আমাদের যেন বদনাম না হয় by আনিসুল হক
ছোট বোনের সঙ্গে তোলা ছবির নিচের অশোভন মন্তব্যগুলোয় আহত হয়ে নাসির পোস্ট দিয়েছিলেন: ডোন্ট ফলো মি |
আমাদের
যেন বদনাম না হয়—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের
ভাষণে বলেছিলেন। ‘শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে,
লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-নন-বেঙ্গলি যারা আছে, তারা
আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপরে, আমাদের ওপরে, আমাদের যেন
বদনাম না হয়।’
একজনের ছোট্ট একটা ভুল আচরণ হয়ে পড়তে পারে অনেক বড় ঘটনা, পুরো জাতিরই কিন্তু মাথা নিচু হয়ে আসতে পারে। বাংলাদেশে তখন চলছিল বিশ্বকাপ ক্রিকেট। ২০১১ সালের ৪ মার্চ। শেরেবাংলা স্টেডিয়াম মিরপুরে সেদিন বাংলাদেশ ক্রিকেট দল খুব খারাপ করেছিল, ৫৮ রানে অলআউট হয়ে গিয়েছিল। ক্রিকেটে এ রকম আকসার ঘটে থাকে। এর চেয়ে কম রানে বহু দল অনেকবার আউট হয়েছে। তাতে খুব বদনাম হয় না। খেলা খেলাই। তাতে জয়-পরাজয় থাকবে। সেটাকে সুন্দরভাবে মেনে নিতে পারাই খেলোয়াড়সুলভ মানসিকতা। কিন্তু আমাদের আসল বদনাম হলো তখন, যখন কোনো এক অবিমৃশ্যকারী ঢিল ছুড়ে বসল ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়বাহী বাসে। ক্রিস গেইল টুইটে লিখলেন, ‘আমাদের বাসে ঢিল ছোড়া হচ্ছে। কাচ ভেঙে যাচ্ছে। এরপর কী? বুলেট’...সেই বার্তায় ঢিঢি পড়ে গেল ক্রিকেট বিশ্বে। বাংলাদেশ অধোবদন হতে বাধ্য হলো।
এতটুকুন একটা দেশ। এখানে গিজগিজ করছে মানুষ। এর মধ্যে একজন-দুজন মানসিকভাবে অসুস্থও থাকতে পারেন। আমি প্রতীকী অর্থে কথাটা বলছি না, শাব্দিক অর্থেই বলছি। ঢাকার রাস্তায় লাখ লাখ লোক চলাচল করে, তাদের মধ্যে সত্যিকারের মানসিক রোগীও তো থাকবেন কয়েক ডজন। কাজেই কে কখন কী করে বসে আর কী বলে বসে, আগেভাগে বলা সত্যি মুশকিল।
স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে কত মানুষ যায়। এদের একেকজনের মানসিকতা একেক রকম। গ্যালারিতে বসে কোনো খেলোয়াড়ের উদ্দেশেই যে অশোভন কোনো কথা বলা যায় না, জাত ধরে, বর্ণ ধরে, ধর্ম ধরে তো বলা যায়ই না, সেটা কি আমরা সবাই জানি? শুধু খেলার মাঠেই বা বলি কেন, ধর্মবিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ, জাতবিদ্বেষ কখনোই পোষণ করা যায় না, প্রকাশ করা যায় না।
কথাটা পাড়ছি নিচের খবরটা পড়ে:
দু-দুবার ঘটেছে একই ঘটনা। ম্যাচ রেফারি ক্রিস ব্রড এরপরই বাধ্য হলেন হুমকিটা দিতে। আর একবার এ ঘটনা ঘটলে টেস্ট ম্যাচ বন্ধই করে দিতে বাধ্য হবেন তিনি।
