বাম্পার ফলন, তারপরও কৃষকের মাথায় হাত
বাম্পার
ফলন ফলিয়ে কৃষকের এখন মাথায় হাত। ধানের মূল্য কম হওয়ায় ফলন খরচই উঠছে না।
হাওরের পর হাওরে ইরি-বোরো ধানের পাকা শীষ উড়লেও কৃষকের মনে লাগছে ধাক্কা।
কষ্ট করে ধান ফলিয়ে তাদের প্রতিমণ ধান বিক্রি করতে হচ্ছে সর্বোচ্চ ৫০০
টাকায়।
স্টাফ রিপার্টার, মৌলভীবাজার থেকে জানান, মৌলভীবাজারের কৃষক হতাশ। বাম্পার ফসল উৎপাদন হলেও মূল্য পাচ্ছেন না ধানের। প্রতিমণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে। তবে হাওর থেকে উজানে ধানের দাম একটু বেশি। মৌলভীবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায় জেলার ৭ উপজেলায় চলতি মওসুমে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৫৫ হাজার ৮ শত ৮৭ হেক্টর। বোরো আবাদ করা হয়েছে ৫১ হাজার ৪ শত ৮৮ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯৬ হাজার ৯০২ মেট্রিক টন চাউল।
মৌলভীবাজার জেলার সবচেয়ে বেশি বোরো আবাদ হয় কাউয়া দিঘি হাওরে। কথা হয় হাওরপাড়ের মমরোজপুর গ্রামের কৃষক আক্তার আহমদের সাথে। বড়গোপাট নামক স্থানে বোরো ধান শুকাচ্ছিলেন। জানালেন এবার যাই ফসল হয়েছে ক্ষেতে আর কামে মিকাপ হবে না। ব্যাখ্যা করে বলেন, প্রতি কিয়ার (৩০ শতকে কিয়ার) জমি তৈরি, চারা রোপণ , নিড়ানি, সেচ এবং ধান কাটা ও মাড়াই পর্যন্ত নিজের শ্রম বাদে ৭ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ধান উৎপাদন হয়েছে ১২/১৪ মণ (জাত ব্রি-২৮/২৯)। বর্তমান শুকনো ধান বিক্রি হচ্ছে হাওরে ৪শ’ এবং কাঁচা ধান ৩৫০ টাকা। পাশ থেকে আরেক কৃষক জালাল মিয়া বলেন, কৃষক ধান ফলায় লাভের আশায় নয়। ফলায় ঘরের ধান খাওয়ার জন্য। নিজের শ্রম কোন সময় যোগ করে না। তাই লাভ-ক্ষতি হিসাবে আসে কম। বর্গা চাষি নোমান মিয়া জানান, নিজে সাত কিয়ার জমি বর্গা করেছেন। নিজের শ্রম বাদ দিয়ে মোট খরচ হয়েছে ২৪ হাজার টাকা। সব ঋণ করে। এখন মালিককে ৩ মণ করে দিয়ে যে ধান নিজের ভাগে পড়েছে তা সব বিক্রি করলেও ঋণের টাকা উঠবে না। আরেক কৃষক সোহাগ মিয়া জানালেন সম্প্রতি তারা ৪ মণ ধান বিক্রি করেছেন ৩শ’ টাকা ধরে। ধানের মূল্য এবার এতো কম হবে তারা ভাবতেও পারেননি। মল্লিকসড়াই গ্রামের পাশে ক্যানেলের পাড়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে ধান প্রক্রিয়া করছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার দিন মোহাম্মদ। জানালেন ৮ কিয়ার জমি চুক্তিতে বর্গা করেছেন। ফসল হয়েছে ১৪/১৫ মণ করে। কিন্তু ৫শ’ টাকা করে ধানের মূল্য হওয়ায় এই বর্গাচাষি হতাশা প্রকাশ কর বলেন, সব দেখে মনে হচ্ছে খরচ উঠবে না। রাজনগর উপজেলার রক্তা গ্রামের বাবর জানালেন প্রতিমণ ধান এখন বিক্রি হচ্ছে ৫শ’ থেকে ৫শ’ ৪০ টাকা দরে। রাজনগর উপজেলার এক অটো-রাইস মিল জানান ধানের বাজার এবার বড় হতাশাজনক।
ঈশ্বরগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে হাইব্রিড ‘নাফকো-১০৮’ জাতের বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। এ বছর উপজেলার প্রায় দুইশত একর জমিতে ওই জাতের ধান আবাদ করা হয়। ‘নাফকো-১০৮’ জাতের বোরো ধানের বাম্পার ফলনে কৃষকের মুখে হাসির ঝিলিক। কিন্তু এ হাসি তারা ধরে রাখতে পারছেন না। বাজার দরের দিকে তাকিয়ে তাদের হাসি মিলিয়ে যাচ্ছে।
মহেশপুর গ্রামের কৃষক লিটন মিয়া জানান, অন্যান্য বছরের তুলনায় ৭৫ শতক জমিতে হাইব্রিড জাতের ধান চাষে এ বছর তিনি অধিক ফলনও পেয়েছেন। তবে বাজার মূল্য কম থাকায় তিনি হতাশা প্রকাশ করেছেন। চাপিলাকান্দা গ্রামের কৃষক হাবিবুর রহমান জানান, এ বছর ৫০ শতক জমিতে ‘নাফকো-১০৮’ জাতের ধান চাষ করে প্রায় ৫৪ মণ ধান পেয়েছেন। যা দেশীয় জাতের ধানের উৎপাদনের চেয়েও দ্বিগুণ। তবে বাজার মূল্য ভাল পাওয়া গেলে বাণিজ্যিকভাবে এ ধান চাষ করে কৃষকরা লাভবান হতে পারবেন বলে জানান তিনি ।
