শহরিস্তান ও মুহতাসিব: নগর ও রাষ্ট্র by সৈয়দ আবুল মকসুদ
পঞ্চাশের
দশকের প্রথম দিকে প্রথম ঢাকায় আসি। স্টিমারে যাত্রা। যখন ফতুল্লার কাছে
পৌঁছে আমাদের স্টিমার, তখন সবে সন্ধ্যা পেরিয়েছে। নদীর ভেতর থেকে দেখতে
পেলাম দূরে কোথাও অগণিত নক্ষত্রের মতো বিন্দু বিন্দু আলো। অত আলো আগে
আর কোনো দিন দেখিনি। আব্বা বললেন, ওই তো ঢাকা দেখা যায়। রোমাঞ্চিত
হলাম। গ্রামে সন্ধ্যার পর নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। শব্দের মধ্যে ঝিঁঝির ডাক।
শহরে অন্ধকার নেই। সন্ধ্যা হতেই জ্বলে ওঠে আলো। পল্লি ও নগর দুই জিনিস।
পঞ্চাশের দশকের ঢাকা আর এখন নেই। গত ৬০-৬২ বছরে ঢাকা হয়েছে আরও আলো ঝলমল। নগর হয়েছে আরও অনেক বড়। ছিল প্রাদেশিক রাজধানী। পরে স্বাধীন দেশের রাজধানী। কারও কারও জন্য এই নগর স্বর্গ, কারও জন্য অভিশাপ। এই নগরে বাস করে দেড় কোটি মানুষ। কিন্তু কারও যে এই নগর নিয়ে কিছুমাত্র মাথাব্যথা আছে, তা গত ছয় দশকে বুঝতে পারিনি। মাস খানেক যাবৎ দেখতে পাচ্ছি, আমাদের নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের কল্যাণে এই নগরকে নিয়ে ভাবার মানুষও আছেন কেউ কেউ। এই নগর নিয়ে তাঁদের মহৎ পরিকল্পনার অন্ত নেই। কেউ দেখতে চান এই নগরকে ‘তিলোত্তমা’। কেউ বানাতে চান এই নগরকে ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নগর’। নগরবাসীর জন্য কত কিছু যে তাঁদের করার পরিকল্পনা ও প্রতিশ্রুতি। তবে এই পৃথিবীতে সুবিধা এই যে কোনো মানুষই তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে বাধ্য নন। অথচ প্রত্যেক মানুষেরই যেকোনো প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে।
৪৩ বছর যাবৎ দেখতে পাচ্ছি মানুষের প্রবল দেশপ্রেম। এবারই প্রথম দেখার সুযোগ হলো নগরপ্রেম কাকে বলে। গত ৩০ বছরে এই নগরের কল্যাণে এক ছটাক কাজ করেননি, কোনো বস্তিতে আগুন লেগে হাজারো মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়লেও এক মিনিটের জন্যও তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াননি, তিনিও বস্তিবাসী ও অট্টালিকাবাসীদের জন্য ঘোষণা করছেন মহৎ পরিকল্পনা। নগরবাসী তা আড়ি পেতে শুনছে টিভির পর্দায়। আর তারা স্বপ্ন দেখছে, রাত পোহালেই বদলে যেতে শুরু করবে এই নগর। রাষ্ট্র থাকবে রাষ্ট্রের মতো যথাপূর্ব, নগরের ঘটবে পুনর্জন্ম। অনেকের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, তাঁরা ঢাকাকে বানাতে চান প্রাচীন গ্রিসের একটি নগররাষ্ট্র—সিটি স্টেট।
প্রাক্-মধ্যযুগের ইউরোপের নগরগুলো ছিল স্বাধীন ও স্বশাসিত। পরবর্তী কালের আধুনিক রাষ্ট্রের নগর অন্য জিনিস। তা রাষ্ট্রেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। পৃথিবীতে অতীতে কত নগর গড়ে উঠেছে, আবার একসময় তা ধ্বংস হয়েছে, গড়ে উঠেছে নতুন নগর। এই যে ঢাকা নিয়ে আমরা বক্তৃতা দিচ্ছি, তারই দুই দিকে কয়েক শ বছর আগে গড়ে উঠেছিল দুটি নগর—একটি সোনারগাঁয়ে, আরেকটি ধামরাইয়ে।