কাল চট্টগ্রাম টেস্টের দ্বিতীয় দিনের শুরুর দিকের ঘটনা। দক্ষিণ আফ্রিকার দ্বাদশ খেলোয়াড় কাগিসো রাবাদার উদ্দেশে কিছু বাজে মন্তব্য করা হয় পশ্চিম গ্যালারি থেকে। ক্রিকেটাররা নাকি এ সময় ‘ব্ল্যাক ব্ল্যাক’ ধ্বনিও শুনতে পান গ্যালারি থেকে। ঘটনাটা দক্ষিণ আফ্রিকা দলের ম্যানেজার জানার আগেই জেনে যান ম্যাচ রেফারি। পানি পানের বিরতিতে সেই তথ্য আম্পায়ারদের মাধ্যমে কানে যায় তাঁর। ভেন্যু ম্যানেজার ফজলে বারী খানকে তখনই প্রথম সতর্কবার্তা দেন ব্রড।
এরপর মধ্যাহ্ন বিরতির সময় আবারও প্রায় একই ঘটনা ঘটে। প্র্যাকটিস উইকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার দু-একজন ক্রিকেটার ব্যাটিং অনুশীলন করছিলেন। এ সময় গ্যালারি থেকে আবারও বাজে মন্তব্য ভেসে আসে, যা জানার পর ম্যাচ রেফারি খুব চটে যান। ভেন্যু ম্যানেজারকে ডেকে বলেন, এটা বর্ণবাদী আচরণ। আর একবার এ ঘটনা ঘটলে তিনি খেলা বন্ধ করে দেবেন। এরপর বেশ কয়েকবার মাইকে ঘোষণা দিয়ে এ ধরনের আচরণ আর না করার জন্য সতর্ক করে দেওয়া হয় দর্শকদের।
কাল রাতে মুঠোফোনে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন ভেন্যু ম্যানেজার। প্রথম আলোকে তিনি বলেছেন, ম্যাচ রেফারির চূড়ান্ত সতর্কবাণী শোনার পর দর্শকদের উদ্দেশে মাইকে এ ধরনের আচরণ করার ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া হয়। পরে এ নিয়ে আর কোনো সমস্যা হয়নি। (প্রথম আলো, ২৩ জুলাই ২০১৫)।
আশা করি, আর সমস্যা হবে না। বাংলাদেশের দর্শকেরা মোটের ওপরে ভালো, চট্টগ্রামের দর্শকেরাও অতিথিপরায়ণ হিসেবেই সুখ্যাত।
আমরা কজন মিলে ২০১১ বিশ্বকাপের সময় ফেসবুকে একটা পেজ খুলেছিলাম, বাংলাদেশ, দ্য ওয়ার্ল্ড কাপ চ্যাম্পিয়নস, দেয়ার ক্যান বি মিরাকলস হোয়েন উই বিলিভ। তাতে আমরা একটা কথাই বারবার প্রচার করেছিলাম, খেলায় জয়-পরাজয় আছে, থাকবে। একটা বিশ্বকাপে সবগুলো দেশ চ্যাম্পিয়ন হতে পারবে না। কিন্তু বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হতে পারে স্বাগতিক হিসেবে, অতিথিপরায়ণতার উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠার মাধ্যমে। আমরা যদি আমাদের অতিথিদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করি, ঐতিহ্যবাহী বাঙালি আতিথেয়তার অপূর্ব উদাহরণগুলো দেখাই, তাহলেই আমরা চ্যাম্পিয়ন হতে পারব।
সেবার আমাদের সুনামও হয়েছিল। ক্রিকইনফো লিখেছিল, বাংলাদেশ বিশ্বকাপকে তার আত্মা ফিরিয়ে দিয়েছে। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় হাঁটছিল, বিশ্বকাপের ভেন্যু দেখতে বেরিয়ে পড়েছিল নারী-শিশুরা, কী উৎসবের পরিবেশই না তৈরি হয়েছিল! স্টেডিয়ামেও ভারতের মানচিত্র গায়ে এঁকে নিয়ে বেড়ানো সুধীরের মতো সমর্থক কিংবা পাকিস্তানের সাদা-সবুজ আলখাল্লা পরা দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানো সুপরিচিত সমর্থক ভদ্রলোককে বাংলাদেশের দর্শকেরা খাতির-যত্ন করেছেন, কোনো বিদেশির প্রতি বিন্দুমাত্র বিরূপতা দেখাননি কেউই।
