দুই শিবিরেই নানা হিসাব by কাফি কামাল
সিটি
করপোরেশন নির্বাচন ঘিরে দুই শিবিরেই চলছে নানা হিসাব-নিকাশ। অরাজনৈতিক এ
নির্বাচনে এখন রাজনীতিই হয়ে উঠেছে মুখ্য। রাজনৈতিক লাভ-লোকসানের হিসাব কষে
এগোচ্ছে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল। প্রার্থী সমর্থন দিয়ে নির্বাচনের মাঠে
নামলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জয়-পরাজয়ের হিসাব কষছে বিএনপির অবস্থানের ওপর।
আর বিএনপি নির্বাচনের ছক করছে সরকারের গতিবিধি ও আচরণ দেখে। এ কারণে এখন
পর্যন্ত প্রার্থী মনোনয়ন ও নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোন ঘোষণা
দেয়নি দলটি। শেষ পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট নির্বাচনের মাঠে
থাকলে আওয়ামী লীগের জন্য নির্বাচনী হিসাব অন্যরকম হবে বলে মনে করছেন দলের
নেতারা। এ কারণে বিরোধী জোটের অবস্থানের ওপর নির্ভর করেই নির্বাচনী কৌশল
ঠিক করতে চায় ক্ষমতাসীন দল। এ ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার যে শক্ত ইঙ্গিত
দিয়ে আসছে তাতে অনেকটা শঙ্কাও ভর করেছে আওয়ামী লীগে। কারণ বিএনপি একক
প্রার্থী দিয়ে মাঠে নামলে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জন্য তা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে
দাঁড়াবে। অন্যদিকে মামলা ও রাজনৈতিক হয়রানিতে বিপর্যস্ত বিএনপিতে
নির্বাচনে অংশ নেয়া না নেয়া নিয়ে নানা মত থাকলেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে
থাকার পক্ষেই মত আসছে। দলটির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, নেতাকর্মীরা হয়রানির
শিকার হলেও সুষ্ঠু ভোট হলে সাধারণ ভোটাররা তাদের পাশে দাঁড়াবেন। এতে
নির্বাচনের ফলও তাদের পক্ষে থাকবে।
শঙ্কায় আওয়ামী লীগ। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট অংশ নেয়ায় কিছুটা শঙ্কায় পড়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এ কারণে জীবনপণ লড়াই মানসিকতা নিয়ে অংশ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা। গত শুক্রবার গণভবনে আয়োজিত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ে বৈঠকে এসব প্রসঙ্গে আলোচনা হয়। বৈঠকে কাউন্সিলর পদে অংশ নিতে আগ্রহী কয়েকজন প্রার্থী বলেন, বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেয়ার বার্তা পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু সেই বার্তা ভুল প্রমাণ করে তারা অংশ নিচ্ছে। দলীয়ভাবে বিশৃঙ্খল অবস্থায় থাকলেও প্রার্থী দেয়ার ক্ষেত্রে তারা কম প্রার্থী দিচ্ছে। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান, সূত্রাপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মান্নাফী, সবুজবাগ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদ ও ওয়ার্ড পর্যায় থেকে আবদুস সালাম ও আসলাম মাস্টার বক্তব্য রাখেন। বক্তারা তাদের বক্তব্যে, নিজেদের মধ্যে নানা বিভেদের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও কামনা করেন নেতারা। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য চলাকালীন সময়ে মাঠ পর্যায়ের নেতারা শেখ হাসিনার নির্দেশ অনুযায়ী দল-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন বলে দলীয় সভানেত্রীকে আশ্বাস দেন। প্রধানমন্ত্রী মহানগর নেতাদের কাউন্সিলর পদে একক প্রার্থী দেয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, এ ব্যাপারে একটি কমিটি করে দেয়া হয়েছে। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এ কমিটি প্রার্থী ঠিক করবে।
ভোটারদের ওপর ভরসা বিএনপির
