প্রেসিডেন্ট হিলারি: টু বি অর নট টু বি? by হাসান ফেরদৌস
অবশেষে
হিলারি ক্লিনটন ঘোষণা করেছেন, তিনি আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হওয়ার
জন্য প্রস্তুত। রোববার এক ভিডিও বার্তায় তিনি এই ঘোষণা দেন।
দুই দশক ধরেই ভাবা হচ্ছে, আজ হোক, কাল হোক, এই নারী আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবেনই। দুই বছর আগে হলেও এ কথা বলা অনেক সহজ ছিল যে হিলারি নির্ঘাত আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। বারাক ওবামার প্রথম দফা প্রেসিডেন্সিতে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। দু-চারজন মুখচেনা রিপাবলিকান ছাড়া শত্রু-মিত্র সবাই তাঁর দক্ষ নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন। কিন্তু তা দুই বছর আগের কথা, যখন হিলারি সব রাজনৈতিক বাদ-বিবাদ সযত্নে এড়িয়ে চলেছেন। এখন প্রার্থিতা ঘোষণা করতে না-করতেই তাঁর রিপাবলিকান প্রতিপক্ষ একদম ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। লিবিয়ার বেনগাজিতে মার্কিন দূতাবাসে সন্ত্রাসী হামলা থেকে শুরু করে অতি সম্প্রতি ফাঁস হওয়া তথ্য যে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে ব্যক্তিগত ই-মেইল ব্যবহার করতেন, যার অধিকাংশ তিনি মুছে ফেলেছেন, সেসব পুরোনো-নতুন নানা কাসুন্দি ঘেঁটে তঁারা এ কথা প্রমাণ করতে চাইছেন, এই মহিলা প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্য নন। ‘স্টপ হিলারি’ নামে এক বিরুদ্ধ-প্রচারণার অংশ হিসেবে গোটা দুই ভিডিও তঁারা এরই মধ্যে বাজারে ছেড়েছেন। একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রও শিগগিরই বাজারে আসছে।
হিলারি যোগ্য এবং যেকোনো রিপাবলিকান প্রার্থীর চেয়ে অধিক জনপ্রিয়—এ কথা তাঁরা জানেন বলেই এ দেশের রক্ষণশীলরা আদাজল খেয়ে এই বিরুদ্ধ প্রচারণায় নেমেছেন। গত সপ্তাহে ওয়াশিংটনে ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত এক সম্মেলনে সম্ভাব্য প্রতিটি রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হেন বিষয় নেই, যার জন্য হিলারিকে দোষারোপ করেননি। ১৪ বছর আগে বিল ক্লিনটন হোয়াইট হাউস ছেড়েছেন, কিন্তু সেই তখন প্রেসিডেন্ট থাকাকালে মনিকা লিউনস্কির সঙ্গে তিনি যে ফষ্টিনষ্টি করেছেন, তা–ও তুলে এনেছেন। তাঁদের কথা শুনে মনে হবে, ক্লিনটন নয়, তাঁর স্ত্রী হিলারিই সেই স্ক্যান্ডালের জন্য দায়ী।
শুধু দক্ষিণপন্থী মহল নয়, ডেমোক্রেটিক দলের ভেতরেও, বিশেষত এর বামঘেঁষা অংশ মনে করে, হিলারি প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছেন। তাদের অভিযোগ, বিল ও হিলারি উভয়েই ওয়াল স্ট্রিট অর্থাৎ করপোরেট মহলের সঙ্গে খোলামেলাভাবে আঁতাতে লিপ্ত। বিল ক্লিনটন তাঁর ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে কোটি কোটি ডলার চাঁদা তুলেছেন, যাঁরা চাঁদা দিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই সন্দেহজনক চরিত্রের মানুষ। দুর্নীতিবাজ বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানও এই তালিকায় রয়েছেন। এই সেদিনও হিলারি এক ভাষণ দিয়ে এক করপোরেশনের কাছ থেকে ৩০ হাজার ডলার ফি আদায় করে নিয়েছেন। ফলে, এমন একজন প্রার্থী প্রেসিডেন্ট হলে আমেরিকার মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তের কোনো লাভ হবে না।
