যাঁদের ঠেকানোর দায়িত্ব তাঁরাই মদদ দিচ্ছেন by শেখ সাবিহা আলম
বাল্যবিবাহ
যাঁদের ঠেকানোর কথা, তাঁরাই এর মদদদাতা। তাঁদের তালিকায় আছেন জনপ্রতিনিধি,
গণ্যমান্য ব্যক্তি, কাজি ও আইনজীবী। বাংলাদেশের বাল্যবিবাহপ্রবণ ১০টি
জেলায় খোঁজ নিয়ে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
আরও জানা গেছে, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বাল্যবিবাহ রোধে কোনো সফলতা সরকার পাচ্ছে না। সব বিয়ের খবর প্রশাসন পাচ্ছে না। খবর পেলে প্রশাসন যাচ্ছে, বিয়ে ভাঙছে, জরিমানা করছে। কিন্তু কিছুদিন পরই এসব শিশুকে আবার বিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সে খবর প্রশাসন রাখছে না।
বাল্যবিবাহের দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। সরকারি হিসাবে দেশের ৬৪ শতাংশ শিশুর বিয়ে হচ্ছে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠিত গার্ল সামিটে ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচে এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ পুরোপুরি বন্ধ করার অঙ্গীকার করেন। এরপর উল্টো বিয়ের বয়স কমাতে আইন সংশোধনের তোড়জোড় শোনা যায়। বাল্যবিবাহ রোধে সরকারের সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ কী, জানতে চাইলে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তারিক-উল-ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউনিসেফ, ইউএনএফপিএ ও বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করছে। আমরা তাগাদা দিচ্ছি।’
২০১৩ সালে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) বাংলাদেশের বাল্যবিবাহ নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। দারিদ্র্য, মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা, বয়স বেড়ে গেলে যৌতুকের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে অভিভাবকেরা কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিচ্ছেন বলে এতে উল্লেখ করা হয়।
মাঠের চিত্র: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফ গত বছর মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার জরিপ প্রকাশ করে। ওই জরিপ অনুযায়ী, বাল্যবিবাহপ্রবণ ১০ জেলা হচ্ছে বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, পঞ্চগড়, জামালপুর, কুষ্টিয়া ও খুলনা। জরিপের সময় বগুড়ায় ১৫-১৯ বছর বয়সী কিশোরীদের ৬০ শতাংশ, জয়পুরহাটে ৫৮ দশমিক ৪ শতাংশ, কুড়িগ্রামে ৫৫ দশমিক ৩ শতাংশ, নাটোরে ৫২ দশমিক ২ শতাংশ, নওগাঁয় ৫০ দশমিক ৬ শতাংশ কিশোরী বিবাহিত ছিল।
বাল্যবিবাহ রোধ নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের পর্যবেক্ষণ হলো, যেসব এলাকায় জন্মনিবন্ধনের হার কম, সেখানে বাল্যবিবাহের হার বেশি। বাল্যবিবাহপ্রবণ এলাকায় জন্মনিবন্ধনের হার ১৫ দশমিক ৯ থেকে ৫৩ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত। একমাত্র কুড়িগ্রাম জেলায় পাঁচ বছরের নিচে শিশুদের জন্মনিবন্ধনের হার ছিল ৮১ দশমিক ৭ শতাংশ।
বেশ কয়েকটি জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জনপ্রতিনিধিদের দেওয়া জন্মসনদের ভিত্তিতে বিয়ে হচ্ছে। কখনো কখনো নাম একটু-আধটু পরিবর্তন করে ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা থেকে একই মেয়ের একাধিক জন্মনিবন্ধন কার্ড তৈরির ঘটনাও ঘটছে।
গত বছরের নভেম্বরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের স্বর্ণকারপট্টিতে ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া একটি মেয়ের বিয়ে ভেঙে দেয় প্রশাসন। মাস খানেকের মাথায় মেয়েটিকে তার অভিভাবক অন্য জায়গায় নিয়ে বিয়ে দেন। স্বজনেরা জানান, বিয়ে দিতে তাঁরা জন্মসনদ জোগাড় করেছিলেন। বনিবনা না হওয়ায় এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে মেয়েটি তালাক দিয়ে ফিরে আসে।
প্রশ্ন উঠেছে, ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া মেয়েটির বিয়ে হলো কীভাবে? খোঁজ নিতে এই প্রতিবেদক চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভায় যান। মেয়রের অনুপস্থিতিতে কথা বলেন পৌরসভার প্যানেল মেয়র মোসলেমা বেগম। তিনি জন্মসনদ দেন না বলে দাবি করেন। তবে অনেকেই ভবিষ্যতে ভোট না পাওয়ার ভয়ে ভুয়া সনদ দিয়ে দেন।
জন্মসনদ থাকলে কাজি, আইনজীবী সবাই নির্বিঘ্নে বিয়ে পড়ান। সন্দেহ হলেও প্রশ্ন তোলেন না। এ সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছেন অসচেতন অভিভাবকেরা। বাংলাদেশ সম্মিলিত ম্যারেজ রেজিস্ট্রার ফোরামের সভাপতি কাজি সাব্বির প্রথম আলোকে বলেন, সব কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকলে তাঁদের বিয়ে না পড়িয়ে উপায় থাকে না। বাল্যবিবাহ রোধ করতে হলে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ভুয়া জন্মসনদ দেওয়া বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া নোটারি পাবলিক বিয়ের হলফনামা না দিলে ৮০ শতাংশ বাল্যবিবাহ কমে যাবে।
দেখা গেছে, কোনো কাজি বিয়ে নিবন্ধন করাতে রাজি না হলে পরিবারগুলো নোটারি পাবলিকের কাছে যায়। নোটারি পাবলিকের সনদ নিয়ে বর-কনে সংসার শুরু করে। পরে সুবিধামতো সময়ে কাজির কাছে নিবন্ধন করিয়ে নেওয়া হয়। গত ৫ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের আদালত চত্বরে কথা হয় আইনজীবী ইকবাল হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ওই দিন সকালে বয়স নিয়ে সন্দেহ হওয়ায় তিনি দুটি পরিবারকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর পাশের আইনজীবী কাগজ দেখে বিয়ের সনদ দিয়েছেন। ওই আইনজীবী অভিযোগ অস্বীকার করেননি। তাঁর বক্তব্য হলো, যতক্ষণ কাগজ ঠিক আছে, ততক্ষণ তিনি যে কাজ করেছেন, তা আইনের পরিপন্থী নয়।
জানা গেছে, প্রতিটি ইউনিয়নে নারী-শিশুদের সুরক্ষায় স্থায়ী কমিটি আছে। কমিটিগুলো নিয়মিত আলোচনায় বসে না। রাজশাহীর হরিয়ান ইউনিয়নে ১২-১৫ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে নিয়মিত। চেয়ারম্যান মো. মফিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, স্থায়ী কমিটি নিয়মিত বসে না, বসলেও বাল্যবিবাহ নিয়ে আলোচনা হয় না।
একই চিত্র পাওয়া গেছে কুষ্টিয়া, জামালপুর, শেরপুর, বগুড়া, জয়পুরহাট, পটুয়াখালী ও বরিশালের গৌরনদীতে। কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আনার কলি মাহবুব জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহি বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেন। প্রয়োজনে তাঁদের আইনের আওতায় আনার পরামর্শ দেন।
প্রশাসনের নজর নেই: ২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে শেরপুর সরকারি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীর সঙ্গে শেরপুর সদর উপজেলার পাকুরিয়া ইউনিয়নের চাটখিল বটতলা বাজারের ২৫ বছর বয়সী যুবকের বিয়ে ঠিক হয়। এ খবর শুনে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার সহযোগিতায় সে সময়কার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আইরীন ফারজানা বিয়ে ভেঙে দেন। মাস দু-এক পর ছাত্রীর বাবা-মা একই ছেলের সঙ্গে গোপনে বিয়ে দেন। সে আর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা দিতে পারেনি। মেয়েটি এখন ১০ মাস বয়সী একটি কন্যাশিশুর মা।