তাজউদ্দীন আহমদ ও প্রথম বাংলাদেশ সরকার by শারমিন আহমদ
বাংলাদেশের
প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও গণপ্রজাতন্ত্রী প্রথম বাংলাদেশ
সরকার গঠন নিবিড়ভাবে জড়িত। ৩০ মার্চ, ১৯৭১, কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তবর্তী
জীবননগর এলাকার টুঙ্গি নামের এক স্থানে সেতুর নিচে আশ্রয়রত এই দূরদর্শী
মানুষটি চিন্তা করেছিলেন এক স্বাধীন সরকার গঠনের। তিনি চিন্তা করেছিলেন যে
পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নির্মম আগ্রাসন থেকে বাংলাদেশকে যদি মুক্ত করতে
হয়, তবে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের বিকল্প নেই। আইনজীবী আমীর-উল ইসলাম, যিনি
ছিলেন তাঁর দুর্গম যাত্রাপথের সাথি, তাঁর সঙ্গে আলাপ করেছিলেন যে ভারত
সরকার যদি তাঁদের স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে গ্রহণ করে,
তবেই তাঁরা ভারতে আশ্রয় নেবেন। এসপি মাহবুব উদ্দীন আহমেদ ও মেহেরপুরের
মহকুমা প্রশাসক তৌফিক–ই–ইলাহী চৌধুরী জিপে করে এই দুই ক্লান্ত,
অনাহারক্লিষ্ট স্বাধীনতাকামীকে সীমান্তে পৌঁছে দিয়ে তাঁদের বার্তা ওপারে
পৌঁছে দিয়েছিলেন। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের
ইন্সপেক্টর জেনারেল গোলোক মজুমদার ওনাদের সে বিষয়ে সম্পূর্ণ আস্থা প্রদান
করেন। ওনাদের গার্ড অব অনার দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিনিধির মর্যাদায়
গ্রহণ করা হয়।
১ এপ্রিল রাত ১০টায় একটি মালবাহী পুরোনো রাশান AN 12 সামরিক বিমানে তাজউদ্দীন আহমদ, আইনজীবী আমীর-উল ইসলাম, গোলোক মজুমদার ও বিএসএফের নিরাপত্তা অফিসার শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায় সঙ্গোপনে নয়াদিল্লির পথে রওনা দেন। সেখানে ভারত সরকার তাজউদ্দীন আহমদ সমন্ধে খোঁজখবর নিয়ে নিশ্চিত হয় যে তিনিই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবর্তমানে মূল ব্যক্তি।
৩ এপ্রিল, ১৯৭১, রাত ১০টায় ১০ নম্বর সফদার জং রোডে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনের বাহুল্যবর্জিত পড়ার ঘরে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর প্রথম সাক্ষাৎ হয়। আলাপে তাজউদ্দীন আহমদ যে বিষয়টিতে জোর দেন তা হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সহায়তার জন্য ভারতের সাহায্যপ্রার্থী হলেও এই যুদ্ধ আমাদের বাংলাদেশের মানুষের যুদ্ধ। বাংলাদেশ চায় না যে ভারত তার সামরিক বল দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দিক। এই স্বাধীনতার যুদ্ধটি করতে হবে বাংলাদেশের মানুষকেই। ভারত হবে বাংলাদেশের মিত্র শক্তি। সেদিনের আলাপে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, রসদ, শরণার্থীদের আহার, বাসস্থান, বাইরের জগতের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য সম্প্রচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভারতের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি লাভ করেন।
ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাফল্যজনক সাক্ষাতের পর ভারতসহ সারা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা ও মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয় কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করে তাকে পরিচালনার জন্য অবিলম্বে সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে অসহযোগ আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মী শীর্ষস্থানীয় পাঁচজন নেতাসহ যে হাইকমান্ড গঠন করা হয়েছিল এবং যাঁরা ছায়া সরকারের কাজ করছিলেন, তাঁদের নিয়েই প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হবে। হাইকমান্ড নিয়ে সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর প্রথম কাজ হয় বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ মন্ত্রিসভার বাকি সদস্যদের খুঁজে বের করা। কলকাতায় এম মনসুর আলী ও আবু হেনা কামরুজ্জামানকে খুঁজে পেলেন। তাঁরাসহ আওয়ামী লীগের প্রায় অর্ধশত এমএলএ, এমপি ও রাজনীতিক, যাঁরা সীমান্ত পার হয়ে কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে সরকার গঠন করার ব্যাপারে সরকারের ভূমিকা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা হয়। সরকার গঠনের পক্ষে তাজউদ্দীন আহমদের শাণিত যুক্তি ও বক্তব্য সবাই মেনে নেন।