গ্রেপ্তার ও পুলিশি হয়রানির ভয়ে আত্মগোপনে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। গ্রেপ্তার আতঙ্কে এলাকাছাড়া তৃণমূল নেতাকর্মীরাও। ঘাড়ের ওপর ডজন ডজন মামলার খড়গ। তাই প্রকাশ্যে নির্বাচনী প্রচারণার সুযোগ নেই তাদের। সক্রিয় সমর্থকরাও নেই স্বস্তিতে। প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন বিএনপির সমর্থন প্রত্যাশী সম্ভাব্য মেয়র ও কমিশনার প্রার্থীরা। এদিকে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির স্বার্থে নির্বাচন কমিশনের কাছে ২০ দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী ঘরনার বিশিষ্ট নাগরিকদের তরফে কিছু পরামর্শ এবং দাবি জানানো হলেও তার ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী এবং সরকারদলীয় নেতাদের বক্তব্যেও সেসব দাবির ব্যাপারে আশাবাদী হতে পারছে না বিরোধী জোট। ইতিমধ্যে প্রশাসনের অবস্থান পরিষ্কার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম বলেছেন, ‘প্রার্থী আসামি হলে ছাড় দেয়া হবে না।’ তবু সিটি করপোরেশন নির্বাচনের লড়াইয়ে থাকছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দল। সক্রিয় নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণের ব্যাপারে যেখানে ন্যূনতম নিশ্চয়তা নেই সেখানে কেন আন্দোলন কর্মসূচি শিথিল করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ? এমন প্রশ্ন ও আলোচনা-পর্যালোচনায় মুখর এখন বিরোধী কর্মী-সমর্থকরা। প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে বিরোধী জোট কিভাবে ফলাফল নিজেদের অনুকূলে আনবে এমন কৌতূহল নানা মহলে। কিন্তু বিএনপির শীর্ষ নেতারা এবার হাঁটছেন নতুন কৌশলে। দলের নেতাকর্মীদের চেয়ে এবার সাধারণ সমর্থক এবং ভোটারদের ওপরই বেশি ভরসা করতে চান তারা। বিএনপি ও জোটের একাধিক শীর্ষস্থানীয় নেতা এমন দৃষ্টিভঙ্গির কথা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, বিগত বছরগুলোতে সরকারের নানা অনিয়ম, বিতর্কিত কর্মকাণ্ড এবং মৌলিক অধিকার বঞ্চিত হওয়ায় সাধারণ মানুষ সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ। তার ওপর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে না পারার ক্ষোভও রয়েছে। সুষ্ঠু পরিবেশ পেলে সিটি নির্বাচনের ফলাফলে তার প্রতিফলন দেখা যাবে। নেতারা জানান, ঢাকা সিটিতে বিরোধী নেতাকর্মীরা একেবারেই কোণঠাসা অবস্থানে। সবার ওপর মামলা ঝুলছে। বাড়িতে বাড়িতে পুলিশি তল্লাশি চলছে। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখেও নির্বাচনের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে বিএনপি। কারণ এবার কর্মীদের চেয়ে ভোটারদের নীরব ভূমিকার ওপর বেশি আস্থা রাখতে চায় শীর্ষ নেতৃত্ব। ভোটারদের ওপর ভরসা করার প্রাথমিক ইঙ্গিত হিসেবে ঢাকায় নির্বাচনী কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে তৎপরতা শুরু করেছেন বিশিষ্ট নাগরিকদের সংগঠন ‘শত নাগরিক’। চট্টগ্রামে ‘চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলন’-এর মতো ঢাকায় সুনির্দিষ্ট প্রার্থীর পক্ষে সমর্থন ঘোষণা দিতে পারে ‘শত নাগরিক’। নাগরিক সমাজের ব্যানারে নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে বিশিষ্ট নাগরিকদের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা হবে। নেতারা জানান, নির্বাচনী পরিবেশের ওপরই সর্বাধিক জোর দেবে ২০ দল। এ নিয়ে শিগগিরই জোটের তরফে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু দাবিও তুলে ধরার সম্ভাবনা রয়েছে। শত নাগরিক-এর সদস্য সচিব আবদুল হাই শিকদার বলেন, নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাতে আলোচ্য বিষয়গুলো বিএনপি চেয়ারপারসনকে অবহিত করা হয়েছে। ওনার কথা-বার্তায় মনে হয়েছে, সরকার ও নির্বাচন কমিশনের আচরণ পর্যবেক্ষণ করছেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন দিয়ে সরকারই ফাঁদে পড়েছে। যে মুহূর্তে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণের নির্দেশনা দেবে, জনগণ ঢাকা ও চট্টগ্রামের রাস্তায় নেমে আসবে। জেল-জুলুম-গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে কোন লাভ হবে না। গ্রেপ্তার করে বিএনপি প্রার্থীদের পরাজিত করা যাবে না। বিএনপিকে ভোট থেকে বিরতও রাখা যাবে না। দলের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানিয়েছেন, নির্বাচন ও আন্দোলন