সুতানাগ by জাকির তালুকদার
সন্ধের মুখে মুখে বাড়িতে ঢুকে নিজের বউকে ‘টেলিভিশন থাইকা নাইমা আসা মাইয়া’ ভেবে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিল মোবারক। না ভেবে উপায়ই বা কী! চুলের পাট, মুখের জৌলুস, শাড়ি পরার কায়দা—একেবারেই অন্যরকম। মনেই হয় না যে এটাই তার বউ সাজেদা। স্বামীর মুখ দেখে মুখ টিপে হাসে বউ। এমনটাই হবে বলে আশা ছিল তার। মোবারক কিছুক্ষণ হা করে বউয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে শুধু বলতে পারে, ‘কী বেপার, আইজ যে একবারে আলাদা। নিজের বউরে চিনবারই পারতিছি না।’ সাজেদা রহস্য ভাঙে না। কেবল বলে, ‘হাতমুখ ধুয়ে আসো। আমি ভাত বাড়তিছি।’ ‘আরে রাখ তোর ভাত! ঘরে চল। আগে তরে ভালো কইরা দেইখা লই।’ বউ কপট চোখ রাঙায়, ‘এই সানঝের আগে কিসের ঘর?’
বলে বটে, কিন্তু ঘরে ঠিকই আসে। বউকে কোলের মধ্যে টেনে নিতে গিয়ে অদ্ভুত মাদকতাময় একটা সুবাস পায় মোবারক। বউয়ের চুল থেকেই বেশি আসছে সুবাস। শরীরেও সুবাস।
নিজেকে সুস্থির করার পরে মোবারক প্রশ্ন করে, ‘কী লাগাইছস সাজু?’
সাজেদা এবার আর রহস্য রাখে না। বলে, ‘শ্যাম্পু লাগাইছি চুলে। খুব ভালো হইছে না?’
‘শ্যাম্পু!’—চোখ বড় বড় হয়ে যায় মোবারকের, ‘কই পাইলি এত ট্যাকা? শ্যাম্পুর দাম কত জানস?’
বউ তুড়ি মারার ভঙ্গিতে বলে, ‘কত আর। তিন ট্যাকা।’
‘তিন ট্যাকায় শ্যাম্পু হয়? আমি তো জানি এক বোতল শ্যাম্পুর দাম চার-পাঁচ শ ট্যাকা।’
‘দূর পাগল। অত ট্যাকা আমরা পামু কই! তিন ট্যাকাই। মিনি প্যাক কয় এইডারে।’
‘কিন্তু পাইলি কই? তুই কি গঞ্জে গেছিলি?’
‘না। উত্তরখান্দারে দোকান করছে না রশিদ মিয়া!’
এই খবরটাও নতুন মোবারকের কাছে। এখানে যে কেউ দোকান দিয়ে বসতে পারে, সেটাই তো ভাবেনি কোনোদিন সে। এই বাঁধের ওপর ঘরহারা মানুষের ঘরের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এখন দুই শ ঘরের কাছাকাছি। আদমশুমারি হয়নি। কিন্তু অনেক বছর থেকে এই বাঁধে মানুষ আসছে, থাকছে। স্থায়ীভাবে থাকছে। এই অঞ্চলের মানুষের কাছে তাই এটার নামই হয়ে গেছে বাঁধগাঁ। বিদ্যুতের আলোর প্রশ্নই আসে না। বাঁধগাঁয়ের মানুষের নাম ভোটার তালিকায় ওঠেনি। সেই কারণে কোনো নেতা-পাতিনেতার গরজ নাই বাঁধগাঁ নিয়ে। এতগুলান মানুষের বাচ্চা, তারা কী খায় কীভাবে বাঁচে, কেউ কোনোদিন উঁকি মেরেও দেখতে আসেনি। পুলিশ এসেছে মাঝেমধ্যে। আশপাশের গাঁয়ে চুরির হিড়িক বেড়ে গেলে লোকেরা বাঁধগাঁয়ের ওপর দোষ চাপায়। এনজিওর লোক আসে। ক্ষুদ্রঋণের দাদন ব্যবসা এখানেও ছড়িয়ে পড়েছে। কিস্তির টাকা তুলতে আসতে হয় তাদের। সবচেয়ে পাশের গ্রাম থেকেও কমপক্ষে এক মাইল উত্তরে বাঁধগাঁ। তার উত্তরে নদীর বালু। নদী এখন অনেকটা দূরে। পয়োস্তি জমিতে ধানচাষ হয়, আলু হয়, খুব বড় জাতের রসুন হয়। ফসলের মাঠের দিকে তাকিয়ে বাঁধগাঁয়ের কোনো কোনো মানুষ নিজের হারানো আবাদি জমির কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তবে বেশির ভাগেরই সেসব চিন্তার বালাই নাই। তারা খাটতে যায়—হয় অন্যের জমিতে, নয়তো কারও দোকানে। কেউ গঞ্জে ভ্যান চালায়, কুলির কাজ করে। মেয়েরা, বিশেষ করে মাঝবয়সী আর বালিকারা আশপাশের গ্রামের সম্পন্ন বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে। বিদ্যুৎ নাই। টেলিভিশন থাকার প্রশ্নই ওঠে না বাঁধগাঁয়ে। ব্যাটারি দিয়ে টিভি চালাবে এমন পয়সাঅলাও কেউ নাই বাঁধগাঁয়ে। তবে টিভি দেখা হয়ে যায় অনেকেরই। পুরুষেরা তো গঞ্জের দোকানে-দোকানে দেখে। মেয়েরাও, যারা ঝিয়ের কাজ করতে যায়, তারাও টিভি দেখার অভ্যেস করে ফেলেছে। বাঁধগাঁয়ের পুরুষ-নারী—সবাই একই কথা ভাবে, ‘টেলিভিশনের ব্যাডা-মাইয়ারা অত সোন্দর হয় কেমন কইরা! আল্লাহ কী আলাদা ছঞ্চ দিয়া বানাইছে অগো।’ বাঁধগাঁয়ের মেয়েরাও সাজে। বিকেলে মেয়েরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে একজন আরেকজনের চুলে নারকোল তেল মাখায়, পরস্পরের বেণি-খোঁপা বেঁধে দেয়। মা–দাদিদের আমল থেকে তারা নানান নামের তেল-স্নো চেনে, পাউডার চেনে, আলতা চেনে।
শ্যাম্পু চিনে ফেলার কথা আজই প্রথম শুনল মোবারক। নিজে সে চেনে ওই জিনিস। গঞ্জে-বাজারে যারা কাজ করতে যায়, তারা সবাই-ই চেনে। কিন্তু কেউ কোনোদিন নিজেদের বাড়িতে ওই রকম কোনো জিনিস আনেনি। পোলাপানদের নিয়ে ভাত-সালুনের ব্যবস্থা করতে করতেই ফাট ফাট, ওই সব জিনিস যাতে কোনো মাইয়ার চোখে না পড়ে, সেদিকেই বরং তাদের নজর ছিল বেশি।
কিন্তু পড়ে তো গেলই।
পরদিন রশিদের দোকান দেখতে গেল মোবারক। টিনের বেড়ার ঘের দেওয়া টিনেরই চালার ঘর। কিন্তু জিনিসপত্রে ঠাসা। আর সাজানের কায়দাও খুব সুন্দর। সব জিনিস যেন খদ্দেরের চোখের সামনে দেখা যায়, গঞ্জের মোল্লা স্টোরের মতো। তার মতো অনেকেই দোকান দেখতে এসেছে। এই সকালবেলাতেও খদ্দের আসা শুরু হয়ে গেছে। কেউ কেউ বউয়ের জন্য কিনছে মিনিপ্যাক। কোনো কোনো ঘর থেকে মেয়েরাও এসেছে কিনতে। বাঁধগাঁয়ে পুরুষের সামনে নারীদের শরম পাওয়ার কোনো অবকাশ নাই। সব গায়ে গা লাগিয়ে থাকতে হয়। কিন্তু এখানে জিনিস কিনতে এসে কারও কারও মুখে একটু সলজ্জ হাসি। দোকানে বেশিক্ষণ কাটানো যায় না। কাজের সন্ধানে বেরোতে হবে মোবারকদের। তাই তারা উঠে পড়ে। একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল মোবারকের মাথায়, রশিদ এত পুঁজি পেল কোথায়? সমিতি থেকে লোন নিয়েছে? এত টাকা লোন দেয় সমিতি? ছিরু মিয়া ভেতরের খোঁজ বের করার ওস্তাদ। সে জানায়, ‘লোন-ফোন কিচ্ছু না। যারা মাল তৈরি করে, সেই কম্পানির লোকেরা বাকিতে মাল দিয়ে যায় রশিদকে। বিক্রি হওয়ার পরে টাকা নেয়। রশিদের লাভ লাভই থাকে। কোনো পুঁজিই লাগে না। এমনকি দোকান বানিয়ে দেওয়া, র্যাক এনে মালামাল সাজিয়ে দেওয়ার কাজও করেছে কম্পানির লোকেরা।’
আহা এমন একটা কোম্পানি যদি মোবারকের দিকে একবার তাকাত!