ইতিমধ্যে ১০ এপ্রিল, বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায় শিলিগুড়ির জঙ্গলের গোপন বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের দিকনির্দেশনাকারী ঐতিহাসিক ভাষণটি প্রচারিত হয়। ভাষণটির খসড়া তিনি নিজে, আইনজীবী আমীর-উল ইসলাম এবং অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান মিলে তৈরি করেছিলেন, যার মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অকুতোভয় সংগ্রাম এবং বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা। ভাষণটির সমাপ্তি পর্বে ধ্বনিত হয় নতুন প্রত্যুষের দিগন্ত আলোকিত স্বপ্ন ও প্রতিজ্ঞা।
১১ এপ্রিল বিএসএফের সহায়তায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও এমপি আবদুল মান্নানের খোঁজ পাওয়া গেল। ময়মনসিংহের তুরা পাহাড়ের কাছে ডাকোটা প্লেন থেকে নেমে তাজউদ্দীন আহমদ একান্তে আলাপ করলেন সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে। সব শুনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁকে আন্তরিক অভিনন্দন জানালেন এবং সরকার গঠনের পক্ষে সম্পূর্ণ মত দিলেন। এরপর ডাকোটা প্লেনে করে তাঁরা আগরতলায় খুঁজে পেলেন মন্ত্রিসভার অপর সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমদকে। সেখানে কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীর সঙ্গে দেখা হলো। তাজউদ্দীন আহমদ ওনার সঙ্গে আলাপ করলেন। প্রথাগত যুদ্ধের বিপরীতে জনযুদ্ধকে গেরিলাযুদ্ধের মধ্যে সংগঠিত করার আহ্বান জানিয়ে তাঁর ওপর প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব অর্পণ করা হলো। তিনি পরবর্তী সময়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জেনারেল পদে উন্নীত হন।
১৭ এপ্রিল, তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমার ভবেরপাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে সূচিত হয় নয়া ইতিহাস। শতাধিক বিদেশি সাংবাদিক ও এলাকাবাসীর সামনে আত্মপ্রকাশ করে গণপ্রজাতন্ত্রী প্রথম বাংলাদেশ সরকার। তাজউদ্দীন আহমদ সেদিন তাঁর বক্তব্যের এক অংশে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে।’ একটি আত্মনির্ভরশীল, সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নকে তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রকাশ করেছিলেন স্বাধীনতাযুদ্ধ অবস্থার সেই নাজুক পরিস্থিতির মধ্যেও।
প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে মুক্তিসংগ্রামকে তিনি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের কাঠামোয় সংহত করে বিজয়কে নিশ্চিত করেছিলেন। সেই দিন ওই প্রথম বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ওই আম্রকাননের নামকরণ করেন ‘মুজিবনগর’, যা হলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী। তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন যে যুদ্ধ অবস্থায় সরকার যেখানেই যাবে, সেই স্থানের নাম হবে মুজিবনগর। বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রেরণা। তিনি বন্দী অবস্থাতেও চেতনায় ছিলেন উপস্থিত। কিন্তু সেই চেতনাকে বাস্তব রূপদানের জন্য তাঁর নিকটতম সহচর তাজউদ্দীন আহমদ নির্মোহ ও নিঃস্বার্থ সাধকের মতোই হাল ধরেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের। মুক্তিযুদ্ধের সময় মন্ত্রিসভার সদস্যরা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে তাঁরা পারিবারিক জীবন যাপন করবেন না। যোদ্ধারা যদি পরিবারবিহীন অবস্থায় যুদ্ধ করতে পারেন, তাঁরা নেতা হয়ে কেন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবেন না। অন্যান্য মন্ত্রিসভার সদস্যদের সে প্রতিজ্ঞা পালন করা সম্ভবপর না হলেও তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোড তথা প্রথম বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাজধানীর (বর্তমান শেক্সপিয়ার সরণি) অফিসকক্ষে দিবারাত্র থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। বাইরে পরার কাপড় ছিল একটি মাত্র খাকি শার্ট, যা তিনি নিজ হাতে ধুয়ে পরতেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়টি প্রধানমন্ত্রী ও দেশরক্ষামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে পাড়ি দিতে হয় পিচ্ছিল সর্পিল পথ, মোকাবিলা করতে হয় জটিলতর পরিস্থিতির। বাইরে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর হামলা, ভেতরে বৈদেশিক মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদের পাকিস্তান ও সিআইএর পক্ষ হয়ে কনফেডারেশন গঠনসহ নানা ষড়যন্ত্র। স্বাধীনতাযুদ্ধের ঐক্য দিখণ্ডকারী এসব ভয়াবহ পরিস্থিতি তাঁকে মোকাবিলা করতে হয় সঙ্গোপনে। বাইরের কাউকে বুঝতে না দিয়ে তিনি তাঁর ধৈর্য, প্রজ্ঞা ও সাহস দিয়ে ষড়যন্ত্রগুলো বানচাল করতে সক্ষম হন।
মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকালে তাজউদ্দীন আহমদের বড় চারটি অর্জন হলো: ১. স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের বিজয়ে যুগান্তকারী সফল নেতৃত্ব প্রদান। ২. নবজাত বাংলাদেশের পক্ষে ভারতের স্বীকৃতি আদায় এবং স্বীকৃতি প্রদানের পরেই মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় মিত্র বাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করবে এই শর্তের উল্লেখ ও বাস্তবায়ন। ৩. ভারতের সঙ্গে চুক্তি যে বাংলাদেশ সরকার যত দিন চাইবে, ভারতীয় সেনাবাহিনী তত দিন পর্যন্তই বাংলাদেশে থাকবে। তারপর তাদের ফিরে যেতে হবে। বিশ্ব ইতিহাসের ওই বিরল চুক্তিটি প্রমাণ করে যে ভিন্ন দেশের মাটিতে আশ্রয় নিয়ে, তাদের সাহায্য, সমর্থন লাভ করার পরেও নিজ রাষ্ট্রের মর্যাদা ও স্বাধীনতার প্রশ্নে কতখানি আপসহীন ছিলেন এই সুউচ্চ চিন্তাশক্তির বিরল রাষ্ট্রনায়ক। ৪. আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রেখে বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তি নিশ্চিতকরণ।
স্বাধীন বাংলাদেশে পবিত্র ধর্মের নাম অপব্যবহার করে সাম্রাজ্যবাদ, রাজতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতাপুষ্ট তথাকথিত ধর্মবাদী দলগুলো যাতে মাথাচাড়া না দিতে পারে, সে জন্যে বিজয়ের আগেই, ১৩ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভায় সম্মিলিতভাবে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তিনি বলতেন, ‘আমরা এমন কাজ যেন না করি, যাতে করে রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধী চক্র একদিন ক্ষমতাসীন হয়ে দেশ স্বাধীন করার “অপরাধে” আমাদেরই উৎখাত করতে সচেষ্ট হয়।’ প্রতিক্রিয়াশীলদের চক্রান্তে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় নেতাদের সঙ্গে নিহত এবং আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সৎ, নির্লোভ, স্বাধীনচেতা ও স্পষ্টবাদী এই রাজনীতিবিদের বহু কথাই আজ সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
তিনি নিজেকে আড়াল করে, কোনো কৃতিত্ব দাবি না করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছিলেন, তার সঠিক মূল্যায়ন রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় পর্যায়ে আজও হয়নি। ইতিহাস প্রমাণ, মানুষটি আজ পরিণত হয়েছেন ইতিহাসের ফুটনোটে। এই দুর্ভাগ্য তাঁর নয়, দুর্ভাগ্য এ জাতির। তার পরও আশা থাকবে যে তরুণ প্রজন্ম যেভাবে ইতিহাসের কলঙ্ক মুছতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও ফাঁসির দাবিতে গণ-আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়েছে, তারা পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে দেশের সমাজ ও রাজনীতিতে শিকড় গাড়া সকল প্রকার কলুষতা, অসত্য, অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে চেতনার নবজাগরণ ঘটাতে; চেতনার রূপান্তরিত নিষ্কলুষ বিকাশে জন্ম নেবে তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর মতো সত্য, ন্যায় ও সুন্দরের প্রতীক নতুন শিশু। তারা বাংলাদেশকে পথনির্দেশ করবে আলোর পথে।
শারমিন আহমদ: লেখক ও গবেষক, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা।
১ এপ্রিল রাত ১০টায় একটি মালবাহী পুরোনো রাশান AN 12 সামরিক বিমানে তাজউদ্দীন আহমদ, আইনজীবী আমীর-উল ইসলাম, গোলোক মজুমদার ও বিএসএফের নিরাপত্তা অফিসার শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায় সঙ্গোপনে নয়াদিল্লির পথে রওনা দেন। সেখানে ভারত সরকার তাজউদ্দীন আহমদ সমন্ধে খোঁজখবর নিয়ে নিশ্চিত হয় যে তিনিই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবর্তমানে মূল ব্যক্তি।
৩ এপ্রিল, ১৯৭১, রাত ১০টায় ১০ নম্বর সফদার জং রোডে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনের বাহুল্যবর্জিত পড়ার ঘরে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর প্রথম সাক্ষাৎ হয়। আলাপে তাজউদ্দীন আহমদ যে বিষয়টিতে জোর দেন তা হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সহায়তার জন্য ভারতের সাহায্যপ্রার্থী হলেও এই যুদ্ধ আমাদের বাংলাদেশের মানুষের যুদ্ধ। বাংলাদেশ চায় না যে ভারত তার সামরিক বল দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দিক। এই স্বাধীনতার যুদ্ধটি করতে হবে বাংলাদেশের মানুষকেই। ভারত হবে বাংলাদেশের মিত্র শক্তি। সেদিনের আলাপে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, রসদ, শরণার্থীদের আহার, বাসস্থান, বাইরের জগতের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য সম্প্রচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভারতের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি লাভ করেন।
ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাফল্যজনক সাক্ষাতের পর ভারতসহ সারা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা ও মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয় কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করে তাকে পরিচালনার জন্য অবিলম্বে সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে অসহযোগ আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মী শীর্ষস্থানীয় পাঁচজন নেতাসহ যে হাইকমান্ড গঠন করা হয়েছিল এবং যাঁরা ছায়া সরকারের কাজ করছিলেন, তাঁদের নিয়েই প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হবে। হাইকমান্ড নিয়ে সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর প্রথম কাজ হয় বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ মন্ত্রিসভার বাকি সদস্যদের খুঁজে বের করা। কলকাতায় এম মনসুর আলী ও আবু হেনা কামরুজ্জামানকে খুঁজে পেলেন। তাঁরাসহ আওয়ামী লীগের প্রায় অর্ধশত এমএলএ, এমপি ও রাজনীতিক, যাঁরা সীমান্ত পার হয়ে কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে সরকার গঠন করার ব্যাপারে সরকারের ভূমিকা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা হয়। সরকার গঠনের পক্ষে তাজউদ্দীন আহমদের শাণিত যুক্তি ও বক্তব্য সবাই মেনে নেন।