একই সঙ্গে চলবে। দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে যেতে পরামর্শ দিয়েছেন। সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি না হলে সিটি নির্বাচন বয়কট করবে বিএনপি। এমন সিদ্ধান্ত বিবেচনায় রেখেই নির্বাচনী ট্র্যাকে ছুটতে শুরু করেছে দলটি। সরকার ও প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া এবং পদক্ষেপ দেখে তারপরই দলীয় প্রার্থীর সমর্থনে নির্বাচনে থাকা না-থাকার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে বিএনপি। বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থকদের চেয়ে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পরিবেশ পাবে কিনা তার ওপরই নির্ভর করবে বিএনপির চূড়ান্ত অংশগ্রহণ বা সরে দাঁড়ানো। এদিকে বিএনপিপন্থি পেশাজীবী নেতারা জানান, এবার সিটি নির্বাচনে কমিশনার প্রার্থীরা একটি বিরাট ফ্যাক্টর হবেন। কারণ প্রতিটি ওয়ার্ডে একাধিক সরকার দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থী থাকতে পারে। আর সেটা হলে কেন্দ্রে ভোট কারচুপির সম্ভাবনাও কমবে। যার সুফল পাবে জনসমর্থিত প্রার্থীরা।
নেতারা জানান, ২০ দলীয় জোটের চলমান আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সরকার এবং বিরোধী জোটের মধ্যে একটি আস্থার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য তৎপর রয়েছেন আন্তর্জাতিক মহলসহ কূটনীতিকরা। আন্দোলনে নানা নৈরাজ্যের ঘটনার দায় বিরোধী দলের ওপর চাপিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে একটি প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে সরকার। সেখানে বিএনপিকে অগণতান্ত্রিক, নির্বাচনবিমুখ এবং জঙ্গি মনোভাবের দল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ফলে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সরকারের সে প্রচারণাকে ভুল প্রমাণ করতে চায় বিএনপি। বিএনপি নেতারা মনে করেন, ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচন কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক মহলের সতর্ক পর্যবেক্ষণে থাকবে। এক্ষেত্রে পরিবেশ পেলে ফলাফল নিজেদের অনুকূলে এনে বিএনপি তাদের পক্ষে জনসমর্থনের বিষয়টি প্রমাণের সুযোগ পাবে। অন্যদিকে তীব্র প্রতিকূল পরিবেশে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে হলে সেক্ষেত্রে আন্দোলনের যৌক্তিক ভিত্তিও সুদৃঢ় হবে। বিএনপি ও জোটের নেতারা জানান, নানামুখী বিচার-বিশ্লেষণের পর সিটি নির্বাচনে ইতিবাচক মনোভাবের বার্তা দিয়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দল। অবরোধ-হরতালের সমন্বয়ে চলমান আন্দোলন কর্মসূচি থেকে কিছুটা বেরিয়ে এসেছে বিরোধী জোট। অনির্দিষ্টকালের অবরোধের পাশাপাশি প্রতি সপ্তাহে দু’দফায় ৫দিন করে হরতালের যে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছিল ২০ দল সেখান থেকে সরে এসেছে। গত সপ্তাহের শেষ দুদিনের পর চলতি সপ্তাহেও নতুন করে হরতালের ঘোষণা আসেনি ২০ দলের তরফে। নেতারা আশা করেন, হরতাল কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে আসার মাধ্যমে যে ইতিবাচক বার্তা দেয়া হয়েছে সরকার সেটাকে নিশ্চয়ই গুরুত্বের সঙ্গেই নেবে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ, রাজনীতি ও নির্বাচনের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে নিশ্চয়ই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
