শীর্ষ ২০০ ঋণখেলাপির কাছে জিম্মি চার সরকারি ব্যাংক by দেলোয়ার হুসেন
রাষ্ট্রায়ত্ত
চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংক জিম্মি হয়ে পড়েছে ২শ’ শীর্ষ ঋণ খেলাপির কাছে।
প্রতিটি ব্যাংকে শীর্ষ খেলাপির সংখ্যা ৫০। ব্যাংক চারটির মোট খেলাপি ঋণের
প্রায় ৭৩ শতাংশই আটকে আছে এসব শীর্ষ খেলাপির হাতে। চার ব্যাংকের মোট খেলাপি
ঋণের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে শীর্ষ ২শ’ খেলাপির
কাছে আটকে আছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। অবলোপন বা রাইটঅফ করা ঋণসহ এর
পরিমাণ আরও বেশি হবে। এসব ঋণ আদায়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নির্দেশনা
থাকলেও ব্যাংকগুলো খুব বেশি টাকা আদায় করতে পারছে না। অন্য খেলাপিদের কাছে
আটকে আছে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা- যা তাদের মোট খেলাপি ঋণের ২৭ শতাংশ।
সূত্র জানায়, গত বছরের শেষ দিকে সরকারি ব্যাংকগুলো ব্যাপক হারে খেলাপি ঋণ নবায়ন করায় তাদের অনেক পুরনো খেলাপি গ্রাহক এখন নিয়মিত হয়ে গেছে। নতুন করে জালিয়াতি শনাক্ত হওয়ার পর অনেকেই শীর্ষ খেলাপির তালিকায় ঢুকেছেন। এদের মধ্যে বহুল আলোচিত হলমার্ক গ্রুপ সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ তালিকায় চলে এসেছে। জনতা ব্যাংকের শীর্ষ তালিকায় স্থান পেয়েছে বহুল আলোচিত অপর জালিয়াতির নায়ক বিসমিল্লাহ গ্রুপ। অগ্রণী ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপির তালিকায় স্থান করে নিয়েছে আরও একটি আলোচিত গ্রুপ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে ব্যাংকগুলো এখন শীর্ষ ২০ খেলাপির পাশাপাশি শীর্ষ ৫০ খেলাপিকেও বিশেষভাবে তদারকি করছে। কিন্তু এদের কাছ থেকে ঋণ আদায় হচ্ছে অনেক কম। কোনো ব্যাংকই গত বছর এ খাতে ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদের বড় ছাড় দেয়া বন্ধ হলেই খেলাপি ঋণ সংস্কৃতি কমে যাবে। খেলাপি হলেই বড় বড় ছাড় পাওয়া যাচ্ছে, এই ধারণা থেকে অনেকেই ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হচ্ছে।
খেলাপি ঋণ বাড়াচ্ছে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় : কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সরকারি চারটি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের চার ভাগের তিন ভাগই আটকে রয়েছে শীর্ষ ২শ’ খেলাপির কাছে। এসব ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়েছে। ফলে ১২ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণের বিপরীতে আরও ১২ হাজার কোটি টাকা আটকে আছে। এই দুটি খাত মিলে চার ব্যাংকের আটকে রয়েছে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে ব্যাংকগুলোকে এসব ঋণের বিপরীতে আরোপিত সুদ স্থগিত রাখতে হচ্ছে। এগুলো আদায় হচ্ছে না বলে আয় খাতে নিতে পারছে না। চার ব্যাংকের স্থগিত সুদের পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। এর সিংহ ভাগই রয়েছে শীর্ষ ২শ’ খেলাপির কাছে। এ আয় থেকেও বঞ্ছিত হচ্ছে ব্যাংকগুলো। ফলে ১২ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রকৃত অর্থে আটকে আছে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
এছাড়া এসব ঋণ আদায়ে আলাদা ব্যবস্থাপনা, মামলা দায়ের এসব মিলে ব্যাংকগুলোর আরও বাড়তি টাকা খরচ হচ্ছে। ফলে বাড়িয়ে দিচ্ছে তাদের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়। চারটি ব্যাংকেরই তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় ৯ থেকে ১১ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। বাড়তি তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের কারণে তারা ঋণের সুদের হার কমাতে পারছে না। আর ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণই তহবিল ব্যবস্থাপনা বাড়িয়ে দিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে। এতে করে ভালো ও নতুন গ্রহীতাদেরকেও ঋণের বিপরীতে চড়া সুদ গুনতে হচ্ছে।
খেলাপিদের কাছে জিম্মি চার ব্যাংক : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত (সরকারি বেসরকারি সব ব্যাংক) ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। এর ২৪ শতাংশই আটকে রয়েছে শীর্ষ ২শ’ খেলাপির কাছে। অর্থাৎ মোট খেলাপি ঋণের চার ভাগের এক ভাগ রয়েছে তাদের কাছে।
ওই সময় পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮ হাজার ২২৪ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে শীর্ষ ৫০ খেলাপির কাছে পাওনা রয়েছে ৫ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা- যা তাদের মোট খেলাপি ঋণের সাড়ে ৬৭ শতাংশ।
সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপিদের মধ্যে শুধু হলমার্ক গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছে পাওনা রয়েছে ২ হাজার ১২২ কোটি টাকার বেশি। হলমার্কের মূল প্রতিষ্ঠানের কাছে ১ হাজার ৭১০ কোটি টাকা এবং তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান টিএম ব্রাদার্সের কাছে ৪১২ কোটি টাকা। হলমার্ক জালিয়াতির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের শেরাটন হোটেল শাখা থেকে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ওই ঋণ খেলাপি হওয়ার পর গত বছর তারা ব্যাংকের শীর্ষ ঋণ খেলাপির তালিকায় চলে এসেছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি শীর্ষ ২০ খেলাপির মধ্যেও রয়েছে। তাদের কাছ থেকে ব্যাংক এখনও কোনো ঋণ আদায় করতে পারছে না। ফলে পুরো ঋণের বিপরীতে এখন শতভাগ প্রভিশন রাখতে হচ্ছে।
এছাড়া ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপির তালিকায় আরও আছে জিএমজি গ্রুপ। তাদের কাছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৬৬ কোটি টাকা। মুন্নু ফেব্রিক্সের কাছে ১৬৫ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। এছাড়া রহমান গ্রুপ, অলটেক্স গ্রুপ ও ইমাম গ্রুপের নামও ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপির তালিকায় রয়েছে।
এদিকে ব্যাংক গত বছর সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছ থেকে ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ৩০১ কোটি টাকা। আদায় করেছে মাত্র ৭৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা- যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ২৫ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রদীপ কুমার দত্ত যুগান্তরকে বলেন, বড় খেলাপিদের মধ্যে যাদের ঋণ আদায় হচ্ছে না, তাদের কাছ থেকে আদায়ের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার আলোকে এ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তবে অন্য খেলাপিদের কাছ থেকে ঋণ আদায় বেড়েছে।
অগ্রণী ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৭০৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে শীর্ষ ৫০ খেলাপির কাছে পাওনা রয়েছে ২ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা- যা তাদের মোট খেলাপি ঋণের সাড়ে ৭৬ শতাংশ। শীর্ষ খেলাপিদের মধ্যে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির দায়ে অভিযুক্ত ঢাকার একটি বহুল আলোচিত গ্র“প রয়েছে। এদের কাছে ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ ১৬০ কোটি টাকা। চট্টগ্রামকেন্দ্রিক নূরজাহান গ্র“পের কাছে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৫০ কোটি টাকা। প্যারাগন গ্র“পের কাছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১২০ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের এমডি সৈয়দ আবদুল হামিদ যুগান্তরকে বলেন, অনেকে মনে করেন ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে আর ফেরত দিতে হয় না। ফলে তারা ঋণ নেয়ার পর ব্যাংকমুখী হন না। ঋণ আদায়ের জন্য আমাদেরই দৌড়ঝাঁপ করতে হয়।
জনতা ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে শীর্ষ ৫০ খেলাপির কাছে তাদের পাওনা রয়েছে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা- যা তাদের মোট খেলাপি ঋণের ৮৫ দশমিক ২১ শতাংশ। ব্যাংক গত বছর শীর্ষ খেলাপির কাছ থেকে ১২০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে মাত্র ৩০ কোটি টাকা- যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ২৫ শতাংশ।
জনতা ব্যাংকসহ চারটি ব্যাংক থেকে বিসমিল্লাহ গ্র“প প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি হাতিয়ে নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। এখন তাদের ঋণ শীর্ষ খেলাপির তালিকায় চলে এসেছে। এছাড়া রূপালী ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ২৩৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে শীর্ষ ৫০ খেলাপির কাছে পাওনা রয়েছে ৮০০ কোটি টাকা- যা তাদের মোট ঋণের ৬৪ দশমিক ৭০ শতাংশ।
তদারকি জোরদার : শীর্ষ ২০ ও শীর্ষ ৫০ খেলাপির কাছ থেকে ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোকে জোরালো পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালায় বিশেষ ছাড় দেয়া হয়েছে। গত এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে চার সরকারি ব্যাংকে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আবার বেড়ে গেছে। খেলাপি ঋণ যাতে না বাড়ে সে বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে নতুন ঋণ দেয়ার সময়ে ঋণ গ্রহীতার সক্ষমতাকে বিবেচনায় নিতে বলা হয়েছে।