রোড আইল্যান্ডের সাবেক গভর্নর লিঙ্কন শেফি তুলেছেন অন্য আরেক আপত্তি। তাঁর যুক্তি, ২০০২ সালে যাঁরা ইরাক যুদ্ধের পক্ষে কংগ্রেসে ভোট দিয়েছেন, তাঁরা কেউই প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্য নন। বলাই বাহুল্য, হিলারি ও আরও ৭৫ জন মার্কিন সিনেটর, যাঁদের অধিকাংশই রিপাবলিকান, সে যুদ্ধের অনুমোদন দিয়েছিলেন। এ কথাও মনে রাখা ভালো, ২০০৮ সালে বারাক ওবামার হাতে তাঁর পরাজয়ের বড় কারণই ছিল ইরাক যুদ্ধ প্রশ্নে তাঁদের ভিন্ন অবস্থান।
এসব যুক্তি তুলে ধরে স্বঘোষিত প্রগতিশীল ডেমোক্র্যাটরা হিলারির বদলে বামপন্থী মহলে জনপ্রিয় ম্যাসাচুসেটস থেকে নির্বাচিত সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেনকে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য উসকে দিচ্ছিলেন। কিন্তু সিনেটর ওয়ারেন স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি সে লড়াইতে আগ্রহী নন। তাই হিলারিকে চ্যালেঞ্জ করে এমন আর কোনো ‘সিরিয়াস’ প্রতিদ্বন্দ্বী এই মুহূর্তে নেই। ম্যারিল্যান্ডের সাবেক গভর্নর মার্টিন ও’ম্যালে ইঙ্গিত করেছেন, তিনি হিলারির বিরুদ্ধে প্রার্থিতা লাভের জন্য প্রচারণায় নামবেন। কিন্তু সে লক্ষ্যে কোনো বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ তিনি নেননি। কেউ কেউ ভার্জিনিয়া থেকে নির্বাচিত সাবেক সিনেটর জিম ওয়েবকে একজন সম্ভাব্য ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকায় রয়েছেন। কিন্তু খুব কম লোকই আছেন, যাঁরা মনে করেন হিলারিকে হারানোর মতো প্রস্তুতি বা রেস্ত তাঁদের রয়েছে।
ফলে নিজ দলের ভেতর কোনো লক্ষণীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই হিলারি প্রস্তুতিপর্বের লড়াই উতরে যাবেন—এ কথা অনেকেই বিশ্বাস করেন। কিন্তু সে ‘সড়ক-বাধা’ অতিক্রমের পর চূড়ান্ত পর্যায়ের লড়াইেয় টিকে থাকতে পারবেন কি না, সেটি অবশ্য স্বতন্ত্র প্রশ্ন। এই ভাষ্যকারের নিজের ধারণা, অন্য কোনো বড় ধরনের স্ক্যান্ডালে জড়িয়ে না পড়লে এবং স্বাস্থ্যগত কোনো জটিলতা প্রকাশিত না হলে, হিলারির হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তন প্রায় নিশ্চিত। মনে রাখা দরকার, ২০১৬ সালে হিলারির বয়স হবে ৬৯। সেদিক দিয়ে তিনি হবেন দ্বিতীয় বয়োবৃদ্ধ প্রেসিডেন্ট। এর আগে রোনাল্ড রিগ্যান ৭০ বছর বয়সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