ইতিমধ্যে ১০ এপ্রিল, বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায় শিলিগুড়ির জঙ্গলের গোপন বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের দিকনির্দেশনাকারী ঐতিহাসিক ভাষণটি প্রচারিত হয়। ভাষণটির খসড়া তিনি নিজে, আইনজীবী আমীর-উল ইসলাম এবং অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান মিলে তৈরি করেছিলেন, যার মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অকুতোভয় সংগ্রাম এবং বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা। ভাষণটির সমাপ্তি পর্বে ধ্বনিত হয় নতুন প্রত্যুষের দিগন্ত আলোকিত স্বপ্ন ও প্রতিজ্ঞা।
১১ এপ্রিল বিএসএফের সহায়তায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও এমপি আবদুল মান্নানের খোঁজ পাওয়া গেল। ময়মনসিংহের তুরা পাহাড়ের কাছে ডাকোটা প্লেন থেকে নেমে তাজউদ্দীন আহমদ একান্তে আলাপ করলেন সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে। সব শুনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁকে আন্তরিক অভিনন্দন জানালেন এবং সরকার গঠনের পক্ষে সম্পূর্ণ মত দিলেন। এরপর ডাকোটা প্লেনে করে তাঁরা আগরতলায় খুঁজে পেলেন মন্ত্রিসভার অপর সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমদকে। সেখানে কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীর সঙ্গে দেখা হলো। তাজউদ্দীন আহমদ ওনার সঙ্গে আলাপ করলেন। প্রথাগত যুদ্ধের বিপরীতে জনযুদ্ধকে গেরিলাযুদ্ধের মধ্যে সংগঠিত করার আহ্বান জানিয়ে তাঁর ওপর প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব অর্পণ করা হলো। তিনি পরবর্তী সময়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জেনারেল পদে উন্নীত হন।
১৭ এপ্রিল, তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমার ভবেরপাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে সূচিত হয় নয়া ইতিহাস। শতাধিক বিদেশি সাংবাদিক ও এলাকাবাসীর সামনে আত্মপ্রকাশ করে গণপ্রজাতন্ত্রী প্রথম বাংলাদেশ সরকার। তাজউদ্দীন আহমদ সেদিন তাঁর বক্তব্যের এক অংশে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে।’ একটি আত্মনির্ভরশীল, সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নকে তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রকাশ করেছিলেন স্বাধীনতাযুদ্ধ অবস্থার সেই নাজুক পরিস্থিতির মধ্যেও।
প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে মুক্তিসংগ্রামকে তিনি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের কাঠামোয় সংহত করে বিজয়কে নিশ্চিত করেছিলেন। সেই দিন ওই প্রথম বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ওই আম্রকাননের নামকরণ করেন ‘মুজিবনগর’, যা হলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী। তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন যে যুদ্ধ অবস্থায় সরকার যেখানেই যাবে, সেই স্থানের নাম হবে মুজিবনগর। বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রেরণা। তিনি বন্দী অবস্থাতেও চেতনায় ছিলেন উপস্থিত। কিন্তু সেই চেতনাকে বাস্তব রূপদানের জন্য তাঁর নিকটতম সহচর তাজউদ্দীন আহমদ নির্মোহ ও নিঃস্বার্থ সাধকের মতোই হাল ধরেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের। মুক্তিযুদ্ধের সময় মন্ত্রিসভার সদস্যরা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে তাঁরা পারিবারিক জীবন যাপন করবেন না। যোদ্ধারা যদি পরিবারবিহীন অবস্থায় যুদ্ধ করতে পারেন, তাঁরা নেতা হয়ে কেন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবেন না। অন্যান্য মন্ত্রিসভার সদস্যদের সে প্রতিজ্ঞা পালন করা সম্ভবপর না হলেও তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোড তথা প্রথম বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাজধানীর (বর্তমান শেক্সপিয়ার সরণি) অফিসকক্ষে দিবারাত্র থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। বাইরে পরার কাপড় ছিল একটি মাত্র খাকি শার্ট, যা তিনি নিজ হাতে ধুয়ে পরতেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়টি প্রধানমন্ত্রী