একটি প্রবাদ আছে, অরণ্যের স্রষ্টা বিধাতা আর নগরের স্রষ্টা মানুষ। এই মহাজগৎ নিয়ে বিধাতার হাতে বহুবিচিত্র কাজ থাকায় মহানগর তৈরির কাজটি তিনি মানুষের হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন। অতীতে দীর্ঘ সময় ধরে সুষ্ঠু পরিকল্পনার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে এক-একটি নগর। কথায় আছে, রোম ওয়াজ নট বিল্ট ইন আ ডে—রোম নগর এক দিনে তৈরি হয়নি। পাঁচ বছরে আরব্য রজনীর জাদুর চেরাগ হাতে বিরাট দৈত্য ছাড়া পৃথিবীর সবচেয়ে দক্ষ মানুষটির পক্ষেও কোনো বিপর্যস্ত নগরকে একটি আধুনিক নগরে পরিণত করা সম্ভব নয়।
কয়েক শ বছর আগে আমাদের চেয়ে কম যোগ্য মানুষই এই ঢাকাকে একটি আধুনিক নগরের রূপ দিয়েছিলেন। ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা নৌযানে এখানে বস্ত্র কিনতে এসে তাজ্জব হয়ে যেতেন পরিকল্পিত নগর দেখে। কেমন ছিল সেকালের মানুষদের পরিকল্পিত নগর, তার কিছু নমুনা যদি দেখতে চান কেউ, চলে যান ঠাটারীবাজার, তাঁতীবাজার, নবাবপুর, ইসলামপুর, বাংলাবাজার থেকে গেন্ডারিয়া, ফরাশগঞ্জ, সতীশ সরকার রোড পর্যন্ত। কোনো রকম বক্তৃতা না দিয়েই এবং মাস খানেক ছোটাছুটি না করেই সতীশচন্দ্র সরকার হয়েছিলেন ঢাকার নগরপ্রধান। গেন্ডারিয়ায় তাঁর সময় গড়ে ওঠে পরিকল্পিত উপশহর।
নির্বাচিত নগরপ্রধানের মধ্যে উনিশ শতকের শেষ দশকে খাজা মোহাম্মদ আসগর ঢাকাকে সম্প্রসারিত করায় বিরাট ভূমিকা রাখেন। নবাব বাহাদুর আহসানুল্লাহ ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা ছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের অনুরাগী। উনিশ শতকের শেষ দিকে, ১৯০১ সালে স্বামী বিবেকানন্দের ঢাকায় আসার আগেই, রামকৃষ্ণভক্ত ঢাকার নগরপিতা খাজা আসগরের পৃষ্ঠপোষকতায় নগরের একপ্রান্তে ফাঁকা জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয় রামকৃষ্ণ মিশন। পুরোনো কাগজপত্র থেকে জানা যায়, নবাববাড়ির মেয়েরা পর্যন্ত রামকৃষ্ণ মিশনে যাতায়াত করতেন টমটমে। আরেক নির্বাচিত নগরপিতা খাজা ইউসুফ ঢাকার উন্নয়নে জীবন উৎসর্গ করেন।
কোনো কোনো সরকার নিয়োজিত প্রশাসক ঢাকার উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন। ওয়ারী আবাদ করেন একটি অভিজাত এলাকা হিসেবে ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জে টি র্যা ঙ্কিন। তাঁর নামেই র্যা ঙ্কিন স্ট্রিট। এখন আমরা দেখলাম তিনটি বছর বসে বসে বেতন খেলেন কয়েকজন কর্মকর্তা এবং শুধু কেনাকাটায় সময় কাটিয়ে দিলেন। কাজ করার ইচ্ছা থাকলে মেয়র-টেয়র না হয়েও নগরের উন্নয়নের জন্য অনেক কিছুই করা যায়। কাজী আলাউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ আওলাদ হোসেন, মোহিনীমোহন দাস ঢাকার জন্য কত কিছু করেছেন।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য ঢাকার সুনাম ছিল, বিশের দশক থেকে কংগ্রেস ও লীগের রাজনীতি তা নষ্ট করে দেয়। রামকৃষ্ণ মিশন ও ব্রাহ্মসমাজের রামমোহন লাইব্রেরি ও উপাসনালয় প্রতিষ্ঠায় যেমন ঢাকার নবাবেরা ভূমিকা রাখেন, তেমনি হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে চিশতী বেহেস্তীর মাজার এবং সচিবালয়ের পশ্চিমে হজরত আবদুল মালেক ইয়ামেনির এক গম্বুজবিশিষ্ট মাজারটি নির্মাণে ইট-সুরকি-টাইলস প্রভৃতি কেনার ব্যয় বহন করেছেন মোহিনী দাস। তিনি কোনো পদপ্রাপ্তির পরোয়া করেননি।
পৃথিবীর নগরসভ্যতায় মধ্যযুগের মুসলমানদের অবদান অতুলনীয়। এখন বোকো হারাম বা ইসলামিক স্টেটের মহামান্য খলিফার সিপাহসালাররা দেশে দেশে যা-ই করুন, শত শত বছর মুসলমানদের পরিচালিত নগরগুলো ছিল সেক্যুলার—সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ। সে নির্দেশ মহানবী (সা.) নিজেই দিয়ে গেছেন। রাসুলুল্লাহ মদিনা সনদের একটি অনুচ্ছেদে নগরের মানুষের পারস্পরিক নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের ওপর ন্যস্ত করেছেন। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ইমাম বা নগরের নেতা নির্বাচনের ওপর তিনি জোর দিয়েছেন এবং বলেছেন, তা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। যেমন ঢাকা ও চট্টগ্রামের মানুষ তাঁদের নগর-নেতা নির্বাচিত করতে যাচ্ছেন আজ।
বিশ্বের নগরসভ্যতার বিস্ময়কর বিকাশ ঘটেছিল স্পেনে মুসলমান শাসকদের হাতে। কর্দোভা, গ্রানাদা, মাদ্রিদ, সেভিল প্রভৃতি নগরসভ্যতার বিস্ময়কর উদাহরণ। এবং নগরগুলো ছিল ধর্মনিরপেক্ষ; শাসক মুসলমান হলেও ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলমানরা পরিপূর্ণ সম্প্রীতির মধ্যে বাস করেছেন। সেখানে পরবর্তীকালে ইহুদি ও মুসলমানদের কচুকাটা করেন খ্রিষ্টান শাসকেরা। দামেস্ক ও বাগদাদ শুধু দৃষ্টান্তমূলক মহানগরই ছিল না, ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। মধ্যযুগের নগরে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন কর্মকর্তা (মেয়র) নিয়োগের প্রথা প্রচলিত হয়। মুসলিম নগরগুলোয় তাঁকে বলা হলো মুহতাসিব। সেকালের মুহতাসিবই একালের মেয়র। তাঁদের কাজ ছিল নগরের বাজারের ব্যবসা-বাণিজ্যের তদারক, জনস্বাস্থ্য তত্ত্বাবধান, গৃহহীনদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা, নাগরিক অধিকার রক্ষা, মাদ্রাসা-মসজিদ ও অন্যান্য ধর্মের উপাসনালয় তদারক, মাদক ও দুর্নীতি বন্ধ, রাস্তাঘাট নির্মাণ, সেতু নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, জন্ম-মৃত্যুর হিসাব রাখা প্রভৃতি। এভাবেই মধ্যযুগে রাষ্ট্রের মধ্যে থেকেও নগরে প্রচলিত হয় স্বায়ত্তশাসন।