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেয়েরা যদি রক্ষা পায়, তাদের নিরাপত্তা দেওয়া বা বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রশাসন কোনো উদ্যোগ নেয় না। লালমনিরহাটে স্কুল কমিটির সভাপতি পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীকে জোর করে বিয়ে করেন গত বছর। প্রথম আলো শিশুটিকে নিয়ে বছরজুড়ে ১২টি প্রতিবেদন ছাপে। প্রশাসন বিয়ে ভেঙে দেওয়ার পর মেয়েটি পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় পাস করলেও আর বিদ্যালয়ে যেতে পারছে না নিরাপত্তার অভাবে।
বাল্যবিবাহপ্রবণ ওই এলাকার বিদ্যালয়গুলোতে কত মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হয়ে ঝরে পড়েছে, সে তথ্য জানতে চেয়ে চিঠি দেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম মুসলেমউদ্দিন। গতকাল পর্যন্ত কোনো বিদ্যালয়ই চিঠির জবাব দেয়নি।
কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার মাজগ্রামের পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া একটি মেয়ে গত বছরের জুলাই মাসে নিজের বিয়ে নিজেই ঠেকিয়েছিল। এর কয়েক মাস যেতেই বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে বখাটেরা তাকে মারধর করে। থানায় মামলা হলেও পুলিশ ব্যবস্থা নেয়নি। পরে স্থানীয় এক সচেতন ব্যক্তি ওই পরিবারকে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় দেন।
{প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন রাজশাহীর আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, কুষ্টিয়ায় তৌহিদী হাসান, বরগুনার জসীমউদ্দীন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আনোয়ার হোসেন, লালমনিরহাটের আবদুর রব, শেরপুরের দেবাশীষ রায়, জামালপুরের আব্দুল আজিজ এবং গৌরনদীর জহিরুল ইসলাম}
আরও জানা গেছে, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বাল্যবিবাহ রোধে কোনো সফলতা সরকার পাচ্ছে না। সব বিয়ের খবর প্রশাসন পাচ্ছে না। খবর পেলে প্রশাসন যাচ্ছে, বিয়ে ভাঙছে, জরিমানা করছে। কিন্তু কিছুদিন পরই এসব শিশুকে আবার বিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সে খবর প্রশাসন রাখছে না।
বাল্যবিবাহের দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। সরকারি হিসাবে দেশের ৬৪ শতাংশ শিশুর বিয়ে হচ্ছে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠিত গার্ল সামিটে ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচে এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ পুরোপুরি বন্ধ করার অঙ্গীকার করেন। এরপর উল্টো বিয়ের বয়স কমাতে আইন সংশোধনের তোড়জোড় শোনা যায়। বাল্যবিবাহ রোধে সরকারের সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ কী, জানতে চাইলে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তারিক-উল-ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউনিসেফ, ইউএনএফপিএ ও বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করছে। আমরা তাগাদা দিচ্ছি।’
২০১৩ সালে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) বাংলাদেশের বাল্যবিবাহ নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। দারিদ্র্য, মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা, বয়স বেড়ে গেলে যৌতুকের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে অভিভাবকেরা কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিচ্ছেন বলে এতে উল্লেখ করা হয়।
মাঠের চিত্র: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফ গত বছর মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার জরিপ প্রকাশ করে। ওই জরিপ অনুযায়ী, বাল্যবিবাহপ্রবণ ১০ জেলা হচ্ছে বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, পঞ্চগড়, জামালপুর, কুষ্টিয়া ও খুলনা। জরিপের সময় বগুড়ায় ১৫-১৯ বছর বয়সী কিশোরীদের ৬০ শতাংশ, জয়পুরহাটে ৫৮ দশমিক ৪ শতাংশ, কুড়িগ্রামে ৫৫ দশমিক ৩ শতাংশ, নাটোরে ৫২ দশমিক ২ শতাংশ, নওগাঁয় ৫০ দশমিক ৬ শতাংশ কিশোরী বিবাহিত ছিল।
বাল্যবিবাহ রোধ নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের পর্যবেক্ষণ হলো, যেসব এলাকায় জন্মনিবন্ধনের হার কম, সেখানে বাল্যবিবাহের হার বেশি। বাল্যবিবাহপ্রবণ এলাকায় জন্মনিবন্ধনের হার ১৫ দশমিক ৯ থেকে ৫৩ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত। একমাত্র কুড়িগ্রাম জেলায় পাঁচ বছরের নিচে শিশুদের জন্মনিবন্ধনের হার ছিল ৮১ দশমিক ৭ শতাংশ।
বেশ কয়েকটি জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জনপ্রতিনিধিদের দেওয়া জন্মসনদের ভিত্তিতে বিয়ে হচ্ছে। কখনো কখনো নাম একটু-আধটু পরিবর্তন করে ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা থেকে একই মেয়ের একাধিক জন্মনিবন্ধন কার্ড তৈরির ঘটনাও ঘটছে।
গত বছরের নভেম্বরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের স্বর্ণকারপট্টিতে ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া একটি মেয়ের বিয়ে ভেঙে দেয় প্রশাসন। মাস খানেকের মাথায় মেয়েটিকে তার অভিভাবক অন্য জায়গায় নিয়ে বিয়ে দেন। স্বজনেরা জানান, বিয়ে দিতে তাঁরা জন্মসনদ জোগাড় করেছিলেন। বনিবনা না হওয়ায় এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে মেয়েটি তালাক দিয়ে ফিরে আসে।
প্রশ্ন উঠেছে, ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া মেয়েটির বিয়ে হলো কীভাবে? খোঁজ নিতে এই প্রতিবেদক চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভায় যান। মেয়রের অনুপস্থিতিতে কথা বলেন পৌরসভার প্যানেল মেয়র মোসলেমা বেগম। তিনি জন্মসনদ দেন না বলে দাবি করেন। তবে অনেকেই ভবিষ্যতে ভোট না পাওয়ার ভয়ে ভুয়া সনদ দিয়ে দেন।
জন্মসনদ থাকলে কাজি, আইনজীবী সবাই নির্বিঘ্নে বিয়ে পড়ান। সন্দেহ হলেও প্রশ্ন তোলেন না। এ সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছেন অসচেতন অভিভাবকেরা। বাংলাদেশ সম্মিলিত ম্যারেজ রেজিস্ট্রার ফোরামের সভাপতি কাজি সাব্বির প্রথম আলোকে বলেন, সব কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকলে তাঁদের বিয়ে না পড়িয়ে উপায় থাকে না। বাল্যবিবাহ রোধ করতে হলে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ভুয়া জন্মসনদ দেওয়া বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া নোটারি পাবলিক বিয়ের হলফনামা না দিলে ৮০ শতাংশ বাল্যবিবাহ কমে যাবে।
দেখা গেছে, কোনো কাজি বিয়ে নিবন্ধন করাতে রাজি না হলে পরিবারগুলো নোটারি পাবলিকের কাছে যায়। নোটারি পাবলিকের সনদ নিয়ে বর-কনে সংসার শুরু করে। পরে সুবিধামতো সময়ে কাজির কাছে নিবন্ধন করিয়ে নেওয়া হয়। গত ৫ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের আদালত চত্বরে কথা হয় আইনজীবী ইকবাল হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ওই দিন সকালে বয়স নিয়ে সন্দেহ হওয়ায় তিনি দুটি পরিবারকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর পাশের আইনজীবী কাগজ দেখে বিয়ের সনদ দিয়েছেন। ওই আইনজীবী অভিযোগ অস্বীকার করেননি। তাঁর বক্তব্য হলো, যতক্ষণ কাগজ ঠিক আছে, ততক্ষণ তিনি যে কাজ করেছেন, তা আইনের পরিপন্থী নয়।
