যে কারণে সিটি নির্বাচনে যাওয়া উচিত by আনিসুল হক
বিএনপির
উচিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যাওয়া। এবং ধারণা করা যায়, বিএনপি
নির্বাচনে যেতে চাইলেই সরকারি দল নানা রকমের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করবে।
কারণ, সরকার খুব ভালো করেই জানে, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির
প্রার্থী থাকা মানেই সরকার-সমর্থিত প্রার্থীদের জয়ের সম্ভাবনা কমে যাওয়া।
গাজীপুরের নির্বাচন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের শিক্ষা হলো,
স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে ভোটাররা সরকার ও সরকারি দলকে একটা সবক দেওয়ার
চেষ্টা করে থাকে। অতীতে এ ধরনের ঘটনা অনেকবারই ঘটতে দেখা গেছে। বিএনপির
আমলেও সরকারি প্রার্থী মির্জা আব্বাসকে হারিয়ে আওয়ামী লীগের মোহাম্মদ
হানিফ ঢাকা শহরে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। কাজেই বিএনপির জন্য এটা একটা
সুবর্ণ সুযোগ। না, আমি মেয়র বা কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগকেই
সোনালি সুযোগ বলছি না। আরও নানাভাবে বিএনপি এবং তার শরিকেরা লাভবান হবে,
যদি তারা দুই বড় শহরের স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নেয়।
প্রথম লাভ, বিএনপি ও তার শরিকেরা সে ক্ষেত্রে ঢাকায় ও চট্টগ্রামে সভা-সমাবেশ করার সুযোগ পাবে। আরাফাত রহমান কোকোর জানাজায় বিপুলসংখ্যক মানুষের যোগদান একটা বার্তা দিয়েছিল। কিন্তু সেই বার্তায় রাজনীতি কম ছিল। কারণ, মৃত মানুষের প্রতি সহানুভূতির পেছনে রাজনীতির ঊর্ধ্বে একটা মানবিক ব্যাপার থাকে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপি জোট সভা-সমাবেশ করার সুযোগ পাবে। সেই সুযোগটা তারা বিপুলভাবে কাজে লাগাতে পারবে। ধারণা করা যায়, সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচারণা উপলক্ষেই যদি ঢাকায় একটা সমাবেশ করার সুযোগ খালেদা জিয়া পান, তা স্মরণকালের অন্যতম বৃহৎ সমাবেশে পরিণত হবে। বিএনপির অবশ্যই এই সুযোগটা নেওয়া উচিত। এরপর নির্বাচনে দুটো ফল হতে পারে—এক. বিএনপির প্রার্থী জয়ী হবে। দুই. বিএনপির প্রার্থী পরাজিত হবে। বিএনপির প্রার্থী জয়ী হলে সেটা সারা দেশে তাদের কর্মী-সমর্থকদের উজ্জীবিত করবে। আর বিএনপির প্রার্থী পরাজিত হলে সেটাকেও আন্দোলনের একটা উপলক্ষ হিসেবে বিএনপি হাজির করতে পারবে। আর সেটা করার মতো দৃশ্যমান ঘটনা নির্বাচনী কেন্দ্রগুলোতে ক্যামেরা-প্লাবিত যুগে সরকারি দল মোটেও জোগাবে না, সেটা হতেই পারে না। নির্বাচনে জিতলেও বিএনপির লাভ, হারলেও বিএনপিরই লাভ। কাজেই বিএনপির উচিত নির্বাচনে যাওয়া।
তবে বিএনপি সুযোগ মিস করার সুযোগ কখনো মিস করে না। এবারও বিএনপি সুযোগটা হাতছাড়া করবে, লক্ষণ স্পষ্ট। ২৫ মার্চ বিএনপির জোট একটা বিবৃতি দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, ‘আন্দোলনের গতিধারাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সরকার ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে।’ তাদের ভাষায়, ‘৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় আরেকটি প্রতারণামূলক নির্বাচনী নাটক মঞ্চস্থ করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন তথা সরকার। আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে যে তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঘোষণা করা হয়েছে, তা গোটা দেশবাসীর ইচ্ছার সঙ্গে তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়।’ অনুমান করা যায়, ২০-দলীয় জোটের এই বিবৃতি নির্বাচনে নেমে পড়া সরকার-সমর্থিত প্রার্থীদের হালে ও জানে পানি এনে দিয়েছে। তাঁরা বড়ই উৎকণ্ঠিত, এই রে, এই বুঝি বিএনপি নির্বাচনে এসে গেল!
বিএনপি অভিযোগ করে থাকে, আওয়ামী লীগ চায় না, বিএনপি নির্বাচনে যাক। যেমন তারা বলত, আওয়ামী লীগ চায় না, বিএনপি সংসদে যাক। বিএনপির মতো বাধ্য বিরোধী দল আর হয় না! সরকারি দলের চাওয়া পূরণ করাই যেন তাদের দায়িত্ব। সরকার চায়নি, তাই আমরা সংসদে যাইনি। সরকার চায়নি, তাই আমরা নির্বাচনে যাইনি। সরকার যা চায় না, তাই করাই কি বিএনপির উচিত ছিল না? অনেকেই বলে থাকেন, বিএনপি যদি গত জাতীয় নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিত, সঙ্গে সঙ্গে হাওয়া তাদের অনুকূলে বইতে শুরু করত; প্রশাসন, কমিশন সেই হাওয়ার বিপরীতে অবস্থান নিতে পারত না।
আর এই মুহূর্তে সরকারেরও চেষ্টা করা উচিত বিএনপিকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আনতে সর্বাত্মক চেষ্টা করা। এতে সরকারেরও লাভ ছাড়াÿ ক্ষতি নেই। পত্রিকায় দেখলাম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নাকি বলেছেন, সব নির্বাচন জেতার জন্য করতে হয় না, অনেক সময় হারার জন্যও নির্বাচন করতে হয়। এটা যদি শেখ হাসিনা বলে থাকেন, তাহলে বলতে হবে, তিনি খুব ভালো একটা কথা বলেছেন, একজন পরিপক্ব রাজনীতিবিদের মতোই বলেছেন। বিএনপি ও তার জোটকে হরতাল-অবরোধ থেকে ফেরার একটা উপলক্ষ দেওয়া হোক, এটা এই কলামে এর আগেও বলা হয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিএনপি যদি আসে, সেটা সরকারকে একধরনের বৈধতাও দেবে। বিএনপি যদি জয়লাভ করে, তাহলে সরকার বলতে পারবে, দেখো, নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। এই নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় জাতীয় সরকারের অধীনে বিএনপি ও তার জোট তো নির্বাচনে আসতেই পারত।
ইংরেজিতে একটা কথা আছে, উইন উইন সিচুয়েশন। এমন পরিস্থিতি যাতে উভয় পক্ষই জয়লাভ করতে পারে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি জোটের অংশ নেওয়া আসলে তেমনি এক পরিস্থিতি। এতে অংশ নিলেই বিএনপি জয়লাভ করবে, ফল যা-ই হোক না কেন। সরকারও জয়লাভ করবে, নির্বাচনে যদি জনমতের প্রতিফলন ঘটে।
এবং তাতে জনগণেরও মঙ্গল। দেশের মঙ্গল। হরতাল-অবরোধ থেকে দেশবাসী কিছুদিনের জন্য হলেও মুক্তি পাবে। একজন মানুষও যদি পেট্রলবোমা থেকে বেঁচে যান, সেটাই অনেক বড় কথা। একটা যানবাহনও যদি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষা পায়, তাতেও দেশের ভালো ছাড়া ক্ষতি নয়। আমরা আর পারি না। আমরা কি একটা দিনও পাব না, যেটা কিনা স্বাভাবিক। জানি, হরতাল পালিত হয় না, অবরোধও হয় না বললেই চলে। কিন্তু আতঙ্ক তো থেকেই যায়। ভয়ের মতো সর্বনাশা জিনিস আর নেই। মরে যাওয়ার চেয়ে মরে যেতে পারি—এই ভয় একজন মানুষের জন্য বেশি ক্ষতিকর। আহা, নির্ভয়ে চলাফেরা করার শান্তি ও স্বস্তিটুকু দেশবাসী কত দিন পায় না! আহা, কত দিন আমাদের শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে ক্লাসে যায় না!
তবে এই দেশে যা হওয়া উচিত, তা হয় না। যা হওয়া উচিত নয়, তা-ই হয়। সেই সূত্র ধরে বলে দেওয়া যায়, বিএনপি এবারও সুযোগ হাতছাড়া করার সুযোগ হাতছাড়া করবে না। সরকার নানাভাবে তাদের নিরুৎসাহিত করবে নির্বাচনে আসতে। বিএনপিও সেটাকেই বড় করে তুলে সিটি করপোরেশন নির্বাচন বর্জন করবে। তারপর তারা তাদের নিষ্ফল আন্দোলন চালিয়েই যাবে। তাতে সরকার গা করবে না। সমঝোতা হবে না। হানাহানি চলতেই থাকবে। এই দেশের সৃজনশীল খেটে-খাওয়া গরিব-দুঃখী মানুষ সন্তানের মুখে হাসি ফোটানোর যে আয়োজন করে, উদয়াস্ত যে খেদমত করে, তা বৃথা যাবে; মানুষের এগিয়ে যাওয়ার পথে সৃষ্টি করা হবে বাধার পরে বাধা। অঞ্জন দত্তের গানের ভাষায়, সুদিন আসবে বলে ওরা আগুন জ্বালায় আর হাজার হাজার মানুষ মরে যায়। সুদিনের কথা বলে বাসে-ট্রেনে মানুষের গায়ে আগুন দেওয়া হবে আর সুদিনের আগমন হয়ে উঠবে সুদূরপরাহত। গণতান্ত্রিক রাজনীতির ব্যর্থতার সুযোগ নেবে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো, সন্ত্রাসী চক্র। শান্তি আনার কথা বলে বাড়বে দমন, নিপীড়ন। বাকস্বাধীনতা হরণ করা হবে, মানবাধিকার মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে রাস্তায় কিংবা নিজেই হয়ে যাবে গুম।
তাই আবারও বলি, বারবার বলি, বিএনপির উচিত হবে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেওয়া। সরকারের উচিত হবে বিএনপিকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আনতে সর্বতোভাবে চেষ্টা করা। আর নির্বাচনের ফল প্রভাবিত করার চেষ্টা না করা। বিএনপি নির্বাচনে এলে সবার লাভ। আর না এলে দেশের ক্ষতি।
ক্ষমতা অনেক সময় বুদ্ধির বিলোপ ঘটায়। আর ক্ষমতায় যাওয়ার উদগ্র বাসনাও অনেক সময় মানুষকে একচক্ষু গন্ডারে পরিণত করে। উভয় পক্ষের মধ্যে এই লক্ষণও বিলক্ষণ দেখা যাচ্ছে। আমরা প্রার্থনা করি, উভয়েরই শুভবুদ্ধির উদয় হোক। সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে দেশে গণতান্ত্রিক সহাবস্থানের একটা নজির তৈরি হোক। আমরা অন্তত কিছুদিনের জন্য একটু দম ফেলার সুযোগ পাই। একজন নাগরিক হিসেবে এই চাওয়াটাই আসলে সব চাওয়ার চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে, যা ছিল আমাদের স্বাভাবিক অধিকার, তা-ই আমাদের ভিক্ষা চাইতে হচ্ছে। গণতান্ত্রিক অধিকার। মানবিক অধিকার। নিরাপদে চলাফেরা করা ও নিরাপদে বাড়ি ফিরে আসার অধিকার। হে আল্লাহ, আপনি ওদের সুমতি দিন।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
প্রথম লাভ, বিএনপি ও তার শরিকেরা সে ক্ষেত্রে ঢাকায় ও চট্টগ্রামে সভা-সমাবেশ করার সুযোগ পাবে। আরাফাত রহমান কোকোর জানাজায় বিপুলসংখ্যক মানুষের যোগদান একটা বার্তা দিয়েছিল। কিন্তু সেই বার্তায় রাজনীতি কম ছিল। কারণ, মৃত মানুষের প্রতি সহানুভূতির পেছনে রাজনীতির ঊর্ধ্বে একটা মানবিক ব্যাপার থাকে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপি জোট সভা-সমাবেশ করার সুযোগ পাবে। সেই সুযোগটা তারা বিপুলভাবে কাজে লাগাতে পারবে। ধারণা করা যায়, সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচারণা উপলক্ষেই যদি ঢাকায় একটা সমাবেশ করার সুযোগ খালেদা জিয়া পান, তা স্মরণকালের অন্যতম বৃহৎ সমাবেশে পরিণত হবে। বিএনপির অবশ্যই এই সুযোগটা নেওয়া উচিত। এরপর নির্বাচনে দুটো ফল হতে পারে—এক. বিএনপির প্রার্থী জয়ী হবে। দুই. বিএনপির প্রার্থী পরাজিত হবে। বিএনপির প্রার্থী জয়ী হলে সেটা সারা দেশে তাদের কর্মী-সমর্থকদের উজ্জীবিত করবে। আর বিএনপির প্রার্থী পরাজিত হলে সেটাকেও আন্দোলনের একটা উপলক্ষ হিসেবে বিএনপি হাজির করতে পারবে। আর সেটা করার মতো দৃশ্যমান ঘটনা নির্বাচনী কেন্দ্রগুলোতে ক্যামেরা-প্লাবিত যুগে সরকারি দল মোটেও জোগাবে না, সেটা হতেই পারে না। নির্বাচনে জিতলেও বিএনপির লাভ, হারলেও বিএনপিরই লাভ। কাজেই বিএনপির উচিত নির্বাচনে যাওয়া।
তবে বিএনপি সুযোগ মিস করার সুযোগ কখনো মিস করে না। এবারও বিএনপি সুযোগটা হাতছাড়া করবে, লক্ষণ স্পষ্ট। ২৫ মার্চ বিএনপির জোট একটা বিবৃতি দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, ‘আন্দোলনের গতিধারাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সরকার ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে।’ তাদের ভাষায়, ‘৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় আরেকটি প্রতারণামূলক নির্বাচনী নাটক মঞ্চস্থ করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন তথা সরকার। আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে যে তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঘোষণা করা হয়েছে, তা গোটা দেশবাসীর ইচ্ছার সঙ্গে তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়।’ অনুমান করা যায়, ২০-দলীয় জোটের এই বিবৃতি নির্বাচনে নেমে পড়া সরকার-সমর্থিত প্রার্থীদের হালে ও জানে পানি এনে দিয়েছে। তাঁরা বড়ই উৎকণ্ঠিত, এই রে, এই বুঝি বিএনপি নির্বাচনে এসে গেল!
বিএনপি অভিযোগ করে থাকে, আওয়ামী লীগ চায় না, বিএনপি নির্বাচনে যাক। যেমন তারা বলত, আওয়ামী লীগ চায় না, বিএনপি সংসদে যাক। বিএনপির মতো বাধ্য বিরোধী দল আর হয় না! সরকারি দলের চাওয়া পূরণ করাই যেন তাদের দায়িত্ব। সরকার চায়নি, তাই আমরা সংসদে যাইনি। সরকার চায়নি, তাই আমরা নির্বাচনে যাইনি। সরকার যা চায় না, তাই করাই কি বিএনপির উচিত ছিল না? অনেকেই বলে থাকেন, বিএনপি যদি গত জাতীয় নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিত, সঙ্গে সঙ্গে হাওয়া তাদের অনুকূলে বইতে শুরু করত; প্রশাসন, কমিশন সেই হাওয়ার বিপরীতে অবস্থান নিতে পারত না।
আর এই মুহূর্তে সরকারেরও চেষ্টা করা উচিত বিএনপিকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আনতে সর্বাত্মক চেষ্টা করা। এতে সরকারেরও লাভ ছাড়াÿ ক্ষতি নেই। পত্রিকায় দেখলাম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নাকি বলেছেন, সব নির্বাচন জেতার জন্য করতে হয় না, অনেক সময় হারার জন্যও নির্বাচন করতে হয়। এটা যদি শেখ হাসিনা বলে থাকেন, তাহলে বলতে হবে, তিনি খুব ভালো একটা কথা বলেছেন, একজন পরিপক্ব রাজনীতিবিদের মতোই বলেছেন। বিএনপি ও তার জোটকে হরতাল-অবরোধ থেকে ফেরার একটা উপলক্ষ দেওয়া হোক, এটা এই কলামে এর আগেও বলা হয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিএনপি যদি আসে, সেটা সরকারকে একধরনের বৈধতাও দেবে। বিএনপি যদি জয়লাভ করে, তাহলে সরকার বলতে পারবে, দেখো, নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। এই নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় জাতীয় সরকারের অধীনে বিএনপি ও তার জোট তো নির্বাচনে আসতেই পারত।
ইংরেজিতে একটা কথা আছে, উইন উইন সিচুয়েশন। এমন পরিস্থিতি যাতে উভয় পক্ষই জয়লাভ করতে পারে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি জোটের অংশ নেওয়া আসলে তেমনি এক পরিস্থিতি। এতে অংশ নিলেই বিএনপি জয়লাভ করবে, ফল যা-ই হোক না কেন। সরকারও জয়লাভ করবে, নির্বাচনে যদি জনমতের প্রতিফলন ঘটে।
এবং তাতে জনগণেরও মঙ্গল। দেশের মঙ্গল। হরতাল-অবরোধ থেকে দেশবাসী কিছুদিনের জন্য হলেও মুক্তি পাবে। একজন মানুষও যদি পেট্রলবোমা থেকে বেঁচে যান, সেটাই অনেক বড় কথা। একটা যানবাহনও যদি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষা পায়, তাতেও দেশের ভালো ছাড়া ক্ষতি নয়। আমরা আর পারি না। আমরা কি একটা দিনও পাব না, যেটা কিনা স্বাভাবিক। জানি, হরতাল পালিত হয় না, অবরোধও হয় না বললেই চলে। কিন্তু আতঙ্ক তো থেকেই যায়। ভয়ের মতো সর্বনাশা জিনিস আর নেই। মরে যাওয়ার চেয়ে মরে যেতে পারি—এই ভয় একজন মানুষের জন্য বেশি ক্ষতিকর। আহা, নির্ভয়ে চলাফেরা করার শান্তি ও স্বস্তিটুকু দেশবাসী কত দিন পায় না! আহা, কত দিন আমাদের শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে ক্লাসে যায় না!
তবে এই দেশে যা হওয়া উচিত, তা হয় না। যা হওয়া উচিত নয়, তা-ই হয়। সেই সূত্র ধরে বলে দেওয়া যায়, বিএনপি এবারও সুযোগ হাতছাড়া করার সুযোগ হাতছাড়া করবে না। সরকার নানাভাবে তাদের নিরুৎসাহিত করবে নির্বাচনে আসতে। বিএনপিও সেটাকেই বড় করে তুলে সিটি করপোরেশন নির্বাচন বর্জন করবে। তারপর তারা তাদের নিষ্ফল আন্দোলন চালিয়েই যাবে। তাতে সরকার গা করবে না। সমঝোতা হবে না। হানাহানি চলতেই থাকবে। এই দেশের সৃজনশীল খেটে-খাওয়া গরিব-দুঃখী মানুষ সন্তানের মুখে হাসি ফোটানোর যে আয়োজন করে, উদয়াস্ত যে খেদমত করে, তা বৃথা যাবে; মানুষের এগিয়ে যাওয়ার পথে সৃষ্টি করা হবে বাধার পরে বাধা। অঞ্জন দত্তের গানের ভাষায়, সুদিন আসবে বলে ওরা আগুন জ্বালায় আর হাজার হাজার মানুষ মরে যায়। সুদিনের কথা বলে বাসে-ট্রেনে মানুষের গায়ে আগুন দেওয়া হবে আর সুদিনের আগমন হয়ে উঠবে সুদূরপরাহত। গণতান্ত্রিক রাজনীতির ব্যর্থতার সুযোগ নেবে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো, সন্ত্রাসী চক্র। শান্তি আনার কথা বলে বাড়বে দমন, নিপীড়ন। বাকস্বাধীনতা হরণ করা হবে, মানবাধিকার মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে রাস্তায় কিংবা নিজেই হয়ে যাবে গুম।
তাই আবারও বলি, বারবার বলি, বিএনপির উচিত হবে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেওয়া। সরকারের উচিত হবে বিএনপিকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আনতে সর্বতোভাবে চেষ্টা করা। আর নির্বাচনের ফল প্রভাবিত করার চেষ্টা না করা। বিএনপি নির্বাচনে এলে সবার লাভ। আর না এলে দেশের ক্ষতি।
ক্ষমতা অনেক সময় বুদ্ধির বিলোপ ঘটায়। আর ক্ষমতায় যাওয়ার উদগ্র বাসনাও অনেক সময় মানুষকে একচক্ষু গন্ডারে পরিণত করে। উভয় পক্ষের মধ্যে এই লক্ষণও বিলক্ষণ দেখা যাচ্ছে। আমরা প্রার্থনা করি, উভয়েরই শুভবুদ্ধির উদয় হোক। সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে দেশে গণতান্ত্রিক সহাবস্থানের একটা নজির তৈরি হোক। আমরা অন্তত কিছুদিনের জন্য একটু দম ফেলার সুযোগ পাই। একজন নাগরিক হিসেবে এই চাওয়াটাই আসলে সব চাওয়ার চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে, যা ছিল আমাদের স্বাভাবিক অধিকার, তা-ই আমাদের ভিক্ষা চাইতে হচ্ছে। গণতান্ত্রিক অধিকার। মানবিক অধিকার। নিরাপদে চলাফেরা করা ও নিরাপদে বাড়ি ফিরে আসার অধিকার। হে আল্লাহ, আপনি ওদের সুমতি দিন।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments