স্বামীহারা তিন নারীর জীবনযুদ্ধ by আশীষ-উর-রহমান ও আনোয়ার পারভেজ
পেট্রলবোমায় স্বামী শহিদুল ইসলামকে হারিয়েছেন। একমাত্র সন্তানকে নিয়ে খেয়ে না-খেয়ে দিনাতিপাত করছেন বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার বন্তেঘড়ি গ্রামের সাবিনা ইয়াসমিন। গত বৃহস্পতিবার ছবিটি তুলেছেন সোয়েল রানা |
‘নাম কী?’
‘সাবিনা।’
‘সাবিনার পর কী লেখেন?’
‘আগে বিবি লেকিচ্চুনু। বিদবা হছি, এখন বেওয়া লেকা লাগবি।’
টিনের ছাউনি দেওয়া লাল মাটির দেয়ালের ঘর। বারান্দার কিনার দিয়ে হাঁটুসমান উঁচু মাটির সরু দেয়াল, বৃষ্টির ছাঁট আটকানোর জন্য। তার ওপরে বসে কথা বলছিলেন ২২-২৪ বছরের সাবিনা বিবি অথবা বেওয়া। তাঁর স্বামী শহিদুল ইসলাম সরকার গত ৫ ফেব্রুয়ারি মারা গেছেন পেট্রলবোমা হামলায়। মায়ের পাশে শুকনো মুখে বসা ছয় বছরের সামিউল সরকার। বাবা হারানোর শোক হয়তো সে পুরোপুরি অনুভবই করে উঠতে পারেনি। একটা সময় হয়তো বাবার মুখও তার আর মনে থাকবে না। তবে আরও মাস পাঁচ-ছয়েক পরে যে ভূমিষ্ঠ হবে, সে তো বাবার মুখই দেখতে পাবে না। সাবিনা পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
গত বৃহস্পতিবার বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার বন্তেঘড়ি গ্রামের শহিদুল ইসলামের বাড়িতে কথা হচ্ছিল তাঁর স্ত্রী সাবিনা, বাবা আফজাল হোসেন সরকার ও মা জোবেদা বেগমের সঙ্গে। আফজালের পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে শহিদুল তৃতীয়। জমিজমা তাঁদের নেই। শিবগঞ্জ বাজারে শাকসবজি বিক্রির অল্প পুঁজির ব্যবসা। শহিদুল পান বিক্রেতা। যশোর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া এসব এলাকা থেকে পাইকারি দরে পান এনে বিক্রি করতেন শিবগঞ্জে দোকানে দোকানে। গত ৩ ফেব্রুয়ারি গিয়েছিলেন শৈলকুপায় পান আনতে। ট্রাকে করে পান নিয়ে (অন্যদের মালের সঙ্গে) ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে রওনা দেন। সেই সময় সাবিনার সঙ্গে তাঁর শেষ কথা। স্ত্রীকে জানিয়েছিলেন, রওনা দিচ্ছেন। ভোর ছয়টা নাগাদ এসে পৌঁছে যাবেন। বগুড়ার তিনমাথায় ট্রাকে পেট্রলবোমা হামলা হলো ৫ ফেব্রুয়ারি ভোর পাঁচটা নাগাদ। বাড়ি ঠিকই ফিরলেন শহিদুল, তবে বিলম্ব হলো খানিকটা। হেঁটে এলেন না। বয়ে আনা হলো তাঁকে। দগ্ধ, নিষ্প্রাণ। ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি।
এই হামলায় ট্রাকচালক, তাঁর সহকারী এবং আরও এক পান ব্যবসায়ী দগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে চালকের সহকারী শৈলকুপা উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামের ইমরান হোসেন পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বগুড়া শহীদ জিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।
