মনন ও সৃজনশীলতায় অনন্য তিনি by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী |
অধ্যাপক
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীকে আমি কখনো শিক্ষক হিসেবে পাইনি, যেহেতু তাঁর
দীর্ঘদিনের কর্মস্থল ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, কিন্তু তাঁকে আমি সব সময়
শিক্ষক হিসেবেই জেনেছি। তাঁকে দেখে শিখেছি সাহিত্যের রুচি কীভাবে তৈরি
করতে হয়, ভাষার ভেতরের শক্তি আর সংগীতকে কীভাবে আবিষ্কার করতে হয়, আদর্শ ও
বিশ্বাসের সঙ্গে কাজকে কীভাবে মেলাতে হয়। শিখেছি বলাটা অবশ্য ঠিক হলো না,
যেহেতু তাঁর থেকে শুধু পাঠ নিয়েছি, পাঠ নিতে উৎসাহী হয়েছি, কিন্তু
অর্জনের রাস্তায় যেতে পেরেছি সামান্যই।
আমাদের এমএ পরীক্ষার মৌখিক অংশের বহিস্থ পরীক্ষক হয়ে ১৯৭৩ সালে ঢাকা এসেছিলেন অধ্যাপক সিদ্দিকী—সেই প্রথম তাঁকে দেখা, তাঁর কথা শোনা এবং একজন সত্যিকার বিদগ্ধ মানুষকে আবিষ্কার করা। এরপর থেকে যত তাঁকে জেনেছি, তত তাঁর চিন্তাভাবনা ও সক্রিয়তার বহুমাত্রিকতাকে বুঝতে পেরেছি। তাঁর চিন্তায় গভীরতা ছিল, তাঁর বৈদগ্ধ্য তাঁর স্বভাবসুলভ বিনয়ের সঙ্গে এক আশ্চর্য সখ্য গড়েছিল। কথা বলতেন ভেবেচিন্তে, এবং প্রতিটি কথার পেছনে ওজন থাকত। অথচ মাঝেমধ্যে সহজ-সরল অন্তরঙ্গতা তিনি আমাদের মনে করিয়ে দিতেন, তাঁর ভেতর একজন মানুষ আছেন, যিনি আনন্দ-হাসিকে উপভোগ করেন।
তাঁকে শুরুতে চিনতাম একজন অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক হিসেবে, পূর্বমেঘ-এর একজন সম্পাদক হিসেবে; তারপর ১৯৭৫-এ তাঁর হৃদয়ে জনপদে বেরোলে তাঁকে চিনলাম একজন শক্তিমান কবি হিসেবে। এরপর তিনি আবির্ভূত হলেন এক সফল অনুবাদকের ভূমিকায়, তাঁর অনূদিত শেক্সপিয়ারের সনেট ঘুরতে লাগল সবার হাতে হাতে। একজন কবি আরেকজন কবির ভাষান্তর ঘটালে স্বভাবতই তাতে শব্দ, শব্দ-প্রতিমা এবং কল্পনার একটা আলাদা মাত্রা পড়ে। এ গ্রন্থেও তা-ই হলো। কিন্তু এরপর যখন তিনি মিল্টনের অ্যারিওপ্যাজিটিকা নিয়ে উপস্থিত হলেন, অবাক হয়ে দেখলাম এই খটমটে, ল্যাটিনের প্রভাবে কঠিন হয়ে যাওয়া ইংরেজি গদ্যের কত কুশলী অনুবাদ তিনি করেছেন।
অধ্যাপক সিদ্দিকীর সঙ্গে স্বল্পদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল বাংলা একাডেমির ইংরেজি-বাংলা অভিধান প্রকল্পে। ওই প্রকল্পের প্রধান, অর্থাৎ প্রস্তাবিত অভিধানের সম্পাদক ছিলেন অধ্যাপক সিদ্দিকী। মাস দুয়েক ছিলাম ওই প্রকল্পে, কিন্তু পরিশ্রমের ধরন দেখে পিঠটান দিই। ওই দুই মাস তাঁকে দেখেছি, প্রচণ্ড নিষ্ঠা ও একাগ্রতা নিয়ে কাজে নেমেছেন