রায়েরকাঠি রাজবাড়ি by এ কে এম ফয়সাল
পিরোজপুরে সাড়ে তিন শ বছরের পুরোনো রায়েরকাঠি রাজবাড়ির অংশবিশেষ অযত্ন-অবহেলায় টিকে রয়েছে l ছবি: প্রথম আলো |
পিরোজপুরের
রায়েরকাঠি রাজবাড়ি। রাজবাড়িতে রয়েছে মোগল সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে
নির্মিত সাড়ে তিন শ বছরের পুরোনো কালী ও শিবমন্দির। ষোড়শ শতাব্দীর
মাঝামাঝি সময়ে রাজা রুদ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী রাজবাড়ি ও মন্দির প্রতিষ্ঠা
করেন।
রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মূল রাজবাড়িটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও কালের সাক্ষী হয়ে আছে ৩৫৭ বছরের পুরোনো কালীমন্দির এবং ৭৫ ফুট উচ্চতার ১১টি মঠ। মনোমুগ্ধকর এসব শৈল্পিক স্থাপনার গায়ে এখন শুধুই অযত্ন-অবহেলার ছাপ।
পিরোজপুর শহর থেকে তিন কিলোমিটার উত্তরে রায়েরকাঠি গ্রামে রাজবাড়িটির অবস্থান। ২০০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত রাজবাড়ির পূর্ব দিকে রয়েছে কালী ও শিবমন্দির। কালের বিবর্তনে ধ্বংসের পথে রাজবাড়ির অধিকাংশ ভবন। সংস্কারের অভাবে সুউচ্চ মঠগুলো ভেঙে যাচ্ছে। রাজপ্রথা বিলুপ্তির পরে চালু হয় জমিদারি প্রথা। আর রুদ্র নারায়ণের উত্তরসূরিরা রাজা থেকে পরিণত হন জমিদারে। একসময় রাজবাড়িতে মহিষ বলি দিয়ে ঘটা করে কালী পূজা হতো। তবে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর রাজবাড়ি তার জৌলুশ হারায়।
পিরোজপুরের ইতিহাস গবেষক গোলাম মোস্তফা তাঁর সংগ্রামী পিরোজপুর বইয়ে লিখেছেন, ‘সম্রাট আকবরের সময় যুবরাজ সেলিম (সম্রাট জাহাঙ্গীর) বিদ্রোহ করে বাংলা মুলুকে আসেন। এরপর তিনি ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও বাগেরহাট জেলার কিছু অংশ নিয়ে একটি পরগণার সৃষ্টি করেন। নিজের নামে পরগণার নাম রাখেন সেলিমাবাদ। ১৬১৮ সালে সেলিমাবাদ পরগণার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পান মদন মোহন। ১৬২৮ সালে মদন মোহন তাঁর ছেলে শ্রীনাথের নামে সেলিমাবাদ পরগণার পাট্টা নেন। শ্রীনাথ ঝালকাঠির লুৎফাবাদ গ্রামে কাচারি স্থাপন করে সেখানে বসবাস করতেন। এরপর মোগল সম্রাট ওই শ্রীনাথকে রাজা উপাধি দেন। ১৬৫৮ সালের শ্রীনাথ রায়ের ছেলে রুদ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী পিরোজপুরের অদূরে বসবাস শুরু করেন। সেখানে জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে রাজবাড়ি ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। বন-জঙ্গল কেটে রাজ্য স্থাপন করেন বলেই নামকরণ করা হয়েছে রায়েরকাঠি। রাজা রুদ্র নারায়ণ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় পাঁচজন চণ্ডালের (নিম্নবর্ণের হিন্দু) মুণ্ডু কেটে তার ওপর মূর্তি স্থাপন করেন। রুদ্র নারায়ণ ওই পাঁচ চণ্ডালকে অর্থ লোভে বশীভূত করে মুণ্ডু দিতে বাধ্য করেন। রাজার এই নিষ্ঠুর ঘটনাটি ঢাকার প্রাদেশিক সুবেদার শাহবাজ খানের কাছে নালিশ যায়। সুবেদার এ ঘটনার বিচার করে রুদ্র নারায়ণকে মৃত্যুদণ্ড দেন। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য রুদ্র নারায়ণকে হাজার হাজার মানুষের সামনে বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তবে খাঁচার মধ্যে তিনি লড়াই করে বাঘকে মেরে ফেলেন। এ খবর সুবেদারের কাছে গেলে তিনি রুদ্র নারায়ণের দণ্ড মওকুফ করে দেন। রুদ্র নারায়ণ তাঁর কৃতকর্মে লজ্জিত হয়ে রাজবাড়িতে না ফিরে ছেলে নরোত্তম নারায়ণ রায়কে রাজত্ব দিয়ে কাশি চলে যান। সেখানে তিনি আমৃত্যু সন্ন্যাস জীবন পালন করেন।’