এ বছরই বরং সুধীরের সঙ্গে কয়েকজন দর্শকের আচরণ সীমা লঙ্ঘন করেছে কি করেনি, এই নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। এবং সর্বশেষ, চট্টগ্রামের টেস্ট বাতিলের হুমকি দিলেন ম্যাচ রেফারি, দর্শকদের বর্ণবাদী মন্তব্যের অভিযোগে। বিষয়টা খুবই গুরুতর, আমাদের উচিত এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা।
তবে এই সতর্কতা আসবে সার্বিক শিক্ষা থেকে, দেশ-বিদেশের জ্ঞান নিজেদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। আমাদের আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে কখনো কখনো আমাদের অশিক্ষা, আমাদের কুশিক্ষা, আমাদের পশ্চাৎপদ মানসিকতার পরিচয় বেরিয়ে আসে। এই উপমহাদেশের মানুষের মধ্যে গায়ের রং নিয়ে যে অবসেশন, তা আর কোথাও আছে কি না সন্দেহ। তাই তো এ দেশে গায়ের রং ফরসা করার ক্রিমের এত রমরমা। রবীন্দ্রনাথকে কবিতা লিখতে হয়, কালো তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ। আর সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে কবিতা লিখতে হয়, কালো বউ গটগট গটগট করে চলে গেল।
আমাদের অনেকেরই মনের ভেতরে অন্ধকার রয়ে গেছে। কখনো কখনো তা বেরিয়েও যায়। আমাদের একজন নেতা, যিনি সুন্দর কথা ও বিদেশি শিক্ষার জন্য সুখ্যাতই, একদিন হঠাৎ করে একজন আমেরিকান মন্ত্রীর পদমর্যাদা ও আদি দেশ নিয়ে কথা বলে ফেলেছিলেন। এটা যে বলা যায় না, ওই নেতা সেটা খুব ভালো করে জানেন, আমরা যারা বিদেশে লেখাপড়ার সুযোগ পাইনি, তারা সেই ভুল করতে পারি, কিন্তু তিনি পারেন না।
আর আছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম! এই জায়গাটা মানুষের মনের অন্ধকার, হিংসা, রিরংসা উগরে দেওয়ার একটা অরণ্যে পরিণত হয়েছে। এটা যে শুধু বাংলাদেশের বেলায় সত্য তা নয়, পৃথিবীজুড়েই প্রায় একই ঘটনা। একাকী একজন মানুষ তার পরিচয় গোপন করে নিজের ÿক্ষুদ্র কোটরে বসে গালি দিতে পারছে পৃথিবীর এক নম্বর কোনো খেলোয়াড়কে বা গায়ককে, কী বিকৃত আনন্দই না সে লাভ করছে! শচীন টেন্ডুলকারের শততম সেঞ্চুরির পর টাইমস অব ইন্ডিয়ার ওয়েব পাতা খুলেছিলাম খবরটা পড়ার জন্য, মন্তব্যের ঘরে ভারতীয়দের কেউ কেউ টেন্ডুলকারকে গালি দিচ্ছেন বাংলাদেশের সঙ্গে ম্যাচ হারার জন্য দায়ী করে, খানিক পরেই মন্তব্যগুলো বিভিন্ন দেশের সমর্থকদের মধ্যে জাতিবিদ্বেষী গালিগালাজের অবাধ অনুশীলনে পর্যবসিত হলো।
বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি ফেসবুকে গ্রাহক আছেন। এক কোটি মানুষের মন এক কোটি রকম। এদের সবার কাছে আপনি সভ্যতা, সংস্কৃতি, উন্নত রুচি ও মূল্যবোধ আশা করতে পারেন না। ক্রিকেটার নাসিরের ছোট বোনের সঙ্গে তোলা ছবির নিচের মন্তব্যগুলো ছিল বেদনাদায়ক আর অশোভন। নাসির তাই পোস্ট দিয়েছিলেন: ডোন্ট ফলো মি। প্রতিবাদে মাশরাফি তাঁর ফেসবুকের