হিলারির নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনার পক্ষে প্রধান যুক্তি, অন্য যেকোনো প্রার্থীর চেয়ে তিনি অধিক অভিজ্ঞ। শুধু আমেরিকায় কেন, সারা পৃথিবীতে খুব বেশি লোক নেই যিনি হিলারির নাম শোনেননি। রিপাবলিকান দলে যিনিই মনোনয়ন পান না কেন, হিলারির ‘নেম-রিকগনিশন’-এর সঙ্গে তাঁকে পাল্লা দিতে হবে। কাজটা খুব সহজ নয়। ৪০ বছর ধরে হিলারি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তাঁর প্রতিটি কথা ও কাজের সঙ্গে এ দেশের মানুষের পরিচয় আছে। রিপাবলিকানদের সব চেষ্টা সত্ত্বেও এ দেশের অধিকাংশ মানুষ তাঁকে যেকোনো রিপাবলিকানের চেয়ে অধিক যোগ্য প্রার্থী মনে করে। মনে রাখা ভালো, ভোটাররা এমন একজনকে তাঁদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চান, যিনি তাঁদের চোখে অভিজ্ঞ ও এই পদের জন্য যোগ্য।
অন্য বড় কারণ আমেরিকার রাজনৈতিক বিভক্তি। বর্তমানে এক হোয়াইট হাউস ছাড়া মার্কিন রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি শাখায় রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রণ। কংগ্রেসের উভয় কক্ষ এবং বিচার বিভাগেও রক্ষণশীলদের দৌরাত্ম্য। অধিকাংশ গভর্নর পদেও রিপাবলিকানরা। এই অবস্থার আশু পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই। সুতরাং, সুস্থ বুদ্ধির কোনো ভোটার চাইবেন না প্রেসিডেন্ট পদটিও রিপাবলিকানদের হাতে চলে যাক।
তৃতীয় কারণ, ২০০৮ সালে নিজের প্রার্থিতার পক্ষে যে ‘কোয়ালিশন’টি বারাক ওবামা গড়ে তোলেন, তা মোটের ওপর এখনো টিকে আছে। এই কোয়ালিশনের মুখ্য সদস্য অনূর্ধ্ব-৩০ যুবক-যুবতী, আফ্রিকান-আমেরিকান ও হিস্পানিক ভোটার। এর সঙ্গে যোগ করুন মহিলা ভোটারদের। দীর্ঘদিন থেকে আমেরিকার নারী সমাজ একজন নারী প্রেসিডেন্টের অপেক্ষায়। অন্য কোনো কারণে না হোক, এই ‘জেন্ডার অ্যাডভানটেজ’ হিলারিকে দৌড়ে অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে রাখবে। যেকোনো রিপাবলিকান প্রার্থীর চেয়ে তো বটেই।
গত ছয় বছরে ওবামার জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে, কিন্তু ২০০৮ সালের যে কোয়ালিশন তিনি নির্মাণ করে, তাঁদের সিংহভাগ এখনো তাঁর নেতৃত্বে আস্থাবান। সে কথা মাথায় রেখে হিলারি খুব ভেবেচিন্তে ওবামাকে আলিঙ্গন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি ওবামার অংশীদার, এভাবেই নিজেকে উপস্থাপন করতে চান, ওবামা থেকে পালিয়ে থাকতে চান না। ওবামার ছয় বছর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর আমেরিকার অর্থনীতি আগের চেয়ে অনেক ভালো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তথ্যাভিজ্ঞ মহল বলছে, হিলারি ওবামার অর্থনৈতিক সাফল্যকে তাঁর ও তাঁর দলের সাফল্য বলেই দেখাতে চাইবেন। আফ্রিকান, আমেরিকান ও হিস্পানিক ভোটারদের মধ্যে ওবামার জনপ্রিয়তা এখনো অটুট। তার সঙ্গে যোগ করুন মহিলা ভোটারদের সংখ্যা।
খোদ ওবামা হিলারির প্রার্থিতা ঘোষণার আগ মুহূর্তে সাংবাদিকদের বলেছেন, তাঁর বিশ্বাস, হিলারি একজন যোগ্য প্রেসিডেন্ট হবেন। হিলারিকে তিনি ‘আমার বন্ধু’ বলেও সম্বোধন করেন। হিলারি বা দলের সঙ্গে কথা না বলে ওবামা এমন মন্তব্য করেছেন, তা ভাবার কোনো কারণ নেই।