ফারসি শব্দ শহর-এর আক্ষরিক অর্থ হলো ‘ক্ষমতার কেন্দ্র’ বা ‘দুর্গবেষ্টিত শাসকের আবাস’—যার নাম ‘শহরিস্তান’। ঢাকা আমাদের শহরিস্তান। একটি সুবিন্যস্ত জীবনযাত্রা পরিচালনার লক্ষ্যে নগরের প্রতিষ্ঠা। মধ্যযুগের পর সাম্রাজ্য বিস্তারকারীরা আরবান বা নাগরিক কালচার গড়ে তোলেন। কোনো কোনো শাসক পুরোনো শহরের কাছেই তাঁর মর্জিমতো নতুন শহরিস্তানের পত্তন ঘটান। সেটা তাঁরা করেছেন কৌশলগত ও নিরাপত্তার কারণে। যেমন তুঘলক দিল্লি থেকে যান আগ্রা, আইয়ুব পিন্ডি থেকে ইসলামাবাদ।
আধুনিক মানুষ নগরনির্ভর হওয়ায় নগরের জন্য পৃথক নগর পরিচালনা কর্তৃপক্ষ বা পৌর প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় শাসকদের অনুমোদন সাপেক্ষে রাজকর্মচারীদেরই একটি অংশ নগর পরিচালনা করতেন। এই উপমহাদেশেও সব কালে নগর এক রকম ছিল না। মৌর্য যুগে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময় এক রকম। অশোকের সময় অন্য রকম। গুপ্ত যুগের নগর ছিল এক রকম। কনিষ্কের রাজত্বকালে এক রকম। সুলতানি আমলে আরেক রকম। গিয়াসুদ্দিন তুঘলক বা মুহম্মদ বিন তুঘলক ভারতবর্ষে অন্য রকম নগরের পত্তন করেন। যে দেশের শাসকেরা যেমন, সে দেশের নগরসভ্যতাও হবে সে রকম।
ঢাকার সমস্যা সমাধানে চার সপ্তাহে হাজারো অঙ্গীকার শুনেছি—মাত্র একটি ছাড়া। রাস্তায় মূত্রত্যাগ। ঢাকার রাস্তায় উবু হয়ে বসে অথবা দাঁড়িয়ে পুরুষ প্রজাতির প্রস্রাব করাটা বন্ধ করা গেলে নগরের পনেরো আনা সমস্যার সমাধান হতো। শুধু মুহতাসিব বা মেয়ররাই নগরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে পারেন না। যে নগরে প্রত্যেক নাগরিকই এক-একজন স্বনির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলর নন, সে নগর অন্ধকারেই পড়ে থাকবে।
যে জাতি মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিতে শুধু অভ্যস্ত নয়, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি শুনতেও পছন্দ করে, তার অগ্রগতি ও অবস্থার পরিবর্তন অসম্ভব। যে রাষ্ট্রের মানুষ ও শাসক যেমন, তাঁদের রাষ্ট্রটিও তেমন হবে। রাষ্ট্র জনগণকে সৃষ্টি করে না, জনগণই রাষ্ট্র সৃষ্টি করে। রাষ্ট্রের ভেতরেই নগর, তার বাইরে স্বতন্ত্র কোনো সত্তা নয়। রাষ্ট্র যেমন হবে, তার নগরগুলোও সে রকম হবে। জার্মানি যেমন, বার্লিন, হামবুর্গ, মিউনিখও সে রকমই। ফ্রান্স যেমন, প্যারিস, মার্সাই, স্ট্রাসবোর্গ তেমনই। সুইজারল্যান্ড যেমন, জুরিখ, বার্ন, জেনেভাও তেমন। আফগানিস্তান যেমন, কাবুল, কান্দাহার, হেরাত সে রকম। সোমালিয়া যেমন, মোগাদিসু ঠিক তা-ই। বাংলাদেশ যেমন—
একটি বসবাসযোগ্য নগরের জন্য হাহাকার করে লাভ নেই। সে রকম একটি নগর চাইলে সেই রকম মানুষ হয়ে উঠতে হবে। তা কোনো একটি নির্বাচনের মাধ্যমে হওয়া সম্ভব নয়, কোনো এক্সিকিউটিভ ফরমানের মাধ্যমেও নয়। যে জাতির রক্তে তাড়াহুড়োর স্বভাব, তাদের পক্ষে বড় কিছু অর্জন সম্ভব নয়। বড় কিছু অর্জন কঠিন সাধনাসাপেক্ষ, দীর্ঘ এক প্রক্রিয়া।
রাত পোহালে যাঁরা নগরপ্রধান হিসেবে নির্বাচিত ঘোষিত হবেন, তাঁদের আগাম অভিনন্দন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
পঞ্চাশের দশকের ঢাকা আর এখন নেই। গত ৬০-৬২ বছরে ঢাকা হয়েছে আরও আলো ঝলমল। নগর হয়েছে আরও অনেক বড়। ছিল প্রাদেশিক রাজধানী। পরে স্বাধীন দেশের রাজধানী। কারও কারও জন্য এই নগর স্বর্গ, কারও জন্য অভিশাপ। এই নগরে বাস করে দেড় কোটি মানুষ। কিন্তু কারও যে এই নগর নিয়ে কিছুমাত্র মাথাব্যথা আছে, তা গত ছয় দশকে বুঝতে পারিনি। মাস খানেক যাবৎ দেখতে পাচ্ছি, আমাদের নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের কল্যাণে এই নগরকে নিয়ে ভাবার মানুষও আছেন কেউ কেউ। এই নগর নিয়ে তাঁদের মহৎ পরিকল্পনার অন্ত নেই। কেউ দেখতে চান এই নগরকে ‘তিলোত্তমা’। কেউ বানাতে চান এই নগরকে ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নগর’। নগরবাসীর জন্য কত কিছু যে তাঁদের করার পরিকল্পনা ও প্রতিশ্রুতি। তবে এই পৃথিবীতে সুবিধা এই যে কোনো মানুষই তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে বাধ্য নন। অথচ প্রত্যেক মানুষেরই যেকোনো প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে।
৪৩ বছর যাবৎ দেখতে পাচ্ছি মানুষের প্রবল দেশপ্রেম। এবারই প্রথম দেখার সুযোগ হলো নগরপ্রেম কাকে বলে। গত ৩০ বছরে এই নগরের কল্যাণে এক ছটাক কাজ করেননি, কোনো বস্তিতে আগুন লেগে হাজারো মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়লেও এক মিনিটের জন্যও তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াননি, তিনিও বস্তিবাসী ও অট্টালিকাবাসীদের জন্য ঘোষণা করছেন মহৎ পরিকল্পনা। নগরবাসী তা আড়ি পেতে শুনছে টিভির পর্দায়। আর তারা স্বপ্ন দেখছে, রাত পোহালেই বদলে যেতে শুরু করবে এই নগর। রাষ্ট্র থাকবে রাষ্ট্রের মতো যথাপূর্ব, নগরের ঘটবে পুনর্জন্ম। অনেকের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, তাঁরা ঢাকাকে বানাতে চান প্রাচীন গ্রিসের একটি নগররাষ্ট্র—সিটি স্টেট।
প্রাক্-মধ্যযুগের ইউরোপের নগরগুলো ছিল স্বাধীন ও স্বশাসিত। পরবর্তী কালের আধুনিক রাষ্ট্রের নগর অন্য জিনিস। তা রাষ্ট্রেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। পৃথিবীতে অতীতে কত নগর গড়ে উঠেছে, আবার একসময় তা ধ্বংস হয়েছে, গড়ে উঠেছে নতুন নগর। এই যে ঢাকা নিয়ে আমরা বক্তৃতা দিচ্ছি, তারই দুই দিকে কয়েক শ বছর আগে গড়ে উঠেছিল দুটি নগর—একটি সোনারগাঁয়ে, আরেকটি ধামরাইয়ে।