কয়েক দিন পরেই বাঁধগাঁয়ে একদল মেয়ে-মদ্দ এসে হাজির। তিন দিন পরে নাকি বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস। তারা এসেছে কোম্পানির তরফ থেকে মানুষকে হাত ধোয়া শেখাতে। গাঁয়ের মানুষ শুনে প্রথমে হাসে। কিন্তু কিছুক্ষণ ওদের কথা শোনার পরেই তারা বুঝতে পারে, এত দিন কী বাজে অভ্যেস লালন করে এসেছে তারা! ছুঁচে এসে মাটিতে হাত ঘষে পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলে। এতে নাকি অনেক ক্ষতি। হাতে তো জীবাণু থাকেই, মাটির জীবাণুও যোগ হয় তার সঙ্গে। ফলে পেটের অসুখ সারা বছর সঙ্গী।
তাই তো! বাঁধগাঁয়ের সব পোলাপানই তো সারা বছর পেটরোগা।
হাত মাইটানির বদলে এখন থেকে হাত ধুতে হবে হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে। তা না পেলে সাবান। প্রথমে বিনা পয়সায় জনপ্রতি একটা করে মিনি সাবান ফ্রি দিয়ে যাচ্ছে কোম্পানির লোকেরা। গাঁয়ের লোক ব্যবহার করেই দেখুক। হাতে হাতে ফল পাবে তারা।
হাত ধোয়া দিবসের পরের দিন গাঁয়ে আসে একরাম সাঁই। সে কবে কখন গাঁয়ে আসে ঠিক নাই। আসে, কয়েক দিন থাকে, গাঁ-পড়িশদের গান শোনায়, গল্প শোনায়, আবার চলে যায়। বাঁধগাঁয়ের মানুষ ভক্তি করার মতো একজনকেই চেনে। ভক্তি নিয়ে কথা শোনে। কিন্তু একরাম সাঁইয়ের সব কথা বুঝতে তারা পারে না। সাঁইও রহস্য ভেঙে বলে না সবকিছু।
এবার গাঁয়ে এসে মিনিপ্যাকের কথা শুনেছে সাঁই। কিংবা শুনেই হয়তো এসেছে গাঁয়ে। তার ভিটায় গল্পের আসর সন্ধের পরে।
‘মনসার তো খুব জেদ। সেই রকম জেদ চাঁদ সদাগরের। মনসা কয়, চাঁদ তোরে আমি নিব্বংশ করমু। চাঁদ কয়, তরে সামনে পাইলে আমি জিগার ওলা দিয়া পিডাইয়া ঠ্যাং ভাঙমু। চাঁদ সদাগরের সাতপুত্রের মইদ্যে ছয়পুত্র ডুইবা মরছে মনসার কোপে। বাকি আছে লখিন্দর। লখাই। তারও মরণ নিশ্চিত। তাই পুত্রের বিয়া দেওনের সময় সদাগর কোনো মাইয়া খুঁইজা পায় না। কোনো বাপ-মায় মাইয়া দিবার চায় না। জাইনা-শুইনা কে বিধবা বানাইবার চায় নিজের মাইয়ারে। কিন্তুক রাজি হয় বেহুলা। রাজি হয় বেহুলার মা-বাপ। এই তত্ত্ব শুইনা মনসা কয়, বিয়া হইব অগো কিন্তু বাসর হইব না। চাঁদ সদাগর লোহার বাসরঘর বানায়। কিন্তু মনসার চরেরা গোপনে সেই দেয়ালে একটা কাঠি রাইখা যায়। তাই লোহা ঢালাই হইলেও একচুল ফাঁক থাইকা যায় একদিকের দেয়ালেত। বাসর রাইতে মনসা একে একে ডাকে কালনাগরে, আজদাহারে, গোক্ষুররে, শীশনাগরে। কিন্তু কেউ ঢুকবার পারে না বাসরঘরে। তখন ডাক পড়ে সুতানাগের। তারপরের কাহিনি তো তোমরা সক্কলেই জানো।’
এই পর্যন্ত বলেই উঠে পড়ে একরাম সাঁই।
বাঁধগাঁয়ে এখন কারও ঘরে আর পয়সা জমা থাকার জো নাই। চালের বাতায় গুঁজে রাখা এক টাকা-দুই টাকার নোট, মেলা থেকে শখ করে কিনে আনা পয়সা জমানোর রং-মাটির ব্যাংক, বাঁশের খুঁটিতে ফোকর বানিয়ে জমানো পয়সা—সব চলে যেতে থাকে রশিদের দোকানে। যেসব জিনিস ছাড়া আগে দিব্যি দিন কেটে যেত তাদের, সেসব ছাড়া এখন চলেই না।
গাঁয়ে কোম্পানির মেয়ে-মদ্দ আসার বিরাম নাই। এবার তারা এসেছে নতুন এক তত্ত্ব নিয়ে। এই যে এত দিন ধরে বাঁধগাঁয়ের মানুষ দাঁত মাজছে কাঠকয়লা আর ঘুঁটের ছাই দিয়ে, এটা আদৌ ঠিক না। ঘুঁটে মানে তো গোবরই। সেই গোবর মুখে তোলা! তাদের কথা শুনে গাঁয়ের মানুষ এ-ওর মুখের দিকে তাকায়। তাই তো!
এখন কী করতে হবে?
এত দিন যা হওয়ার হয়েছে। এবার থেকে দাঁত মাজতে হবে ব্রাশ আর টুথপেস্ট দিয়ে। এবারও একটা করে ব্রাশ আর একটা মিনিপ্যাক টুথপেস্ট ফ্রি।