পাতা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আপনি যেকোনো জনপ্রিয় ব্যক্তির ফেসবুকের কমেন্টস পড়ে দেখুন, সেটা সাকিব আল হাসানই হোন, মুশফিকুর রহিমই হোন, কিংবা আমাদের মন্ত্রীরাই হোন। যদি কোনো নারীর সঙ্গে তাঁদের ছবি থাকে, তাহলে তার নিচে যেসব মন্তব্য দেখবেন, তাতে আপনার বিবমিষার উদ্রেক হতে বাধ্য। যে দেশের সমর্থকেরা মাশরাফিকে অস্ট্রেলিয়ায় জুমার নামাজ শেষে ধরতে পারে, তাঁর গায়ে হাত তুলে বলতে পারে, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে কেন বাংলাদেশ খারাপ করল, সেই দেশের মানুষ কী করতে পারে, ভেবে আমাদের অন্তর সারাক্ষণই শঙ্কিত হয়ে থাকে।
তবু ভরসা এই যে এরা সংখ্যায় কম। এবং অন্ধকার দূর করার আর কোনো উপায় নেই, আলো জ্বালানো ছাড়া। আমাদের আলোর কথা, ভালোর কথা, সুসংস্কৃত দেশ, আলোকিত মানুষ, আলোকিত হৃদয় তৈরির কথা বলে যেতেই হবে। বই হতে পারে সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। সংস্কৃতির চর্চা হতে পারে মনের দিগন্ত বাড়ানোর বড় উপায়। আর থাকবে স্কুলের শিক্ষা, পারিবারিক শিক্ষা, গণমাধ্যমের ভূমিকা এবং নেতাদের আদর্শ আচরণ। নেতা বলতে সবÿক্ষেত্রের নেতাদের কথাই বলছি, রাজনীতি থেকে শুরু করে শিল্পী-খেলোয়াড়-শিক্ষক কিংবা পাড়ার মুরব্বি। সবার আচরণ হতে হবে সুন্দর, সুশোভন, অনুকরণীয়। ভালো হতে আসলেই পয়সা লাগে না। তাই ভালো হওয়ার চেষ্টা আমাদের করে যেতে হবে সারাক্ষণ। ক্রিকেট মাঠে খেলোয়াড়দের উদ্দেশে বর্ণবাদী কিংবা জাতিবিদ্বেষী উক্তি করা হলে সেটা হবে খুব বড় বদনাম। বঙ্গবন্ধুর উক্তিটাই বারবার করে বলব, আমাদের যেন বদনাম না হয়।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
একজনের ছোট্ট একটা ভুল আচরণ হয়ে পড়তে পারে অনেক বড় ঘটনা, পুরো জাতিরই কিন্তু মাথা নিচু হয়ে আসতে পারে। বাংলাদেশে তখন চলছিল বিশ্বকাপ ক্রিকেট। ২০১১ সালের ৪ মার্চ। শেরেবাংলা স্টেডিয়াম মিরপুরে সেদিন বাংলাদেশ ক্রিকেট দল খুব খারাপ করেছিল, ৫৮ রানে অলআউট হয়ে গিয়েছিল। ক্রিকেটে এ রকম আকসার ঘটে থাকে। এর চেয়ে কম রানে বহু দল অনেকবার আউট হয়েছে। তাতে খুব বদনাম হয় না। খেলা খেলাই। তাতে জয়-পরাজয় থাকবে। সেটাকে সুন্দরভাবে মেনে নিতে পারাই খেলোয়াড়সুলভ মানসিকতা। কিন্তু আমাদের আসল বদনাম হলো তখন, যখন কোনো এক অবিমৃশ্যকারী ঢিল ছুড়ে বসল ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়বাহী বাসে। ক্রিস গেইল টুইটে লিখলেন, ‘আমাদের বাসে ঢিল ছোড়া হচ্ছে। কাচ ভেঙে যাচ্ছে। এরপর কী? বুলেট’...সেই বার্তায় ঢিঢি পড়ে গেল ক্রিকেট বিশ্বে। বাংলাদেশ অধোবদন হতে বাধ্য হলো।
এতটুকুন একটা দেশ। এখানে গিজগিজ করছে মানুষ। এর মধ্যে একজন-দুজন মানসিকভাবে অসুস্থও থাকতে পারেন। আমি প্রতীকী অর্থে কথাটা বলছি না, শাব্দিক অর্থেই বলছি। ঢাকার রাস্তায় লাখ লাখ লোক চলাচল করে, তাদের মধ্যে সত্যিকারের মানসিক রোগীও তো থাকবেন কয়েক ডজন। কাজেই কে কখন কী করে বসে আর কী বলে বসে, আগেভাগে বলা সত্যি মুশকিল।