একাধিকবার নবায়ন করা ঋণের বিপরীতে তদারকি বাড়িয়ে ওইসব ঋণ আদায় করার জন্য ব্যাংকগুলোকে সর্বশক্তি নিয়োগের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই ঋণ বারবার নবায়নের সুযোগ কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর অনুমোদন করবে না।
সূত্র জানায়, গত বছরের শেষ দিকে সরকারি ব্যাংকগুলো ব্যাপক হারে খেলাপি ঋণ নবায়ন করায় তাদের অনেক পুরনো খেলাপি গ্রাহক এখন নিয়মিত হয়ে গেছে। নতুন করে জালিয়াতি শনাক্ত হওয়ার পর অনেকেই শীর্ষ খেলাপির তালিকায় ঢুকেছেন। এদের মধ্যে বহুল আলোচিত হলমার্ক গ্রুপ সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ তালিকায় চলে এসেছে। জনতা ব্যাংকের শীর্ষ তালিকায় স্থান পেয়েছে বহুল আলোচিত অপর জালিয়াতির নায়ক বিসমিল্লাহ গ্রুপ। অগ্রণী ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপির তালিকায় স্থান করে নিয়েছে আরও একটি আলোচিত গ্রুপ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে ব্যাংকগুলো এখন শীর্ষ ২০ খেলাপির পাশাপাশি শীর্ষ ৫০ খেলাপিকেও বিশেষভাবে তদারকি করছে। কিন্তু এদের কাছ থেকে ঋণ আদায় হচ্ছে অনেক কম। কোনো ব্যাংকই গত বছর এ খাতে ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদের বড় ছাড় দেয়া বন্ধ হলেই খেলাপি ঋণ সংস্কৃতি কমে যাবে। খেলাপি হলেই বড় বড় ছাড় পাওয়া যাচ্ছে, এই ধারণা থেকে অনেকেই ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হচ্ছে।
খেলাপি ঋণ বাড়াচ্ছে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় : কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সরকারি চারটি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের চার ভাগের তিন ভাগই আটকে রয়েছে শীর্ষ ২শ’ খেলাপির কাছে। এসব ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়েছে। ফলে ১২ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণের বিপরীতে আরও ১২ হাজার কোটি টাকা আটকে আছে। এই দুটি খাত মিলে চার ব্যাংকের আটকে রয়েছে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে ব্যাংকগুলোকে এসব ঋণের বিপরীতে আরোপিত সুদ স্থগিত রাখতে হচ্ছে। এগুলো আদায় হচ্ছে না বলে আয় খাতে নিতে পারছে না। চার ব্যাংকের স্থগিত সুদের পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। এর সিংহ ভাগই রয়েছে শীর্ষ ২শ’ খেলাপির কাছে। এ আয় থেকেও বঞ্ছিত হচ্ছে ব্যাংকগুলো। ফলে ১২ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রকৃত অর্থে আটকে আছে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
এছাড়া এসব ঋণ আদায়ে আলাদা ব্যবস্থাপনা, মামলা দায়ের এসব মিলে ব্যাংকগুলোর আরও বাড়তি টাকা খরচ হচ্ছে। ফলে বাড়িয়ে দিচ্ছে তাদের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়। চারটি ব্যাংকেরই তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় ৯ থেকে ১১ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। বাড়তি তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের কারণে তারা ঋণের সুদের হার কমাতে পারছে না। আর ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণই তহবিল ব্যবস্থাপনা বাড়িয়ে দিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে। এতে করে ভালো ও নতুন গ্রহীতাদেরকেও ঋণের বিপরীতে চড়া সুদ গুনতে হচ্ছে।
খেলাপিদের কাছে জিম্মি চার ব্যাংক : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত (সরকারি বেসরকারি সব ব্যাংক) ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। এর ২৪ শতাংশই আটকে রয়েছে শীর্ষ ২শ’ খেলাপির কাছে। অর্থাৎ মোট খেলাপি ঋণের চার ভাগের এক ভাগ রয়েছে তাদের কাছে।
ওই সময় পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮ হাজার ২২৪ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে শীর্ষ ৫০ খেলাপির কাছে পাওনা রয়েছে ৫ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা- যা তাদের মোট খেলাপি ঋণের সাড়ে ৬৭ শতাংশ।
সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপিদের মধ্যে শুধু হলমার্ক গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছে পাওনা রয়েছে ২ হাজার ১২২ কোটি টাকার বেশি। হলমার্কের মূল প্রতিষ্ঠানের কাছে ১ হাজার ৭১০ কোটি টাকা এবং তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান টিএম ব্রাদার্সের কাছে ৪১২ কোটি টাকা। হলমার্ক জালিয়াতির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের শেরাটন হোটেল শাখা থেকে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ওই ঋণ খেলাপি হওয়ার পর গত বছর তারা ব্যাংকের শীর্ষ ঋণ খেলাপির তালিকায় চলে এসেছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি শীর্ষ ২০ খেলাপির মধ্যেও রয়েছে। তাদের কাছ থেকে ব্যাংক এখনও কোনো ঋণ আদায় করতে পারছে না। ফলে পুরো ঋণের বিপরীতে এখন শতভাগ প্রভিশন রাখতে হচ্ছে।
