পঞ্চম না প্রথম by তালহা বিন নজরুল
ক্রিকেট
বিশ্বের চোখ আজ মেলবোর্নে। মুখোমুখি অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ড।
ধুন্ধুমার ব্যাটিংয়ের মোকাবিলায় আগুনে বোলিং। উড়ন্ত কিউই দল আজ অফুরন্ত
শক্তির আঁধারে। প্রবীণ আর নবীনের লড়াইও বলা যায়। ফাইনালে খেলা যাদের অনেকটা
অভ্যাসে পরিণত তাদের মোকাবিলায় মঞ্চে নবাগত। ছয়বারের ফাইনাল খেলে চারবার
শিরোপা নিয়ে ফিরেছে অস্ট্রেলিয়া। আর নিউজিল্যান্ড সাতবারের প্রচেষ্টায়
প্রথম খেলছে ফাইনালে। অস্ট্রেলিয়া কি পঞ্চমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হবে নাকি
প্রথম শিরোপা জিতে নিউজিল্যান্ড গড়বে নতুন ইতিহাস। ১৯৯২-এ
নিউজিল্যান্ডারদের দুরন্ত নৈপুণ্যে যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন মার্টিন ক্রো
তিনি আজ মরণব্যাধিতে আক্রান্ত। ভাবাবেগে আপ্লুত তারই উত্তরসূরিদের
অদম্যস্পৃহায়। গতকাল তিনি লিখেছেন, মৃত্যুর আগে সম্ভবত এটিই তার দেখা শেষ
ম্যাচ হবে। তার আবদার যদি আজ জিততে পারে ব্রেন্ডন ম্যাককালামের দল তবে তিনি
একটা সুখস্মৃতি নিয়ে চিরনিদ্রায় যেতে পারবেন। আবেগ আর উৎকণ্ঠা সাগরের দুই
তীরে। কি হবে আজ? কে হাসবে শেষ হাসি? অস্ট্রেলিয়া না নিউজিল্যান্ড- কে হবে
ক্রিকেট বিশ্বের নতুন চ্যাম্পিয়ন? মাইকেল ক্লার্ক না ব্রেন্ডন ম্যাককালাম,
কার হাতে শোভা পাবে দৈর্ঘে ৬০ সেন্টিমিটার আর ১১ কিলোগ্রাম ওজনের সোনা আর
রূপায় গড়া ট্রফিটি? বাকি আর মাত্র কয়েকটি ঘণ্টা। সব অপেক্ষার অবসান হচ্ছে
আজই। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে আজকের খেলা দিয়েই পর্দা নামছে বিশ্বকাপ
ক্রিকেট ২০১৫-এর। ১৪ই ফেব্রুয়ারি ১৪ দলের যে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই শুরু হয়েছিল
তার ফল বের হবে আজ অপরাহ্ণে। অস্ট্রেলিয়ায় তখন রাতের প্রথম প্রহর আর
নিউজিল্যান্ডে মাঝরাত। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একই মহাদেশের দুটি দেশ
অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ড। মাঝে বিশাল তাসমান সাগর। তবুও যেন একই বৃন্তে
দুটি ফুল। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, ভাষা সবই এক। দুটি দেশই হাজার হাজার মাইল
দূরে বৃটেনের সিংহাসনে বসা রানীর বশ্যতা খুব গভীরভাবে স্বীকার করে চলেছে
আজও। অজি-কিউইদের পূর্ব পুরুষরাই যে যুক্তরাজ্য থেকে আগত। এর চেয়ে আদর্শ
ফাইনাল আর কি হতে পারতো। গত বিশ্বকাপে দুই সহ আয়োজক ভারত আর শ্রীলঙ্কা
ফাইনালে খেলেছে। তারাও সাগরের জলরাশিতে বিভক্ত। কিন্তু তাদের ভাষা আর ধর্মে
পার্থক্য বিরাট। বিশ্বকাপের ১১ আসরে দ্বিতীয়বার এবং টানা দুই সহ আয়োজক
ফাইনাল খেলছে। ক্রিকেটের ইতিহাসে অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের ফারাকটাও
কিন্তু তাসমান সাগরের চেয়ে কম নয়। অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট শুরু ১৮৭৭ সালে আর
নিউজিল্যান্ডের ১৯৩০-এ। শুধু ঐতিহ্যে নয়, সাফল্যেও। তবে মাঠের লড়াই ভিন্ন।
ওসব কাগজে কলমের হিসাব ধোপে টেকে না। ছোট-বড় কেউ কারে নাহি ছাড়ে, লড়ে যায়
সমানে সমান। এবারের প্রেক্ষাপটে কোন অঘটন নয়, দাপুটে দু’টি দলই খেলছে
ফাইনাল। অনেকের মতেই স্বপ্নের ফাইনাল। একই গ্রুপের দুটি দল। নিউজিল্যান্ড
প্রথম আর অস্ট্রেলিয়া দ্বিতীয়। নিউজিল্যান্ডের কাছেই একমাত্র হার অজিদের।
যদিও তা এক উইকেটের ব্যবধানে তবুও অঙ্কের হিসাবে এগিয়ে তারাই।
নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যানরা এবার যে তাণ্ডব দেখিয়েছেন তা কিংবদন্তির মতো
হয়ে থাকবে। ম্যাককালাম, গাপটিল, উইলিয়ামসন, কোরি অ্যান্ডারসনতো আগেই
দেখিয়েছেন। শেষটা জ্বলজ্বলে রেখেছেন গ্রান্ট এলিয়ট। অভিজ্ঞ রস টেইলর তো
হাতই খুলতে পারছেন না নতুনদের দাপটে। লুক রনকিও তেমন সুযোগ পাননি। তবে
সবার এক সঙ্গে জ্বলে ওঠা হয়নি। একেক ম্যাচে একেক জন। এটা যেমন সাহসের তেমনি
ভয়েরও। তারা সব ম্যাচ খেলেছে নিজেদের মাঠে এবং সেই সব মাঠ অস্ট্রেলিয়ার
মাঠের চেয়ে ছোট। এটা তাদের জন্য নেতিবাচকও হতে পারে। প্রায় ১০০০০০ লাখ
দর্শকের বেশির ভাগই থাকবে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে। অবশ্য নিউজিল্যান্ড আশা
করতেই পারে যে, ভারতের বিশাল সমর্থকগোষ্ঠীর সমর্থনটা তাদের দিকেই যাবে আজ।
তাদের আহ্বানও জানিয়েছেন কিউই অধিনায়ক। অস্ট্রেলিয়ার দাপট কিন্তু নতুন নয়।
অনেক ভারসাম্যপূর্ণ দল। ব্যাটে-বলে প্রতিভার ছড়াছড়ি তাদেরও। স্বয়ং অধিনায়ক
চোটের কারণে নিজেকে মেলে ধরতে না পারলেও সতীর্থরা বিশেষ করে স্মিথ,
ওয়ার্নার, ওয়াটসন, ম্যাক্সওয়েল ব্যর্থ হলেও ফিঞ্চ-হ্যাডিনও বুক চিতিয়ে
দাঁড়াতে পারেন। তবে গ্রুপ পর্বে যেমন বোলারদের লড়াই হয়েছিল এবার তেমন হবে
বলে আশা করছেন না বিশেষজ্ঞ মহল। মেলবোর্ন বলেই এমন ধারণা। বোল্ট-সাউদি যদি
তাদের দাপট দেখাতে পারেন তবে কিন্তু স্টার্ক-জনসনের সঙ্গে হ্যাজলউডও
প্রস্তুত আছেন। ভেট্টরির জবাব দেয়ার জন্য ম্যাক্সওয়েলই যথেষ্ট হবেন কিনা
বলা যায় না। ম্যাককালাম আত্মবিশ্বাসী জয়ের ব্যাপারে। তবে কাল মেলবোর্নে
ক্লার্ক যেন কি বললেন ম্যাককালামকে। পিঠে হাত রেখে সময় কাটালেন। মাইকেল
ক্লার্ক ঘোষণা দিয়েছেন কালই, যে এটি তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ। এ
ম্যাচকে স্মরণীয় করে রাখতে সতীর্থরা নিজেদের উজাড় করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি
দিয়েছেন কাল টিম মিটিংয়ে। টস আজ বড় একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতে পারে। কেউ না
চাইলেও এটাই সত্য যে বিশ্বকাপ ফাইনালের মতো বড় স্নায়ুক্ষয়ী খেলায় টস বিরাট
ভূমিকা রাখে। যে দলই জিতুক তারা চাইবে ৩০০ রানের বেশি তুলতে। ৩০০ না হলে
সংগ্রহটা নিরাপদ থাকবে। মেলবোর্নের ইতিহাস বলে ৩০০ রানই নিরাপদ স্কোর হতে
পারে। এই রান তাড়া করে জয়ের নজির খুবই কম। তাই বলে ্টাে এমন নয় যে, যে দল
টস জিতবে সে দলই ম্যাচ জিতবে। যদিও বিম্বকাপ ফাইনালে বেশির ভাগই জয় পেয়েছে
আগে ব্যাটিং করা দল। ১৯৯২এ মাঠেই পাকিস্তান মাত্র ২৪৯ রান করেও ইংল্যান্ডকে
হারায় ২২ রানে। বিশ্বকাপের ফাইনালে এ অবধি অবশ্য কোন দলই ৩০০ রান করতে
পারেনি। ১৯৯২তে নিজ দেশে নিউজিল্যান্ডের কাছে হেরে সেমিফাইনালেই খেলতে
পারেন অস্ট্রেলিয়া সেটি নাকি এখনও তাদের পোড়ায়। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড
যে দলই জিতুক ক্রিকেট বিশ্বের কিছু যায় আসে না। তারা চায় জয় হোক ক্রিকেটের।
No comments