স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে কত মানুষ যায়। এদের একেকজনের মানসিকতা একেক রকম। গ্যালারিতে বসে কোনো খেলোয়াড়ের উদ্দেশেই যে অশোভন কোনো কথা বলা যায় না, জাত ধরে, বর্ণ ধরে, ধর্ম ধরে তো বলা যায়ই না, সেটা কি আমরা সবাই জানি? শুধু খেলার মাঠেই বা বলি কেন, ধর্মবিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ, জাতবিদ্বেষ কখনোই পোষণ করা যায় না, প্রকাশ করা যায় না।
কথাটা পাড়ছি নিচের খবরটা পড়ে:
দু-দুবার ঘটেছে একই ঘটনা। ম্যাচ রেফারি ক্রিস ব্রড এরপরই বাধ্য হলেন হুমকিটা দিতে। আর একবার এ ঘটনা ঘটলে টেস্ট ম্যাচ বন্ধই করে দিতে বাধ্য হবেন তিনি।
কাল চট্টগ্রাম টেস্টের দ্বিতীয় দিনের শুরুর দিকের ঘটনা। দক্ষিণ আফ্রিকার দ্বাদশ খেলোয়াড় কাগিসো রাবাদার উদ্দেশে কিছু বাজে মন্তব্য করা হয় পশ্চিম গ্যালারি থেকে। ক্রিকেটাররা নাকি এ সময় ‘ব্ল্যাক ব্ল্যাক’ ধ্বনিও শুনতে পান গ্যালারি থেকে। ঘটনাটা দক্ষিণ আফ্রিকা দলের ম্যানেজার জানার আগেই জেনে যান ম্যাচ রেফারি। পানি পানের বিরতিতে সেই তথ্য আম্পায়ারদের মাধ্যমে কানে যায় তাঁর। ভেন্যু ম্যানেজার ফজলে বারী খানকে তখনই প্রথম সতর্কবার্তা দেন ব্রড।
এরপর মধ্যাহ্ন বিরতির সময় আবারও প্রায় একই ঘটনা ঘটে। প্র্যাকটিস উইকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার দু-একজন ক্রিকেটার ব্যাটিং অনুশীলন করছিলেন। এ সময় গ্যালারি থেকে আবারও বাজে মন্তব্য ভেসে আসে, যা জানার পর ম্যাচ রেফারি খুব চটে যান। ভেন্যু ম্যানেজারকে ডেকে বলেন, এটা বর্ণবাদী আচরণ। আর একবার এ ঘটনা ঘটলে তিনি খেলা বন্ধ করে দেবেন। এরপর বেশ কয়েকবার মাইকে ঘোষণা দিয়ে এ ধরনের আচরণ আর না করার জন্য সতর্ক করে দেওয়া হয় দর্শকদের।
কাল রাতে মুঠোফোনে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন ভেন্যু ম্যানেজার। প্রথম আলোকে তিনি বলেছেন, ম্যাচ রেফারির চূড়ান্ত সতর্কবাণী শোনার পর দর্শকদের উদ্দেশে মাইকে এ ধরনের আচরণ করার ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া হয়। পরে এ নিয়ে আর কোনো সমস্যা হয়নি। (প্রথম আলো, ২৩ জুলাই ২০১৫)।
আশা করি, আর সমস্যা হবে না। বাংলাদেশের দর্শকেরা মোটের ওপরে ভালো, চট্টগ্রামের দর্শকেরাও অতিথিপরায়ণ হিসেবেই সুখ্যাত।