নাটোর প্রতিনিধি জানান, নাটোরে শুরু হয়েছে বোরো ধান কাটার পুরো মওসুম। বাতাসে সোনালী ধানের গন্ধ ভাসলেও দেশের শস্য ভাণ্ডারখ্যাত চলনবিলের চাষিদের মনে লাগেনি এর ছোঁয়া। ধান বিক্রি করে নিশ্চিত লোকসানের ছাপ কৃষকের মুখে। ধান উৎপাদন খরচের চেয়ে বাজার মূল্য কম হওয়ায় ঋণের টাকা পরিশোধের চিন্তায় দিশাহারা নাটোরের বোরো চাষিরা। আর যে সমস্ত চাষি লাভের আশায় দাদন নিয়ে বোরোর আবাদ করেছিলেন তাদের অবস্থা আরও নাজুক। তারা এখন পথে বসার উপক্রম। এছাড়া এবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন কৃষকদের বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে। ঝরবৃষ্টির কবল থেকে দ্রুত ফসল ঘরে তুলতে দেখা দিয়েছে শ্রমিক সংকট। অতিরিক্ত দাম দিয়েও মিলছে না শ্রমিক। এছাড়া কয়েক দফা শিলাবৃষ্টি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে এবার জেলায় ব্যাপক বোরো আবাদের ক্ষতি হয়েছে। তবে কৃষি বিভাগের মতে সেটা অসহনীয় পর্যায়ে যায়নি।
নাটোরের কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় ৫৭ হাজার ৪৯২ হেক্টর জমিতে জমিতে বোরো চাষ হয়েছে গত বছরের তুলনায় যা ২৬৭ হেক্টর বেশি। খাদ্য উদ্বৃত্ত জেলা নাটোরে আবাদ বাড়লেও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফলন কমে গেছে বলে কৃষকদের দাবি।
দেশের সর্ববৃহৎ চলনবিলের চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ধানের আবাদ করে লাভতো দূরের কথা ঋণের টাকা পরিশোধ করতে জমি বন্ধক কিংবা বিক্রি ছাড়া তাদের আর গতি নেই। সার ও কৃষি উৎপাদন সামগ্রির দাম বেশি হওয়ায় অনেক কৃষক চড়া সুদে ঋণ নিয়েছেন। এর ওপর দাদন ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যতো আছেই। নিজের ঘরে ধান না উঠলেও যে কোন মূল্যে সুদসহ দাদন ব্যবসায়ীদের টাকা শোধ করতে হবে।
চলনবিল অধ্যুষিত সিংড়া উপজেলার চৌগ্রাম ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও বোরো চাষি গোলজার হোসেন গিয়াস বলেন, চলনবিলের বেশির ভাগ মানুষের একমাত্র ফসল বোরো ধান। এতেই তাদের সারা বছরের খাওয়ার চাল ও বিক্রিকৃত টাকা দিয়ে সংসার চলে। এখানকার অনেক কৃষক চড়া সূদে ঋণ নিয়ে ধানের আবাদ করে থাকেন। এবার ধানের যে মূল্য তাতে তাদের পক্ষে সূদের টাকা যোগাতে আবার সূদে টাকা নিতে হবে অথবা চক্রবৃদ্ধি হারে সূদ দিতে গিয়ে জমিজিরাত বিক্রি অথবা বন্ধক দিতে হবে।
সিংড়ার চৌগ্রামের আরও এক চাষি বললেন, আমাদের প্রতিমণ ধান চাষ করতে খরচ পড়ে সাড়ে ৬শ’ টাকা থেকে ৭শ’ টাকা আর বিক্রি করতে হয় ৫শ’ টাকা। তাহলে আমরা যাব কোথায়। কথা হয় সদর উপজেলার দিঘাপতিয়া এলাকার ধান ব্যবসায়ী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তিনি বলেন, এখন ধানের দাম সাড়ে ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকা। পরে সরবরাহ বাড়লে আরও কিছু কমবে। এ রকম বাজার থাকলে কৃষকদের লোকসান হবে। এদিকে বোরো ধানের বাজার নিয়ে ভবিষ্যতে এর বিরূপ প্রভাব আগামী মওসুমে পড়লে জেলায় খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা করেছেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে বোরো ধানের যৌক্তিক মূল্য না দেয়া গেলে কৃষকরা বোরো আবাদে আগ্রহ হারাবেন।
স্টাফ রিপোর্টার, বগুড়া থেকে জানান, বগুড়ায় ধানের দাম কমে যাওয়ায় কৃষকের চোখেমুখে বিষণ্নতার ছাপ। কেউ কেউ বলছে ধান বিক্রি করে উৎপাদন খরচই উঠছে না। আবার কেউ বা বলছে বাজারে ধানের ক্রেতা কম। কম দামে ভারত থেকে চাল আমদানি হওয়ার কারণেই ধানের বাজারে তার প্রভাব পড়েছে।
জানা যায়, বগুড়ার বিভিন্ন হাটবাজারে শুকনা বিআর-২৮, বিআর ২৯ ধান ৫৮০ থেকে ৬শ’ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে। হাইব্রিড হীরাজাতের ধান বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৫শ’ টাকা পর্যন্ত। মাঠ থেকে ধান কেটে নিয়ে আসার পর কাঁচা ছড়ানো ধান বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৫১০ টাকা মণ।
বগুড়ার ধুনট উপজেলার চিথুলিয়া গ্রামের কৃষক রবিন সরকার জানান, সার কীটনাশক, কৃষাণ, পানিসহ অন্যান্য খরচ বাবদ প্রতি বিঘা জমিতে খরচ পড়েছে সাড়ে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত। এছাড়া জমির মূল্যতো আছে। আ প্রতিবিঘায় উৎপাদন হয়েছে ২০ থেকে ২২ মণ। হিসাব করে দেখা গেছে উৎপাদন খরচ ও ধানের দাম প্রায় সমান। কোন কোন ক্ষেত্রে উৎপাদিত ধানের দাম উৎপাদন খরচের চেয়ে বেশি। বাজারে ধান বিক্রি করতে গেলে একেবারেই কম দাম বলা হচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে ধানের ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। বগুড়া কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক চণ্ডী দাস কুণ্ডুু জানান, চলতি মওমুমে ১ লাখ ৯২ হাজার ৫৮০ হেক্টর জমিতে এবার বোরো ধান চাষ করা হয়। উৎপাদন হবে ৮ লাখ ১৮ হাজার মেট্রিক টন। সরকার প্রতিমণ ধানের দাম নির্ধারণ করেছে ৮৮০ টাকা।