এক বছরের মধ্যেই বাঁধগাঁয়ের চেহারা পাল্টে যায়। রশিদের দোকানের জৌলুস বাড়ে আর গাঁয়ের মেয়েদের চেহারায় জৌলুসও কিছুটা বাড়ে। কিন্তু অশান্তি কেন এত! চালের হাঁড়িতে কোনো কোনো দিন চাল কম পড়ে। হঠাৎ রোগ-ব্যাধি হলে তার ওষুধ জোটানো কঠিন হয়ে পড়ে। কেউ বুঝতে পারে না যে তাদের খরচ বেড়ে গেছে, কিন্তু উপার্জন আছে আগের মতোই। গাঁয়ের মধ্যে কোনো চুরি-চামারি ছিল না। এখন গাঁয়ে তো চুরি হচ্ছেই, আশপাশের গ্রামগুলোতে ছিঁচকে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ছে বাঁধগাঁয়ের মানুষ। মেয়েরা গেরস্ত বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে ছোঁক ছোঁক করে। সুযোগমতো টাকা হাতড়ায়। টাকা না পেলে অন্য জিনিস। ধরা পড়ে যথারীতি। চোরের দশদিন তো গেরস্তের একদিন! উত্তমমধ্যম খায়। তাড়িয়ে দেয় কাজ থেকে। এক বছরেই অবস্থা এমন যে বাঁধগাঁয়ের মানুষকে আর কাজ দিতে চায় না কেউ।
বাঁশঝাড়ের ছায়ায় একসঙ্গে বসে পুরুষেরা আলোচনা করে, ‘এসব কী ঘটছে?’ কিন্তু উত্তর পায় না কেউ। তারা দুপুরে আলোচনা করে। সন্ধ্যায় আলোচনা করে। রাতে আলোচনা করে। দুজনে আলোচনা করে। চারজনে আলোচনা করে। দশজনে আলোচনা করে। দলবেঁধে আলোচনা করে। কিন্তু উত্তর খুঁজে পায় না। উপায় খুঁজে পায় না। তারা বিরসমুখে ঘরের দিকে ফিরে যায়। শ্যাম্পুর সুবাস ছড়ানো বউয়ের শরীর তাদের উচ্ছ্বসিত করে না। পেস্ট দিয়ে দাঁত মেজে আসা বউ তাদের দিকে ঠোঁট এগিয়ে দেয়। কিন্তু তারা বিড়ির গন্ধঅলা মুখ দিয়ে স্বাগত জানায় না সেই ঠোঁট। তারা শুধু বিষণ্ন হতে থাকে, নির্জীব হতে থাকে। রাতে ঘুম ভালো হয় না তাদের। ভোর হতেই আবার গিয়ে বসে বাঁশতলায়। মনে আশা, কেউ যদি সমাধানের কোনো সূত্র নিয়ে উপস্থিত হতে পারে! কিন্তু ভোরের পর ভোর কেটে যায়। দিনের পর দিন কেটে যায়। কোনো সমাধান হয় না।
হঠাৎ-ই এক রাতে একরাম সাঁইয়ের গলার গান শোনা যায়। ‘বাউল আইছে! এইবার একখান সমাধান পাওয়া যাইবার পারে।’—গাঁয়ের অর্ধেক পুরুষ উত্তেজিত হয়ে বিছানায় উঠে বসে। রাত বেশি হয়নি। তারা ঘর থেকে বেরিয়ে একরাম সাঁইয়ের ঘরের দিকে যায়। মোবারক সেখানে পৌঁছে দেখতে পায়, অন্তত তিরিশজন মানুষ উপস্থিত। কিন্তু সাঁই তার ঘরে নাই। তাহলে এই অমাবস্যা রাতে কে গান গাইল তাদের গাঁয়ের পথে? তারা হতাশ হয়ে ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ করে নিজ নিজ ঘরে।
কিন্তু হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে জামিরুল বুড়া, ‘পাইছি! শত্তুররে খুঁইজা পাইছি।’
এই বাঁধে আসার আগে জামিরুল বুড়া নিজের গ্রামে ছিল মোড়লস্থানীয় মানুষ। চলাফেরা, কথাবার্তার মধ্যে এখনো কিছুটা সেই ছাপ রয়ে গেছে। তাই কখনো কখনো কর্তৃত্বব্যঞ্জক আচরণই করে ফেলে সে। এই মুহূর্তে সবাই তার কর্তৃত্ব মেনেও নেয়। জানতে চায়, ‘কও মোড়ল, কে সেই শত্তুর?’
মোড়ল এমনভাবে বিড়বিড় করে বলে যাতে সবাই শুনতে পায়, সাঁই তো এক বচ্ছর আগেই কইয়া গেছিল শত্তুরের কথা। সুতানাগ।’
‘সুতানাগ?’
মুহূর্তে অন্যরাও বুঝে ফেলে শব্দটার তাৎপর্য, ‘ওরে! এ যে সেই মিনিপ্যাক! রশিদের দোকান!’
লাঠিসোঁটা-শাবল হাতে জনা তিরিশেক ক্রুদ্ধ মানুষ অন্ধকারেই জোরপায়ে হেঁটে চলে উত্তরখান্দারের দিকে। আজ তারা রশিদের দোকানের চিহ্ন রাখবে না।
তারা উত্তেজিত।
কিছুটা হিংস্রও।
তাদের জীবনে অশান্তি ডেকে আনা, অভাবের মধ্যে আরও অভাব ডেকে আনা এই দোকান আজ তারা উচ্ছেদ করবেই।
অন্ধকারে বারবার হোঁচট খেতে হচ্ছে। ব্যথাও লাগছে। কিন্তু কেউই কঁকিয়ে উঠছে না। কেউই ফিরে যাওয়ার নাম করছে না।
তবে তারা এই উত্তেজনার মধ্যেও একটু অবাক হয়েই খেয়াল করে যে তারা যত উত্তরখান্দারের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, ততই ফিকে হয়ে আসছে অন্ধকার। ব্যাপারটা কী? ওই দিকে কি চাঁদ উঠেছে নাকি বিজলি বাতি জ্বলেছে?
রশিদের দোকানের সামনে পৌঁছে ক্রুদ্ধ মানুষগুলো হতবাক হয়ে যায়। আলোয় আলোময় চারপাশ। সেই আলোর নিচে ঝিকমিক করে হেসে চলেছে রশিদের দোকানের নতুন টিনের চালা, টিনের বেড়া। বেড়ার গায়ে গায়ে অপ্সরীর মতো মুম্বাই নায়িকাদের ফটো। তারা একেকজন একেকটা মিনিপ্যাক নিয়ে মোহনীয় আহ্বানের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। যেন মিনিপ্যাক কিনলেই সঙ্গে সঙ্গে তাকে পাওয়া যাবে।
কিন্তু এত আলো কোত্থেকে এল! রশিদের দোকানের মাথার ওপর খোপকাটা একটা বড় প্যানেল। সৌরবিদ্যুৎ।
এত আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া মানুষগুলো নিজেদের ভবিষ্যৎ বুঝে ফেলে। তাদের হাতের ভোঁতা হাতিয়ারগুলো ভারী হয়ে আসে। হাত থেকে খসে পড়তে চায়। তারা বুঝে যায়, রশিদ আসলে রশিদ নয়। রশিদ হচ্ছে কোম্পানির হাত। আর কোম্পানির দোকান উচ্ছেদ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয় কোনোদিন।
বলে বটে, কিন্তু ঘরে ঠিকই আসে। বউকে কোলের মধ্যে টেনে নিতে গিয়ে অদ্ভুত মাদকতাময় একটা সুবাস পায় মোবারক। বউয়ের চুল থেকেই বেশি আসছে সুবাস। শরীরেও সুবাস।
নিজেকে সুস্থির করার পরে মোবারক প্রশ্ন করে, ‘কী লাগাইছস সাজু?’
সাজেদা এবার আর রহস্য রাখে না। বলে, ‘শ্যাম্পু লাগাইছি চুলে। খুব ভালো হইছে না?’
‘শ্যাম্পু!’—চোখ বড় বড় হয়ে যায় মোবারকের, ‘কই পাইলি এত ট্যাকা? শ্যাম্পুর দাম কত জানস?’
বউ তুড়ি মারার ভঙ্গিতে বলে, ‘কত আর। তিন ট্যাকা।’
‘তিন ট্যাকায় শ্যাম্পু হয়? আমি তো জানি এক বোতল শ্যাম্পুর দাম চার-পাঁচ শ ট্যাকা।’
‘দূর পাগল। অত ট্যাকা আমরা পামু কই! তিন ট্যাকাই। মিনি প্যাক কয় এইডারে।’
‘কিন্তু পাইলি কই? তুই কি গঞ্জে গেছিলি?’
‘না। উত্তরখান্দারে দোকান করছে না রশিদ মিয়া!’
এই খবরটাও নতুন মোবারকের কাছে। এখানে যে কেউ দোকান দিয়ে বসতে পারে, সেটাই তো ভাবেনি কোনোদিন সে। এই বাঁধের ওপর ঘরহারা মানুষের ঘরের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এখন দুই শ ঘরের কাছাকাছি। আদমশুমারি হয়নি। কিন্তু অনেক বছর থেকে এই বাঁধে মানুষ আসছে, থাকছে। স্থায়ীভাবে থাকছে। এই অঞ্চলের মানুষের কাছে তাই এটার নামই হয়ে গেছে বাঁধগাঁ। বিদ্যুতের আলোর প্রশ্নই আসে না। বাঁধগাঁয়ের মানুষের নাম ভোটার তালিকায় ওঠেনি। সেই কারণে কোনো নেতা-পাতিনেতার গরজ নাই বাঁধগাঁ নিয়ে। এতগুলান মানুষের বাচ্চা, তারা কী খায় কীভাবে বাঁচে, কেউ কোনোদিন উঁকি মেরেও দেখতে আসেনি। পুলিশ এসেছে মাঝেমধ্যে। আশপাশের গাঁয়ে চুরির হিড়িক বেড়ে গেলে লোকেরা বাঁধগাঁয়ের ওপর দোষ চাপায়। এনজিওর লোক আসে। ক্ষুদ্রঋণের দাদন ব্যবসা এখানেও ছড়িয়ে পড়েছে। কিস্তির টাকা তুলতে আসতে হয় তাদের। সবচেয়ে পাশের গ্রাম থেকেও কমপক্ষে এক মাইল উত্তরে বাঁধগাঁ। তার উত্তরে নদীর বালু। নদী এখন অনেকটা দূরে। পয়োস্তি জমিতে ধানচাষ হয়, আলু হয়, খুব বড় জাতের রসুন হয়। ফসলের মাঠের দিকে তাকিয়ে বাঁধগাঁয়ের কোনো কোনো মানুষ নিজের হারানো আবাদি জমির কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তবে বেশির ভাগেরই সেসব চিন্তার বালাই নাই। তারা খাটতে যায়—হয় অন্যের জমিতে, নয়তো কারও দোকানে। কেউ গঞ্জে ভ্যান চালায়, কুলির কাজ করে। মেয়েরা, বিশেষ করে মাঝবয়সী আর বালিকারা আশপাশের গ্রামের সম্পন্ন বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে। বিদ্যুৎ নাই। টেলিভিশন থাকার প্রশ্নই ওঠে না বাঁধগাঁয়ে। ব্যাটারি দিয়ে টিভি চালাবে এমন পয়সাঅলাও কেউ নাই বাঁধগাঁয়ে। তবে টিভি দেখা হয়ে যায় অনেকেরই। পুরুষেরা তো গঞ্জের দোকানে-দোকানে দেখে। মেয়েরাও, যারা ঝিয়ের কাজ করতে যায়, তারাও টিভি দেখার অভ্যেস করে ফেলেছে। বাঁধগাঁয়ের পুরুষ-নারী—সবাই একই কথা ভাবে, ‘টেলিভিশনের ব্যাডা-মাইয়ারা অত সোন্দর হয় কেমন কইরা! আল্লাহ কী আলাদা ছঞ্চ দিয়া বানাইছে অগো।’ বাঁধগাঁয়ের মেয়েরাও সাজে। বিকেলে মেয়েরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে একজন আরেকজনের চুলে নারকোল তেল মাখায়, পরস্পরের বেণি-খোঁপা বেঁধে দেয়। মা–দাদিদের আমল থেকে তারা নানান নামের তেল-স্নো চেনে, পাউডার চেনে, আলতা চেনে।
শ্যাম্পু চিনে ফেলার কথা আজই প্রথম শুনল মোবারক। নিজে সে চেনে ওই জিনিস। গঞ্জে-বাজারে যারা কাজ করতে যায়, তারা সবাই-ই চেনে। কিন্তু কেউ কোনোদিন নিজেদের বাড়িতে ওই রকম কোনো জিনিস আনেনি। পোলাপানদের নিয়ে ভাত-সালুনের ব্যবস্থা করতে করতেই ফাট ফাট, ওই সব জিনিস যাতে কোনো মাইয়ার চোখে না পড়ে, সেদিকেই বরং তাদের নজর ছিল বেশি।
কিন্তু পড়ে তো গেলই।
পরদিন রশিদের দোকান দেখতে গেল মোবারক। টিনের বেড়ার ঘের দেওয়া টিনেরই চালার ঘর। কিন্তু জিনিসপত্রে ঠাসা। আর সাজানের কায়দাও খুব সুন্দর। সব জিনিস যেন খদ্দেরের চোখের সামনে দেখা যায়, গঞ্জের মোল্লা স্টোরের মতো। তার মতো অনেকেই দোকান দেখতে এসেছে। এই সকালবেলাতেও খদ্দের আসা শুরু হয়ে গেছে। কেউ কেউ বউয়ের জন্য কিনছে মিনিপ্যাক। কোনো কোনো ঘর থেকে মেয়েরাও এসেছে কিনতে। বাঁধগাঁয়ে পুরুষের সামনে নারীদের শরম পাওয়ার কোনো অবকাশ নাই। সব গায়ে গা লাগিয়ে থাকতে হয়। কিন্তু এখানে জিনিস কিনতে এসে কারও কারও মুখে একটু সলজ্জ হাসি। দোকানে বেশিক্ষণ কাটানো যায় না। কাজের সন্ধানে বেরোতে হবে মোবারকদের। তাই তারা উঠে পড়ে। একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল মোবারকের মাথায়, রশিদ এত পুঁজি পেল কোথায়? সমিতি থেকে লোন নিয়েছে? এত টাকা লোন দেয় সমিতি? ছিরু মিয়া ভেতরের খোঁজ বের করার ওস্তাদ। সে জানায়, ‘লোন-ফোন কিচ্ছু না। যারা মাল তৈরি করে, সেই কম্পানির লোকেরা বাকিতে মাল দিয়ে যায় রশিদকে। বিক্রি হওয়ার পরে টাকা নেয়। রশিদের লাভ লাভই থাকে। কোনো পুঁজিই লাগে না। এমনকি দোকান বানিয়ে দেওয়া, র্যাক এনে মালামাল সাজিয়ে দেওয়ার কাজও করেছে কম্পানির লোকেরা।’
আহা এমন একটা কোম্পানি যদি মোবারকের দিকে একবার তাকাত!
কয়েক দিন পরেই বাঁধগাঁয়ে একদল মেয়ে-মদ্দ এসে হাজির। তিন দিন পরে নাকি বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস। তারা এসেছে কোম্পানির তরফ থেকে মানুষকে হাত ধোয়া শেখাতে। গাঁয়ের মানুষ শুনে প্রথমে হাসে। কিন্তু কিছুক্ষণ ওদের কথা শোনার পরেই তারা বুঝতে পারে, এত দিন কী বাজে অভ্যেস লালন করে এসেছে তারা! ছুঁচে এসে মাটিতে হাত ঘষে পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলে। এতে নাকি অনেক ক্ষতি। হাতে তো জীবাণু থাকেই, মাটির জীবাণুও যোগ হয় তার সঙ্গে। ফলে পেটের অসুখ সারা বছর সঙ্গী।
তাই তো! বাঁধগাঁয়ের সব পোলাপানই তো সারা বছর পেটরোগা।
হাত মাইটানির বদলে এখন থেকে হাত ধুতে হবে হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে। তা না পেলে সাবান। প্রথমে বিনা পয়সায় জনপ্রতি একটা করে মিনি সাবান ফ্রি দিয়ে যাচ্ছে কোম্পানির লোকেরা। গাঁয়ের লোক ব্যবহার করেই দেখুক। হাতে হাতে ফল পাবে তারা।
হাত ধোয়া দিবসের পরের দিন গাঁয়ে আসে একরাম সাঁই। সে কবে কখন গাঁয়ে আসে ঠিক নাই। আসে, কয়েক দিন থাকে, গাঁ-পড়িশদের গান শোনায়, গল্প শোনায়, আবার চলে যায়। বাঁধগাঁয়ের মানুষ ভক্তি করার মতো একজনকেই চেনে। ভক্তি নিয়ে কথা শোনে। কিন্তু একরাম সাঁইয়ের সব কথা বুঝতে তারা পারে না। সাঁইও রহস্য ভেঙে বলে না সবকিছু।
এবার গাঁয়ে এসে মিনিপ্যাকের কথা শুনেছে সাঁই। কিংবা শুনেই হয়তো এসেছে গাঁয়ে। তার ভিটায় গল্পের আসর সন্ধের পরে।
‘মনসার তো খুব জেদ। সেই রকম জেদ চাঁদ সদাগরের। মনসা কয়, চাঁদ তোরে আমি নিব্বংশ করমু। চাঁদ কয়, তরে সামনে পাইলে আমি জিগার ওলা দিয়া পিডাইয়া ঠ্যাং ভাঙমু। চাঁদ সদাগরের সাতপুত্রের মইদ্যে ছয়পুত্র ডুইবা মরছে মনসার কোপে। বাকি আছে লখিন্দর। লখাই। তারও মরণ নিশ্চিত। তাই পুত্রের বিয়া দেওনের সময় সদাগর কোনো মাইয়া খুঁইজা পায় না। কোনো বাপ-মায় মাইয়া দিবার চায় না। জাইনা-শুইনা কে বিধবা বানাইবার চায় নিজের মাইয়ারে। কিন্তুক রাজি হয় বেহুলা। রাজি হয় বেহুলার মা-বাপ। এই তত্ত্ব শুইনা মনসা কয়, বিয়া হইব অগো কিন্তু বাসর হইব না। চাঁদ সদাগর লোহার বাসরঘর বানায়। কিন্তু মনসার চরেরা গোপনে সেই দেয়ালে একটা কাঠি রাইখা যায়। তাই লোহা ঢালাই হইলেও একচুল ফাঁক থাইকা যায় একদিকের দেয়ালেত। বাসর রাইতে মনসা একে একে ডাকে কালনাগরে, আজদাহারে, গোক্ষুররে, শীশনাগরে। কিন্তু কেউ ঢুকবার পারে না বাসরঘরে। তখন ডাক পড়ে সুতানাগের। তারপরের কাহিনি তো তোমরা সক্কলেই জানো।’
এই পর্যন্ত বলেই উঠে পড়ে একরাম সাঁই।
বাঁধগাঁয়ে এখন কারও ঘরে আর পয়সা জমা থাকার জো নাই। চালের বাতায় গুঁজে রাখা এক টাকা-দুই টাকার নোট, মেলা থেকে শখ করে কিনে আনা পয়সা জমানোর রং-মাটির ব্যাংক, বাঁশের খুঁটিতে ফোকর বানিয়ে জমানো পয়সা—সব চলে যেতে থাকে রশিদের দোকানে। যেসব জিনিস ছাড়া আগে দিব্যি দিন কেটে যেত তাদের, সেসব ছাড়া এখন চলেই না।
গাঁয়ে কোম্পানির মেয়ে-মদ্দ আসার বিরাম নাই। এবার তারা এসেছে নতুন এক তত্ত্ব নিয়ে। এই যে এত দিন ধরে বাঁধগাঁয়ের মানুষ দাঁত মাজছে কাঠকয়লা আর ঘুঁটের ছাই দিয়ে, এটা আদৌ ঠিক না। ঘুঁটে মানে তো গোবরই। সেই গোবর মুখে তোলা! তাদের কথা শুনে গাঁয়ের মানুষ এ-ওর মুখের দিকে তাকায়। তাই তো!
এখন কী করতে হবে?
এত দিন যা হওয়ার হয়েছে। এবার থেকে দাঁত মাজতে হবে ব্রাশ আর টুথপেস্ট দিয়ে। এবারও একটা করে ব্রাশ আর একটা মিনিপ্যাক টুথপেস্ট ফ্রি।
এক বছরের মধ্যেই বাঁধগাঁয়ের চেহারা পাল্টে যায়। রশিদের দোকানের জৌলুস বাড়ে আর গাঁয়ের মেয়েদের চেহারায় জৌলুসও কিছুটা বাড়ে। কিন্তু অশান্তি কেন এত! চালের হাঁড়িতে কোনো কোনো দিন চাল কম পড়ে। হঠাৎ রোগ-ব্যাধি হলে তার ওষুধ জোটানো কঠিন হয়ে পড়ে। কেউ বুঝতে পারে না যে তাদের খরচ বেড়ে গেছে, কিন্তু উপার্জন আছে আগের মতোই। গাঁয়ের মধ্যে কোনো চুরি-চামারি ছিল না। এখন গাঁয়ে তো চুরি হচ্ছেই, আশপাশের গ্রামগুলোতে ছিঁচকে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ছে বাঁধগাঁয়ের মানুষ। মেয়েরা গেরস্ত বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে ছোঁক ছোঁক করে। সুযোগমতো টাকা হাতড়ায়। টাকা না পেলে অন্য জিনিস। ধরা পড়ে যথারীতি। চোরের দশদিন তো গেরস্তের একদিন! উত্তমমধ্যম খায়। তাড়িয়ে দেয় কাজ থেকে। এক বছরেই অবস্থা এমন যে বাঁধগাঁয়ের মানুষকে আর কাজ দিতে চায় না কেউ।
বাঁশঝাড়ের ছায়ায় একসঙ্গে বসে পুরুষেরা আলোচনা করে, ‘এসব কী ঘটছে?’ কিন্তু উত্তর পায় না কেউ। তারা দুপুরে আলোচনা করে। সন্ধ্যায় আলোচনা করে। রাতে আলোচনা করে। দুজনে আলোচনা করে। চারজনে আলোচনা করে। দশজনে আলোচনা করে। দলবেঁধে আলোচনা করে। কিন্তু উত্তর খুঁজে পায় না। উপায় খুঁজে পায় না। তারা বিরসমুখে ঘরের দিকে ফিরে যায়। শ্যাম্পুর সুবাস ছড়ানো বউয়ের শরীর তাদের উচ্ছ্বসিত করে না। পেস্ট দিয়ে দাঁত মেজে আসা বউ তাদের দিকে ঠোঁট এগিয়ে দেয়। কিন্তু তারা বিড়ির গন্ধঅলা মুখ দিয়ে স্বাগত জানায় না সেই ঠোঁট। তারা শুধু বিষণ্ন হতে থাকে, নির্জীব হতে থাকে। রাতে ঘুম ভালো হয় না তাদের। ভোর হতেই আবার গিয়ে বসে বাঁশতলায়। মনে আশা, কেউ যদি সমাধানের কোনো সূত্র নিয়ে উপস্থিত হতে পারে! কিন্তু ভোরের পর ভোর কেটে যায়। দিনের পর দিন কেটে যায়। কোনো সমাধান হয় না।
হঠাৎ-ই এক রাতে একরাম সাঁইয়ের গলার গান শোনা যায়। ‘বাউল আইছে! এইবার একখান সমাধান পাওয়া যাইবার পারে।’—গাঁয়ের অর্ধেক পুরুষ উত্তেজিত হয়ে বিছানায় উঠে বসে। রাত বেশি হয়নি। তারা ঘর থেকে বেরিয়ে একরাম সাঁইয়ের ঘরের দিকে যায়। মোবারক সেখানে পৌঁছে দেখতে পায়, অন্তত তিরিশজন মানুষ উপস্থিত। কিন্তু সাঁই তার ঘরে নাই। তাহলে এই অমাবস্যা রাতে কে গান গাইল তাদের গাঁয়ের পথে? তারা হতাশ হয়ে ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ করে নিজ নিজ ঘরে।
কিন্তু হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে জামিরুল বুড়া, ‘পাইছি! শত্তুররে খুঁইজা পাইছি।’
এই বাঁধে আসার আগে জামিরুল বুড়া নিজের গ্রামে ছিল মোড়লস্থানীয় মানুষ। চলাফেরা, কথাবার্তার মধ্যে এখনো কিছুটা সেই ছাপ রয়ে গেছে। তাই কখনো কখনো কর্তৃত্বব্যঞ্জক আচরণই করে ফেলে সে। এই মুহূর্তে সবাই তার কর্তৃত্ব মেনেও নেয়। জানতে চায়, ‘কও মোড়ল, কে সেই শত্তুর?’
মোড়ল এমনভাবে বিড়বিড় করে বলে যাতে সবাই শুনতে পায়, সাঁই তো এক বচ্ছর আগেই কইয়া গেছিল শত্তুরের কথা। সুতানাগ।’
‘সুতানাগ?’
মুহূর্তে অন্যরাও বুঝে ফেলে শব্দটার তাৎপর্য, ‘ওরে! এ যে সেই মিনিপ্যাক! রশিদের দোকান!’
লাঠিসোঁটা-শাবল হাতে জনা তিরিশেক ক্রুদ্ধ মানুষ অন্ধকারেই জোরপায়ে হেঁটে চলে উত্তরখান্দারের দিকে। আজ তারা রশিদের দোকানের চিহ্ন রাখবে না।
তারা উত্তেজিত।
কিছুটা হিংস্রও।
তাদের জীবনে অশান্তি ডেকে আনা, অভাবের মধ্যে আরও অভাব ডেকে আনা এই দোকান আজ তারা উচ্ছেদ করবেই।
অন্ধকারে বারবার হোঁচট খেতে হচ্ছে। ব্যথাও লাগছে। কিন্তু কেউই কঁকিয়ে উঠছে না। কেউই ফিরে যাওয়ার নাম করছে না।
তবে তারা এই উত্তেজনার মধ্যেও একটু অবাক হয়েই খেয়াল করে যে তারা যত উত্তরখান্দারের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, ততই ফিকে হয়ে আসছে অন্ধকার। ব্যাপারটা কী? ওই দিকে কি চাঁদ উঠেছে নাকি বিজলি বাতি জ্বলেছে?
রশিদের দোকানের সামনে পৌঁছে ক্রুদ্ধ মানুষগুলো হতবাক হয়ে যায়। আলোয় আলোময় চারপাশ। সেই আলোর নিচে ঝিকমিক করে হেসে চলেছে রশিদের দোকানের নতুন টিনের চালা, টিনের বেড়া। বেড়ার গায়ে গায়ে অপ্সরীর মতো মুম্বাই নায়িকাদের ফটো। তারা একেকজন একেকটা মিনিপ্যাক নিয়ে মোহনীয় আহ্বানের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। যেন মিনিপ্যাক কিনলেই সঙ্গে সঙ্গে তাকে পাওয়া যাবে।
কিন্তু এত আলো কোত্থেকে এল! রশিদের দোকানের মাথার ওপর খোপকাটা একটা বড় প্যানেল। সৌরবিদ্যুৎ।
এত আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া মানুষগুলো নিজেদের ভবিষ্যৎ বুঝে ফেলে। তাদের হাতের ভোঁতা হাতিয়ারগুলো ভারী হয়ে আসে। হাত থেকে খসে পড়তে চায়। তারা বুঝে যায়, রশিদ আসলে রশিদ নয়। রশিদ হচ্ছে কোম্পানির হাত। আর কোম্পানির দোকান উচ্ছেদ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয় কোনোদিন।
No comments