সংস্কার চায় পশ্চিমারা by মাসুদ করিম
রাজনৈতিক
সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার চায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
অবাধ, সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লক্ষ্যে তারা এ
প্রস্তাব নিয়ে মাঠে নামতে যাচ্ছে। একই লক্ষ্যে করণীয় নির্ধারণে নাগরিক
সমাজের মতামতকেও গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন বিদেশীরা।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ভোটের দিন দুপুরের আগেই বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই মূলত নির্বাচনী পদ্ধতির উন্নয়নের বিষয়ে জোর দেয়া হচ্ছে। সিটি নির্বাচনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং সহিংসতার অভিযোগে হতাশা ব্যক্ত করেছে। পাশাপাশি মাঝপথে নির্বাচন বর্জনে বিএনপির ঘোষণাতেও হতাশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মনে করে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন গঠনেই সমস্যা আছে। সরকারি দলের রাজনীতির প্রতি সমর্থন আছে এমন লোকজনকে নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। কাজেই ওই কমিশনের পক্ষে নিরপেক্ষভাবে কাজ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এ ক্ষেত্রে সরকার যেভাবে চায় কমিশনকে সেভাবেই নির্বাচন করতে হয়। রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে ইসি এমনিতেই সরকারের প্রতি অনুগত থাকে। এর সঙ্গে যোগ হয় সরকারের অলিখিত আদেশ। সব মিলিয়ে যে সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে তখন তাদের মতো করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ফলে তা গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে না। অথচ নির্বাচনই হচ্ছে গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের মূল শক্তি। জনগণ ভোটের মাধ্যমেই তার প্রতিনিধি নির্বাচন করে থাকে। সেই নির্বাচনে যদি জনগণ ভোটই দিতে না পারে তবে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন কীভাবে। আর গণতান্ত্রিক সরকারই বা প্রতিষ্ঠা হবে কোন পদ্ধতিতে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক বলেন, বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে কীভাবে নির্বাচন হচ্ছে, সেখানে নির্বাচন কমিশনই বা গঠন হচ্ছে কীভাবে- এগুলো বাংলাদেশকে দেখতে হবে। এ ছাড়া পশ্চিমা দেশগুলোসহ উন্নত বিশ্বের নির্বাচনের পদ্ধতিগুলোও পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তাদের মতো ব্যবস্থা চালু করতে না পারলে ইসি শক্তিশালী হবে না। আর ইসি শক্তিশালী না হলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। আর নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে না। তিনি বলেন, ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত না হলে জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠিত হয় না।
নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে শক্তিশালী ইসি গঠন প্রায় অসম্ভব। কারণ এখানে অধিকাংশ ইস্যুতেই কেউ কারও কথা মানতে চায় না। দলগুলোর মধ্যে আস্থার অভাব। কাজেই শক্তিশালী ইসি গঠন এবং নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কারের বিষয়ে পশ্চিমাদেরই সুনির্দিষ্ট ফর্মুলা দিতে হবে। অন্যথায় সংস্কার প্রস্তাব কখনও বাস্তবায়িত হবে না।
তিন সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নির্বাচনের বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান চায়- তা স্পষ্ট হয়েছে ওয়েন্ডি শারম্যানের মন্তব্যে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের আন্ডার সেক্রেটারি ওয়েন্ডি শারম্যান বলেছেন, ‘আমরা এখনও এর একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান আশা করি, যেখানে সব দল সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারবে এবং যেখানে বাংলাদেশী জনগণ শান্তিপূর্ণভাবে তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ লাভ করবে।’
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের রাজনীতিসংক্রান্ত আন্ডার সেক্রেটারি ওয়েন্ডি শারম্যানের বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হয়। শারম্যান সেখানে নির্বাচনী ব্যবস্থার উন্নয়নের সুপারিশ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে বাংলাদেশে ইভিএম চালুর চিন্তা-ভাবনার কথা বলেন। ইভিএম চালুর ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর চিন্তার প্রশংসা করেন ওয়েন্ডি শারম্যান। এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, নির্বাচনী পদ্ধতি সংস্কারের কথা প্রধানমন্ত্রী নিজেই ভাবছেন। এ বিষয়ে তিনি বিদেশীদের কাছে তার চিন্তা-ভাবনা তুলে ধরেছেন। সিটি নির্বাচনে সহিংসতায় কোনো মানুষ মারা না যাওয়া বিশেষ এক স্বস্তির বিষয় বলে মনে করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী।