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হ্যাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক একেএম লায়েক আলী জানান, ধানের দাম কমে যাওয়ার হিসাব টা খুবই সহজ। কম দামে ভারত থেকে চাল আমদানি করায় দেশে উৎপাদিত ধান বিক্রি হয়নি। সেগুলি স্টক জমে গেছে। এছাড়ও এবারের উৎপাদিত ধান রয়েছে। ভারত থেকে চাল আমদানি করার বিরুদ্ধে আমরা প্রতিবাদ করলেও আমাদের কথা শোনা হয়নি। আগে চালের দাম বেড়ে গেলেই বলা হতো সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানো হয়েছে। দোষ দেয়া হতো আমাদের। এখন কোথায় গেল সে সিন্ডিকেট।
স্টাফ রিপোর্টার, কিশোরগঞ্জ থেকে জানান, কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলে চলছে বোরো ধান সংগ্রহে শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা। বছরের একমাত্র বোরো ফসলকে ঘিরে এখন উৎসবে রঙিন পুরো হাওর-জনপদ। বোশেখের তপ্ত রোদে নেয়ে-ঘেমে ধান কাটছেন দাওয়ালুরা। কেটে আনা ধান ঘরে তুলতে ব্যস্ত কিষাণ-কিষাণি। থেমে নেই ছোট ছোট শিশুরাও, তারাও মা-বাবার সহযোগী হয়ে মহাব্যস্ত। ধান কাটার পর মাড়াই-শুকানো সবই চলছে সমান তালে। কারো কোন ফুরসত নেই। অনুকূল আবহাওয়ায় এবার বোরোর বাম্পার ফলন হলেও দাম না পাওয়ার কারণে স্বস্তিতে নেই কৃষক। কৃষকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, গত চার বছর ধরে তারা বোরো আবাদে ক্রমাগত লোকসান দিয়ে যাচ্ছেন। এবার ভাল ফলন হওয়ায় সে ধকল কিছুটা কাটিয়ে ওঠার আশা করেছিলেন তারা। কিন্তু তাদের সে আশায় গুড়েবালি। ধানের প্রাথমিক মূল্য কম থাকায় এবারও লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের। সরকার ধান ও চালের দাম কেজিপ্রতি যথাক্রমে ২২ ও ৩২ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও জেলায় এখনও ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়নি। ফলে সরকার নির্ধারিত দামের অর্ধেক মূল্যে বাধ্য হয়ে কৃষককে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে।
জেলা কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক অমিতাভ দাস জানান, এবার জেলার ১৩টি উপজেলায় বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল এক লাখ ৬৪ হাজার ৫৮১ হেক্টর জমিতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে আবাদ হয়েছে এক লাখ ৬৬ হাজার ২৮৫ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে কেবল জেলার হাওরাঞ্চলেই আবাদ হয়েছে ৯৯ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে।
জেলা খাদ্য বিভাগ সূত্র জানায়, ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও নিকলী এই চারটি হাওর উপজেলার কৃষকের কাছ থেকে ধান এবং অন্য উপজেলার তালিকাভুক্ত মিলারদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করা হয়। তবে এ বছর ধান-চাল সংগ্রহের বিষয়ে এখনও কোন চিঠি জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে এসে পৌঁছেনি। সহসাই সে চিঠি পাওয়া গেলে সপ্তাহখানেক পরে এ অভিযান শুরু করা হতে পারে বলে কার্যালয়ের একটি সূত্র থেকে ধারণা পাওয়া যায়।
মিঠামইনে হাওরের কাটখাল গ্রামের ষাটোর্ধ কৃষক কামাল মিয়া এবার ১০ একর জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন। ফলনও ভাল হয়েছে। তারপরও স্বস্তি নেই তার মনে। মহাজনের ঋণের বোঝা তার মাথার উপর ঝুলছে। ধানের কম দাম তার ফসল তোলার আনন্দকে ম্লান করে দিয়েছে। মহাজনের ঋণ শোধ করে যে সারাটা বছর কিভাবে চলবে তা একমাত্র আলাহ্ই জানে! বলতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন কামাল মিয়া।
একই উপজেলার ঘাগড়া গ্রামের কৃষক আরমান মিয়া জানান, তিনি ৮ একর জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন। জমি আবাদ করতে গিয়ে মহাজনের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। এখন তাকে পরিশোধ করতে হবে ৭৫ হাজার টাকা। ধানের দাম কম হওয়া সত্ত্বেও তাকে ঋণ পরিশোধ করতে খলাতে রেখেই ধান বিক্রি করতে হচ্ছে।
