় থাকতে পারতেন না? অবসর নেওয়ার ঘোষণাটা আরেকটু স্থিতিশীল সময়ে দিলে কী এমন ক্ষতি হতো?’
আর এটা নিছক অসুস্থ হয়ে একজন রাজনীতিকের সরে দাঁড়ানোর ব্যাপার হলে আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়াগুলোও এতটা তীব্র ও জোরালো হতো না। দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, ‘আপনারা জেনে খুশি হবেন যে বিএনপির সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করে, হতাশা ব্যক্ত করে আজ বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সমশের মবিন চৌধুরী দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। আমার বিশ্বাস, বিএনপির মধ্যে এখনো যাঁরা বিবেকবান মানুষ আছেন, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, তাঁরা প্রত্যেকেই এই দল থেকে বেরিয়ে আসবেন। খালেদা জিয়া-তারেক রহমানকে বাদ দিয়ে বিএনপিকে ঢেলে সাজাবেন। তাহলেই বিএনপি মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারবে। সন্ত্রাস ও নাশকতা সৃষ্টিকারী বিএনপি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমরা তাঁকে স্বাগত ও অভিনন্দন জানাই।’ সমশের মবিন চৌধুরীর পদত্যাগপত্রে অবশ্য আমরা ‘বিএনপির সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন’ করার মতো কোনো বিষয় দেখিনি। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা ও মন্ত্রী তো সমশের মবিনের উদাহরণ টেনে অন্য নেতাদের দল থেকে কেটে পড়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
এ তো রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া। এতে বাড়তি অনেক কিছু ও ‘রাজনৈতিক’ কথাবার্তা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু জনগণের মনেও এই পদত্যাগ নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে তাঁর পদত্যাগের খবরের নিচে পাঠকেরা নানা ধরনের যে মন্তব্য করেছেন, তার কয়েকটি বিবেচনায় নিলে বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। এক পাঠক লিখেছেন, ভালো একটি নজির স্থাপন করলেন রাজনীতি থেকে ‘অবসর’ নিয়ে। এ দেশে কেউ রাজনীতি থেকে ‘অবসর’ নেয় না। আরেক পাঠক মন্তব্য করেছেন, রাজনীতি থেকে কেউ ‘অবসর’ নেয়? অন্য দলে যোগ দিলেই তো হতো! আরেকজনের প্রশ্ন, তিনি কি কোনো ভয়ে পদত্যাগ করলেন?
জনমনের এসব প্রশ্ন ও চিন্তাভাবনার জবাব এখনই মিলবে, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। তবে পরিস্থিতি বিচার-বিবেচনা করতে কিছু পুরোনো ও জানা তথ্য পাঠকদের উদ্দেশ্যে নতুন করে ভাগাভাগি করতে চাই। সমশের মবিন চৌধুরী একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা সেই সময় থেকেই। যুদ্ধে তিনি আহত হয়েছেন। বীর বিক্রম খেতাব পেয়েছেন। কোমরে গুলি লাগার কারণে তিনি আর কখনোই পুরোপুরি সুস্থ জীবনে ফিরতে পারেননি। সেনাবাহিনী থেকে তাঁর চাকরি স্থানান্তরিত হয়েছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্রসচিব—এসব দায়িত্ব পালন করে চাকরি শেষে ২০০৮ সালে তিনি বিএনপির রাজনীতিতে যোগ দেন।
আগেই বলেছি, দলের পক্ষ থেকে মূলত বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। সাম্প্রতিক সময়ে নানা কারণেই আলোচিত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে তারেক রহমানের সঙ্গে তাঁর কথিত টেলিফোন আলাপের একটি অডিও ফাঁস হয়ে পড়ে। সমশের মবিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে একটি বড় সমালোচনা হচ্ছে তিনি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিদেশে পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। আমরা স্মরণ করতে পারি যে ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে কৃষক লীগের শোকসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিভিন্ন দূতাবাসে পুনর্বাসন করেন। ওই দায়িত্ব পড়ে আজকের সমশের মবিন চৌধুরীর ওপর। তাঁকে বঙ্গবন্ধু জার্মানিতে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু বেইমান চিরকালই বেইমান। এটা হয়তো অনেকে জানেন না।’ (প্রথম আলো, ৪ আগস্ট ২০১৪)।
এই সমশের মবিন চৌধুরী বিএনপি থেকে পদত্যাগ করলেন এমন এক সময়ে, যখন দল হিসেবে বিএনপি কার্যত স্থবির ও নিষ্ক্রিয়। দলটির চেয়ারপারসনও দেশের বাইরে। ‘অসুস্থতার কারণে’ একজন রাজনীতিকের দল ও রাজনীতি থেকে পদত্যাগের ঘোষণা নিয়ে তাই নানা প্রশ্ন ও কানাঘুষা। পদত্যাগ করে নিশ্চুপ থাকার কৌশল বা নীতিও নেননি সমশের মবিন চৌধুরী। বারবার উচ্চারিত ‘অসুস্থতা’ শব্দটির আড়ালে ‘রাজনীতি’ বের হয়ে গেছে ঠিকই। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বিএনপি এখন জিয়াউর রহমানের নীতি ও আদর্শ অনুযায়ী চলছে কি না, সে প্রশ্নও তিনি তুলেছেন।
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা আনুষ্ঠানিকভাবে যতই বলুক না কেন সমশের মবিন চৌধুরীর পদত্যাগ ‘একান্ত ব্যক্তিগত’ ব্যাপার বা অবসরে যাওয়ার বিষয়টি ‘স্বাভাবিক’, কিন্তু দল হিসেবে বিএনপির জন্য এটা একটা ধাক্কা। প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি শুধুই একটি ধাক্কা নাকি এর সূচনা মাত্র? দেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনা নিলে এ ধরনের প্রশ্ন জাগাই স্বাভাবিক।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছে লেখা পদত্যাগপত্রের শুরুতেই তিনি লিখেছেন, ‘আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমি গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলাম।’ আর শেষটা করেছেন এভাবে, ‘একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার স্বাস্থ্যগত সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে সামনে রেখে দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করার প্রয়াস আমার চিরকাল থাকবে।’ ফলে ‘বর্তমান স্বাস্থ্যগত কারণে’ পদত্যাগ করা সমশের মবিন চৌধুরী ভবিষ্যতে আর কখনোই রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন না বা ‘মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে’ সামনে রেখে ‘দেশ ও জাতির কল্যাণে’ কিছু করতে আগ্রহী হবেন না, তা বলা কঠিন।
এই পদত্যাগ নিয়ে এখন যা হচ্ছে তা সবই ধারণা ও জল্পনা-কল্পনা। সামনের দিনগুলোর ঘটনাপ্রবাহে হয়তো অনেক কিছু পরিষ্কার হবে। হয়তো হবেও না। জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে চায়!’ আমাদের দেশে রাজনীতিবিদদের রাজনীতি ছাড়াটা কেন জানি এমনই এক হাহাকারের মতো শোনা যায়; কে হায় রাজনীতি ছাড়িতে চায়!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.