ও দেশরক্ষামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে পাড়ি দিতে হয় পিচ্ছিল সর্পিল পথ, মোকাবিলা করতে হয় জটিলতর পরিস্থিতির। বাইরে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর হামলা, ভেতরে বৈদেশিক মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদের পাকিস্তান ও সিআইএর পক্ষ হয়ে কনফেডারেশন গঠনসহ নানা ষড়যন্ত্র। স্বাধীনতাযুদ্ধের ঐক্য দিখণ্ডকারী এসব ভয়াবহ পরিস্থিতি তাঁকে মোকাবিলা করতে হয় সঙ্গোপনে। বাইরের কাউকে বুঝতে না দিয়ে তিনি তাঁর ধৈর্য, প্রজ্ঞা ও সাহস দিয়ে ষড়যন্ত্রগুলো বানচাল করতে সক্ষম হন।
মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকালে তাজউদ্দীন আহমদের বড় চারটি অর্জন হলো: ১. স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের বিজয়ে যুগান্তকারী সফল নেতৃত্ব প্রদান। ২. নবজাত বাংলাদেশের পক্ষে ভারতের স্বীকৃতি আদায় এবং স্বীকৃতি প্রদানের পরেই মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় মিত্র বাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করবে এই শর্তের উল্লেখ ও বাস্তবায়ন। ৩. ভারতের সঙ্গে চুক্তি যে বাংলাদেশ সরকার যত দিন চাইবে, ভারতীয় সেনাবাহিনী তত দিন পর্যন্তই বাংলাদেশে থাকবে। তারপর তাদের ফিরে যেতে হবে। বিশ্ব ইতিহাসের ওই বিরল চুক্তিটি প্রমাণ করে যে ভিন্ন দেশের মাটিতে আশ্রয় নিয়ে, তাদের সাহায্য, সমর্থন লাভ করার পরেও নিজ রাষ্ট্রের মর্যাদা ও স্বাধীনতার প্রশ্নে কতখানি আপসহীন ছিলেন এই সুউচ্চ চিন্তাশক্তির বিরল রাষ্ট্রনায়ক। ৪. আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রেখে বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তি নিশ্চিতকরণ।
স্বাধীন বাংলাদেশে পবিত্র ধর্মের নাম অপব্যবহার করে সাম্রাজ্যবাদ, রাজতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতাপুষ্ট তথাকথিত ধর্মবাদী দলগুলো যাতে মাথাচাড়া না দিতে পারে, সে জন্যে বিজয়ের আগেই, ১৩ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভায় সম্মিলিতভাবে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তিনি বলতেন, ‘আমরা এমন কাজ যেন না করি, যাতে করে রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধী চক্র একদিন ক্ষমতাসীন হয়ে দেশ স্বাধীন করার “অপরাধে” আমাদেরই উৎখাত করতে সচেষ্ট হয়।’ প্রতিক্রিয়াশীলদের চক্রান্তে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় নেতাদের সঙ্গে নিহত এবং আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সৎ, নির্লোভ, স্বাধীনচেতা ও স্পষ্টবাদী এই রাজনীতিবিদের বহু কথাই আজ সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
তিনি নিজেকে আড়াল করে, কোনো কৃতিত্ব দাবি না করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছিলেন, তার সঠিক মূল্যায়ন রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় পর্যায়ে আজও হয়নি। ইতিহাস প্রমাণ, মানুষটি আজ পরিণত হয়েছেন ইতিহাসের ফুটনোটে। এই দুর্ভাগ্য তাঁর নয়, দুর্ভাগ্য এ জাতির। তার পরও আশা থাকবে যে তরুণ প্রজন্ম যেভাবে ইতিহাসের কলঙ্ক মুছতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও ফাঁসির দাবিতে গণ-আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়েছে, তারা পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে দেশের সমাজ ও রাজনীতিতে শিকড় গাড়া সকল প্রকার কলুষতা, অসত্য, অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে চেতনার নবজাগরণ ঘটাতে; চেতনার রূপান্তরিত নিষ্কলুষ বিকাশে জন্ম নেবে তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর মতো সত্য, ন্যায় ও সুন্দরের প্রতীক নতুন শিশু। তারা বাংলাদেশকে পথনির্দেশ করবে আলোর পথে।
শারমিন আহমদ: লেখক ও গবেষক, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা।
No comments