সমতল ও সংস্কার by তোফায়েল আহমেদ
ঢাকা
ও চট্টগ্রাম মহানগরের নির্বাচন দেশের সামগ্রিক রাজনীতির গতি-প্রকৃতিতে
কিছু সাময়িক স্বস্তির পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক হয়েছে—এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়।
দীর্ঘ মেয়াদে এ স্বস্তি কতটুকু সুস্থিরতা দেবে, তা দুই বাংলাদেশি রাজনৈতিক
পরাশক্তি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভর করবে। তবে এ
পর্যন্ত উভয় পক্ষের আচার-আচরণে সহনশীলতার পরিচয় ছিল। নির্বাচনে ‘সমতল
ভূমি’বিষয়ক সব প্রশ্নের এখনো সুরাহা হয়নি। ঘুড়ি আকাশে উড়ছে, নাটাই এখনো
সরকারেরই হাতে। সহাবস্থানের শুভসূচনা হয়েছে কিন্তু তা এখনো খুবই ভঙ্গুর,
ইংরেজিতে যাকে বলা যায় ফ্রেজাইল। এটিকে টেকসই এবং সুদূরপ্রসারী করতে হলে এ
নির্বাচনের মাধ্যমে আস্থা ও বিশ্বাসের ভিতকে আরও সুদৃঢ় করার সুযোগ আছে।
প্রার্থিতা, প্রতীক এবং প্রতিশ্রুতিপর্ব চূড়ান্ত। প্রচারণা পর্ব চলছে কিন্তু গতি পেয়েছে বলা যাচ্ছে না। নির্বাচনের আগের ১০ দিন প্রার্থীরা প্রচারণায় সর্বশক্তিতে সমর্পিত হবেন। কিছু কিছু প্রার্থী এখনো আত্মগোপনে বা আদালতের বারান্দায়। তাতে সর্বসাধারণের মধ্যেও সংশয়, অবস্থা বুঝে নাটাইয়ের সুতায় কী ধরনের টান পড়ে, তা বোঝা যাচ্ছে না। নির্বাচন কমিশন তিন সিটি করপোরেশনের প্রার্থীদের নিয়ে সভা করে তাঁদের অভয় দিয়েছেন। এ উদ্যোগ অভিনন্দনযোগ্য। বিরোধী জোট-সমর্থিত প্রার্থীরা পুরোপুরি সন্তুষ্টি নিয়ে ফিরতে পারেননি। তাঁদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয়টি হচ্ছে, যাঁরা বৈধ প্রার্থী হিসেবে কমিশনের প্রতীক বরাদ্দ পেলেন, তাঁদের অবাধ প্রচারণায় আইনি বাধা বা পুলিশি ভীতি বহাল থাকলে নিরীহ ভোটাররাই বা কোন ভরসায় ভোটকেন্দ্রে যাবেন।
নিকট অতীতের নির্বাচনী-প্রক্রিয়া এবং ফলাফল সাধারণ ভোটারদের কিছুটা নির্বাচনবিমুখ করেছে। সে প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা বর্তমান নির্বাচনেও বজায় থাকবে, নাকি এখানে কিছু গুণগত পরিবর্তন আসবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গ নাই-ই বা আনা হলো। বিগত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের অনিয়মগুলোর প্রতিরোধ বা প্রতিকারের বিষয় মনে এলেই নির্বাচনে আগ্রহ ফিরে আসার কথা নয়। এখানে সরকার ও সরকারি দলের পক্ষ থেকে সদিচ্ছা, আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক নীতি-আদর্শের প্রতি আস্থা-বিশ্বাসের প্রমাণই নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার গ্যারান্টি। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন এবং দেশের ‘স্বাধীন’ বিচারব্যবস্থার ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনটি সিটি করপোরেশনের মোট ১৭৯টি ওয়ার্ড। ভোটকেন্দ্র ২ হাজার ৭১০ এবং বুথ সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার ৫১৭। কেন্দ্রে প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং এবং পোলিং কর্মকর্তা মিলে কমপক্ষে ২৫ হাজার কর্মকর্তা নিয়োজিত হবেন। এই কর্মকর্তাদের নিষ্ঠা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হলে যে পদক্ষেপ ও সহায়তা দরকার, তার আয়োজন কতটুকু সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে হবে, সেটি নির্বাচন কমিশনের সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক দলের ক্যাডার, সাধারণ প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন তথা সরকারের ভূমিকা এখানেই সত্যিকারের অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন।
দশম জাতীয় সংসদ ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কেন্দ্র ব্যবস্থাপনায় উল্লিখিত সব পক্ষেরই একপক্ষীয় আচরণ উৎকটভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। অনেক নির্বাচন কর্মকর্তা লাঞ্ছিত-অপমানিত হয়েছিলেন, যার সত্যিকার কোনো প্রতিকার তাঁরা পাননি। কেন্দ্র ব্যবস্থাপনার অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সব বৈধ প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্টদের আইনসম্মত দায়িত্ব পালনের সুযোগ নিশ্চিত করা। নির্বাচন কমিশন (রিটার্নিং কর্মকর্তা) এজেন্টদের নিরাপত্তার বিষয়টির কী নিশ্চয়তা দিতে পারবে, সেটি অতীত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে আগাম নিশ্চিত করতে হবে। ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, সেনাবাহিনী নিয়োগের প্রশ্নগুলো এ বিষয়গুলোর সঙ্গেই সম্পর্কিত। বিষয়টি ভাবাবেগে উপেক্ষার নয়।
নির্বাচনী বিরোধ, হয়রানি, হানাহানি নির্বাচনের দিনই শেষ হয় না। তার রেশ আরও বহুদিন চলে। তাই সুস্থ-স্বাভাবিক আইনের শাসনই এসব কিছুর স্থায়ী সমাধান। আমরা সবাই মিলে ভবিষ্যৎ দিনগুলোতে আইনের শাসনের পথে কি হাঁটতে পারব? দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতাদের বচন এবং আচরণ তো আমাদের কোনোভাবে এ বিষয়ে আশাবাদী করতে পারছে না।
তবু নির্বাচনী প্রচারণা ধীরে ধীরে গতি পাচ্ছে। এটি আরও গতি পাক। মেয়র পদপ্রার্থীরা রীতিমতো জাতীয় নির্বাচনের মতো তথাকথিত। ‘ইশতেহার’ প্রকাশ করছেন। নির্বাচনের পর কাকে, কীভাবে পাওয়া যাবে এবং শেষ পর্যন্ত আগামী পাঁচ বছরে এ দুটি নগরের মানুষ কী কী সমস্যার সমাধান পাবে, সেটি এখনো সুদূরের ভাবনা। তবে অন্তত একগুচ্ছ ইশতেহার ইতিমধ্যে পেয়েছে। এ পাওনাটিও নিতান্ত তুচ্ছ নয়। ঢাকা শহর নিয়ে জননেতৃত্ব থেকে এ-জাতীয় চিন্তাভাবনা অতীতে দেখা যায়নি। কিছু ব্যক্তি নির্বাচন উপলক্ষে অন্তত কিছু ‘স্বপ্নের সওদাগরি’ করছেন। শহর নিয়ে স্বপ্ন দেখা এবং দেখানো কিংবা স্বপ্নচর্চার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। নেতাদের কাজ স্বপ্ন বিনির্মাণ এবং সে স্বপ্নের সঙ্গে মানুষের সম্পৃক্তি ঘটানো।
প্রসঙ্গক্রমে এ ইশতেহার বা ঘোষণাগুলোর একটি সাধারণ ভ্রান্তির কথা স্পষ্টভাবে এ সময়টাতেই বলা প্রয়োজন। ঢাকা বা চট্টগ্রাম মহানগর নিয়ে যে স্বপ্নের তালিকা মেয়র প্রার্থীরা সুলিখিত বাক্যে এবং সুললিত ভাষণে প্রচার করছেন, তা কি তাঁদের নিজ নিজ দলের প্রতিশ্রুতি নাকি প্রার্থীর ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা? সিটি করপোরেশন একটি প্রতিষ্ঠান, যা একটি আইনি কাঠামোর অধীনে কাজ করে। প্রতিটি করপোরেশনে একটি নির্বাচিত কাউন্সিল থাকবে। মেয়ররা সে কাউন্সিলগুলোর সভাপতি হবেন। মেয়রই কাউন্সিল নয়। এখন মান্যবর মেয়র পদপ্রার্থীদের অনেকে যে ভাষায় প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তাতে মনে হচ্ছে তিনি কাউন্সিলের অস্তিত্ব, ভূমিকা এবং শক্তি সম্পর্কে হয়তো অজ্ঞ-উদাসীন কিংবা লা পরোয়া। এ-জাতীয় ইশতেহার অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করত যদি কোনো মেয়র প্রার্থী একগুচ্ছ কাউন্সিলর প্রার্থীসহ এ-জাতীয় ঘোষণাপত্র তৈরি করতে পারতেন। ব্যক্তি মেয়র প্রার্থীর একক ঘোষণাপত্রের ওপর আস্থা যেমন রাখা যাচ্ছে না, তেমনিভাবে ব্যক্তিসর্বস্বতা সিটি করপোরেশনকে তার প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি ও সামর্থ্য অর্জনের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ানোর পুরোনো ভীতিকে আবার নতুনভাবে নাড়া দিচ্ছে।
এটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে ব্যক্তির সততা, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, ব্যবস্থাপনাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতার অপরিসীম মূল্য রয়েছে। ব্যক্তির যোগ্যতার সঙ্গে সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিকতার সংযোগের প্রশ্নও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সমষ্টির চিন্তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের গণতান্ত্রিক আদর্শ এখানে ভূলুণ্ঠিত হতে পারে না। আমাদের বিদ্যমান কাঠামোর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যক্তিশাসনের প্রাবল্য এবং প্রাতিষ্ঠানিকতা ও গণতন্ত্রায়ণ পদে পদে বিপর্যস্ত। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারের সব আইনের সরষের মধ্যেই ভূত। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সিটি করপোরেশন—সর্বত্রই নারী-পুরুষনির্বিশেষে সব সদস্য এবং কাউন্সিলরই অক্ষম ও অসহায়। আবার মেয়র-চেয়ারম্যানরা কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক শক্তির কাছে সমর্পিত-পরাজিত। স্থানীয় সরকারে সর্বত্রই অধিকার প্রতিষ্ঠার চেয়ে অনুগ্রহপ্রার্থীরা অনেক বেশি সক্রিয়। এ অচলায়তন আমাদের সামগ্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে অসংস্কৃতি এবং অধস্তনতার সংস্কৃতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। তাই বলা যায়, বর্তমান ব্যবস্থায় মোটামুটি একটা ভোটাভুটিই হবে। কিন্তু গণতন্ত্র, সুশাসন ও স্বশাসনের সূচনা এখনো সুদূরপরাহত।
এসব বিষয় নিয়ে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যম আজকাল অনেক সোচ্চার। কিন্তু বড় দুটি দল বা জোটের নীতিনির্ধারকেরা বরাবরের মতোই নির্বিকার। এ নীরবতা ভেঙে এ বিষয়টি নিয়ে নীতিনির্ধারকদের সক্রিয়তার কাছে আকুতি—এভাবে নির্বাচনেই শুরু, নির্বাচনেই শেষ—এ রাজনীতির ভবিষ্যৎ ভালো নয়। স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঠিক, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন যেমন প্রয়োজন, তার সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলোকে দক্ষ, কার্যকর ও জবাবদিহিমূলক করার জন্য প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কারগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করা প্রয়োজন। এগুলো দীর্ঘদিনের উপেক্ষিত বিষয়। দিনে দিনে সমস্যা বেড়ে যাচ্ছে। নির্বাচিত স্থানীয় পরিষদগুলোকে কাজের সুযোগ করে দিলে জাতীয়ভাবে গণতন্ত্র, উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধির একটি স্থিতিশীল কাঠামো বিনির্মাণে আমাদের সামগ্রিক অগ্রগতি অনেক বেশি অর্থবহ ও টেকসই হবে।
ড. তোফায়েল আহমেদ: স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ।
প্রার্থিতা, প্রতীক এবং প্রতিশ্রুতিপর্ব চূড়ান্ত। প্রচারণা পর্ব চলছে কিন্তু গতি পেয়েছে বলা যাচ্ছে না। নির্বাচনের আগের ১০ দিন প্রার্থীরা প্রচারণায় সর্বশক্তিতে সমর্পিত হবেন। কিছু কিছু প্রার্থী এখনো আত্মগোপনে বা আদালতের বারান্দায়। তাতে সর্বসাধারণের মধ্যেও সংশয়, অবস্থা বুঝে নাটাইয়ের সুতায় কী ধরনের টান পড়ে, তা বোঝা যাচ্ছে না। নির্বাচন কমিশন তিন সিটি করপোরেশনের প্রার্থীদের নিয়ে সভা করে তাঁদের অভয় দিয়েছেন। এ উদ্যোগ অভিনন্দনযোগ্য। বিরোধী জোট-সমর্থিত প্রার্থীরা পুরোপুরি সন্তুষ্টি নিয়ে ফিরতে পারেননি। তাঁদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয়টি হচ্ছে, যাঁরা বৈধ প্রার্থী হিসেবে কমিশনের প্রতীক বরাদ্দ পেলেন, তাঁদের অবাধ প্রচারণায় আইনি বাধা বা পুলিশি ভীতি বহাল থাকলে নিরীহ ভোটাররাই বা কোন ভরসায় ভোটকেন্দ্রে যাবেন।
নিকট অতীতের নির্বাচনী-প্রক্রিয়া এবং ফলাফল সাধারণ ভোটারদের কিছুটা নির্বাচনবিমুখ করেছে। সে প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা বর্তমান নির্বাচনেও বজায় থাকবে, নাকি এখানে কিছু গুণগত পরিবর্তন আসবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গ নাই-ই বা আনা হলো। বিগত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের অনিয়মগুলোর প্রতিরোধ বা প্রতিকারের বিষয় মনে এলেই নির্বাচনে আগ্রহ ফিরে আসার কথা নয়। এখানে সরকার ও সরকারি দলের পক্ষ থেকে সদিচ্ছা, আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক নীতি-আদর্শের প্রতি আস্থা-বিশ্বাসের প্রমাণই নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার গ্যারান্টি। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন এবং দেশের ‘স্বাধীন’ বিচারব্যবস্থার ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনটি সিটি করপোরেশনের মোট ১৭৯টি ওয়ার্ড। ভোটকেন্দ্র ২ হাজার ৭১০ এবং বুথ সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার ৫১৭। কেন্দ্রে প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং এবং পোলিং কর্মকর্তা মিলে কমপক্ষে ২৫ হাজার কর্মকর্তা নিয়োজিত হবেন। এই কর্মকর্তাদের নিষ্ঠা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হলে যে পদক্ষেপ ও সহায়তা দরকার, তার আয়োজন কতটুকু সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে হবে, সেটি নির্বাচন কমিশনের সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক দলের ক্যাডার, সাধারণ প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন তথা সরকারের ভূমিকা এখানেই সত্যিকারের অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন।
দশম জাতীয় সংসদ ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কেন্দ্র ব্যবস্থাপনায় উল্লিখিত সব পক্ষেরই একপক্ষীয় আচরণ উৎকটভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। অনেক নির্বাচন কর্মকর্তা লাঞ্ছিত-অপমানিত হয়েছিলেন, যার সত্যিকার কোনো প্রতিকার তাঁরা পাননি। কেন্দ্র ব্যবস্থাপনার অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সব বৈধ প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্টদের আইনসম্মত দায়িত্ব পালনের সুযোগ নিশ্চিত করা। নির্বাচন কমিশন (রিটার্নিং কর্মকর্তা) এজেন্টদের নিরাপত্তার বিষয়টির কী নিশ্চয়তা দিতে পারবে, সেটি অতীত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে আগাম নিশ্চিত করতে হবে। ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, সেনাবাহিনী নিয়োগের প্রশ্নগুলো এ বিষয়গুলোর সঙ্গেই সম্পর্কিত। বিষয়টি ভাবাবেগে উপেক্ষার নয়।
নির্বাচনী বিরোধ, হয়রানি, হানাহানি নির্বাচনের দিনই শেষ হয় না। তার রেশ আরও বহুদিন চলে। তাই সুস্থ-স্বাভাবিক আইনের শাসনই এসব কিছুর স্থায়ী সমাধান। আমরা সবাই মিলে ভবিষ্যৎ দিনগুলোতে আইনের শাসনের পথে কি হাঁটতে পারব? দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতাদের বচন এবং আচরণ তো আমাদের কোনোভাবে এ বিষয়ে আশাবাদী করতে পারছে না।
তবু নির্বাচনী প্রচারণা ধীরে ধীরে গতি পাচ্ছে। এটি আরও গতি পাক। মেয়র পদপ্রার্থীরা রীতিমতো জাতীয় নির্বাচনের মতো তথাকথিত। ‘ইশতেহার’ প্রকাশ করছেন। নির্বাচনের পর কাকে, কীভাবে পাওয়া যাবে এবং শেষ পর্যন্ত আগামী পাঁচ বছরে এ দুটি নগরের মানুষ কী কী সমস্যার সমাধান পাবে, সেটি এখনো সুদূরের ভাবনা। তবে অন্তত একগুচ্ছ ইশতেহার ইতিমধ্যে পেয়েছে। এ পাওনাটিও নিতান্ত তুচ্ছ নয়। ঢাকা শহর নিয়ে জননেতৃত্ব থেকে এ-জাতীয় চিন্তাভাবনা অতীতে দেখা যায়নি। কিছু ব্যক্তি নির্বাচন উপলক্ষে অন্তত কিছু ‘স্বপ্নের সওদাগরি’ করছেন। শহর নিয়ে স্বপ্ন দেখা এবং দেখানো কিংবা স্বপ্নচর্চার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। নেতাদের কাজ স্বপ্ন বিনির্মাণ এবং সে স্বপ্নের সঙ্গে মানুষের সম্পৃক্তি ঘটানো।
প্রসঙ্গক্রমে এ ইশতেহার বা ঘোষণাগুলোর একটি সাধারণ ভ্রান্তির কথা স্পষ্টভাবে এ সময়টাতেই বলা প্রয়োজন। ঢাকা বা চট্টগ্রাম মহানগর নিয়ে যে স্বপ্নের তালিকা মেয়র প্রার্থীরা সুলিখিত বাক্যে এবং সুললিত ভাষণে প্রচার করছেন, তা কি তাঁদের নিজ নিজ দলের প্রতিশ্রুতি নাকি প্রার্থীর ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা? সিটি করপোরেশন একটি প্রতিষ্ঠান, যা একটি আইনি কাঠামোর অধীনে কাজ করে। প্রতিটি করপোরেশনে একটি নির্বাচিত কাউন্সিল থাকবে। মেয়ররা সে কাউন্সিলগুলোর সভাপতি হবেন। মেয়রই কাউন্সিল নয়। এখন মান্যবর মেয়র পদপ্রার্থীদের অনেকে যে ভাষায় প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তাতে মনে হচ্ছে তিনি কাউন্সিলের অস্তিত্ব, ভূমিকা এবং শক্তি সম্পর্কে হয়তো অজ্ঞ-উদাসীন কিংবা লা পরোয়া। এ-জাতীয় ইশতেহার অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করত যদি কোনো মেয়র প্রার্থী একগুচ্ছ কাউন্সিলর প্রার্থীসহ এ-জাতীয় ঘোষণাপত্র তৈরি করতে পারতেন। ব্যক্তি মেয়র প্রার্থীর একক ঘোষণাপত্রের ওপর আস্থা যেমন রাখা যাচ্ছে না, তেমনিভাবে ব্যক্তিসর্বস্বতা সিটি করপোরেশনকে তার প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি ও সামর্থ্য অর্জনের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ানোর পুরোনো ভীতিকে আবার নতুনভাবে নাড়া দিচ্ছে।
এটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে ব্যক্তির সততা, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, ব্যবস্থাপনাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতার অপরিসীম মূল্য রয়েছে। ব্যক্তির যোগ্যতার সঙ্গে সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিকতার সংযোগের প্রশ্নও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সমষ্টির চিন্তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের গণতান্ত্রিক আদর্শ এখানে ভূলুণ্ঠিত হতে পারে না। আমাদের বিদ্যমান কাঠামোর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যক্তিশাসনের প্রাবল্য এবং প্রাতিষ্ঠানিকতা ও গণতন্ত্রায়ণ পদে পদে বিপর্যস্ত। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারের সব আইনের সরষের মধ্যেই ভূত। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সিটি করপোরেশন—সর্বত্রই নারী-পুরুষনির্বিশেষে সব সদস্য এবং কাউন্সিলরই অক্ষম ও অসহায়। আবার মেয়র-চেয়ারম্যানরা কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক শক্তির কাছে সমর্পিত-পরাজিত। স্থানীয় সরকারে সর্বত্রই অধিকার প্রতিষ্ঠার চেয়ে অনুগ্রহপ্রার্থীরা অনেক বেশি সক্রিয়। এ অচলায়তন আমাদের সামগ্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে অসংস্কৃতি এবং অধস্তনতার সংস্কৃতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। তাই বলা যায়, বর্তমান ব্যবস্থায় মোটামুটি একটা ভোটাভুটিই হবে। কিন্তু গণতন্ত্র, সুশাসন ও স্বশাসনের সূচনা এখনো সুদূরপরাহত।
এসব বিষয় নিয়ে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যম আজকাল অনেক সোচ্চার। কিন্তু বড় দুটি দল বা জোটের নীতিনির্ধারকেরা বরাবরের মতোই নির্বিকার। এ নীরবতা ভেঙে এ বিষয়টি নিয়ে নীতিনির্ধারকদের সক্রিয়তার কাছে আকুতি—এভাবে নির্বাচনেই শুরু, নির্বাচনেই শেষ—এ রাজনীতির ভবিষ্যৎ ভালো নয়। স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঠিক, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন যেমন প্রয়োজন, তার সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলোকে দক্ষ, কার্যকর ও জবাবদিহিমূলক করার জন্য প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কারগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করা প্রয়োজন। এগুলো দীর্ঘদিনের উপেক্ষিত বিষয়। দিনে দিনে সমস্যা বেড়ে যাচ্ছে। নির্বাচিত স্থানীয় পরিষদগুলোকে কাজের সুযোগ করে দিলে জাতীয়ভাবে গণতন্ত্র, উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধির একটি স্থিতিশীল কাঠামো বিনির্মাণে আমাদের সামগ্রিক অগ্রগতি অনেক বেশি অর্থবহ ও টেকসই হবে।
ড. তোফায়েল আহমেদ: স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ।
No comments