কূটনৈতিক সূত্রমতে, ওয়েন্ডি শারম্যান ঢাকায় আসার পূর্বে ভারতে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। নয়াদিল্লির পক্ষ থেকে স্পষ্ট বার্তা দেয়া হয়েছে যে, বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত থেকে সম্ভাব্য জঙ্গি উত্থান প্রতিরোধে কাজ করছে ভারত। জঙ্গি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের উদ্বেগ নিরসনে শেখ হাসিনার সরকার আন্তরিক বলে উভয় দেশ একমত হয়েছে।
ঢাকায় একজন কূটনীতিক যুগান্তরকে বলেছেন, পশ্চিমারা ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্যে বর্তমান সরকারের ওপর চাপ রাখবে। তবে জঙ্গি দমনে শেখ হাসিনার সরকারের তাদের প্রয়োজনও রয়েছে।
সিটি নির্বাচন নিয়ে নানা অভিযোগের পর জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন টেলিফোন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেছেন। মহাসচিব বাংলাদেশের সংকটের দিক দেখাশোনা করার জন্যে অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে দায়িত্ব দিয়েছেন বলে প্রধানমন্ত্রীকে জানান। অস্কার অনেকটা সময় নিয়ে খুবই ধীরগতিতে সংকট উত্তরণে সরকার ও বিএনপির সঙ্গে কাজ করবেন বলে জানা গেছে।
সূত্রটি আরও জানায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ভিন্ন এক ধারণাও দেয়া হয়েছে। মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যদের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সংশ্লিষ্ট হয়ে ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভূমিকা না রাখলে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের পথে যেতে পারে। অস্থিতিশীলতার সুযোগে জঙ্গি উত্থান ঘটতে পারে। ফলে জঙ্গি ইস্যু বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে।
নাগরিক সমাজ ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রতি জোর দিচ্ছেন। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘ইলেকট্রনিক ভোটিং সিস্টেম’সহ (ইভিএম) নির্বাচন পদ্ধতিতে আধুনিকায়নে সরকারের মনোযোগ রয়েছে। এতে করে নির্বাচনী ত্র“টি দূর করা সম্ভব হতে পারে। তবে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের খোলনলচে পাল্টে দিতে চায় বিএনপি।
নির্বাচনী ব্যবস্থা সুষ্ঠু করার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান কোন পথে জানতে চাইলে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এটিএম শামসুল হুদা রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু করতে একটা জিনিসই লাগে। আর সেটা হল রাজনৈতিক সদিচ্ছা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আমরা নির্বাচন করার সময় সরকার বলেছিল, নির্বাচন সুষ্ঠু করতে হবে। এজন্যে যা লাগবে আমরা তা দেব। সরকারের এমন একটা সদিচ্ছা থাকতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি দিয়েও নির্বাচন সুষ্ঠু করা সম্ভব নয়। ভারতে তাকিয়ে দেখেন, সেখানে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার বাইরের সব দলের লক্ষ্যই থাকে কিভাবে সুষ্ঠু ভোট করা যায়। ফলে নির্বাচন সুষ্ঠু করাটা শুধু নির্বাচন কমিশনের ব্যাপার থাকে না। সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করার ব্যাপারে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে নির্বাচন কমিশনে আজ্ঞাবহ লোক বসানো হবে না। যোগ্য লোকদের সেখানে দায়িত্ব দেয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন করা কোনো কঠিন কাজ নয়। রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, প্রশাসন, মিডিয়া সবাই মিলে চেষ্টা করতে হবে। তখন আইনের সংস্কার করা যায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে মিডিয়া ও নাগরিক সমাজ সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে বলতে থাকলে একটা সময় চাপ সৃষ্টি হবে। তখন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান ভবিষ্যতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে আলোচনা প্রয়োজন বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু করার বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। আমরা মনে করি, বর্তমান বিতর্কিত নির্বাচন কমিশন নিয়ে বেশি দূর আগানো যাবে না। এ নির্বাচন কমিশনের খোলনলচে পাল্টে দিতে হবে। ভারতে নির্বাচন কমিশন নিয়ে কোনো প্রশ্ন আসে না। ফলে এই লক্ষ্যে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। নাগরিক সমাজ ও পেশাজীবীদের মধ্যে ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচন করার বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা হতে হবে। কেননা গত ৪৪ বছরে নির্বাচন ব্যবস্থা আমরা ঠিক করতে পারিনি।’
ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ভোটের দিন দুপুরের আগেই বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই মূলত নির্বাচনী পদ্ধতির উন্নয়নের বিষয়ে জোর দেয়া হচ্ছে। সিটি নির্বাচনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং সহিংসতার অভিযোগে হতাশা ব্যক্ত করেছে। পাশাপাশি মাঝপথে নির্বাচন বর্জনে বিএনপির ঘোষণাতেও হতাশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মনে করে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন গঠনেই সমস্যা আছে। সরকারি দলের রাজনীতির প্রতি সমর্থন আছে এমন লোকজনকে নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। কাজেই ওই কমিশনের পক্ষে নিরপেক্ষভাবে কাজ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এ ক্ষেত্রে সরকার যেভাবে চায় কমিশনকে সেভাবেই নির্বাচন করতে হয়। রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে ইসি এমনিতেই সরকারের প্রতি অনুগত থাকে। এর সঙ্গে যোগ হয় সরকারের অলিখিত আদেশ। সব মিলিয়ে যে সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে তখন তাদের মতো করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ফলে তা গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে না। অথচ নির্বাচনই হচ্ছে গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের মূল শক্তি। জনগণ ভোটের মাধ্যমেই তার প্রতিনিধি নির্বাচন করে থাকে। সেই নির্বাচনে যদি জনগণ ভোটই দিতে না পারে তবে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন কীভাবে। আর গণতান্ত্রিক সরকারই বা প্রতিষ্ঠা হবে কোন পদ্ধতিতে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক বলেন, বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে কীভাবে নির্বাচন হচ্ছে, সেখানে নির্বাচন কমিশনই বা গঠন হচ্ছে কীভাবে- এগুলো বাংলাদেশকে দেখতে হবে। এ ছাড়া পশ্চিমা দেশগুলোসহ উন্নত বিশ্বের নির্বাচনের পদ্ধতিগুলোও পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তাদের মতো ব্যবস্থা চালু করতে না পারলে ইসি শক্তিশালী হবে না। আর ইসি শক্তিশালী না হলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। আর নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে না। তিনি বলেন, ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত না হলে জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠিত হয় না।
নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে শক্তিশালী ইসি গঠন প্রায় অসম্ভব। কারণ এখানে অধিকাংশ ইস্যুতেই কেউ কারও কথা মানতে চায় না। দলগুলোর মধ্যে আস্থার অভাব। কাজেই শক্তিশালী ইসি গঠন এবং নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কারের বিষয়ে পশ্চিমাদেরই সুনির্দিষ্ট ফর্মুলা দিতে হবে। অন্যথায় সংস্কার প্রস্তাব কখনও বাস্তবায়িত হবে না।
তিন সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নির্বাচনের বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান চায়- তা স্পষ্ট হয়েছে ওয়েন্ডি শারম্যানের মন্তব্যে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের আন্ডার সেক্রেটারি ওয়েন্ডি শারম্যান বলেছেন, ‘আমরা এখনও এর একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান আশা করি, যেখানে সব দল সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারবে এবং যেখানে বাংলাদেশী জনগণ শান্তিপূর্ণভাবে তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ লাভ করবে।’
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের রাজনীতিসংক্রান্ত আন্ডার সেক্রেটারি ওয়েন্ডি শারম্যানের বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হয়। শারম্যান সেখানে নির্বাচনী ব্যবস্থার উন্নয়নের সুপারিশ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে বাংলাদেশে ইভিএম চালুর চিন্তা-ভাবনার কথা বলেন। ইভিএম চালুর ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর চিন্তার প্রশংসা করেন ওয়েন্ডি শারম্যান। এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, নির্বাচনী পদ্ধতি সংস্কারের কথা প্রধানমন্ত্রী নিজেই ভাবছেন। এ বিষয়ে তিনি বিদেশীদের কাছে তার চিন্তা-ভাবনা তুলে ধরেছেন। সিটি নির্বাচনে সহিংসতায় কোনো মানুষ মারা না যাওয়া বিশেষ এক স্বস্তির বিষয় বলে মনে করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী।
কূটনৈতিক সূত্রমতে, ওয়েন্ডি শারম্যান ঢাকায় আসার পূর্বে ভারতে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। নয়াদিল্লির পক্ষ থেকে স্পষ্ট বার্তা দেয়া হয়েছে যে, বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত থেকে সম্ভাব্য জঙ্গি উত্থান প্রতিরোধে কাজ করছে ভারত। জঙ্গি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের উদ্বেগ নিরসনে শেখ হাসিনার সরকার আন্তরিক বলে উভয় দেশ একমত হয়েছে।
ঢাকায় একজন কূটনীতিক যুগান্তরকে বলেছেন, পশ্চিমারা ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্যে বর্তমান সরকারের ওপর চাপ রাখবে। তবে জঙ্গি দমনে শেখ হাসিনার সরকারের তাদের প্রয়োজনও রয়েছে।
সিটি নির্বাচন নিয়ে নানা অভিযোগের পর জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন টেলিফোন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেছেন। মহাসচিব বাংলাদেশের সংকটের দিক দেখাশোনা করার জন্যে অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে দায়িত্ব দিয়েছেন বলে প্রধানমন্ত্রীকে জানান। অস্কার অনেকটা সময় নিয়ে খুবই ধীরগতিতে সংকট উত্তরণে সরকার ও বিএনপির সঙ্গে কাজ করবেন বলে জানা গেছে।
সূত্রটি আরও জানায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ভিন্ন এক ধারণাও দেয়া হয়েছে। মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যদের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সংশ্লিষ্ট হয়ে ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভূমিকা না রাখলে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের পথে যেতে পারে। অস্থিতিশীলতার সুযোগে জঙ্গি উত্থান ঘটতে পারে। ফলে জঙ্গি ইস্যু বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে।
নাগরিক সমাজ ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রতি জোর দিচ্ছেন। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘ইলেকট্রনিক ভোটিং সিস্টেম’সহ (ইভিএম) নির্বাচন পদ্ধতিতে আধুনিকায়নে সরকারের মনোযোগ রয়েছে। এতে করে নির্বাচনী ত্র“টি দূর করা সম্ভব হতে পারে। তবে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের খোলনলচে পাল্টে দিতে চায় বিএনপি।
নির্বাচনী ব্যবস্থা সুষ্ঠু করার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান কোন পথে জানতে চাইলে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এটিএম শামসুল হুদা রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু করতে একটা জিনিসই লাগে। আর সেটা হল রাজনৈতিক সদিচ্ছা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আমরা নির্বাচন করার সময় সরকার বলেছিল, নির্বাচন সুষ্ঠু করতে হবে। এজন্যে যা লাগবে আমরা তা দেব। সরকারের এমন একটা সদিচ্ছা থাকতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি দিয়েও নির্বাচন সুষ্ঠু করা সম্ভব নয়। ভারতে তাকিয়ে দেখেন, সেখানে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার বাইরের সব দলের লক্ষ্যই থাকে কিভাবে সুষ্ঠু ভোট করা যায়। ফলে নির্বাচন সুষ্ঠু করাটা শুধু নির্বাচন কমিশনের ব্যাপার থাকে না। সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করার ব্যাপারে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে নির্বাচন কমিশনে আজ্ঞাবহ লোক বসানো হবে না। যোগ্য লোকদের সেখানে দায়িত্ব দেয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন করা কোনো কঠিন কাজ নয়। রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, প্রশাসন, মিডিয়া সবাই মিলে চেষ্টা করতে হবে। তখন আইনের সংস্কার করা যায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে মিডিয়া ও নাগরিক সমাজ সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে বলতে থাকলে একটা সময় চাপ সৃষ্টি হবে। তখন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান ভবিষ্যতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে আলোচনা প্রয়োজন বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু করার বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। আমরা মনে করি, বর্তমান বিতর্কিত নির্বাচন কমিশন নিয়ে বেশি দূর আগানো যাবে না। এ নির্বাচন কমিশনের খোলনলচে পাল্টে দিতে হবে। ভারতে নির্বাচন কমিশন নিয়ে কোনো প্রশ্ন আসে না। ফলে এই লক্ষ্যে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। নাগরিক সমাজ ও পেশাজীবীদের মধ্যে ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচন করার বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা হতে হবে। কেননা গত ৪৪ বছরে নির্বাচন ব্যবস্থা আমরা ঠিক করতে পারিনি।’
No comments