সাবিনা এখন বুড়ো শ্বশুর-শাশুড়ির সংসারে আছেন। তাঁর বাবা দিনমজুর। নিজেরই সংসার চলে না। এই অবস্থায় এই ‘আড়াই জন’কে লালন-পালনের সাধ্য তাঁদের নেই। শহিদুলের মা জোবেদা কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন ‘পোয়াতি বউ আর এই অবুজ ছোল (ছেলে) থুয়্যা হামার জুয়ান ব্যাটা মর্যাে গেল বারে। অরকোরক, (ওদের) দেকার আর কেউ নাই।’
সাবিনা কেমন যেন নির্বাক হয়ে গেছেন। দু-তিনবার জিজ্ঞাসা করলে হয়তো একটি জবাব দেন, আর সারাক্ষণ চুপ করেই থাকেন। হয়তো ডুবে থাকেন নিজের, অনাগত সন্তান, ছোট্ট ছেলের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভাবনায়। লাখ খানেক টাকার পুঁজি ছিল শহিদুলের। তাঁর শরীরের মতো পানও পুড়ে গিয়েছিল। পুঁজিও শেষ।
সাহায্য হিসেবে তাঁরা পেয়েছেন ৫০ হাজার টাকার সরকারি অনুদান, স্থানীয় সাংসদের দেওয়া ৩০ হাজার ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার তরফ থেকে পাঁচ হাজার—এই ৮৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া লাশ পরিবহন-দাফন বাবদ ২০ হাজার টাকার সাহায্য এখনো হাতে পাননি। স্থানীয় আওয়ামী লীগ সভাপতির কাছে আছে সেই টাকা। তবে তিনি দিয়ে দেবেন বলে পরিবারটি আমাদের জানায়।
বৃহস্পতিবার নারহট্ট ইউনিয়নের নিশ্চিন্তপুর গ্রামে আমরা যখন যাই, তখন দুপুর। এটি কাহালু উপজেলা। জাহাঙ্গীর আলম জিলাদারের বাড়িটি সহজেই চেনা গেল। পেট্রলবোমায় নিহত হওয়ায় গ্রামের আশপাশের সবাই এখন তাঁর বাড়ি চেনে। জাহাঙ্গীরের বাড়িটি বেশ পরিচ্ছন্ন। মেটে ঘরের দেয়ালে পলিমাটি লেপে তাতে ফুলের নকশা আঁকা। স্ত্রী বিউটি আক্তার, ১৪ বছরের ছেলে জাহিদ হাসান আর মেয়ে ৯ বছরের জুঁইকে রেখে গেছেন তিনি।
জাহাঙ্গীর ট্রাকচালকের সহকারী। ট্রাকচালক মাসুদ মিয়া তাঁর ভগ্নিপতি। মাসুদ দুবাই থাকতেন। বছর চারেক আগে দেশে ফিরে ট্রাকটি কিনে নিজেই চালান। গত ২৩ জানুয়ারি তাঁরা কাহালু থেকে সবজি নিয়ে বগুড়ায় নামিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। শহরের চারমাথার কাছে সন্ধ্যায় তাঁদের ট্রাকে পেট্রলবোমা হামলা হয়। দুজনই গুরুতর দগ্ধ হন। ট্রাকটি সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। তাঁদের ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। এক মাসের বেশি যন্ত্রণায় ভুগে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি মারা যান জাহাঙ্গীর। ভগ্নিপতি মাসুদ এখনো চিকিৎসাধীন।
শহিদুলের স্ত্রী সাবিনার চেয়ে জাহাঙ্গীরের স্ত্রী বিউটি আর্থিক সহযোগিতা প্রাপ্তির দিক থেকে এগিয়ে। জাহাঙ্গীর ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে থাকার সময় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুসারে তাঁর তহবিল থেকে ১০ লাখ টাকার (চেক) বিশেষ আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। এ ছাড়া সরকারি অনুদানের ৫০ হাজার টাকা, লাশ দাফনসংক্রান্ত ২০ হাজার—এই ৭০ হাজার টাকা পেয়েছেন নগদ। এই নগদ টাকা ভেঙেই আপাতত তাঁদের সংসার চলছে। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ অনুদানের অর্থপ্রাপ্তির প্রক্রিয়া চলছে। এই টাকা আমানত হিসেবে রাখা হবে বলে বিউটি জানিয়েছেন। তবে তাঁর ইচ্ছা আছে গ্রামের আশপাশে কিছু জমি কেনার। কারণ, নগদ টাকা থাকলে খরচ হয়ে যাওয়ার ভয়। প্রধানমন্ত্রীর এই অনুদানের টাকাটাই তো এখন সম্বল।
এই সম্বলটুকুও নেই শাজাহানপুর উপজেলার বেজড়া শ্যামলাকাতি গ্রামের ইয়াসমিন বিজলির। বয়স হবে ১৭-১৮ বছর। বিয়ে হয়েছিল অল্প বয়সে। কোলে পাঁচ মাস বয়সী এক ছেলে। উপরন্তু আর্থিক স্বার্থ কতটা নির্মম হয়ে উঠতে পারে, আরও একবার তার চাক্ষুষ প্রমাণ পাওয়া গেল এই হতভাগ্য তরুণীর মুখোমুখি হয়ে।
কাহালু থেকে আমরা যখন ইয়াসমিনের বাড়িতে যাই, তখন পড়ন্ত বেলা। ছেলে ইস্রাফিল হাকিমকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন ইয়াসমিন। তাঁর স্বামী হাসিবুল ইসলামও ছিলেন ট্রাকচালকের সহকারী। গত ৭ জানুয়ারি বগুড়া-নাটোর সড়কের নন্দরূপিহার এলাকায় রাতে তাঁদের সবজিবাহী ট্রাকে পেট্রলবোমা হামলা হয়। দগ্ধ হয়েছিলেন তিনজন। হাসপাতালে আনার পরপরই তিনি মারা যান।
হাসিবুল বগুড়া শহরের চারমাথায় তাঁর বাবার কেনা তিন শতক জায়গায় ছাপরাঘর তুলে স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন। বাড়ি সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার সোনামুখী গ্রামে। বাবা ইয়াসিন আলী, মা রোকেয়া বেগম ও আত্মীয়দের সঙ্গে নিয়ে ইয়াসমিন স্বামীর লাশ দাফন করতে যান সোনামুখী। শ্বশুর-শাশুড়ি লাশ দাফনের ২০ হাজার টাকা তাঁর কাছ থেকে নিয়ে নেন। এরপর শুরু হয় ইয়াসমিনকে তাঁর চেয়ে বয়সে ছোট দেবরের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা।
ইয়াসমিনের মা রোকেয়া বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, নানা রকম প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছিল। ইয়াসমিনকে আসতে দেওয়া হচ্ছিল না। দাফনের পাঁচ দিন পর একরকম জোরজবরদস্তি করেই ইয়াসমিনকে ছেলেসহ তাঁরা নিয়ে এসেছেন। ইয়াসমিনের শ্বশুরবাড়ির লোকেদের ধারণা, হাসিবুলের মৃত্যুতে বেশ মোটা অঙ্কের অনুদান পাবে ইয়াসমিন। কাজেই টাকাগুলো যাতে পরিবারের বাইরে না যায়, সে জন্য তাঁরা হাসিবুলের ছোট ভাই সুজন ইসলামের সঙ্গে জোরজবরদস্তি করেই ইয়াসমিনের বিয়ে দিতে চেষ্টা করছিলেন। সে চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে তাঁরা বগুড়ার বাড়িটিতেও উঠতে দিচ্ছেন না ইয়াসমিনকে। অনুদানের কোনো টাকা তাঁর হাতে আসেনি। তবে তিনি শুনেছেন আরও ২৫ হাজার টাকার অনুদান তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তুলে নিয়েছেন।
ইয়াসিন আলী মেয়েকে তো নিয়ে এলেন, কিন্তু লালন করার সামর্থ্য নেই তাঁর। বগুড়া শহরে বিভিন্ন ছাপাখানায় বই বাঁধাইয়ের কাজ করেন তিনি। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। ঘরে আরও দুই ছেলেমেয়ে আছে। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী। এর সঙ্গে যোগ হলো অকাল বিধবা মেয়ে আর নাতি। থাকার জায়গাই তো নেই তাঁদের। মাটির একটি ঘর। ভেতরে দুই পাশে দুই চৌকি। এক পাশে তাঁরা দুজন অন্য পাশে দুই ছেলেমেয়ে থাকত। এখন ইয়াসমিন আসায় নিজেদের বিছানা ছেড়ে দিয়ে ঘরের পাশেই বাঁশের বেড়ার ছাপরায় মাচান পেতে থাকেন; এত দিন সেখানে থাকত শুধু দুটি পালিত ছাগল।