চট্টগ্রামে মনজুর আলমের পর ঢাকায় আবদুল আউয়াল মিন্টু ও সর্বশেষ হেভিওয়েট প্রার্থী হিসেবে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের পক্ষে মনোনয়নপত্র সংগ্রহের পর জমে উঠতে শুরু করেছে নির্বাচন। এ দুজনের মেয়র পদে প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনায় বিএনপি নেতা-কর্মীরা কিছুটা উচ্ছ্বসিত ও আশাবাদী। তবে বিএনপি নেতারা জানান, বিকল্প চিন্তা মাথায় রেখে ঢাকার দুই সিটিতে দলের প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। প্রার্থিতা চূড়ান্ত হওয়ার পর এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে নির্বাচন নিয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের মনোভাব গভীরভাবে পর্যালোচনা করবে বিএনপির হাইকমান্ড। পরিস্থিতি অনুকূল না হলে কিংবা সবার জন্য সমান নির্বাচনী মাঠ তৈরি না হলে নেয়া হবে ভিন্ন কৌশল। যদি সরকার নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি না করে, বিরোধী নেতাকর্মীদের সমানভাবে প্রচার-প্রচারণার সুযোগ না দেয়, তাহলে নির্বাচন থেকে সরে এসে আন্দোলনের পথ বেছে নেবে বিএনপি। নির্বাচন থেকে সরে এলেও কৌশলে নির্বাচনে থাকবে দলটি। সেক্ষেত্রে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ঢাকা উত্তরে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক কারাবন্দি মাহমুদুর রহমান মান্না পেতে পারেন অঘোষিত সমর্থন।
শঙ্কায় আওয়ামী লীগ। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট অংশ নেয়ায় কিছুটা শঙ্কায় পড়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এ কারণে জীবনপণ লড়াই মানসিকতা নিয়ে অংশ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা। গত শুক্রবার গণভবনে আয়োজিত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ে বৈঠকে এসব প্রসঙ্গে আলোচনা হয়। বৈঠকে কাউন্সিলর পদে অংশ নিতে আগ্রহী কয়েকজন প্রার্থী বলেন, বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেয়ার বার্তা পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু সেই বার্তা ভুল প্রমাণ করে তারা অংশ নিচ্ছে। দলীয়ভাবে বিশৃঙ্খল অবস্থায় থাকলেও প্রার্থী দেয়ার ক্ষেত্রে তারা কম প্রার্থী দিচ্ছে। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান, সূত্রাপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মান্নাফী, সবুজবাগ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদ ও ওয়ার্ড পর্যায় থেকে আবদুস সালাম ও আসলাম মাস্টার বক্তব্য রাখেন। বক্তারা তাদের বক্তব্যে, নিজেদের মধ্যে নানা বিভেদের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও কামনা করেন নেতারা। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য চলাকালীন সময়ে মাঠ পর্যায়ের নেতারা শেখ হাসিনার নির্দেশ অনুযায়ী দল-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন বলে দলীয় সভানেত্রীকে আশ্বাস দেন। প্রধানমন্ত্রী মহানগর নেতাদের কাউন্সিলর পদে একক প্রার্থী দেয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, এ ব্যাপারে একটি কমিটি করে দেয়া হয়েছে। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এ কমিটি প্রার্থী ঠিক করবে।
ভোটারদের ওপর ভরসা বিএনপির
গ্রেপ্তার ও পুলিশি হয়রানির ভয়ে আত্মগোপনে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। গ্রেপ্তার আতঙ্কে এলাকাছাড়া তৃণমূল নেতাকর্মীরাও। ঘাড়ের ওপর ডজন ডজন মামলার খড়গ। তাই প্রকাশ্যে নির্বাচনী প্রচারণার সুযোগ নেই তাদের। সক্রিয় সমর্থকরাও নেই স্বস্তিতে। প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন বিএনপির সমর্থন প্রত্যাশী সম্ভাব্য মেয়র ও কমিশনার প্রার্থীরা। এদিকে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির স্বার্থে নির্বাচন কমিশনের কাছে ২০ দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী ঘরনার বিশিষ্ট নাগরিকদের তরফে কিছু পরামর্শ এবং দাবি জানানো হলেও তার ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী এবং সরকারদলীয় নেতাদের বক্তব্যেও সেসব দাবির ব্যাপারে আশাবাদী হতে পারছে না বিরোধী জোট। ইতিমধ্যে প্রশাসনের অবস্থান পরিষ্কার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম বলেছেন, ‘প্রার্থী আসামি হলে ছাড় দেয়া হবে না।’ তবু সিটি করপোরেশন নির্বাচনের লড়াইয়ে থাকছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দল। সক্রিয় নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণের ব্যাপারে যেখানে ন্যূনতম নিশ্চয়তা নেই সেখানে কেন আন্দোলন কর্মসূচি শিথিল করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ? এমন প্রশ্ন ও আলোচনা-পর্যালোচনায় মুখর এখন বিরোধী কর্মী-সমর্থকরা। প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে বিরোধী জোট কিভাবে ফলাফল নিজেদের অনুকূলে আনবে এমন কৌতূহল নানা মহলে। কিন্তু বিএনপির শীর্ষ নেতারা এবার হাঁটছেন নতুন কৌশলে। দলের নেতাকর্মীদের চেয়ে এবার সাধারণ সমর্থক এবং ভোটারদের ওপরই বেশি ভরসা করতে চান তারা। বিএনপি ও জোটের একাধিক শীর্ষস্থানীয় নেতা এমন দৃষ্টিভঙ্গির কথা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, বিগত বছরগুলোতে সরকারের নানা অনিয়ম, বিতর্কিত কর্মকাণ্ড এবং মৌলিক অধিকার বঞ্চিত হওয়ায় সাধারণ মানুষ সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ। তার ওপর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে না পারার ক্ষোভও রয়েছে। সুষ্ঠু পরিবেশ পেলে সিটি নির্বাচনের ফলাফলে তার প্রতিফলন দেখা যাবে। নেতারা জানান, ঢাকা সিটিতে বিরোধী নেতাকর্মীরা একেবারেই কোণঠাসা অবস্থানে। সবার ওপর মামলা ঝুলছে। বাড়িতে বাড়িতে পুলিশি তল্লাশি চলছে। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখেও নির্বাচনের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে বিএনপি। কারণ এবার কর্মীদের চেয়ে ভোটারদের নীরব ভূমিকার ওপর বেশি আস্থা রাখতে চায় শীর্ষ নেতৃত্ব। ভোটারদের ওপর ভরসা করার প্রাথমিক ইঙ্গিত হিসেবে ঢাকায় নির্বাচনী কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে তৎপরতা শুরু করেছেন বিশিষ্ট নাগরিকদের সংগঠন ‘শত নাগরিক’। চট্টগ্রামে ‘চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলন’-এর মতো ঢাকায় সুনির্দিষ্ট প্রার্থীর পক্ষে সমর্থন ঘোষণা দিতে পারে ‘শত নাগরিক’। নাগরিক সমাজের ব্যানারে নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে বিশিষ্ট নাগরিকদের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা হবে। নেতারা জানান, নির্বাচনী পরিবেশের ওপরই সর্বাধিক জোর দেবে ২০ দল। এ নিয়ে শিগগিরই জোটের তরফে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু দাবিও তুলে ধরার সম্ভাবনা রয়েছে। শত নাগরিক-এর সদস্য সচিব আবদুল হাই শিকদার বলেন, নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাতে আলোচ্য বিষয়গুলো বিএনপি চেয়ারপারসনকে অবহিত করা হয়েছে। ওনার কথা-বার্তায় মনে হয়েছে, সরকার ও নির্বাচন কমিশনের আচরণ পর্যবেক্ষণ করছেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন দিয়ে সরকারই ফাঁদে পড়েছে। যে মুহূর্তে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণের নির্দেশনা দেবে, জনগণ ঢাকা ও চট্টগ্রামের রাস্তায় নেমে আসবে। জেল-জুলুম-গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে কোন লাভ হবে না। গ্রেপ্তার করে বিএনপি প্রার্থীদের পরাজিত করা যাবে না। বিএনপিকে ভোট থেকে বিরতও রাখা যাবে না। দলের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানিয়েছেন, নির্বাচন ও আন্দোলন একই সঙ্গে চলবে। দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে যেতে পরামর্শ দিয়েছেন। সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি না হলে সিটি নির্বাচন বয়কট করবে বিএনপি। এমন সিদ্ধান্ত বিবেচনায় রেখেই নির্বাচনী ট্র্যাকে ছুটতে শুরু করেছে দলটি। সরকার ও প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া এবং পদক্ষেপ দেখে তারপরই দলীয় প্রার্থীর সমর্থনে নির্বাচনে থাকা না-থাকার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে বিএনপি। বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থকদের চেয়ে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পরিবেশ পাবে কিনা তার ওপরই নির্ভর করবে বিএনপির চূড়ান্ত অংশগ্রহণ বা সরে দাঁড়ানো। এদিকে বিএনপিপন্থি পেশাজীবী নেতারা জানান, এবার সিটি নির্বাচনে কমিশনার প্রার্থীরা একটি বিরাট ফ্যাক্টর হবেন। কারণ প্রতিটি ওয়ার্ডে একাধিক সরকার দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থী থাকতে পারে। আর সেটা হলে কেন্দ্রে ভোট কারচুপির সম্ভাবনাও কমবে। যার সুফল পাবে জনসমর্থিত প্রার্থীরা।