আমাদের দেশে অভিধানবিদ্যায় এক নতুন অধ্যায় সংযোজন করতে। তাঁর অভিনিবেশ ছিল অকল্পনীয়। তিনি ভাষার একেবারে ভেতরে ঢুকে প্রতিটি শব্দের সম্ভাব্য অর্থকে আবিষ্কারের চেষ্টা করতেন। তিনি খুব যোগ্য কয়েকজন সহকর্মী পেয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে বহুভাষাবিদ ড. জাহাঙ্গীর তারেক ছিলেন অন্যতম। একদিন ড. তারেক আমাকে জানালেন, অধ্যাপক সিদ্দিকীর সঙ্গে কাজ করতে করতে তাঁর মনে হয়েছে ড. স্যামুয়েল জনসনের মতো উচ্চতাতেই যেন তাঁর অধিষ্ঠান।
কথাটা বাড়িয়ে বলেননি ড. তারেক। ড. জনসনও বিখ্যাত ছিলেন অভিধানবিদ ও রচয়িতা হিসেবে, তাঁরও পাণ্ডিত্য ছিল গভীর। আমার এখন মনে হয়, দুজনের মধ্যে আরেকটি মিলও ছিল—ড. জনসনের জীবনীকার বসওয়েল বলেছিলেন, ড. জনসন তাঁর জীবনকালেই তাঁর সমসাময়িকদের থেকে সেই প্রশংসা ও শ্রদ্ধা পেয়েছিলেন, যা মেধাবী মানুষ শুধু পরবর্তী প্রজন্মগুলো থেকে পান। অধ্যাপক সিদ্দিকীর প্রশংসা শুনতাম তাঁর বন্ধুদের মুখে, যাঁদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সহপাঠী কবি শামসুর রাহমান ও সাংবাদিক এস এম আলী। তাঁদের কাছে অধ্যাপক সিদ্দিকীর কথা শুনে আমার মনে হয়েছে, তাঁকে তাঁরা পছন্দ করতেন তাঁর চরিত্রের সমুন্নতির জন্য, স্বচ্ছ জীবনদৃষ্টির জন্য এবং অসাম্প্রদায়িকতা, মানবিকতা এবং শ্রেয়বোধের প্রতি তাঁর সুদৃঢ় অঙ্গীকারের জন্য।
অধ্যাপক সিদ্দিকী শিক্ষাবিদ ছিলেন, শিক্ষা নিয়ে ভাবতেন, বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা বিষয়ে ইংরেজিতে একটি বইও লিখেছিলেন। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিপদ নিয়ে বাংলায় লেখা তাঁর বইটি বেরোয় ১৯৮৯ সালে, যখন অনেকের কাছে এগুলো বিপদের গুরুত্ব নিয়ে আসেনি। তাঁর যে দূরদৃষ্টি ছিল, এবং তার আলোকে যে তিনি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সমাজকে পড়তে পারতেন, তা তাঁর লেখালেখিতে, বক্তৃতায়-ভাষণে প্রকাশ পেত। জাতির নানান সংকটের সময় তিনি একজন সচেতকের ভূমিকা পালন করতেন, তাঁর লেখনীর শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ গড়তেন, মানুষের শুভবুদ্ধিকে জাগাতেন।
এক বছর আগে এই দিনে অধ্যাপক সিদ্দিকী আমাদের থেকে বিদায় নেন। ৮৬ বছরের দীর্ঘ জীবন তিনি কাটিয়েছেন জ্ঞান সাধনায়, সাহিত্যচর্চায়, অধ্যাপনায় ও লেখালেখিতে। যত দিন তিনি ছিলেন, তাঁর উপস্থিতি খুবই প্রয়োজনীয় ছিল আমাদের কাছে। তিনি চলে যাওয়ার পর তাঁর অভাবটা তীব্রভাবেই অনুভব করছি আমরা। সৃজনশীলতা ও বুদ্ধির চর্চার একটা সংযোগ তিনি ঘটিয়েছিলেন, দেশজ চিন্তার সঙ্গে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির একটা সম্পর্কও তিনি তৈরি করেছিলেন। তাঁর থেকে অনেক কিছু আমরা পেয়েছি। আমাদের থেকে কতটা তিনি নিতে পেরেছিলেন, তা আমাদের কোনো দিন জানা হবে না, কিন্তু এটুকু বলা যায়, তাঁর জন্য তোলা থাকবে আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আমাদের এমএ পরীক্ষার মৌখিক অংশের বহিস্থ পরীক্ষক হয়ে ১৯৭৩ সালে ঢাকা এসেছিলেন অধ্যাপক সিদ্দিকী—সেই প্রথম তাঁকে দেখা, তাঁর কথা শোনা এবং একজন সত্যিকার বিদগ্ধ মানুষকে আবিষ্কার করা। এরপর থেকে যত তাঁকে জেনেছি, তত তাঁর চিন্তাভাবনা ও সক্রিয়তার বহুমাত্রিকতাকে বুঝতে পেরেছি। তাঁর চিন্তায় গভীরতা ছিল, তাঁর বৈদগ্ধ্য তাঁর স্বভাবসুলভ বিনয়ের সঙ্গে এক আশ্চর্য সখ্য গড়েছিল। কথা বলতেন ভেবেচিন্তে, এবং প্রতিটি কথার পেছনে ওজন থাকত। অথচ মাঝেমধ্যে সহজ-সরল অন্তরঙ্গতা তিনি আমাদের মনে করিয়ে দিতেন, তাঁর ভেতর একজন মানুষ আছেন, যিনি আনন্দ-হাসিকে উপভোগ করেন।
তাঁকে শুরুতে চিনতাম একজন অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক হিসেবে, পূর্বমেঘ-এর একজন সম্পাদক হিসেবে; তারপর ১৯৭৫-এ তাঁর হৃদয়ে জনপদে বেরোলে তাঁকে চিনলাম একজন শক্তিমান কবি হিসেবে। এরপর তিনি আবির্ভূত হলেন এক সফল অনুবাদকের ভূমিকায়, তাঁর অনূদিত শেক্সপিয়ারের সনেট ঘুরতে লাগল সবার হাতে হাতে। একজন কবি আরেকজন কবির ভাষান্তর ঘটালে স্বভাবতই তাতে শব্দ, শব্দ-প্রতিমা এবং কল্পনার একটা আলাদা মাত্রা পড়ে। এ গ্রন্থেও তা-ই হলো। কিন্তু এরপর যখন তিনি মিল্টনের অ্যারিওপ্যাজিটিকা নিয়ে উপস্থিত হলেন, অবাক হয়ে দেখলাম এই খটমটে, ল্যাটিনের প্রভাবে কঠিন হয়ে যাওয়া ইংরেজি গদ্যের কত কুশলী অনুবাদ তিনি করেছেন।
অধ্যাপক সিদ্দিকীর সঙ্গে স্বল্পদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল বাংলা একাডেমির ইংরেজি-বাংলা অভিধান প্রকল্পে। ওই প্রকল্পের প্রধান, অর্থাৎ প্রস্তাবিত অভিধানের সম্পাদক ছিলেন অধ্যাপক সিদ্দিকী। মাস দুয়েক ছিলাম ওই প্রকল্পে, কিন্তু পরিশ্রমের ধরন দেখে পিঠটান দিই। ওই দুই মাস তাঁকে দেখেছি, প্রচণ্ড নিষ্ঠা ও একাগ্রতা নিয়ে কাজে নেমেছেন আমাদের দেশে অভিধানবিদ্যায় এক নতুন অধ্যায় সংযোজন করতে। তাঁর অভিনিবেশ ছিল অকল্পনীয়। তিনি ভাষার একেবারে ভেতরে ঢুকে প্রতিটি শব্দের সম্ভাব্য অর্থকে আবিষ্কারের চেষ্টা করতেন। তিনি খুব যোগ্য কয়েকজন সহকর্মী পেয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে বহুভাষাবিদ ড. জাহাঙ্গীর তারেক ছিলেন অন্যতম। একদিন ড. তারেক আমাকে জানালেন, অধ্যাপক সিদ্দিকীর সঙ্গে কাজ করতে করতে তাঁর মনে হয়েছে ড. স্যামুয়েল জনসনের মতো উচ্চতাতেই যেন তাঁর অধিষ্ঠান।
কথাটা বাড়িয়ে বলেননি ড. তারেক। ড. জনসনও বিখ্যাত ছিলেন অভিধানবিদ ও রচয়িতা হিসেবে, তাঁরও পাণ্ডিত্য ছিল গভীর। আমার এখন মনে হয়, দুজনের মধ্যে আরেকটি মিলও ছিল—ড. জনসনের জীবনীকার বসওয়েল বলেছিলেন, ড. জনসন তাঁর জীবনকালেই তাঁর সমসাময়িকদের থেকে সেই প্রশংসা ও শ্রদ্ধা পেয়েছিলেন, যা মেধাবী মানুষ শুধু পরবর্তী প্রজন্মগুলো থেকে পান। অধ্যাপক সিদ্দিকীর প্রশংসা শুনতাম তাঁর বন্ধুদের মুখে, যাঁদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সহপাঠী কবি শামসুর রাহমান ও সাংবাদিক এস এম আলী। তাঁদের কাছে অধ্যাপক সিদ্দিকীর কথা শুনে আমার মনে হয়েছে, তাঁকে তাঁরা পছন্দ করতেন তাঁর চরিত্রের সমুন্নতির জন্য, স্বচ্ছ জীবনদৃষ্টির জন্য এবং অসাম্প্রদায়িকতা, মানবিকতা এবং শ্রেয়বোধের প্রতি তাঁর সুদৃঢ় অঙ্গীকারের জন্য।
অধ্যাপক সিদ্দিকী শিক্ষাবিদ ছিলেন, শিক্ষা নিয়ে ভাবতেন, বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা বিষয়ে ইংরেজিতে একটি বইও লিখেছিলেন। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিপদ নিয়ে বাংলায় লেখা তাঁর বইটি বেরোয় ১৯৮৯ সালে, যখন অনেকের কাছে এগুলো বিপদের গুরুত্ব নিয়ে আসেনি। তাঁর যে দূরদৃষ্টি ছিল, এবং তার আলোকে যে তিনি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সমাজকে পড়তে পারতেন, তা তাঁর লেখালেখিতে, বক্তৃতায়-ভাষণে প্রকাশ পেত। জাতির নানান সংকটের সময় তিনি একজন সচেতকের ভূমিকা পালন করতেন, তাঁর লেখনীর শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ গড়তেন, মানুষের শুভবুদ্ধিকে জাগাতেন।
এক বছর আগে এই দিনে অধ্যাপক সিদ্দিকী আমাদের থেকে বিদায় নেন। ৮৬ বছরের দীর্ঘ জীবন তিনি কাটিয়েছেন জ্ঞান সাধনায়, সাহিত্যচর্চায়, অধ্যাপনায় ও লেখালেখিতে। যত দিন তিনি ছিলেন, তাঁর উপস্থিতি খুবই প্রয়োজনীয় ছিল আমাদের কাছে। তিনি চলে যাওয়ার পর তাঁর অভাবটা তীব্রভাবেই অনুভব করছি আমরা। সৃজনশীলতা ও বুদ্ধির চর্চার একটা সংযোগ তিনি ঘটিয়েছিলেন, দেশজ চিন্তার সঙ্গে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির একটা সম্পর্কও তিনি তৈরি করেছিলেন। তাঁর থেকে অনেক কিছু আমরা পেয়েছি। আমাদের থেকে কতটা তিনি নিতে পেরেছিলেন, তা আমাদের কোনো দিন জানা হবে না, কিন্তু এটুকু বলা যায়, তাঁর জন্য তোলা থাকবে আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments