নতুন ঢাকায় মিলনের সুরধ্বনি by মোছাব্বের হোসেন
বনানীর পূজা মন্ডপের বর্ণিল আয়োজন -প্রথম আলো |
কয়েক
বছর আগেও ঢাকায় শারদীয় দুর্গোৎসব বলতে মূলত পুরান ঢাকার ছবিই ভাসত।
রাজধানীর অন্য এলাকার ভক্তের সমাগমও ওমুখীই ছিল। পূজার বর্ণছটা ‘নতুন
ঢাকা’য় খুব একটা ছিল না।
পূজা এলেই নতুন ঢাক হিসেবে পরিচিত গুলশান-বনানী-ধানমণ্ডির হিন্দু সমাজের অনেকেই মন ভার হতো। অবশ্য এখন তাঁরা খুশি।
ধানমন্ডির সুরধ্বনি: ধানমন্ডি লেকের পাড়ে হাঁটা ও ব্যায়ামের পরিচয় থেকে হয় বন্ধুত্ব। আন্তরিক যোগাযোগে একদল মানুষ গড়ে তোলেন সুরধ্বনি নামের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। সুরধ্বনিরই বন্ধুরা, যাঁদের কেউ হিন্দু কেউবা মুসলমান; ধানমন্ডি এলাকায় দুর্গাপূজার আয়োজনের কথা ভাবলেন।
২০০৭ সালের কথা। দুর্গাপূজার মাত্র ১৮ দিন বাকি। কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের মাঠে পূজার আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়। মাঠ কর্তৃপক্ষকে জানাতে তাঁরাও সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। ব্যস, শুরু হয়ে গেল মিলনের আয়োজন।
এই ইতিহাসেরই একজন যতি দাস কুণ্ডু। তাঁর মুখেই শোনা যাক: আমাদের দলে হিন্দু-মুসলমান সবাই ছিলেন। হাতে হাত মিলিয়ে দুর্গাপূজার এই আয়োজন করেছিলাম।’ তিনিই জানালেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক কর্মকর্তা খালেদা বেগমের উৎসাহের কথা।
খালেদার স্মৃতিতেও তো অনেক কথা জমা, ‘নতুন ঢাকায় বড় পরিসরে পূজার এটিই প্রথম উদ্যোগ। সেদিন হিন্দু-মুসলমান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তড়িঘড়ি করে কাজে নেমে পড়লাম। বেশির ভাগ টাকা বিভিন্ন মুসলমান বন্ধুরাই দেন।’ এভাবেই শুরু কলাবাগান মাঠে দুর্গোৎসবের সূচনাপর্ব।
ধানমন্ডি পূজা কমিটি থেকে প্রকাশিত স্মরণিকার নামও দেওয়া হয় সম্প্রীতি।
কলাবাগান মাঠের পূজার হাত ধরেই কিন্তু বনানী মাঠে, উত্তরাতে বা আজিমপুর সরকারি কোয়ার্টারে পূজা শুরু হয়। ধানমন্ডি হয়েছে তাদের পথিকৃৎ।
ধানমন্ডির বাসিন্দা সম্রাট সরকার বললেন, ‘এই পূজা শুরু করার সময় মুসলমান বন্ধুরাই সাহস ও উৎসাহ জুগিয়েছেন। আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। সম্প্রদায়বোধ কোনো সমস্যা হয়নি।’
ধানমন্ডি মাঠে নিয়মিত পূজা দেখতে আসেন এলিফ্যান্ট রোডের বাসিন্দা শাহানা হোসেন। তাঁর কথা ‘যখন থেকে এই মাঠে পূজা শুরু হয়েছে, তখন থেকেই সন্তানদের এখানে পূজা দেখাতে নিয়ে আসি। ওদের ধর্ম ওরা পালন করবে, আমার ধর্ম আমার। কিন্তু উৎসব তো সবারই’।
কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি সফিকুল আলমেরও ভূমিকা আছে এ আয়োজনে। বললেন, ‘আমাদের দেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ। এই মাঠে হিন্দুদের পূজাতে সহায়তা করতে পেরে আমাদের ভালো লাগে। মনে হয় যেন এই উৎসব আমাদেরও।’
গুলশান-বনানীর আলোবাদ্য: ‘২০০৮ সালের আগে আমাদের এলাকার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কোনো স্থায়ী পূজা করার জায়গা ছিল না। দুর্গাপূজা এলেই মন ভার হয়ে থাকত। পুরান ঢাকার কোথাও গিয়ে পূজা করতে হতো। কিন্তু শান্তি মিলত না। ২০০৮ সালে আমাদের হিন্দু আর মুসলমান বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা মিলে এই এলাকায় পূজা করার বিষয়ে কথা হয়। সিদ্ধান্ত নিই ২৮ সেপ্টেম্বর। আর পূজা শুরু ৪ অক্টোবরে।’ এভাবেই গল্পে গল্পে ইতিহাস বর্ণনা করছিলেন গুলশান-বনানী সর্বজনীন পূজা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও নটর ডেম কলেজের সাবেক শিক্ষক পান্না লাল দত্ত: ‘অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই আদা-জল খেয়ে নেমে পড়ি। তখন বনানী খেলার মাঠ আজকের মতো এত সুন্দর আর পরিপাটি ছিল না। কয়েক দিনের মধ্যেই কয়েক শ ট্রাক বালু ফেলে মাঠ পূজার উপযোগী করা হয়। শুরুতে নানা ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হলেও এখন তৃপ্তি পাই। সেই যে শুরু, এখনো চলছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে মুসলমান বন্ধু, প্রিয়জন, এলাকার বাসিন্দাদের অকৃপণ সহায়তায়।’
পান্না লাল দত্তরা নতুন প্রজন্মের কাছে একটি অসাম্প্রদায়িক উৎসব উপহার দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর ভাষায়, ‘ঈদে যেমন আমরা আমাদের মুসলমান বন্ধুদের বাসায় যাই, তেমনি পূজাতেও মুসলমান বন্ধুরা পরিবার-পরিজন নিয়ে এখানে আসে। ধর্ম যার যার, উৎসব তো সবার।’ এখানে পূজা শুরুর সময় যুক্ত ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আলী যাকের। তিনিও মনে করেন, ‘আমাদের সবার ঐক্য প্রচেষ্টায় এটা সম্ভব হয়েছিল।’
এবারও বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের ওই মাঠটিতে অষ্টমবারের মতো সর্বজনীন দুর্গাপূজা উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। মণ্ডপের রং শ্বেত মর্মরের মতো, যা শান্তির বার্তাও বহন করে। গুলশান-বনানী সর্বজনীন পূজা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুধাংশু কে দাসও জানালেন, দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মিলিত উদ্যোগের কথা।
উত্তরায় দুর্গা: ২০০৯ সাল থেকে উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টর পার্কের মাঠে এ আয়োজন হচ্ছে। উত্তরা থানা পূজা কমিটির সহসভাপতি সুদেব চন্দ্র পাল। তিনিও বলেন, ‘আমাদের আয়োজনে মুসলমানেরাও অংশ নেন। পার্কে অনুষ্ঠিত হয় পূজা। আমরা এখানে মুসলমানসহ সব ধর্মের মানুষদের নিমন্ত্রণ করি। মূলত মুসলমান প্রতিবেশীদের জন্যই এখানে পূজার আয়োজন করা সম্ভব হয়েছে।’ প্রতিবেশিতা থেকে সহমর্মিতা। সম্প্রীতির সুরে মিলনের এই গান ছড়াতে থাকুক সবখানে।
পূজা এলেই নতুন ঢাক হিসেবে পরিচিত গুলশান-বনানী-ধানমণ্ডির হিন্দু সমাজের অনেকেই মন ভার হতো। অবশ্য এখন তাঁরা খুশি।
ধানমন্ডির সুরধ্বনি: ধানমন্ডি লেকের পাড়ে হাঁটা ও ব্যায়ামের পরিচয় থেকে হয় বন্ধুত্ব। আন্তরিক যোগাযোগে একদল মানুষ গড়ে তোলেন সুরধ্বনি নামের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। সুরধ্বনিরই বন্ধুরা, যাঁদের কেউ হিন্দু কেউবা মুসলমান; ধানমন্ডি এলাকায় দুর্গাপূজার আয়োজনের কথা ভাবলেন।
২০০৭ সালের কথা। দুর্গাপূজার মাত্র ১৮ দিন বাকি। কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের মাঠে পূজার আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়। মাঠ কর্তৃপক্ষকে জানাতে তাঁরাও সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। ব্যস, শুরু হয়ে গেল মিলনের আয়োজন।
এই ইতিহাসেরই একজন যতি দাস কুণ্ডু। তাঁর মুখেই শোনা যাক: আমাদের দলে হিন্দু-মুসলমান সবাই ছিলেন। হাতে হাত মিলিয়ে দুর্গাপূজার এই আয়োজন করেছিলাম।’ তিনিই জানালেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক কর্মকর্তা খালেদা বেগমের উৎসাহের কথা।
খালেদার স্মৃতিতেও তো অনেক কথা জমা, ‘নতুন ঢাকায় বড় পরিসরে পূজার এটিই প্রথম উদ্যোগ। সেদিন হিন্দু-মুসলমান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তড়িঘড়ি করে কাজে নেমে পড়লাম। বেশির ভাগ টাকা বিভিন্ন মুসলমান বন্ধুরাই দেন।’ এভাবেই শুরু কলাবাগান মাঠে দুর্গোৎসবের সূচনাপর্ব।
ধানমন্ডি পূজা কমিটি থেকে প্রকাশিত স্মরণিকার নামও দেওয়া হয় সম্প্রীতি।
কলাবাগান মাঠের পূজার হাত ধরেই কিন্তু বনানী মাঠে, উত্তরাতে বা আজিমপুর সরকারি কোয়ার্টারে পূজা শুরু হয়। ধানমন্ডি হয়েছে তাদের পথিকৃৎ।
ধানমন্ডির বাসিন্দা সম্রাট সরকার বললেন, ‘এই পূজা শুরু করার সময় মুসলমান বন্ধুরাই সাহস ও উৎসাহ জুগিয়েছেন। আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। সম্প্রদায়বোধ কোনো সমস্যা হয়নি।’
ধানমন্ডি মাঠে নিয়মিত পূজা দেখতে আসেন এলিফ্যান্ট রোডের বাসিন্দা শাহানা হোসেন। তাঁর কথা ‘যখন থেকে এই মাঠে পূজা শুরু হয়েছে, তখন থেকেই সন্তানদের এখানে পূজা দেখাতে নিয়ে আসি। ওদের ধর্ম ওরা পালন করবে, আমার ধর্ম আমার। কিন্তু উৎসব তো সবারই’।
কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি সফিকুল আলমেরও ভূমিকা আছে এ আয়োজনে। বললেন, ‘আমাদের দেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ। এই মাঠে হিন্দুদের পূজাতে সহায়তা করতে পেরে আমাদের ভালো লাগে। মনে হয় যেন এই উৎসব আমাদেরও।’
গুলশান-বনানীর আলোবাদ্য: ‘২০০৮ সালের আগে আমাদের এলাকার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কোনো স্থায়ী পূজা করার জায়গা ছিল না। দুর্গাপূজা এলেই মন ভার হয়ে থাকত। পুরান ঢাকার কোথাও গিয়ে পূজা করতে হতো। কিন্তু শান্তি মিলত না। ২০০৮ সালে আমাদের হিন্দু আর মুসলমান বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা মিলে এই এলাকায় পূজা করার বিষয়ে কথা হয়। সিদ্ধান্ত নিই ২৮ সেপ্টেম্বর। আর পূজা শুরু ৪ অক্টোবরে।’ এভাবেই গল্পে গল্পে ইতিহাস বর্ণনা করছিলেন গুলশান-বনানী সর্বজনীন পূজা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও নটর ডেম কলেজের সাবেক শিক্ষক পান্না লাল দত্ত: ‘অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই আদা-জল খেয়ে নেমে পড়ি। তখন বনানী খেলার মাঠ আজকের মতো এত সুন্দর আর পরিপাটি ছিল না। কয়েক দিনের মধ্যেই কয়েক শ ট্রাক বালু ফেলে মাঠ পূজার উপযোগী করা হয়। শুরুতে নানা ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হলেও এখন তৃপ্তি পাই। সেই যে শুরু, এখনো চলছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে মুসলমান বন্ধু, প্রিয়জন, এলাকার বাসিন্দাদের অকৃপণ সহায়তায়।’
পান্না লাল দত্তরা নতুন প্রজন্মের কাছে একটি অসাম্প্রদায়িক উৎসব উপহার দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর ভাষায়, ‘ঈদে যেমন আমরা আমাদের মুসলমান বন্ধুদের বাসায় যাই, তেমনি পূজাতেও মুসলমান বন্ধুরা পরিবার-পরিজন নিয়ে এখানে আসে। ধর্ম যার যার, উৎসব তো সবার।’ এখানে পূজা শুরুর সময় যুক্ত ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আলী যাকের। তিনিও মনে করেন, ‘আমাদের সবার ঐক্য প্রচেষ্টায় এটা সম্ভব হয়েছিল।’
এবারও বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের ওই মাঠটিতে অষ্টমবারের মতো সর্বজনীন দুর্গাপূজা উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। মণ্ডপের রং শ্বেত মর্মরের মতো, যা শান্তির বার্তাও বহন করে। গুলশান-বনানী সর্বজনীন পূজা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুধাংশু কে দাসও জানালেন, দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মিলিত উদ্যোগের কথা।
উত্তরায় দুর্গা: ২০০৯ সাল থেকে উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টর পার্কের মাঠে এ আয়োজন হচ্ছে। উত্তরা থানা পূজা কমিটির সহসভাপতি সুদেব চন্দ্র পাল। তিনিও বলেন, ‘আমাদের আয়োজনে মুসলমানেরাও অংশ নেন। পার্কে অনুষ্ঠিত হয় পূজা। আমরা এখানে মুসলমানসহ সব ধর্মের মানুষদের নিমন্ত্রণ করি। মূলত মুসলমান প্রতিবেশীদের জন্যই এখানে পূজার আয়োজন করা সম্ভব হয়েছে।’ প্রতিবেশিতা থেকে সহমর্মিতা। সম্প্রীতির সুরে মিলনের এই গান ছড়াতে থাকুক সবখানে।
No comments