হাসিবুলের বড় ভাই সোহেল ইসলামের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, দাফনের ২০ হাজার টাকা ছাড়া তাঁরা কোনো অনুদান পাননি। সেই টাকা দাফন ও পরে ‘হালকা-পাতলা’ অনুষ্ঠান করে খরচ করেছেন। এখন হাসিবুলের ছেলের পক্ষ থেকে তাঁরা সরকারি অনুদানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরসহ বিভিন্ন জায়গায় আবেদন করছেন। হাসিবুলের স্ত্রী ইয়াসমিনের সঙ্গে তাঁর ছোট ভাইয়ের বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা সম্পর্কে তিনি বলেন, গ্রামাঞ্চলে এ ধরনের নিয়ম আছে। আত্মীয়স্বজনের পক্ষ থেকে এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তবে তাঁরা কোনো জোরজবরদস্তি করেননি।
গত ৬ জানুয়ারি থেকে বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধে বগুড়ায় পেট্রলবোমা ও সহিংসতায় মারা গেছেন ছয়জন। ওই চারজন ছাড়াও ১০ জানুয়ারি নাটোরের গুরুদাসপুরের ট্রাকচালক ইমাদুর রহমান, ২২ জানুয়ারি সাতক্ষীরার ট্রাকচালকের সহকারী আবদুর রহিম মারা গেছেন। এই দুজন ও ট্রাকচালকের সহকারী শৈলকুপার ইমরান হোসেনের পরিবারের অবস্থা বগুড়া থেকে জানা সম্ভব হয়নি। হয়তো তাঁদের পরিবারও কমবেশি কিছু আর্থিক অনুদান পেয়েছে। তাঁদেরও কেউ অকাল বিধবা, কেউ এতিম, কেউ বা সন্তানহারা। কেউ জানবে না তাঁদের গোপন দীর্ঘশ্বাস, নিভৃত অশ্রুধারা। মানুষের জীবন কতই না তুচ্ছ হয়ে গেছে আজকাল!
‘সাবিনা।’
‘সাবিনার পর কী লেখেন?’
‘আগে বিবি লেকিচ্চুনু। বিদবা হছি, এখন বেওয়া লেকা লাগবি।’
টিনের ছাউনি দেওয়া লাল মাটির দেয়ালের ঘর। বারান্দার কিনার দিয়ে হাঁটুসমান উঁচু মাটির সরু দেয়াল, বৃষ্টির ছাঁট আটকানোর জন্য। তার ওপরে বসে কথা বলছিলেন ২২-২৪ বছরের সাবিনা বিবি অথবা বেওয়া। তাঁর স্বামী শহিদুল ইসলাম সরকার গত ৫ ফেব্রুয়ারি মারা গেছেন পেট্রলবোমা হামলায়। মায়ের পাশে শুকনো মুখে বসা ছয় বছরের সামিউল সরকার। বাবা হারানোর শোক হয়তো সে পুরোপুরি অনুভবই করে উঠতে পারেনি। একটা সময় হয়তো বাবার মুখও তার আর মনে থাকবে না। তবে আরও মাস পাঁচ-ছয়েক পরে যে ভূমিষ্ঠ হবে, সে তো বাবার মুখই দেখতে পাবে না। সাবিনা পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
গত বৃহস্পতিবার বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার বন্তেঘড়ি গ্রামের শহিদুল ইসলামের বাড়িতে কথা হচ্ছিল তাঁর স্ত্রী সাবিনা, বাবা আফজাল হোসেন সরকার ও মা জোবেদা বেগমের সঙ্গে। আফজালের পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে শহিদুল তৃতীয়। জমিজমা তাঁদের নেই। শিবগঞ্জ বাজারে শাকসবজি বিক্রির অল্প পুঁজির ব্যবসা। শহিদুল পান বিক্রেতা। যশোর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া