এছাড়া ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপির তালিকায় আরও আছে জিএমজি গ্রুপ। তাদের কাছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৬৬ কোটি টাকা। মুন্নু ফেব্রিক্সের কাছে ১৬৫ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। এছাড়া রহমান গ্রুপ, অলটেক্স গ্রুপ ও ইমাম গ্রুপের নামও ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপির তালিকায় রয়েছে।
এদিকে ব্যাংক গত বছর সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছ থেকে ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ৩০১ কোটি টাকা। আদায় করেছে মাত্র ৭৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা- যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ২৫ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রদীপ কুমার দত্ত যুগান্তরকে বলেন, বড় খেলাপিদের মধ্যে যাদের ঋণ আদায় হচ্ছে না, তাদের কাছ থেকে আদায়ের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার আলোকে এ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তবে অন্য খেলাপিদের কাছ থেকে ঋণ আদায় বেড়েছে।
অগ্রণী ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৭০৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে শীর্ষ ৫০ খেলাপির কাছে পাওনা রয়েছে ২ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা- যা তাদের মোট খেলাপি ঋণের সাড়ে ৭৬ শতাংশ। শীর্ষ খেলাপিদের মধ্যে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির দায়ে অভিযুক্ত ঢাকার একটি বহুল আলোচিত গ্র“প রয়েছে। এদের কাছে ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ ১৬০ কোটি টাকা। চট্টগ্রামকেন্দ্রিক নূরজাহান গ্র“পের কাছে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৫০ কোটি টাকা। প্যারাগন গ্র“পের কাছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১২০ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের এমডি সৈয়দ আবদুল হামিদ যুগান্তরকে বলেন, অনেকে মনে করেন ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে আর ফেরত দিতে হয় না। ফলে তারা ঋণ নেয়ার পর ব্যাংকমুখী হন না। ঋণ আদায়ের জন্য আমাদেরই দৌড়ঝাঁপ করতে হয়।
জনতা ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে শীর্ষ ৫০ খেলাপির কাছে তাদের পাওনা রয়েছে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা- যা তাদের মোট খেলাপি ঋণের ৮৫ দশমিক ২১ শতাংশ। ব্যাংক গত বছর শীর্ষ খেলাপির কাছ থেকে ১২০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে মাত্র ৩০ কোটি টাকা- যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ২৫ শতাংশ।
জনতা ব্যাংকসহ চারটি ব্যাংক থেকে বিসমিল্লাহ গ্র“প প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি হাতিয়ে নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। এখন তাদের ঋণ শীর্ষ খেলাপির তালিকায় চলে এসেছে। এছাড়া রূপালী ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ২৩৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে শীর্ষ ৫০ খেলাপির কাছে পাওনা রয়েছে ৮০০ কোটি টাকা- যা তাদের মোট ঋণের ৬৪ দশমিক ৭০ শতাংশ।
তদারকি জোরদার : শীর্ষ ২০ ও শীর্ষ ৫০ খেলাপির কাছ থেকে ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোকে জোরালো পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালায় বিশেষ ছাড় দেয়া হয়েছে। গত এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে চার সরকারি ব্যাংকে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আবার বেড়ে গেছে। খেলাপি ঋণ যাতে না বাড়ে সে বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে নতুন ঋণ দেয়ার সময়ে ঋণ গ্রহীতার সক্ষমতাকে বিবেচনায় নিতে বলা হয়েছে।
একাধিকবার নবায়ন করা ঋণের বিপরীতে তদারকি বাড়িয়ে ওইসব ঋণ আদায় করার জন্য ব্যাংকগুলোকে সর্বশক্তি নিয়োগের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই ঋণ বারবার নবায়নের সুযোগ কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর অনুমোদন করবে না।
No comments