কৃষক ইন্তাজ আলী জানান, প্রতিমণ ধান ফলাতে কৃষকের খরচ পড়েছে প্রায় ৭শ’ টাকা। অথচ বর্তমানে সর্বনিম্ন সাড়ে ৪শ’ টাকা এবং সর্বোচ্চ সাড়ে ৫শ’ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি করা যাচ্ছে। এতে তাদের মণপ্রতি বড় অঙ্কের লোকসান গুণতে হচ্ছে।
ইটনা উপজেলার মৃগা গ্রামের কৃষক শামীম মিয়া জানান, একটি মাত্র বোরো ফসলই হাওরের জীবন-জীবিকা। কৃষকের হাতে নগদ টাকা না থাকায় শ্রমিক খরচসহ নানা খরচের যোগান দিতে বাধ্য হয়ে কম মূল্যে তাদের ধান বিক্রি করতে হচ্ছে। এই কারণে ধানের ফলনে খুশি হলেও তারা দামে ধরা খাচ্ছেন।
একই উপজেলার করনশী গ্রামের কৃষক হাবিবুর রহমান বলেন, প্রতি বছর ভালো দাম পাওয়ার আশা করলেও আমরা বার বারই নিরাশ হচ্ছি। তবুও বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে আমাদের বাধ্য হয়ে ধান চাষ করতে হচ্ছে।
একই গ্রামের কৃষক আবুল কাশেম জানান, উৎপাদিত ধানের বেশির ভাগই ধান কাটা ও মাড়াইয়ের মজুরি মেটাতে চলে যায়। এছাড়া মসুমজুড়ে হালচাষ, আবাদ, সার ও কীটনাশকসহ উৎপাদন সংশ্লিষ্ট নানা খরচ গুণতে হয়েছে। কিন্তু ধানের দাম কৃষকদেরকে চরমভাবে হতাশ করেছে।
একই রকম কথা জানালেন মিঠামইনের মহিষারকান্দি গ্রামের কৃষক সাহিদ মিয়া, কালু মিয়া ও বাছির মিয়া, ঢাকী গ্রামের শফিকুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর মিয়া ও জিল্লুর রহমান, অষ্টগ্রামের সাপান্ত গ্রামের কৃষক বিষ্টু লাল দাস, চৌদন্ত বড়হাটির কৃষক আনন্দ দাস ও সুখময় দাস এবং ইটনার ধনপুর গ্রামের কৃষক ভজন দাস, সদরের আজাদ হোসেন ও আবদুর রউফসহ অনেকেই। তারা জানান, হাওরে এখন অধিকাংশ কৃষকের একই দশা। ধানের দাম না থাকায় তাদের মাথায় হাত পড়েছে। তারা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, যখন কৃষকের হাতে ধান থাকে তখন দাম কমে যায়। ধান কৃষকের হাত থেকে চলে গেলে দাম বাড়ে।
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, হাওরের জেলা সুনামগঞ্জে বোরো ধানের দাম নিয়ে অসন্তুষ্ট কৃষক। ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে কৃষকরা। জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রতিমণ ধান ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ধানের দাম কম হওয়ায় কৃষকের মাথায় হাত।
সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে, হাওরে ধান কাটা শেষ না হওয়ায় ধান ক্রয় বিক্রয় তেমন একটা শুরু হয়নি। কৃষক ধান কাটা নিয়েই ব্যস্ত। তবে যাদের ধান কাটা শেষ হয়েছে তারাও ধানের দাম কম পাওয়ায় বিক্রি করছে না। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের নুরুল্লা গ্রামের কৃষক বাবুল মিয়া জানান, প্রতিমণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকায়। ধানের দাম কম হওয়ায় আমি ধান বিক্রি না করেই রেখে দিয়েছি। যদি দাম বাড়ে তখন ধান বিক্রি করবো।
দিরাই উপজেলার চাপতির হাওরপাড়ের কৃষক আবদুুস ছত্তার ও হিরন সরদার জানান, একমণ ধান ফলাতে যে অর্থ ব্যয় ও পরিশ্রম হয়েছে তা ৫০০ টাকা মণ বিক্রি করে কৃষকের পুষায় না। তাই আমরা ধান বিক্রি করছি না। দেখা গেছে, প্রায় প্রতিদিনই বৃষ্টি হওয়ায় ধান কাটার পর তা শুকাতে পারছে না কৃষক। ভিজা ধান কিনতে বেপারীদের আগ্রহ কম থাকায় পুরোদমে শুরু হয়নি ধান বিক্রি।
জামালগঞ্জ উপজেলার গজারিয়া গ্রামের সজল মিয়া জানান, জলাবদ্ধতার কারণে এখনও ধান কাটা শেষ হয়নি। রৌদ্রের অভাবে ধান নষ্ট হওয়ার উপক্রম। তাই বেপারীরা ধান কিনছে না। টাকার অভাবেই অনেকেই কম দামে ধান বিক্রি করছে। দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার গাজীনগর গ্রামের কৃষক বদরুল মিয়া বলেন, অতিবৃষ্টির কারণে হাওরে জলবদ্ধতায় পানির নিচে চলে গেছে বোরো ধান। আমরা প্রায় ১৫ বিঘা জমির ধান পানির নিচে। আমার মতো অনেক কৃষকেরই একই অবস্থা।
সুনামগঞ্জ কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. জাহেদুল হক বলেন, সরকারি ভাবে ধান-চাল সংগ্রহ শুরু হলে ধানের দাম বাড়বে। এছাড়াও জেলায় যে পরিমাণ ধান-চাল সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তার পরিমাণ বাড়ালে জেলায় ধানের দাম বাড়বে।
স্টাফ রিপার্টার, মৌলভীবাজার থেকে জানান, মৌলভীবাজারের কৃষক হতাশ। বাম্পার ফসল উৎপাদন হলেও মূল্য পাচ্ছেন না ধানের। প্রতিমণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে। তবে হাওর থেকে উজানে ধানের দাম একটু বেশি। মৌলভীবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায় জেলার ৭ উপজেলায় চলতি মওসুমে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৫৫ হাজার ৮ শত ৮৭ হেক্টর। বোরো আবাদ করা হয়েছে ৫১ হাজার ৪ শত ৮৮ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯৬ হাজার ৯০২ মেট্রিক টন চাউল।
মৌলভীবাজার জেলার সবচেয়ে বেশি বোরো আবাদ হয় কাউয়া দিঘি হাওরে। কথা হয় হাওরপাড়ের মমরোজপুর গ্রামের কৃষক আক্তার আহমদের সাথে। বড়গোপাট নামক স্থানে বোরো ধান শুকাচ্ছিলেন। জানালেন এবার যাই ফসল হয়েছে ক্ষেতে আর কামে মিকাপ হবে না। ব্যাখ্যা করে বলেন, প্রতি কিয়ার (৩০ শতকে কিয়ার) জমি তৈরি, চারা রোপণ , নিড়ানি, সেচ এবং ধান কাটা ও মাড়াই পর্যন্ত নিজের শ্রম বাদে ৭ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ধান উৎপাদন হয়েছে ১২/১৪ মণ (জাত ব্রি-২৮/২৯)। বর্তমান শুকনো ধান বিক্রি হচ্ছে হাওরে ৪শ’ এবং কাঁচা ধান ৩৫০ টাকা। পাশ থেকে আরেক কৃষক জালাল মিয়া বলেন, কৃষক ধান ফলায় লাভের আশায় নয়। ফলায় ঘরের ধান খাওয়ার জন্য। নিজের শ্রম কোন সময় যোগ করে না। তাই লাভ-ক্ষতি হিসাবে আসে কম। বর্গা চাষি নোমান মিয়া জানান, নিজে সাত কিয়ার জমি বর্গা করেছেন। নিজের শ্রম বাদ দিয়ে মোট খরচ হয়েছে ২৪ হাজার টাকা। সব ঋণ করে। এখন মালিককে ৩ মণ করে দিয়ে যে ধান নিজের ভাগে পড়েছে তা সব বিক্রি করলেও ঋণের টাকা উঠবে না। আরেক কৃষক সোহাগ মিয়া জানালেন সম্প্রতি তারা ৪ মণ ধান বিক্রি করেছেন ৩শ’ টাকা ধরে। ধানের মূল্য এবার এতো কম হবে তারা ভাবতেও পারেননি। মল্লিকসড়াই গ্রামের পাশে ক্যানেলের পাড়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে ধান প্রক্রিয়া করছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার দিন মোহাম্মদ। জানালেন ৮ কিয়ার জমি চুক্তিতে বর্গা করেছেন। ফসল হয়েছে ১৪/১৫ মণ করে। কিন্তু ৫শ’ টাকা করে ধানের মূল্য হওয়ায় এই বর্গাচাষি হতাশা প্রকাশ কর বলেন, সব দেখে মনে হচ্ছে খরচ উঠবে না। রাজনগর উপজেলার রক্তা গ্রামের বাবর জানালেন প্রতিমণ ধান এখন বিক্রি হচ্ছে ৫শ’ থেকে ৫শ’ ৪০ টাকা দরে। রাজনগর উপজেলার এক অটো-রাইস মিল জানান ধানের বাজার এবার বড় হতাশাজনক।
ঈশ্বরগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে হাইব্রিড ‘নাফকো-১০৮’ জাতের বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। এ বছর উপজেলার প্রায় দুইশত একর জমিতে ওই জাতের ধান আবাদ করা হয়। ‘নাফকো-১০৮’ জাতের বোরো ধানের বাম্পার ফলনে কৃষকের মুখে হাসির ঝিলিক। কিন্তু এ হাসি তারা ধরে রাখতে পারছেন না। বাজার দরের দিকে তাকিয়ে তাদের হাসি মিলিয়ে যাচ্ছে।
মহেশপুর গ্রামের কৃষক লিটন মিয়া জানান, অন্যান্য বছরের তুলনায় ৭৫ শতক জমিতে হাইব্রিড জাতের ধান চাষে এ বছর তিনি অধিক ফলনও পেয়েছেন। তবে বাজার মূল্য কম থাকায় তিনি হতাশা প্রকাশ করেছেন। চাপিলাকান্দা গ্রামের কৃষক হাবিবুর রহমান জানান, এ বছর ৫০ শতক জমিতে ‘নাফকো-১০৮’ জাতের ধান চাষ করে প্রায় ৫৪ মণ ধান পেয়েছেন। যা দেশীয় জাতের ধানের উৎপাদনের চেয়েও দ্বিগুণ। তবে বাজার মূল্য ভাল পাওয়া গেলে বাণিজ্যিকভাবে এ ধান চাষ করে কৃষকরা লাভবান হতে পারবেন বলে জানান তিনি ।
নাটোর প্রতিনিধি জানান, নাটোরে শুরু হয়েছে বোরো ধান কাটার পুরো মওসুম। বাতাসে সোনালী ধানের গন্ধ ভাসলেও দেশের শস্য ভাণ্ডারখ্যাত চলনবিলের চাষিদের মনে লাগেনি এর ছোঁয়া। ধান বিক্রি করে নিশ্চিত লোকসানের ছাপ কৃষকের মুখে। ধান উৎপাদন খরচের চেয়ে বাজার মূল্য কম হওয়ায় ঋণের টাকা পরিশোধের চিন্তায় দিশাহারা নাটোরের বোরো চাষিরা। আর যে সমস্ত চাষি লাভের আশায় দাদন নিয়ে বোরোর আবাদ করেছিলেন তাদের অবস্থা আরও নাজুক। তারা এখন পথে বসার উপক্রম। এছাড়া এবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন কৃষকদের বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে। ঝরবৃষ্টির কবল থেকে দ্রুত ফসল ঘরে তুলতে দেখা দিয়েছে শ্রমিক সংকট। অতিরিক্ত দাম দিয়েও মিলছে না শ্রমিক। এছাড়া কয়েক দফা শিলাবৃষ্টি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে এবার জেলায় ব্যাপক বোরো আবাদের ক্ষতি হয়েছে। তবে কৃষি বিভাগের মতে সেটা অসহনীয় পর্যায়ে যায়নি।
নাটোরের কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় ৫৭ হাজার ৪৯২ হেক্টর জমিতে জমিতে বোরো চাষ হয়েছে গত বছরের তুলনায় যা ২৬৭ হেক্টর বেশি। খাদ্য উদ্বৃত্ত জেলা নাটোরে আবাদ বাড়লেও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফলন কমে গেছে বলে কৃষকদের দাবি।
দেশের সর্ববৃহৎ চলনবিলের চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ধানের আবাদ করে লাভতো দূরের কথা ঋণের টাকা পরিশোধ করতে জমি বন্ধক কিংবা বিক্রি ছাড়া তাদের আর গতি নেই। সার ও কৃষি উৎপাদন সামগ্রির দাম বেশি হওয়ায় অনেক কৃষক চড়া সুদে ঋণ নিয়েছেন। এর ওপর দাদন ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যতো আছেই। নিজের ঘরে ধান না উঠলেও যে কোন মূল্যে সুদসহ দাদন ব্যবসায়ীদের টাকা শোধ করতে হবে।
চলনবিল অধ্যুষিত সিংড়া উপজেলার চৌগ্রাম ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও বোরো চাষি গোলজার হোসেন গিয়াস বলেন, চলনবিলের বেশির ভাগ মানুষের একমাত্র ফসল বোরো ধান। এতেই তাদের সারা বছরের খাওয়ার চাল ও বিক্রিকৃত টাকা দিয়ে সংসার চলে। এখানকার অনেক কৃষক চড়া সূদে ঋণ নিয়ে ধানের আবাদ করে থাকেন। এবার ধানের যে মূল্য তাতে তাদের পক্ষে সূদের টাকা যোগাতে আবার সূদে টাকা নিতে হবে অথবা চক্রবৃদ্ধি হারে সূদ দিতে গিয়ে জমিজিরাত বিক্রি অথবা বন্ধক দিতে হবে।
সিংড়ার চৌগ্রামের আরও এক চাষি বললেন, আমাদের প্রতিমণ ধান চাষ করতে খরচ পড়ে সাড়ে ৬শ’ টাকা থেকে ৭শ’ টাকা আর বিক্রি করতে হয় ৫শ’ টাকা। তাহলে আমরা যাব কোথায়। কথা হয় সদর উপজেলার দিঘাপতিয়া এলাকার ধান ব্যবসায়ী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তিনি বলেন, এখন ধানের দাম সাড়ে ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকা। পরে সরবরাহ বাড়লে আরও কিছু কমবে। এ রকম বাজার থাকলে কৃষকদের লোকসান হবে। এদিকে বোরো ধানের বাজার নিয়ে ভবিষ্যতে এর বিরূপ প্রভাব আগামী মওসুমে পড়লে জেলায় খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা করেছেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে বোরো ধানের যৌক্তিক মূল্য না দেয়া গেলে কৃষকরা বোরো আবাদে আগ্রহ হারাবেন।
স্টাফ রিপোর্টার, বগুড়া থেকে জানান, বগুড়ায় ধানের দাম কমে যাওয়ায় কৃষকের চোখেমুখে বিষণ্নতার ছাপ। কেউ কেউ বলছে ধান বিক্রি করে উৎপাদন খরচই উঠছে না। আবার কেউ বা বলছে বাজারে ধানের ক্রেতা কম। কম দামে ভারত থেকে চাল আমদানি হওয়ার কারণেই ধানের বাজারে তার প্রভাব পড়েছে।
জানা যায়, বগুড়ার বিভিন্ন হাটবাজারে শুকনা বিআর-২৮, বিআর ২৯ ধান ৫৮০ থেকে ৬শ’ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে। হাইব্রিড হীরাজাতের ধান বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৫শ’ টাকা পর্যন্ত। মাঠ থেকে ধান কেটে নিয়ে আসার পর কাঁচা ছড়ানো ধান বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৫১০ টাকা মণ।
বগুড়ার ধুনট উপজেলার চিথুলিয়া গ্রামের কৃষক রবিন সরকার জানান, সার কীটনাশক, কৃষাণ, পানিসহ অন্যান্য খরচ বাবদ প্রতি বিঘা জমিতে খরচ পড়েছে সাড়ে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত। এছাড়া জমির মূল্যতো আছে। আ প্রতিবিঘায় উৎপাদন হয়েছে ২০ থেকে ২২ মণ। হিসাব করে দেখা গেছে উৎপাদন খরচ ও ধানের দাম প্রায় সমান। কোন কোন ক্ষেত্রে উৎপাদিত ধানের দাম উৎপাদন খরচের চেয়ে বেশি। বাজারে ধান বিক্রি করতে গেলে একেবারেই কম দাম বলা হচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে ধানের ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। বগুড়া কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক চণ্ডী দাস কুণ্ডুু জানান, চলতি মওমুমে ১ লাখ ৯২ হাজার ৫৮০ হেক্টর জমিতে এবার বোরো ধান চাষ করা হয়। উৎপাদন হবে ৮ লাখ ১৮ হাজার মেট্রিক টন। সরকার প্রতিমণ ধানের দাম নির্ধারণ করেছে ৮৮০ টাকা।
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হ্যাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক একেএম লায়েক আলী জানান, ধানের দাম কমে যাওয়ার হিসাব টা খুবই সহজ। কম দামে ভারত থেকে চাল আমদানি করায় দেশে উৎপাদিত ধান বিক্রি হয়নি। সেগুলি স্টক জমে গেছে। এছাড়ও এবারের উৎপাদিত ধান রয়েছে। ভারত থেকে চাল আমদানি করার বিরুদ্ধে আমরা প্রতিবাদ করলেও আমাদের কথা শোনা হয়নি। আগে চালের দাম বেড়ে গেলেই বলা হতো সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানো হয়েছে। দোষ দেয়া হতো আমাদের। এখন কোথায় গেল সে সিন্ডিকেট।
স্টাফ রিপোর্টার, কিশোরগঞ্জ থেকে জানান, কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলে চলছে বোরো ধান সংগ্রহে শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা। বছরের একমাত্র বোরো ফসলকে ঘিরে এখন উৎসবে রঙিন পুরো হাওর-জনপদ। বোশেখের তপ্ত রোদে নেয়ে-ঘেমে ধান কাটছেন দাওয়ালুরা। কেটে আনা ধান ঘরে তুলতে ব্যস্ত কিষাণ-কিষাণি। থেমে নেই ছোট ছোট শিশুরাও, তারাও মা-বাবার সহযোগী হয়ে মহাব্যস্ত। ধান কাটার পর মাড়াই-শুকানো সবই চলছে সমান তালে। কারো কোন ফুরসত নেই। অনুকূল আবহাওয়ায় এবার বোরোর বাম্পার ফলন হলেও দাম না পাওয়ার কারণে স্বস্তিতে নেই কৃষক। কৃষকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, গত চার বছর ধরে তারা বোরো আবাদে ক্রমাগত লোকসান দিয়ে যাচ্ছেন। এবার ভাল ফলন হওয়ায় সে ধকল কিছুটা কাটিয়ে ওঠার আশা করেছিলেন তারা। কিন্তু তাদের সে আশায় গুড়েবালি। ধানের প্রাথমিক মূল্য কম থাকায় এবারও লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের। সরকার ধান ও চালের দাম কেজিপ্রতি যথাক্রমে ২২ ও ৩২ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও জেলায় এখনও ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়নি। ফলে সরকার নির্ধারিত দামের অর্ধেক মূল্যে বাধ্য হয়ে কৃষককে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে।
জেলা কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক অমিতাভ দাস জানান, এবার জেলার ১৩টি উপজেলায় বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল এক লাখ ৬৪ হাজার ৫৮১ হেক্টর জমিতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে আবাদ হয়েছে এক লাখ ৬৬ হাজার ২৮৫ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে কেবল জেলার হাওরাঞ্চলেই আবাদ হয়েছে ৯৯ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে।
জেলা খাদ্য বিভাগ সূত্র জানায়, ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও নিকলী এই চারটি হাওর উপজেলার কৃষকের কাছ থেকে ধান এবং অন্য উপজেলার তালিকাভুক্ত মিলারদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করা হয়। তবে এ বছর ধান-চাল সংগ্রহের বিষয়ে এখনও কোন চিঠি জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে এসে পৌঁছেনি। সহসাই সে চিঠি পাওয়া গেলে সপ্তাহখানেক পরে এ অভিযান শুরু করা হতে পারে বলে কার্যালয়ের একটি সূত্র থেকে ধারণা পাওয়া যায়।
মিঠামইনে হাওরের কাটখাল গ্রামের ষাটোর্ধ কৃষক কামাল মিয়া এবার ১০ একর জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন। ফলনও ভাল হয়েছে। তারপরও স্বস্তি নেই তার মনে। মহাজনের ঋণের বোঝা তার মাথার উপর ঝুলছে। ধানের কম দাম তার ফসল তোলার আনন্দকে ম্লান করে দিয়েছে। মহাজনের ঋণ শোধ করে যে সারাটা বছর কিভাবে চলবে তা একমাত্র আলাহ্ই জানে! বলতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন কামাল মিয়া।
একই উপজেলার ঘাগড়া গ্রামের কৃষক আরমান মিয়া জানান, তিনি ৮ একর জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন। জমি আবাদ করতে গিয়ে মহাজনের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। এখন তাকে পরিশোধ করতে হবে ৭৫ হাজার টাকা। ধানের দাম কম হওয়া সত্ত্বেও তাকে ঋণ পরিশোধ করতে খলাতে রেখেই ধান বিক্রি করতে হচ্ছে।
কৃষক ইন্তাজ আলী জানান, প্রতিমণ ধান ফলাতে কৃষকের খরচ পড়েছে প্রায় ৭শ’ টাকা। অথচ বর্তমানে সর্বনিম্ন সাড়ে ৪শ’ টাকা এবং সর্বোচ্চ সাড়ে ৫শ’ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি করা যাচ্ছে। এতে তাদের মণপ্রতি বড় অঙ্কের লোকসান গুণতে হচ্ছে।
ইটনা উপজেলার মৃগা গ্রামের কৃষক শামীম মিয়া জানান, একটি মাত্র বোরো ফসলই হাওরের জীবন-জীবিকা। কৃষকের হাতে নগদ টাকা না থাকায় শ্রমিক খরচসহ নানা খরচের যোগান দিতে বাধ্য হয়ে কম মূল্যে তাদের ধান বিক্রি করতে হচ্ছে। এই কারণে ধানের ফলনে খুশি হলেও তারা দামে ধরা খাচ্ছেন।
একই উপজেলার করনশী গ্রামের কৃষক হাবিবুর রহমান বলেন, প্রতি বছর ভালো দাম পাওয়ার আশা করলেও আমরা বার বারই নিরাশ হচ্ছি। তবুও বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে আমাদের বাধ্য হয়ে ধান চাষ করতে হচ্ছে।
একই গ্রামের কৃষক আবুল কাশেম জানান, উৎপাদিত ধানের বেশির ভাগই ধান কাটা ও মাড়াইয়ের মজুরি মেটাতে চলে যায়। এছাড়া মসুমজুড়ে হালচাষ, আবাদ, সার ও কীটনাশকসহ উৎপাদন সংশ্লিষ্ট নানা খরচ গুণতে হয়েছে। কিন্তু ধানের দাম কৃষকদেরকে চরমভাবে হতাশ করেছে।
একই রকম কথা জানালেন মিঠামইনের মহিষারকান্দি গ্রামের কৃষক সাহিদ মিয়া, কালু মিয়া ও বাছির মিয়া, ঢাকী গ্রামের শফিকুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর মিয়া ও জিল্লুর রহমান, অষ্টগ্রামের সাপান্ত গ্রামের কৃষক বিষ্টু লাল দাস, চৌদন্ত বড়হাটির কৃষক আনন্দ দাস ও সুখময় দাস এবং ইটনার ধনপুর গ্রামের কৃষক ভজন দাস, সদরের আজাদ হোসেন ও আবদুর রউফসহ অনেকেই। তারা জানান, হাওরে এখন অধিকাংশ কৃষকের একই দশা। ধানের দাম না থাকায় তাদের মাথায় হাত পড়েছে। তারা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, যখন কৃষকের হাতে ধান থাকে তখন দাম কমে যায়। ধান কৃষকের হাত থেকে চলে গেলে দাম বাড়ে।
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, হাওরের জেলা সুনামগঞ্জে বোরো ধানের দাম নিয়ে অসন্তুষ্ট কৃষক। ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে কৃষকরা। জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রতিমণ ধান ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ধানের দাম কম হওয়ায় কৃষকের মাথায় হাত।
সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে, হাওরে ধান কাটা শেষ না হওয়ায় ধান ক্রয় বিক্রয় তেমন একটা শুরু হয়নি। কৃষক ধান কাটা নিয়েই ব্যস্ত। তবে যাদের ধান কাটা শেষ হয়েছে তারাও ধানের দাম কম পাওয়ায় বিক্রি করছে না। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের নুরুল্লা গ্রামের কৃষক বাবুল মিয়া জানান, প্রতিমণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকায়। ধানের দাম কম হওয়ায় আমি ধান বিক্রি না করেই রেখে দিয়েছি। যদি দাম বাড়ে তখন ধান বিক্রি করবো।
দিরাই উপজেলার চাপতির হাওরপাড়ের কৃষক আবদুুস ছত্তার ও হিরন সরদার জানান, একমণ ধান ফলাতে যে অর্থ ব্যয় ও পরিশ্রম হয়েছে তা ৫০০ টাকা মণ বিক্রি করে কৃষকের পুষায় না। তাই আমরা ধান বিক্রি করছি না। দেখা গেছে, প্রায় প্রতিদিনই বৃষ্টি হওয়ায় ধান কাটার পর তা শুকাতে পারছে না কৃষক। ভিজা ধান কিনতে বেপারীদের আগ্রহ কম থাকায় পুরোদমে শুরু হয়নি ধান বিক্রি।
জামালগঞ্জ উপজেলার গজারিয়া গ্রামের সজল মিয়া জানান, জলাবদ্ধতার কারণে এখনও ধান কাটা শেষ হয়নি। রৌদ্রের অভাবে ধান নষ্ট হওয়ার উপক্রম। তাই বেপারীরা ধান কিনছে না। টাকার অভাবেই অনেকেই কম দামে ধান বিক্রি করছে। দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার গাজীনগর গ্রামের কৃষক বদরুল মিয়া বলেন, অতিবৃষ্টির কারণে হাওরে জলবদ্ধতায় পানির নিচে চলে গেছে বোরো ধান। আমরা প্রায় ১৫ বিঘা জমির ধান পানির নিচে। আমার মতো অনেক কৃষকেরই একই অবস্থা।
সুনামগঞ্জ কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. জাহেদুল হক বলেন, সরকারি ভাবে ধান-চাল সংগ্রহ শুরু হলে ধানের দাম বাড়বে। এছাড়াও জেলায় যে পরিমাণ ধান-চাল সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তার পরিমাণ বাড়ালে জেলায় ধানের দাম বাড়বে।
No comments