নেতারা জানান, ২০ দলীয় জোটের চলমান আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সরকার এবং বিরোধী জোটের মধ্যে একটি আস্থার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য তৎপর রয়েছেন আন্তর্জাতিক মহলসহ কূটনীতিকরা। আন্দোলনে নানা নৈরাজ্যের ঘটনার দায় বিরোধী দলের ওপর চাপিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে একটি প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে সরকার। সেখানে বিএনপিকে অগণতান্ত্রিক, নির্বাচনবিমুখ এবং জঙ্গি মনোভাবের দল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ফলে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সরকারের সে প্রচারণাকে ভুল প্রমাণ করতে চায় বিএনপি। বিএনপি নেতারা মনে করেন, ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচন কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক মহলের সতর্ক পর্যবেক্ষণে থাকবে। এক্ষেত্রে পরিবেশ পেলে ফলাফল নিজেদের অনুকূলে এনে বিএনপি তাদের পক্ষে জনসমর্থনের বিষয়টি প্রমাণের সুযোগ পাবে। অন্যদিকে তীব্র প্রতিকূল পরিবেশে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে হলে সেক্ষেত্রে আন্দোলনের যৌক্তিক ভিত্তিও সুদৃঢ় হবে। বিএনপি ও জোটের নেতারা জানান, নানামুখী বিচার-বিশ্লেষণের পর সিটি নির্বাচনে ইতিবাচক মনোভাবের বার্তা দিয়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দল। অবরোধ-হরতালের সমন্বয়ে চলমান আন্দোলন কর্মসূচি থেকে কিছুটা বেরিয়ে এসেছে বিরোধী জোট। অনির্দিষ্টকালের অবরোধের পাশাপাশি প্রতি সপ্তাহে দু’দফায় ৫দিন করে হরতালের যে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছিল ২০ দল সেখান থেকে সরে এসেছে। গত সপ্তাহের শেষ দুদিনের পর চলতি সপ্তাহেও নতুন করে হরতালের ঘোষণা আসেনি ২০ দলের তরফে। নেতারা আশা করেন, হরতাল কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে আসার মাধ্যমে যে ইতিবাচক বার্তা দেয়া হয়েছে সরকার সেটাকে নিশ্চয়ই গুরুত্বের সঙ্গেই নেবে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ, রাজনীতি ও নির্বাচনের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে নিশ্চয়ই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
চট্টগ্রামে মনজুর আলমের পর ঢাকায় আবদুল আউয়াল মিন্টু ও সর্বশেষ হেভিওয়েট প্রার্থী হিসেবে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের পক্ষে মনোনয়নপত্র সংগ্রহের পর জমে উঠতে শুরু করেছে নির্বাচন। এ দুজনের মেয়র পদে প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনায় বিএনপি নেতা-কর্মীরা কিছুটা উচ্ছ্বসিত ও আশাবাদী। তবে বিএনপি নেতারা জানান, বিকল্প চিন্তা মাথায় রেখে ঢাকার দুই সিটিতে দলের প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। প্রার্থিতা চূড়ান্ত হওয়ার পর এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে নির্বাচন নিয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের মনোভাব গভীরভাবে পর্যালোচনা করবে বিএনপির হাইকমান্ড। পরিস্থিতি অনুকূল না হলে কিংবা সবার জন্য সমান নির্বাচনী মাঠ তৈরি না হলে নেয়া হবে ভিন্ন কৌশল। যদি সরকার নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি না করে, বিরোধী নেতাকর্মীদের সমানভাবে প্রচার-প্রচারণার সুযোগ না দেয়, তাহলে নির্বাচন থেকে সরে এসে আন্দোলনের পথ বেছে নেবে বিএনপি। নির্বাচন থেকে সরে এলেও কৌশলে নির্বাচনে থাকবে দলটি। সেক্ষেত্রে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ঢাকা উত্তরে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক কারাবন্দি মাহমুদুর রহমান মান্না পেতে পারেন অঘোষিত সমর্থন।
No comments