হিলারির বিজয়ের পক্ষে অন্য সম্ভাব্য যুক্তি খোদ রিপাবলিকান পার্টি ও এই দলের প্রার্থীরা। প্রাইমারি পর্যায়ে তাঁদের প্রার্থিতা নিশ্চিত করতে প্রায় সব রিপাবলিকান প্রার্থী সবচেয়ে কট্টর ও দক্ষিণপন্থী অবস্থান নেবেন—এ কথা প্রায় নিশ্চিত। অভিবাসন থেকে বৈশ্বিক উষ্ণতা, হেন প্রশ্ন নেই যাতে রিপাবলিকান প্রার্থীরা তাঁদের ‘বেস’ বা তৃণমূলকে খুশি করতে সবচেয়ে অবাস্তব ও যুক্তিবিরুদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করবেন। গর্ভপাতের মতো প্রশ্নে তাঁদের প্রত্যেকেরই চলতি অবস্থান অতিরক্ষণশীল। প্রার্থিতা নিশ্চিত হলে দলের মনোনীত প্রার্থী তাঁর অবস্থান বদলাবেন, তা আমরা জানি। কিন্তু আগামী এক বছর প্রাইমারি প্রক্রিয়ায় তাঁরা যা বলবেন, তার কোনোটাই ইথারে মিলিয়ে যাবে না। হিলারি ও তাঁর নির্বাচনী দল সেসব কথার প্রতিটি বারবার শুনিয়ে ভোটারদের মনে করিয়ে দেবেন কেন এই কট্টর প্রার্থীকে নির্বাচিত করা তাঁদের স্বার্থের পরিপন্থী।
এসব কারণে হিলারির দলের প্রার্থিতা ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে একধরনের অনিবার্যতা রয়েছে। সেটি তাঁর জন্য সুখবর বটে, কিন্তু তা আবার বিপদের কারণও হতে পারে। ২০০৮ সালে সেই রকম অনিবার্য অবস্থান থেকেই তিনি শেষ পর্যন্ত ঠকে গিয়েছিলেন। এবারও সেই একই ঘটনা ঘটবে না, এ কথা হলফ করে বলা কঠিন। তবে টেবিলে এই মুহূর্তে যে কখানা তাস রয়েছে, তা দেখে বলা যায়, তেমন বিপর্যয়ের আশঙ্কা কার্যত শূন্য।
রাজনীতিতে অবশ্য শেষ বলে কোনো কথা নেই। হিলারির ব্যাপারেও না।
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
দুই দশক ধরেই ভাবা হচ্ছে, আজ হোক, কাল হোক, এই নারী আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবেনই। দুই বছর আগে হলেও এ কথা বলা অনেক সহজ ছিল যে হিলারি নির্ঘাত আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। বারাক ওবামার প্রথম দফা প্রেসিডেন্সিতে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। দু-চারজন মুখচেনা রিপাবলিকান ছাড়া শত্রু-মিত্র সবাই তাঁর দক্ষ নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন। কিন্তু তা দুই বছর আগের কথা, যখন হিলারি সব রাজনৈতিক বাদ-বিবাদ সযত্নে এড়িয়ে চলেছেন। এখন প্রার্থিতা ঘোষণা করতে না-করতেই তাঁর রিপাবলিকান প্রতিপক্ষ একদম ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। লিবিয়ার বেনগাজিতে মার্কিন দূতাবাসে সন্ত্রাসী হামলা থেকে শুরু করে অতি সম্প্রতি ফাঁস হওয়া তথ্য যে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে ব্যক্তিগত ই-মেইল ব্যবহার করতেন, যার অধিকাংশ তিনি মুছে ফেলেছেন, সেসব পুরোনো-নতুন নানা কাসুন্দি ঘেঁটে তঁারা এ কথা প্রমাণ করতে চাইছেন, এই মহিলা প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্য নন। ‘স্টপ হিলারি’ নামে এক বিরুদ্ধ-প্রচারণার অংশ হিসেবে গোটা দুই ভিডিও তঁারা এরই মধ্যে বাজারে ছেড়েছেন। একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রও শিগগিরই বাজারে আসছে।
হিলারি যোগ্য এবং যেকোনো রিপাবলিকান প্রার্থীর চেয়ে অধিক জনপ্রিয়—এ কথা তাঁরা জানেন বলেই এ দেশের রক্ষণশীলরা আদাজল খেয়ে এই বিরুদ্ধ প্রচারণায় নেমেছেন। গত সপ্তাহে ওয়াশিংটনে ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত এক সম্মেলনে সম্ভাব্য প্রতিটি রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হেন বিষয় নেই, যার জন্য হিলারিকে দোষারোপ করেননি। ১৪ বছর আগে বিল ক্লিনটন হোয়াইট হাউস ছেড়েছেন, কিন্তু সেই তখন প্রেসিডেন্ট থাকাকালে মনিকা লিউনস্কির সঙ্গে তিনি যে ফষ্টিনষ্টি করেছেন, তা–ও তুলে এনেছেন। তাঁদের কথা শুনে মনে হবে, ক্লিনটন নয়, তাঁর স্ত্রী হিলারিই সেই স্ক্যান্ডালের জন্য দায়ী।
শুধু দক্ষিণপন্থী মহল নয়, ডেমোক্রেটিক দলের ভেতরেও, বিশেষত এর বামঘেঁষা অংশ মনে করে, হিলারি প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছেন। তাদের অভিযোগ, বিল ও হিলারি উভয়েই ওয়াল স্ট্রিট অর্থাৎ করপোরেট মহলের সঙ্গে খোলামেলাভাবে আঁতাতে লিপ্ত। বিল ক্লিনটন তাঁর ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে কোটি কোটি ডলার চাঁদা তুলেছেন, যাঁরা চাঁদা দিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই সন্দেহজনক চরিত্রের মানুষ। দুর্নীতিবাজ বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানও এই তালিকায় রয়েছেন। এই সেদিনও হিলারি এক ভাষণ দিয়ে এক করপোরেশনের কাছ থেকে ৩০ হাজার ডলার ফি আদায় করে নিয়েছেন। ফলে, এমন একজন প্রার্থী প্রেসিডেন্ট হলে আমেরিকার মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তের কোনো লাভ হবে না।
রোড আইল্যান্ডের সাবেক গভর্নর লিঙ্কন শেফি তুলেছেন অন্য আরেক আপত্তি। তাঁর যুক্তি, ২০০২ সালে যাঁরা ইরাক যুদ্ধের পক্ষে কংগ্রেসে ভোট দিয়েছেন, তাঁরা কেউই প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্য নন। বলাই বাহুল্য, হিলারি ও আরও ৭৫ জন মার্কিন সিনেটর, যাঁদের অধিকাংশই রিপাবলিকান, সে যুদ্ধের অনুমোদন দিয়েছিলেন। এ কথাও মনে রাখা ভালো, ২০০৮ সালে বারাক ওবামার হাতে তাঁর পরাজয়ের বড় কারণই ছিল ইরাক যুদ্ধ প্রশ্নে তাঁদের ভিন্ন অবস্থান।
এসব যুক্তি তুলে ধরে স্বঘোষিত প্রগতিশীল ডেমোক্র্যাটরা হিলারির বদলে বামপন্থী মহলে জনপ্রিয় ম্যাসাচুসেটস থেকে নির্বাচিত সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেনকে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য উসকে দিচ্ছিলেন। কিন্তু সিনেটর ওয়ারেন স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি সে লড়াইতে আগ্রহী নন। তাই হিলারিকে চ্যালেঞ্জ করে এমন আর কোনো ‘সিরিয়াস’ প্রতিদ্বন্দ্বী এই মুহূর্তে নেই। ম্যারিল্যান্ডের সাবেক গভর্নর মার্টিন ও’ম্যালে ইঙ্গিত করেছেন, তিনি হিলারির বিরুদ্ধে প্রার্থিতা লাভের জন্য প্রচারণায় নামবেন। কিন্তু সে লক্ষ্যে কোনো বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ তিনি নেননি। কেউ কেউ ভার্জিনিয়া থেকে নির্বাচিত সাবেক সিনেটর জিম ওয়েবকে একজন সম্ভাব্য ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকায় রয়েছেন। কিন্তু খুব কম লোকই আছেন, যাঁরা মনে করেন হিলারিকে হারানোর মতো প্রস্তুতি বা রেস্ত তাঁদের রয়েছে।
ফলে নিজ দলের ভেতর কোনো লক্ষণীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই হিলারি প্রস্তুতিপর্বের লড়াই উতরে যাবেন—এ কথা অনেকেই বিশ্বাস করেন। কিন্তু সে ‘সড়ক-বাধা’ অতিক্রমের পর চূড়ান্ত পর্যায়ের লড়াইেয় টিকে থাকতে পারবেন কি না, সেটি অবশ্য স্বতন্ত্র প্রশ্ন। এই ভাষ্যকারের নিজের ধারণা, অন্য কোনো বড় ধরনের স্ক্যান্ডালে জড়িয়ে না পড়লে এবং স্বাস্থ্যগত কোনো জটিলতা প্রকাশিত না হলে, হিলারির হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তন প্রায় নিশ্চিত। মনে রাখা দরকার, ২০১৬ সালে হিলারির বয়স হবে ৬৯। সেদিক দিয়ে তিনি হবেন দ্বিতীয় বয়োবৃদ্ধ প্রেসিডেন্ট। এর আগে রোনাল্ড রিগ্যান ৭০ বছর বয়সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
হিলারির নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনার পক্ষে প্রধান যুক্তি, অন্য যেকোনো প্রার্থীর চেয়ে তিনি অধিক অভিজ্ঞ। শুধু আমেরিকায় কেন, সারা পৃথিবীতে খুব বেশি লোক নেই যিনি হিলারির নাম শোনেননি। রিপাবলিকান দলে যিনিই মনোনয়ন পান না কেন, হিলারির ‘নেম-রিকগনিশন’-এর সঙ্গে তাঁকে পাল্লা দিতে হবে। কাজটা খুব সহজ নয়। ৪০ বছর ধরে হিলারি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তাঁর প্রতিটি কথা ও কাজের সঙ্গে এ দেশের মানুষের পরিচয় আছে। রিপাবলিকানদের সব চেষ্টা সত্ত্বেও এ দেশের অধিকাংশ মানুষ তাঁকে যেকোনো রিপাবলিকানের চেয়ে অধিক যোগ্য প্রার্থী মনে করে। মনে রাখা ভালো, ভোটাররা এমন একজনকে তাঁদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চান, যিনি তাঁদের চোখে অভিজ্ঞ ও এই পদের জন্য যোগ্য।
অন্য বড় কারণ আমেরিকার রাজনৈতিক বিভক্তি। বর্তমানে এক হোয়াইট হাউস ছাড়া মার্কিন রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি শাখায় রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রণ। কংগ্রেসের উভয় কক্ষ এবং বিচার বিভাগেও রক্ষণশীলদের দৌরাত্ম্য। অধিকাংশ গভর্নর পদেও রিপাবলিকানরা। এই অবস্থার আশু পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই। সুতরাং, সুস্থ বুদ্ধির কোনো ভোটার চাইবেন না প্রেসিডেন্ট পদটিও রিপাবলিকানদের হাতে চলে যাক।
তৃতীয় কারণ, ২০০৮ সালে নিজের প্রার্থিতার পক্ষে যে ‘কোয়ালিশন’টি বারাক ওবামা গড়ে তোলেন, তা মোটের ওপর এখনো টিকে আছে। এই কোয়ালিশনের মুখ্য সদস্য অনূর্ধ্ব-৩০ যুবক-যুবতী, আফ্রিকান-আমেরিকান ও হিস্পানিক ভোটার। এর সঙ্গে যোগ করুন মহিলা ভোটারদের। দীর্ঘদিন থেকে আমেরিকার নারী সমাজ একজন নারী প্রেসিডেন্টের অপেক্ষায়। অন্য কোনো কারণে না হোক, এই ‘জেন্ডার অ্যাডভানটেজ’ হিলারিকে দৌড়ে অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে রাখবে। যেকোনো রিপাবলিকান প্রার্থীর চেয়ে তো বটেই।
গত ছয় বছরে ওবামার জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে, কিন্তু ২০০৮ সালের যে কোয়ালিশন তিনি নির্মাণ করে, তাঁদের সিংহভাগ এখনো তাঁর নেতৃত্বে আস্থাবান। সে কথা মাথায় রেখে হিলারি খুব ভেবেচিন্তে ওবামাকে আলিঙ্গন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি ওবামার অংশীদার, এভাবেই নিজেকে উপস্থাপন করতে চান, ওবামা থেকে পালিয়ে থাকতে চান না। ওবামার ছয় বছর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর আমেরিকার অর্থনীতি আগের চেয়ে অনেক ভালো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তথ্যাভিজ্ঞ মহল বলছে, হিলারি ওবামার অর্থনৈতিক সাফল্যকে তাঁর ও তাঁর দলের সাফল্য বলেই দেখাতে চাইবেন। আফ্রিকান, আমেরিকান ও হিস্পানিক ভোটারদের মধ্যে ওবামার জনপ্রিয়তা এখনো অটুট। তার সঙ্গে যোগ করুন মহিলা ভোটারদের সংখ্যা।
খোদ ওবামা হিলারির প্রার্থিতা ঘোষণার আগ মুহূর্তে সাংবাদিকদের বলেছেন, তাঁর বিশ্বাস, হিলারি একজন যোগ্য প্রেসিডেন্ট হবেন। হিলারিকে তিনি ‘আমার বন্ধু’ বলেও সম্বোধন করেন। হিলারি বা দলের সঙ্গে কথা না বলে ওবামা এমন মন্তব্য করেছেন, তা ভাবার কোনো কারণ নেই।
হিলারির বিজয়ের পক্ষে অন্য সম্ভাব্য যুক্তি খোদ রিপাবলিকান পার্টি ও এই দলের প্রার্থীরা। প্রাইমারি পর্যায়ে তাঁদের প্রার্থিতা নিশ্চিত করতে প্রায় সব রিপাবলিকান প্রার্থী সবচেয়ে কট্টর ও দক্ষিণপন্থী অবস্থান নেবেন—এ কথা প্রায় নিশ্চিত। অভিবাসন থেকে বৈশ্বিক উষ্ণতা, হেন প্রশ্ন নেই যাতে রিপাবলিকান প্রার্থীরা তাঁদের ‘বেস’ বা তৃণমূলকে খুশি করতে সবচেয়ে অবাস্তব ও যুক্তিবিরুদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করবেন। গর্ভপাতের মতো প্রশ্নে তাঁদের প্রত্যেকেরই চলতি অবস্থান অতিরক্ষণশীল। প্রার্থিতা নিশ্চিত হলে দলের মনোনীত প্রার্থী তাঁর অবস্থান বদলাবেন, তা আমরা জানি। কিন্তু আগামী এক বছর প্রাইমারি প্রক্রিয়ায় তাঁরা যা বলবেন, তার কোনোটাই ইথারে মিলিয়ে যাবে না। হিলারি ও তাঁর নির্বাচনী দল সেসব কথার প্রতিটি বারবার শুনিয়ে ভোটারদের মনে করিয়ে দেবেন কেন এই কট্টর প্রার্থীকে নির্বাচিত করা তাঁদের স্বার্থের পরিপন্থী।
এসব কারণে হিলারির দলের প্রার্থিতা ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে একধরনের অনিবার্যতা রয়েছে। সেটি তাঁর জন্য সুখবর বটে, কিন্তু তা আবার বিপদের কারণও হতে পারে। ২০০৮ সালে সেই রকম অনিবার্য অবস্থান থেকেই তিনি শেষ পর্যন্ত ঠকে গিয়েছিলেন। এবারও সেই একই ঘটনা ঘটবে না, এ কথা হলফ করে বলা কঠিন। তবে টেবিলে এই মুহূর্তে যে কখানা তাস রয়েছে, তা দেখে বলা যায়, তেমন বিপর্যয়ের আশঙ্কা কার্যত শূন্য।
রাজনীতিতে অবশ্য শেষ বলে কোনো কথা নেই। হিলারির ব্যাপারেও না।
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
No comments