এসব এলাকা থেকে পাইকারি দরে পান এনে বিক্রি করতেন শিবগঞ্জে দোকানে দোকানে। গত ৩ ফেব্রুয়ারি গিয়েছিলেন শৈলকুপায় পান আনতে। ট্রাকে করে পান নিয়ে (অন্যদের মালের সঙ্গে) ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে রওনা দেন। সেই সময় সাবিনার সঙ্গে তাঁর শেষ কথা। স্ত্রীকে জানিয়েছিলেন, রওনা দিচ্ছেন। ভোর ছয়টা নাগাদ এসে পৌঁছে যাবেন। বগুড়ার তিনমাথায় ট্রাকে পেট্রলবোমা হামলা হলো ৫ ফেব্রুয়ারি ভোর পাঁচটা নাগাদ। বাড়ি ঠিকই ফিরলেন শহিদুল, তবে বিলম্ব হলো খানিকটা। হেঁটে এলেন না। বয়ে আনা হলো তাঁকে। দগ্ধ, নিষ্প্রাণ। ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি।
এই হামলায় ট্রাকচালক, তাঁর সহকারী এবং আরও এক পান ব্যবসায়ী দগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে চালকের সহকারী শৈলকুপা উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামের ইমরান হোসেন পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বগুড়া শহীদ জিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।
সাবিনা এখন বুড়ো শ্বশুর-শাশুড়ির সংসারে আছেন। তাঁর বাবা দিনমজুর। নিজেরই সংসার চলে না। এই অবস্থায় এই ‘আড়াই জন’কে লালন-পালনের সাধ্য তাঁদের নেই। শহিদুলের মা জোবেদা কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন ‘পোয়াতি বউ আর এই অবুজ ছোল (ছেলে) থুয়্যা হামার জুয়ান ব্যাটা মর্যাে গেল বারে। অরকোরক, (ওদের) দেকার আর কেউ নাই।’
সাবিনা কেমন যেন নির্বাক হয়ে গেছেন। দু-তিনবার জিজ্ঞাসা করলে হয়তো একটি জবাব দেন, আর সারাক্ষণ চুপ করেই থাকেন। হয়তো ডুবে থাকেন নিজের, অনাগত সন্তান, ছোট্ট ছেলের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভাবনায়। লাখ খানেক টাকার পুঁজি ছিল শহিদুলের। তাঁর শরীরের মতো পানও পুড়ে গিয়েছিল। পুঁজিও শেষ।
সাহায্য হিসেবে তাঁরা পেয়েছেন ৫০ হাজার টাকার সরকারি অনুদান, স্থানীয় সাংসদের দেওয়া ৩০ হাজার ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার তরফ থেকে পাঁচ হাজার—এই ৮৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া লাশ পরিবহন-দাফন বাবদ ২০ হাজার টাকার সাহায্য এখনো হাতে পাননি। স্থানীয় আওয়ামী লীগ সভাপতির কাছে আছে সেই টাকা। তবে তিনি দিয়ে দেবেন বলে পরিবারটি আমাদের জানায়।
বৃহস্পতিবার নারহট্ট ইউনিয়নের নিশ্চিন্তপুর গ্রামে আমরা যখন যাই, তখন দুপুর। এটি কাহালু উপজেলা। জাহাঙ্গীর আলম জিলাদারের বাড়িটি সহজেই চেনা গেল। পেট্রলবোমায় নিহত হওয়ায় গ্রামের আশপাশের সবাই এখন তাঁর বাড়ি চেনে। জাহাঙ্গীরের বাড়িটি বেশ পরিচ্ছন্ন। মেটে ঘরের দেয়ালে পলিমাটি লেপে তাতে ফুলের নকশা আঁকা। স্ত্রী বিউটি আক্তার, ১৪ বছরের ছেলে জাহিদ হাসান আর মেয়ে ৯ বছরের জুঁইকে রেখে গেছেন তিনি।
জাহাঙ্গীর ট্রাকচালকের সহকারী। ট্রাকচালক মাসুদ মিয়া তাঁর ভগ্নিপতি। মাসুদ দুবাই থাকতেন। বছর চারেক আগে দেশে ফিরে ট্রাকটি কিনে নিজেই চালান। গত ২৩ জানুয়ারি তাঁরা কাহালু থেকে সবজি নিয়ে বগুড়ায় নামিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। শহরের চারমাথার কাছে সন্ধ্যায় তাঁদের ট্রাকে পেট্রলবোমা হামলা হয়। দুজনই গুরুতর দগ্ধ হন। ট্রাকটি সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। তাঁদের ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। এক মাসের বেশি যন্ত্রণায় ভুগে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি মারা যান জাহাঙ্গীর। ভগ্নিপতি মাসুদ এখনো চিকিৎসাধীন।
শহিদুলের স্ত্রী সাবিনার চেয়ে জাহাঙ্গীরের স্ত্রী বিউটি আর্থিক সহযোগিতা প্রাপ্তির দিক থেকে এগিয়ে। জাহাঙ্গীর ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে থাকার সময় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুসারে তাঁর তহবিল থেকে ১০ লাখ টাকার (চেক) বিশেষ আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। এ ছাড়া সরকারি অনুদানের ৫০ হাজার টাকা, লাশ দাফনসংক্রান্ত ২০ হাজার—এই ৭০ হাজার টাকা পেয়েছেন নগদ। এই নগদ টাকা ভেঙেই আপাতত তাঁদের সংসার চলছে। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ অনুদানের অর্থপ্রাপ্তির প্রক্রিয়া চলছে। এই টাকা আমানত হিসেবে রাখা হবে বলে বিউটি জানিয়েছেন। তবে তাঁর ইচ্ছা আছে গ্রামের আশপাশে কিছু জমি কেনার। কারণ, নগদ টাকা থাকলে খরচ হয়ে যাওয়ার ভয়। প্রধানমন্ত্রীর এই অনুদানের টাকাটাই তো এখন সম্বল।
এই সম্বলটুকুও নেই শাজাহানপুর উপজেলার বেজড়া শ্যামলাকাতি গ্রামের ইয়াসমিন বিজলির। বয়স হবে ১৭-১৮ বছর। বিয়ে হয়েছিল অল্প বয়সে। কোলে পাঁচ মাস বয়সী এক ছেলে। উপরন্তু আর্থিক স্বার্থ কতটা নির্মম হয়ে উঠতে পারে, আরও একবার তার চাক্ষুষ প্রমাণ পাওয়া গেল এই হতভাগ্য তরুণীর মুখোমুখি হয়ে।
কাহালু থেকে আমরা যখন ইয়াসমিনের বাড়িতে যাই, তখন পড়ন্ত বেলা। ছেলে ইস্রাফিল হাকিমকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন ইয়াসমিন। তাঁর স্বামী হাসিবুল ইসলামও ছিলেন ট্রাকচালকের সহকারী। গত ৭ জানুয়ারি বগুড়া-নাটোর সড়কের নন্দরূপিহার এলাকায় রাতে তাঁদের সবজিবাহী ট্রাকে পেট্রলবোমা হামলা হয়। দগ্ধ হয়েছিলেন তিনজন। হাসপাতালে আনার পরপরই তিনি মারা যান।
হাসিবুল বগুড়া শহরের চারমাথায় তাঁর বাবার কেনা তিন শতক জায়গায় ছাপরাঘর তুলে স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন। বাড়ি সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার সোনামুখী গ্রামে। বাবা ইয়াসিন আলী, মা রোকেয়া বেগম ও আত্মীয়দের সঙ্গে নিয়ে ইয়াসমিন স্বামীর লাশ দাফন করতে যান সোনামুখী। শ্বশুর-শাশুড়ি লাশ দাফনের ২০ হাজার টাকা তাঁর কাছ থেকে নিয়ে নেন। এরপর শুরু হয় ইয়াসমিনকে তাঁর চেয়ে বয়সে ছোট দেবরের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা।
ইয়াসমিনের মা রোকেয়া বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, নানা রকম প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছিল। ইয়াসমিনকে আসতে দেওয়া হচ্ছিল না। দাফনের পাঁচ দিন পর একরকম জোরজবরদস্তি করেই ইয়াসমিনকে ছেলেসহ তাঁরা নিয়ে এসেছেন। ইয়াসমিনের শ্বশুরবাড়ির লোকেদের ধারণা, হাসিবুলের মৃত্যুতে বেশ মোটা অঙ্কের অনুদান পাবে ইয়াসমিন। কাজেই টাকাগুলো যাতে পরিবারের বাইরে না যায়, সে জন্য তাঁরা হাসিবুলের ছোট ভাই সুজন ইসলামের সঙ্গে জোরজবরদস্তি করেই ইয়াসমিনের বিয়ে দিতে চেষ্টা করছিলেন। সে চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে তাঁরা বগুড়ার বাড়িটিতেও উঠতে দিচ্ছেন না ইয়াসমিনকে। অনুদানের কোনো টাকা তাঁর হাতে আসেনি। তবে তিনি শুনেছেন আরও ২৫ হাজার টাকার অনুদান তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তুলে নিয়েছেন।
ইয়াসিন আলী মেয়েকে তো নিয়ে এলেন, কিন্তু লালন করার সামর্থ্য নেই তাঁর। বগুড়া শহরে বিভিন্ন ছাপাখানায় বই বাঁধাইয়ের কাজ করেন তিনি। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। ঘরে আরও দুই ছেলেমেয়ে আছে। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী। এর সঙ্গে যোগ হলো অকাল বিধবা মেয়ে আর নাতি। থাকার জায়গাই তো নেই তাঁদের। মাটির একটি ঘর। ভেতরে দুই পাশে দুই চৌকি। এক পাশে তাঁরা দুজন অন্য পাশে দুই ছেলেমেয়ে থাকত। এখন ইয়াসমিন আসায় নিজেদের বিছানা ছেড়ে দিয়ে ঘরের পাশেই বাঁশের বেড়ার ছাপরায় মাচান পেতে থাকেন; এত দিন সেখানে থাকত শুধু দুটি পালিত ছাগল।
হাসিবুলের বড় ভাই সোহেল ইসলামের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, দাফনের ২০ হাজার টাকা ছাড়া তাঁরা কোনো অনুদান পাননি। সেই টাকা দাফন ও পরে ‘হালকা-পাতলা’ অনুষ্ঠান করে খরচ করেছেন। এখন হাসিবুলের ছেলের পক্ষ থেকে তাঁরা সরকারি অনুদানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরসহ বিভিন্ন জায়গায় আবেদন করছেন। হাসিবুলের স্ত্রী ইয়াসমিনের সঙ্গে তাঁর ছোট ভাইয়ের বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা সম্পর্কে তিনি বলেন, গ্রামাঞ্চলে এ ধরনের নিয়ম আছে। আত্মীয়স্বজনের পক্ষ থেকে এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তবে তাঁরা কোনো জোরজবরদস্তি করেননি।
গত ৬ জানুয়ারি থেকে বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধে বগুড়ায় পেট্রলবোমা ও সহিংসতায় মারা গেছেন ছয়জন। ওই চারজন ছাড়াও ১০ জানুয়ারি নাটোরের গুরুদাসপুরের ট্রাকচালক ইমাদুর রহমান, ২২ জানুয়ারি সাতক্ষীরার ট্রাকচালকের সহকারী আবদুর রহিম মারা গেছেন। এই দুজন ও ট্রাকচালকের সহকারী শৈলকুপার ইমরান হোসেনের পরিবারের অবস্থা বগুড়া থেকে জানা সম্ভব হয়নি। হয়তো তাঁদের পরিবারও কমবেশি কিছু আর্থিক অনুদান পেয়েছে। তাঁদেরও কেউ অকাল বিধবা, কেউ এতিম, কেউ বা সন্তানহারা। কেউ জানবে না তাঁদের গোপন দীর্ঘশ্বাস, নিভৃত অশ্রুধারা। মানুষের জীবন কতই না তুচ্ছ হয়ে গেছে আজকাল!
No comments