একটি প্রবাদ আছে, অরণ্যের স্রষ্টা বিধাতা আর নগরের স্রষ্টা মানুষ। এই মহাজগৎ নিয়ে বিধাতার হাতে বহুবিচিত্র কাজ থাকায় মহানগর তৈরির কাজটি তিনি মানুষের হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন। অতীতে দীর্ঘ সময় ধরে সুষ্ঠু পরিকল্পনার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে এক-একটি নগর। কথায় আছে, রোম ওয়াজ নট বিল্ট ইন আ ডে—রোম নগর এক দিনে তৈরি হয়নি। পাঁচ বছরে আরব্য রজনীর জাদুর চেরাগ হাতে বিরাট দৈত্য ছাড়া পৃথিবীর সবচেয়ে দক্ষ মানুষটির পক্ষেও কোনো বিপর্যস্ত নগরকে একটি আধুনিক নগরে পরিণত করা সম্ভব নয়।
কয়েক শ বছর আগে আমাদের চেয়ে কম যোগ্য মানুষই এই ঢাকাকে একটি আধুনিক নগরের রূপ দিয়েছিলেন। ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা নৌযানে এখানে বস্ত্র কিনতে এসে তাজ্জব হয়ে যেতেন পরিকল্পিত নগর দেখে। কেমন ছিল সেকালের মানুষদের পরিকল্পিত নগর, তার কিছু নমুনা যদি দেখতে চান কেউ, চলে যান ঠাটারীবাজার, তাঁতীবাজার, নবাবপুর, ইসলামপুর, বাংলাবাজার থেকে গেন্ডারিয়া, ফরাশগঞ্জ, সতীশ সরকার রোড পর্যন্ত। কোনো রকম বক্তৃতা না দিয়েই এবং মাস খানেক ছোটাছুটি না করেই সতীশচন্দ্র সরকার হয়েছিলেন ঢাকার নগরপ্রধান। গেন্ডারিয়ায় তাঁর সময় গড়ে ওঠে পরিকল্পিত উপশহর।
নির্বাচিত নগরপ্রধানের মধ্যে উনিশ শতকের শেষ দশকে খাজা মোহাম্মদ আসগর ঢাকাকে সম্প্রসারিত করায় বিরাট ভূমিকা রাখেন। নবাব বাহাদুর আহসানুল্লাহ ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা ছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের অনুরাগী। উনিশ শতকের শেষ দিকে, ১৯০১ সালে স্বামী বিবেকানন্দের ঢাকায় আসার আগেই, রামকৃষ্ণভক্ত ঢাকার নগরপিতা খাজা আসগরের পৃষ্ঠপোষকতায় নগরের একপ্রান্তে ফাঁকা জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয় রামকৃষ্ণ মিশন। পুরোনো কাগজপত্র থেকে জানা যায়, নবাববাড়ির মেয়েরা পর্যন্ত রামকৃষ্ণ মিশনে যাতায়াত করতেন টমটমে। আরেক নির্বাচিত নগরপিতা খাজা ইউসুফ ঢাকার উন্নয়নে জীবন উৎসর্গ করেন।
কোনো কোনো সরকার নিয়োজিত প্রশাসক ঢাকার উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন। ওয়ারী আবাদ করেন একটি অভিজাত এলাকা হিসেবে ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জে টি র্যা ঙ্কিন। তাঁর নামেই র্যা ঙ্কিন স্ট্রিট। এখন আমরা দেখলাম তিনটি বছর বসে বসে বেতন খেলেন কয়েকজন কর্মকর্তা এবং শুধু কেনাকাটায় সময় কাটিয়ে দিলেন। কাজ করার ইচ্ছা থাকলে মেয়র-টেয়র না হয়েও নগরের উন্নয়নের জন্য অনেক কিছুই করা যায়। কাজী আলাউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ আওলাদ হোসেন, মোহিনীমোহন দাস ঢাকার জন্য কত কিছু করেছেন।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য ঢাকার সুনাম ছিল, বিশের দশক থেকে কংগ্রেস ও লীগের রাজনীতি তা নষ্ট করে দেয়। রামকৃষ্ণ মিশন ও ব্রাহ্মসমাজের রামমোহন লাইব্রেরি ও উপাসনালয় প্রতিষ্ঠায় যেমন ঢাকার নবাবেরা ভূমিকা রাখেন, তেমনি হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে চিশতী বেহেস্তীর মাজার এবং সচিবালয়ের পশ্চিমে হজরত আবদুল মালেক ইয়ামেনির এক গম্বুজবিশিষ্ট মাজারটি নির্মাণে ইট-সুরকি-টাইলস প্রভৃতি কেনার ব্যয় বহন করেছেন মোহিনী দাস। তিনি কোনো পদপ্রাপ্তির পরোয়া করেননি।
পৃথিবীর নগরসভ্যতায় মধ্যযুগের মুসলমানদের অবদান অতুলনীয়। এখন বোকো হারাম বা ইসলামিক স্টেটের মহামান্য খলিফার সিপাহসালাররা দেশে দেশে যা-ই করুন, শত শত বছর মুসলমানদের পরিচালিত নগরগুলো ছিল সেক্যুলার—সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ। সে নির্দেশ মহানবী (সা.) নিজেই দিয়ে গেছেন। রাসুলুল্লাহ মদিনা সনদের একটি অনুচ্ছেদে নগরের মানুষের পারস্পরিক নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের ওপর ন্যস্ত করেছেন। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ইমাম বা নগরের নেতা নির্বাচনের ওপর তিনি জোর দিয়েছেন এবং বলেছেন, তা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। যেমন ঢাকা ও চট্টগ্রামের মানুষ তাঁদের নগর-নেতা নির্বাচিত করতে যাচ্ছেন আজ।
বিশ্বের নগরসভ্যতার বিস্ময়কর বিকাশ ঘটেছিল স্পেনে মুসলমান শাসকদের হাতে। কর্দোভা, গ্রানাদা, মাদ্রিদ, সেভিল প্রভৃতি নগরসভ্যতার বিস্ময়কর উদাহরণ। এবং নগরগুলো ছিল ধর্মনিরপেক্ষ; শাসক মুসলমান হলেও ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলমানরা পরিপূর্ণ সম্প্রীতির মধ্যে বাস করেছেন। সেখানে পরবর্তীকালে ইহুদি ও মুসলমানদের কচুকাটা করেন খ্রিষ্টান শাসকেরা। দামেস্ক ও বাগদাদ শুধু দৃষ্টান্তমূলক মহানগরই ছিল না, ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। মধ্যযুগের নগরে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন কর্মকর্তা (মেয়র) নিয়োগের প্রথা প্রচলিত হয়। মুসলিম নগরগুলোয় তাঁকে বলা হলো মুহতাসিব। সেকালের মুহতাসিবই একালের মেয়র। তাঁদের কাজ ছিল নগরের বাজারের ব্যবসা-বাণিজ্যের তদারক, জনস্বাস্থ্য তত্ত্বাবধান, গৃহহীনদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা, নাগরিক অধিকার রক্ষা, মাদ্রাসা-মসজিদ ও অন্যান্য ধর্মের উপাসনালয় তদারক, মাদক ও দুর্নীতি বন্ধ, রাস্তাঘাট নির্মাণ, সেতু নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, জন্ম-মৃত্যুর হিসাব রাখা প্রভৃতি। এভাবেই মধ্যযুগে রাষ্ট্রের মধ্যে থেকেও নগরে প্রচলিত হয় স্বায়ত্তশাসন।
ফারসি শব্দ শহর-এর আক্ষরিক অর্থ হলো ‘ক্ষমতার কেন্দ্র’ বা ‘দুর্গবেষ্টিত শাসকের আবাস’—যার নাম ‘শহরিস্তান’। ঢাকা আমাদের শহরিস্তান। একটি সুবিন্যস্ত জীবনযাত্রা পরিচালনার লক্ষ্যে নগরের প্রতিষ্ঠা। মধ্যযুগের পর সাম্রাজ্য বিস্তারকারীরা আরবান বা নাগরিক কালচার গড়ে তোলেন। কোনো কোনো শাসক পুরোনো শহরের কাছেই তাঁর মর্জিমতো নতুন শহরিস্তানের পত্তন ঘটান। সেটা তাঁরা করেছেন কৌশলগত ও নিরাপত্তার কারণে। যেমন তুঘলক দিল্লি থেকে যান আগ্রা, আইয়ুব পিন্ডি থেকে ইসলামাবাদ।