জানা গেছে, প্রতিটি ইউনিয়নে নারী-শিশুদের সুরক্ষায় স্থায়ী কমিটি আছে। কমিটিগুলো নিয়মিত আলোচনায় বসে না। রাজশাহীর হরিয়ান ইউনিয়নে ১২-১৫ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে নিয়মিত। চেয়ারম্যান মো. মফিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, স্থায়ী কমিটি নিয়মিত বসে না, বসলেও বাল্যবিবাহ নিয়ে আলোচনা হয় না।
একই চিত্র পাওয়া গেছে কুষ্টিয়া, জামালপুর, শেরপুর, বগুড়া, জয়পুরহাট, পটুয়াখালী ও বরিশালের গৌরনদীতে। কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আনার কলি মাহবুব জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহি বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেন। প্রয়োজনে তাঁদের আইনের আওতায় আনার পরামর্শ দেন।
প্রশাসনের নজর নেই: ২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে শেরপুর সরকারি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীর সঙ্গে শেরপুর সদর উপজেলার পাকুরিয়া ইউনিয়নের চাটখিল বটতলা বাজারের ২৫ বছর বয়সী যুবকের বিয়ে ঠিক হয়। এ খবর শুনে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার সহযোগিতায় সে সময়কার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আইরীন ফারজানা বিয়ে ভেঙে দেন। মাস দু-এক পর ছাত্রীর বাবা-মা একই ছেলের সঙ্গে গোপনে বিয়ে দেন। সে আর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা দিতে পারেনি। মেয়েটি এখন ১০ মাস বয়সী একটি কন্যাশিশুর মা।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেয়েরা যদি রক্ষা পায়, তাদের নিরাপত্তা দেওয়া বা বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রশাসন কোনো উদ্যোগ নেয় না। লালমনিরহাটে স্কুল কমিটির সভাপতি পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীকে জোর করে বিয়ে করেন গত বছর। প্রথম আলো শিশুটিকে নিয়ে বছরজুড়ে ১২টি প্রতিবেদন ছাপে। প্রশাসন বিয়ে ভেঙে দেওয়ার পর মেয়েটি পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় পাস করলেও আর বিদ্যালয়ে যেতে পারছে না নিরাপত্তার অভাবে।
বাল্যবিবাহপ্রবণ ওই এলাকার বিদ্যালয়গুলোতে কত মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হয়ে ঝরে পড়েছে, সে তথ্য জানতে চেয়ে চিঠি দেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম মুসলেমউদ্দিন। গতকাল পর্যন্ত কোনো বিদ্যালয়ই চিঠির জবাব দেয়নি।
কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার মাজগ্রামের পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া একটি মেয়ে গত বছরের জুলাই মাসে নিজের বিয়ে নিজেই ঠেকিয়েছিল। এর কয়েক মাস যেতেই বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে বখাটেরা তাকে মারধর করে। থানায় মামলা হলেও পুলিশ ব্যবস্থা নেয়নি। পরে স্থানীয় এক সচেতন ব্যক্তি ওই পরিবারকে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় দেন।
{প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন রাজশাহীর আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, কুষ্টিয়ায় তৌহিদী হাসান, বরগুনার জসীমউদ্দীন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আনোয়ার হোসেন, লালমনিরহাটের আবদুর রব, শেরপুরের দেবাশীষ রায়, জামালপুরের আব্দুল আজিজ এবং গৌরনদীর জহিরুল ইসলাম}
No comments