আমরা কজন মিলে ২০১১ বিশ্বকাপের সময় ফেসবুকে একটা পেজ খুলেছিলাম, বাংলাদেশ, দ্য ওয়ার্ল্ড কাপ চ্যাম্পিয়নস, দেয়ার ক্যান বি মিরাকলস হোয়েন উই বিলিভ। তাতে আমরা একটা কথাই বারবার প্রচার করেছিলাম, খেলায় জয়-পরাজয় আছে, থাকবে। একটা বিশ্বকাপে সবগুলো দেশ চ্যাম্পিয়ন হতে পারবে না। কিন্তু বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হতে পারে স্বাগতিক হিসেবে, অতিথিপরায়ণতার উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠার মাধ্যমে। আমরা যদি আমাদের অতিথিদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করি, ঐতিহ্যবাহী বাঙালি আতিথেয়তার অপূর্ব উদাহরণগুলো দেখাই, তাহলেই আমরা চ্যাম্পিয়ন হতে পারব।
সেবার আমাদের সুনামও হয়েছিল। ক্রিকইনফো লিখেছিল, বাংলাদেশ বিশ্বকাপকে তার আত্মা ফিরিয়ে দিয়েছে। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় হাঁটছিল, বিশ্বকাপের ভেন্যু দেখতে বেরিয়ে পড়েছিল নারী-শিশুরা, কী উৎসবের পরিবেশই না তৈরি হয়েছিল! স্টেডিয়ামেও ভারতের মানচিত্র গায়ে এঁকে নিয়ে বেড়ানো সুধীরের মতো সমর্থক কিংবা পাকিস্তানের সাদা-সবুজ আলখাল্লা পরা দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানো সুপরিচিত সমর্থক ভদ্রলোককে বাংলাদেশের দর্শকেরা খাতির-যত্ন করেছেন, কোনো বিদেশির প্রতি বিন্দুমাত্র বিরূপতা দেখাননি কেউই।
এ বছরই বরং সুধীরের সঙ্গে কয়েকজন দর্শকের আচরণ সীমা লঙ্ঘন করেছে কি করেনি, এই নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। এবং সর্বশেষ, চট্টগ্রামের টেস্ট বাতিলের হুমকি দিলেন ম্যাচ রেফারি, দর্শকদের বর্ণবাদী মন্তব্যের অভিযোগে। বিষয়টা খুবই গুরুতর, আমাদের উচিত এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা।
তবে এই সতর্কতা আসবে সার্বিক শিক্ষা থেকে, দেশ-বিদেশের জ্ঞান নিজেদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। আমাদের আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে কখনো কখনো আমাদের অশিক্ষা, আমাদের কুশিক্ষা, আমাদের পশ্চাৎপদ মানসিকতার পরিচয় বেরিয়ে আসে। এই উপমহাদেশের মানুষের মধ্যে গায়ের রং নিয়ে যে অবসেশন, তা আর কোথাও আছে কি না সন্দেহ। তাই তো এ দেশে গায়ের রং ফরসা করার ক্রিমের এত রমরমা। রবীন্দ্রনাথকে কবিতা লিখতে হয়, কালো তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ। আর সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে কবিতা লিখতে হয়, কালো বউ গটগট গটগট করে চলে গেল।
আমাদের অনেকেরই মনের ভেতরে অন্ধকার রয়ে গেছে। কখনো কখনো তা বেরিয়েও যায়। আমাদের একজন নেতা, যিনি সুন্দর কথা ও বিদেশি শিক্ষার জন্য সুখ্যাতই, একদিন হঠাৎ করে একজন আমেরিকান মন্ত্রীর পদমর্যাদা ও আদি দেশ নিয়ে কথা বলে ফেলেছিলেন। এটা যে বলা যায় না, ওই নেতা সেটা খুব ভালো করে জানেন, আমরা যারা বিদেশে লেখাপড়ার সুযোগ পাইনি, তারা সেই ভুল করতে পারি, কিন্তু তিনি পারেন না।
আর আছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম! এই জায়গাটা মানুষের মনের অন্ধকার, হিংসা, রিরংসা উগরে দেওয়ার একটা অরণ্যে পরিণত হয়েছে। এটা যে শুধু বাংলাদেশের বেলায় সত্য তা নয়, পৃথিবীজুড়েই প্রায় একই ঘটনা। একাকী একজন মানুষ তার পরিচয় গোপন করে নিজের ÿক্ষুদ্র কোটরে বসে গালি দিতে পারছে পৃথিবীর এক নম্বর কোনো খেলোয়াড়কে বা গায়ককে, কী বিকৃত আনন্দই না সে লাভ করছে! শচীন টেন্ডুলকারের শততম সেঞ্চুরির পর টাইমস অব ইন্ডিয়ার ওয়েব পাতা খুলেছিলাম খবরটা পড়ার জন্য, মন্তব্যের ঘরে ভারতীয়দের কেউ কেউ টেন্ডুলকারকে গালি দিচ্ছেন বাংলাদেশের সঙ্গে ম্যাচ হারার জন্য দায়ী করে, খানিক পরেই মন্তব্যগুলো বিভিন্ন দেশের সমর্থকদের মধ্যে জাতিবিদ্বেষী গালিগালাজের অবাধ অনুশীলনে পর্যবসিত হলো।
বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি ফেসবুকে গ্রাহক আছেন। এক কোটি মানুষের মন এক কোটি রকম। এদের সবার কাছে আপনি সভ্যতা, সংস্কৃতি, উন্নত রুচি ও মূল্যবোধ আশা করতে পারেন না। ক্রিকেটার নাসিরের ছোট বোনের সঙ্গে তোলা ছবির নিচের মন্তব্যগুলো ছিল বেদনাদায়ক আর অশোভন। নাসির তাই পোস্ট দিয়েছিলেন: ডোন্ট ফলো মি। প্রতিবাদে মাশরাফি তাঁর ফেসবুকের পাতা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আপনি যেকোনো জনপ্রিয় ব্যক্তির ফেসবুকের কমেন্টস পড়ে দেখুন, সেটা সাকিব আল হাসানই হোন, মুশফিকুর রহিমই হোন, কিংবা আমাদের মন্ত্রীরাই হোন। যদি কোনো নারীর সঙ্গে তাঁদের ছবি থাকে, তাহলে তার নিচে যেসব মন্তব্য দেখবেন, তাতে আপনার বিবমিষার উদ্রেক হতে বাধ্য। যে দেশের সমর্থকেরা মাশরাফিকে অস্ট্রেলিয়ায় জুমার নামাজ শেষে ধরতে পারে, তাঁর গায়ে হাত তুলে বলতে পারে, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে কেন বাংলাদেশ খারাপ করল, সেই দেশের মানুষ কী করতে পারে, ভেবে আমাদের অন্তর সারাক্ষণই শঙ্কিত হয়ে থাকে।
তবু ভরসা এই যে এরা সংখ্যায় কম। এবং অন্ধকার দূর করার আর কোনো উপায় নেই, আলো জ্বালানো ছাড়া। আমাদের আলোর কথা, ভালোর কথা, সুসংস্কৃত দেশ, আলোকিত মানুষ, আলোকিত হৃদয় তৈরির কথা বলে যেতেই হবে। বই হতে পারে সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। সংস্কৃতির চর্চা হতে পারে মনের দিগন্ত বাড়ানোর বড় উপায়। আর থাকবে স্কুলের শিক্ষা, পারিবারিক শিক্ষা, গণমাধ্যমের ভূমিকা এবং নেতাদের আদর্শ আচরণ। নেতা বলতে সবÿক্ষেত্রের নেতাদের কথাই বলছি, রাজনীতি থেকে শুরু করে শিল্পী-খেলোয়াড়-শিক্ষক কিংবা পাড়ার মুরব্বি। সবার আচরণ হতে হবে সুন্দর, সুশোভন, অনুকরণীয়। ভালো হতে আসলেই পয়সা লাগে না। তাই ভালো হওয়ার চেষ্টা আমাদের করে যেতে হবে সারাক্ষণ। ক্রিকেট মাঠে খেলোয়াড়দের উদ্দেশে বর্ণবাদী কিংবা জাতিবিদ্বেষী উক্তি করা হলে সেটা হবে খুব বড় বদনাম। বঙ্গবন্ধুর উক্তিটাই বারবার করে বলব, আমাদের যেন বদনাম না হয়।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments