স্কুলগেটের সামনে স্মৃতির ওপর হামলে পড়ে বখাটে তৌহিদ
দুই
বছর আগে স্মৃতির পিছে লেগেছিল বখাটে তৌহিদ। এই দীর্ঘ সময়ে লাগাতার
স্মৃতিকে সে নানা ভাবে উত্ত্যক্ত করে আসছিল। একই গ্রামের দিনমজুর মামা
আবদুল কাইয়ুমের বাড়িতে থাকতে হতো বলে পিতৃহীন স্মৃতি মুখ বুঝে সব সহ্য
করতো। সম্প্রতি বখাটেপনায় আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে তৌহিদ। স্কুলে আসা-যাওয়ার
পথে কুপ্রস্তাব দেয়া ছাড়াও স্মৃতির হাত ধরে টানাহেঁচড়া করতো সে। কিন্তু
কিছুতেই স্মৃতির কোন রকমের সাড়া পাচ্ছিল না। একপর্যায়ে স্মৃতিকে দুনিয়া
থেকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করে সে। ১৭ই অক্টোবর শনিবার বিকালে গাজীপুরের
কোনাপাড়ার একটি দোকান থেকে ৩০০ টাকায় ধারালো একটি বটিদা কিনে তৌহিদ। পরে
সন্ধ্যায় কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার পণকলিমা গ্রামের নিজবাড়িতে ফিরে আসে। পরদিন
১৮ই অক্টোবর রোববার সকালে বটিদা একটি ব্যাগে ভরে কাঁধে ঝুলিয়ে তিন সহযোগী
সাইফুল, মামুন ও সাদ্দামকে নিয়ে তৌহিদ স্কুলগেটের সামনে অবস্থান নেয়।
নান্দলা অছম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী স্মৃতি আক্তার
এসএসসির নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশ নিতে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে স্কুলগেটের কাছে
পৌঁছামাত্র বখাটেদল তার পথরোধ করে দাঁড়ায়। এ সময় বখাটে তৌহিদ স্মৃতিকে
প্রেম নিবেদন করলে স্মৃতি তা উপেক্ষা করে। এরপরই হিংস্র উন্মত্ততায় স্মৃতির
ওপর বটিদা নিয়ে হামলে পড়ে তৌহিদ। প্রকাশ্য দিবালোকে সহপাঠীদের সামনে একের
পর এক কোপে ক্ষতবিক্ষত করে স্মৃতিকে। একপর্যায়ে রক্তাক্ত স্মৃতি মাটিতে
লুটিয়ে পড়লে সে মারা গেছে ভেবে চলে যায় বখাটেরা। পালানোর সময়ে তৌহিদ
বটিদাটি ঘটনাস্থলের পাশের একটি কচু ক্ষেতে ফেলে রেখে যায়। কিন্তু শেষ রক্ষা
হয়নি তৌহিদের। গতকাল মঙ্গলবার সকাল পৌনে দশটার দিকে পাশের পাকুন্দিয়া
উপজেলার কুমড়ীগ্রামের এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে তাকে আটক করেছে পুলিশ। আটকের
পর পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে তৌহিদ স্কুলছাত্রী স্মৃতিকে খুনের পরিকল্পনার
আদ্যোপান্ত বর্ণনা দেয়। এদিকে তৌহিদকে আটকের পর দুপুরে পুলিশ সুপারের
কার্যালয়ের কনফারেন্স রুমে এক প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়। ব্রিফিংয়ে
কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন খান জানান, স্কুলছাত্রীকে খুন
করার উদ্দেশ্যে তৌহিদ ধারালো বটিদা দিয়ে স্মৃতি আক্তারের মাথার বামপাশে
তিনটি, বাম ঘাড়ে দুইটি, বাম কাঁধে একটি এবং ঘাড়ের পেছনে একটি কোপ দিয়ে
মারাত্মক জখম করে। ঘটনার পর পরই পুলিশ ঘটনায় জড়িতদের ধরতে বিভিন্ন থানা
এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে। গতকাল মঙ্গলবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে আহুতিয়া
তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ এসআই মতিউর রহমান সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে পাকুন্দিয়ার
কুমড়ীগ্রামে অভিযান চালিয়ে সেখানে আত্মগোপনে থাকা মূল অভিযুক্ত তৌহিদকে আটক
করে। এ ছাড়া ঘটনার দিনই মামুন (২৪) নামে তৌহিদের এক সহযোগীকে আটক করা হয়।
প্রেস ব্রিফিংয়ে কিশোরগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সৈয়দ আবু সায়েম,
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) এসএম মোস্তাইন হোসেন, কিশোরগঞ্জ সদর মডেল
থানার ওসি মীর মোশারফ হোসেনসহ পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা
উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে বখাটে তৌহিদের গ্রেপ্তারের খবর পেয়ে বিদ্যালয়ের
শিক্ষার্থীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের
সামনে বিক্ষোভ করেছে। দুপুরে বিদ্যালয় থেকে মিছিল নিয়ে অন্তত ১০ কিলোমিটার
রাস্তা অতিক্রম করে তারা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনে এসে বিক্ষোভ করে। এ
সময় বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বখাটে তৌহিদের ফাঁসি চেয়ে বিভিন্ন স্লোগান
দেয়। এর আগে ঘটনার পর পরই রোববার সকালে শিক্ষার্থীসহ স্থানীয় এলাকাবাসী
কিশোরগঞ্জ-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এ ছাড়া সোমবার
বিদ্যালয়ের সামনে কিশোরগঞ্জ-ঢাকা মহাসড়কের পাশে প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী
মানববন্ধন কর্মসূচিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ স্থানীয় বিপুলসংখ্যক এলাকাবাসী
অংশ নেন। সন্ত্রাসী হামলার শিকার স্মৃতি আক্তার কটিয়াদী উপজেলার কুড়িয়াপাড়া
গ্রামের মৃত হেলাল উদ্দিনের মেয়ে। ৮-৯ বছর আগে হেলাল উদ্দিন মারা যাওয়ার
পর থেকে স্মৃতি কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার চৌদ্দশত পণকলিমা গ্রামের নানার বাড়ি
থেকে লেখাপড়া করতো। তার মা কিরণ আক্তার ঢাকায় গার্মেন্টে কাজ করে। দুই বোন ও
এক ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় স্মৃতি পড়াশোনায় ভাল হওয়ায় দিনমজুর মামা আবদুল
কাইয়ুমের বাড়িতে থেকে নান্দলা অছম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতো। নবম
শ্রেণীতে পড়ার সময় তার ওপর কুনজর পড়ে পণকলিমা গ্রামের অটোচালক হুমায়ুন
মিয়ার বখাটে ছেলে তৌহিদের। এরপর থেকে প্রায় নিয়মিত তৌহিদ নানাভাবে স্মৃতিকে
উত্ত্যক্ত করতো। এ নিয়ে একবার সালিশে তৌহিদের বিচার হলেও সে নিবৃত্ত হয়নি।
এসএসসির নির্বাচনী পরীক্ষা শুরুর দিন রোববার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে স্মৃতি
স্কুলের গেটের সামনে পৌঁছা মাত্রই আগে থেকে ওত পেতে থাকা তৌহিদ ও তার তিন
সহযোগী স্মৃতির ওপর হামলা চালিয়ে তাকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। মুমূর্ষু
স্মৃতিকে প্রথমে কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ও পরে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল
কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে
চিকিৎসাধীন স্মৃতির অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল রয়েছে বলে পরিবার সূত্রে
জানা গেছে। কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি মীর মোশারফ হোসেন জানান, এ
ব্যাপারে স্কুলছাত্রীর মামা মো. কাইয়ুম মিয়া বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন
দমন আইনে মামলা করেছেন। মামলায় বখাটে তৌহিদ, তার তিন সহযোগী সাইফুল, মামুন
ও সাদ্দাম এবং তৌহিদের বাবা হুমায়ুন মিয়া ও মা ঝরনা আক্তার এই ছয়জনকে
আসামি করা হয়েছে। ঘটনার দিনই ঘটনাস্থল থেকে আলামত হিসেবে ধারালো বটিদা
উদ্ধার করে জব্দ করা হয়েছে।
No comments