অত্যাচার-নীপিড়নের অভিযোগের পাশাপাশি জনহিতকর কাজের জন্যেও এই রাজপরিবারের সুনাম রয়েছে। প্রজাদের পানীয়জলের সুবিধার জন্য তারা অনেক দিঘি খনন করে। সড়ক ও কাঠের সেতু নির্মাণ করেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজবাড়ির প্রধান ফটক, রাজাদের বসবাসের বহুতল ভবনগুলো, বিচারালয়, কাচারিঘর, জলসাঘর, অন্ধকূপ ভেঙে গেছে। মোগলদের মন্দিরের নকশায় নির্মিত মঠগুলো ক্ষয়িষ্ণু। মঠের দেয়ালে মাটির অলংকরণ ক্ষয়ে গেছে। মঠের গায়ে শেওলা ও লতাপাতা জন্মেছে। নবরত্ন মঠসহ তিনটি মঠের কিছু অংশ ভেঙে গেছে। একটি মঠে সংরক্ষিত আছে কষ্টিপাথরের মহামূল্যবান শিবমূর্তি।
রায়েরকাঠি শিব ও কালীমন্দির ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও ওই রাজবংশের ২৯তম পুরুষ গৌতম নারায়ণ রায় চৌধুরী বলেন, ‘রাজবাড়ি ও মঠগুলো সংরক্ষণ করা খুবই ব্যয়বহুল। আর এই খরচ বহন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। আমরা বেশ কয়েকবার প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কাছে এগুলো সংরক্ষণের জন্য আবেদন করেও কোনো সাড়া পাইনি।’
পিরোজপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি শফিউল হক বলেন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উচিত এই রাজবাড়ি ও মঠগুলো সংরক্ষণ করা। তাহলে পিরোজপুরের ঐতিহাসিক স্থানটি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক (খুলনা অঞ্চল) মো. আমিরুজ্জামান বলেন, ‘পিরোজপুর জেলায় আমাদের কোনো জরিপ হয়নি। এ কারণে রাজবাড়িটি সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। তবে এ ব্যাপারে লিখিত আবেদন পেলে আমরা সরেজমিনে দেখে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন পাঠাতে পারি।
রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মূল রাজবাড়িটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও কালের সাক্ষী হয়ে আছে ৩৫৭ বছরের পুরোনো কালীমন্দির এবং ৭৫ ফুট উচ্চতার ১১টি মঠ। মনোমুগ্ধকর এসব শৈল্পিক স্থাপনার গায়ে এখন শুধুই অযত্ন-অবহেলার ছাপ।
পিরোজপুর শহর থেকে তিন কিলোমিটার উত্তরে রায়েরকাঠি গ্রামে রাজবাড়িটির অবস্থান। ২০০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত রাজবাড়ির পূর্ব দিকে রয়েছে কালী ও শিবমন্দির। কালের বিবর্তনে ধ্বংসের পথে রাজবাড়ির অধিকাংশ ভবন। সংস্কারের অভাবে সুউচ্চ মঠগুলো ভেঙে যাচ্ছে। রাজপ্রথা বিলুপ্তির পরে চালু হয় জমিদারি প্রথা। আর রুদ্র নারায়ণের উত্তরসূরিরা রাজা থেকে পরিণত হন জমিদারে। একসময় রাজবাড়িতে মহিষ বলি দিয়ে ঘটা করে কালী পূজা হতো। তবে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর রাজবাড়ি তার জৌলুশ হারায়।
পিরোজপুরের ইতিহাস গবেষক গোলাম মোস্তফা তাঁর সংগ্রামী পিরোজপুর বইয়ে লিখেছেন, ‘সম্রাট আকবরের সময় যুবরাজ সেলিম (সম্রাট জাহাঙ্গীর) বিদ্রোহ করে বাংলা মুলুকে আসেন। এরপর তিনি ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও বাগেরহাট জেলার কিছু অংশ নিয়ে একটি পরগণার সৃষ্টি করেন। নিজের নামে পরগণার নাম রাখেন সেলিমাবাদ। ১৬১৮ সালে সেলিমাবাদ পরগণার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পান মদন মোহন। ১৬২৮ সালে মদন মোহন তাঁর ছেলে শ্রীনাথের নামে সেলিমাবাদ পরগণার পাট্টা নেন। শ্রীনাথ ঝালকাঠির লুৎফাবাদ গ্রামে কাচারি স্থাপন করে সেখানে বসবাস করতেন। এরপর মোগল সম্রাট ওই শ্রীনাথকে রাজা উপাধি দেন। ১৬৫৮ সালের শ্রীনাথ রায়ের ছেলে রুদ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী পিরোজপুরের অদূরে বসবাস শুরু করেন। সেখানে জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে রাজবাড়ি ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। বন-জঙ্গল কেটে রাজ্য স্থাপন করেন বলেই নামকরণ করা হয়েছে রায়েরকাঠি। রাজা রুদ্র নারায়ণ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় পাঁচজন চণ্ডালের (নিম্নবর্ণের হিন্দু) মুণ্ডু কেটে তার ওপর মূর্তি স্থাপন করেন। রুদ্র নারায়ণ ওই পাঁচ চণ্ডালকে অর্থ লোভে বশীভূত করে মুণ্ডু দিতে বাধ্য করেন। রাজার এই নিষ্ঠুর ঘটনাটি ঢাকার প্রাদেশিক সুবেদার শাহবাজ খানের কাছে নালিশ যায়। সুবেদার এ ঘটনার বিচার করে রুদ্র নারায়ণকে মৃত্যুদণ্ড দেন। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য রুদ্র নারায়ণকে হাজার হাজার মানুষের সামনে বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তবে খাঁচার মধ্যে তিনি লড়াই করে বাঘকে মেরে ফেলেন। এ খবর সুবেদারের কাছে গেলে তিনি রুদ্র নারায়ণের দণ্ড মওকুফ করে দেন। রুদ্র নারায়ণ তাঁর কৃতকর্মে লজ্জিত হয়ে রাজবাড়িতে না ফিরে ছেলে নরোত্তম নারায়ণ রায়কে রাজত্ব দিয়ে কাশি চলে যান। সেখানে তিনি আমৃত্যু সন্ন্যাস জীবন পালন করেন।’
অত্যাচার-নীপিড়নের অভিযোগের পাশাপাশি জনহিতকর কাজের জন্যেও এই রাজপরিবারের সুনাম রয়েছে। প্রজাদের পানীয়জলের সুবিধার জন্য তারা অনেক দিঘি খনন করে। সড়ক ও কাঠের সেতু নির্মাণ করেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজবাড়ির প্রধান ফটক, রাজাদের বসবাসের বহুতল ভবনগুলো, বিচারালয়, কাচারিঘর, জলসাঘর, অন্ধকূপ ভেঙে গেছে। মোগলদের মন্দিরের নকশায় নির্মিত মঠগুলো ক্ষয়িষ্ণু। মঠের দেয়ালে মাটির অলংকরণ ক্ষয়ে গেছে। মঠের গায়ে শেওলা ও লতাপাতা জন্মেছে। নবরত্ন মঠসহ তিনটি মঠের কিছু অংশ ভেঙে গেছে। একটি মঠে সংরক্ষিত আছে কষ্টিপাথরের মহামূল্যবান শিবমূর্তি।
রায়েরকাঠি শিব ও কালীমন্দির ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও ওই রাজবংশের ২৯তম পুরুষ গৌতম নারায়ণ রায় চৌধুরী বলেন, ‘রাজবাড়ি ও মঠগুলো সংরক্ষণ করা খুবই ব্যয়বহুল। আর এই খরচ বহন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। আমরা বেশ কয়েকবার প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কাছে এগুলো সংরক্ষণের জন্য আবেদন করেও কোনো সাড়া পাইনি।’
পিরোজপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি শফিউল হক বলেন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উচিত এই রাজবাড়ি ও মঠগুলো সংরক্ষণ করা। তাহলে পিরোজপুরের ঐতিহাসিক স্থানটি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক (খুলনা অঞ্চল) মো. আমিরুজ্জামান বলেন, ‘পিরোজপুর জেলায় আমাদের কোনো জরিপ হয়নি। এ কারণে রাজবাড়িটি সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। তবে এ ব্যাপারে লিখিত আবেদন পেলে আমরা সরেজমিনে দেখে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন পাঠাতে পারি।
No comments