আধুনিক মানুষ নগরনির্ভর হওয়ায় নগরের জন্য পৃথক নগর পরিচালনা কর্তৃপক্ষ বা পৌর প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় শাসকদের অনুমোদন সাপেক্ষে রাজকর্মচারীদেরই একটি অংশ নগর পরিচালনা করতেন। এই উপমহাদেশেও সব কালে নগর এক রকম ছিল না। মৌর্য যুগে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময় এক রকম। অশোকের সময় অন্য রকম। গুপ্ত যুগের নগর ছিল এক রকম। কনিষ্কের রাজত্বকালে এক রকম। সুলতানি আমলে আরেক রকম। গিয়াসুদ্দিন তুঘলক বা মুহম্মদ বিন তুঘলক ভারতবর্ষে অন্য রকম নগরের পত্তন করেন। যে দেশের শাসকেরা যেমন, সে দেশের নগরসভ্যতাও হবে সে রকম।
ঢাকার সমস্যা সমাধানে চার সপ্তাহে হাজারো অঙ্গীকার শুনেছি—মাত্র একটি ছাড়া। রাস্তায় মূত্রত্যাগ। ঢাকার রাস্তায় উবু হয়ে বসে অথবা দাঁড়িয়ে পুরুষ প্রজাতির প্রস্রাব করাটা বন্ধ করা গেলে নগরের পনেরো আনা সমস্যার সমাধান হতো। শুধু মুহতাসিব বা মেয়ররাই নগরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে পারেন না। যে নগরে প্রত্যেক নাগরিকই এক-একজন স্বনির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলর নন, সে নগর অন্ধকারেই পড়ে থাকবে।
যে জাতি মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিতে শুধু অভ্যস্ত নয়, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি শুনতেও পছন্দ করে, তার অগ্রগতি ও অবস্থার পরিবর্তন অসম্ভব। যে রাষ্ট্রের মানুষ ও শাসক যেমন, তাঁদের রাষ্ট্রটিও তেমন হবে। রাষ্ট্র জনগণকে সৃষ্টি করে না, জনগণই রাষ্ট্র সৃষ্টি করে। রাষ্ট্রের ভেতরেই নগর, তার বাইরে স্বতন্ত্র কোনো সত্তা নয়। রাষ্ট্র যেমন হবে, তার নগরগুলোও সে রকম হবে। জার্মানি যেমন, বার্লিন, হামবুর্গ, মিউনিখও সে রকমই। ফ্রান্স যেমন, প্যারিস, মার্সাই, স্ট্রাসবোর্গ তেমনই। সুইজারল্যান্ড যেমন, জুরিখ, বার্ন, জেনেভাও তেমন। আফগানিস্তান যেমন, কাবুল, কান্দাহার, হেরাত সে রকম। সোমালিয়া যেমন, মোগাদিসু ঠিক তা-ই। বাংলাদেশ যেমন—
একটি বসবাসযোগ্য নগরের জন্য হাহাকার করে লাভ নেই। সে রকম একটি নগর চাইলে সেই রকম মানুষ হয়ে উঠতে হবে। তা কোনো একটি নির্বাচনের মাধ্যমে হওয়া সম্ভব নয়, কোনো এক্সিকিউটিভ ফরমানের মাধ্যমেও নয়। যে জাতির রক্তে তাড়াহুড়োর স্বভাব, তাদের পক্ষে বড় কিছু অর্জন সম্ভব নয়। বড় কিছু অর্জন কঠিন সাধনাসাপেক্ষ, দীর্ঘ এক প্রক্রিয়া।
রাত পোহালে যাঁরা নগরপ্রধান হিসেবে নির্বাচিত ঘোষিত হবেন, তাঁদের আগাম অভিনন্দন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments